কৃতকার্য


পারমিতা ভট্টাচার্য , তারকেশ্বর, হুগলী ##

বহু দিন পর অবশেষে সেই আকাঙ্খিত দিনটি এলো সুনয়নার জীবনে। কত দিন ধরে সে এই দিনটারই অপেক্ষা করে যাচ্ছিল। স্নান করে তাই আজ একটু বেশি সময়ই ঠাকুর ঘরে কাটালো সে। ওই ঠাকুরের কাছে কত যে মাথা ঠুকেছে তা সেই জানে। আজ সে সফল মা। তার এক মাত্র ছেলে সুপ্রতীক আজ বিদেশ থেকে দেশে ফিরছে, প্রায়  তিন বছর পর। আজ সে মস্ত বড় ডাক্তার। এফ আর সি এস করতে লন্ডনে গিয়েছিল সে। এতো বছর শুধুই আই ফোনে ছেলেকে একটু দেখে মনের আশা মেটাত সুনয়না। যত বড় ডাক্তারই হোক না কেন মায়ের কাছে ছেলে কি কখনও বড় হয়? পূজো সেরে সুনয়না রান্না ঘরে গিয়ে ঢুকলো। আজ শরীরটা যেন কোনও অজ্ঞাত কারণে বেশ ভালো হয়ে গেছে। তাই ছেলের জন্য পঞ্চ ব্যঞ্জন রান্নার আয়োজন নিজের হাতেই করতে লাগলো সে।

 – ‘ কই গো কোথায় গেলে? দেখো তোমার ছেলে এসে গেছে।  সুনয়নার স্বামী সুশোভন বললেন।

ছুটে আসে সুনয়না। কই তার ছেলে? দূর থেকে ছেলেকে দেখেই সে থমকে যায়। ওমা, এ কাকে দেখছে সে? এ যে আপাদমস্তক ব্রিটিশ। বাঙ্গালিয়ানা যে তার চোখে মুখে কোথাও নেই। মায়ের কাছে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে সুপ্রতীক। দামী সিগারেটের গন্ধ পায় সুনয়না। সে তখন বোঝে তার ছোট্ট সুপ্রতীক অনেক বড় হয়ে গেছে।

‘ ওপরের ঘরে যা বাবা। সব রেডি আছে তোর। ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আয়। ‘ মা বলে ছেলেকে ।   

আর বাড়ির চাকর রঘুকে আদেশ করে সুপ্রতীকের লাগেজ উপরের ঘরে দিয়ে আসতে।

বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়। ছেলে ফোনেই ব্যাস্ত। পুরনো বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় – স্বজন সবাই ছেলের সাথে কথা বলতে চাইছে। ছেলে আর ওর বাবা সামলাচ্ছে সব। সুনয়না আর কীই বা করতে পারে? সংসারে কোন কথাটাই আর তার খাটে। স্বল্প শিক্ষিত সুনয়না, তাই বরাবর আড়ালে থাকতেই ভালোবাসে। এটাই ওর চরিত্র। আজ খালি ভাবে তার ছেলে মস্ত বড় ডাক্তার। স্বল্প শিক্ষিত হয়েও কী ভাবে কত কষ্ট করে ওই ছেলেকে সে মানুষ করেছে। শুধু মাত্র ছেলেকে মানুষ করবে বলেই সুশোভনকে বলে এই বাড়িটা তৈরি করিয়েছিল সুনয়না। এই বাড়িতে আসার পর অনেক আত্মীয় – স্বজনেরই বক্র দৃষ্টি ও বক্র বচন সহ্য করতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু আজ সে সফল। স্বল্প শিক্ষিত সুনয়নার জেদটা বরাবরই একটু বেশি। জেদের কথা বুঝতে সে দেয় না বাইরে থেকে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো ফুটতে থাকে। এই সব সাত পাঁচ ভাবতে থাকে সে দূরে মাঠের দিকে তাকিয়ে। সম্বিৎ  ফেরে সুশোভনের ডাকে।

‘ কি গো খেতে হবে না নাকি? ক’টা বাজে দেখেছো? ‘

প্রায় লাফিয়ে ওঠে সুনয়না। সত্যি তো অনেক বেলা হয়ে গেছে। এই তার দোষ। সময় – অসময় নেই, ভাবতে ভাবতে কোথায় যে হারিয়ে যায় সে….

খাবার টেবিলে সুপ্রতীক, সুশোভন আর সুশোভনের ভাই সুবিনয়। সুবিনয় সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট। এক সপ্তাহের ছুটিতে এসে দাদার কাছেই সে উঠেছে। ইংরেজির ঝড় উঠেছে খাবার টেবিলে। কেউ তো বাংলায় কথাই বলে না। সুনয়ার সাহেব সুবো পুত্র তো মায়ের সাথে ভালো করে কথাই বলেনি এসে থেকে। এক ফোন না হলে বাপ – কাকার সাথে লন্ডনের আর নিজের কেরিয়ারের কথা নিয়েই সে ব্যস্ত। আজ সুনয়না অনেক কিছু রান্না করেছে তার ছেলের জন্য। কিন্তু বিনিময় ছেলের কাছ থেকে বক্রোক্তি পায় সে – ‘ অতো কি খাওয়া যায় নাকি? করেছ কেন অতো রান্না? আমাকে বরং মটনটা দিয়ে দাও, আর কিছু লাগবে না।‘

সুপ্রতীকের কথা শুনে ওর বাবা – কাকা দুজনেই স্মিত হাসি হেসে ওঠে। সুনয়না প্রথমে কিছুটা থমকে যায় । পরে আর একটাও কথা না বলে মাংসের বাটি টা ছেলের দিকে এগিয়ে দেয় ।

বিকেলে ক্রমে আসতে থাকে সুপ্রতীকের বন্ধুরা। ওপরের ঘরে মদ, সিগারেটের ফোয়ারা ছোটে। সুপ্রতীকের বন্ধুরা সবাই সুপ্রতিষ্ঠিত। এক বার চা দিতে গিয়ে সুনয়না দেখে ছেলেদের মুখে ভাষার বেলাগাম উপস্থিতি। নিজে হাতে ছেলের বন্ধুদের চা দেবে বলে বিকেলেই ফুলকপির পাকোড়া আর চা – কফির ব্যবস্থা সে করেই রেখেছিল। কিন্তু ছেলের ঘরে সুনয়না সেগুলো দিতে গেলে কিছুটা বিরক্তির সুরে ছেলে বন্ধুদের সামনেই মা কে বলল – ‘ তুমি আনতে গেলে কেন? রঘুকে দিয়ে পাঠালেই পারতে।‘

বলাই বাহুল্য খুব খারাপ লাগলো সুনয়নার। কিন্তু কিছু না বলেই হাসি মুখে চা আর পাকোড়া গুলো টেবিলে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সে। শাড়ির খুঁট ভিজে গেলো চোখের জলে। তবু চিরকাল নিজেকে গুটিয়ে রাখা সুনয়না আজও কিছু মুখ ফুটে বলল না।

আজ সকাল থেকে সুনয়নার মনটা আনন্দে ভরে আছে। আজ পয়লা বৈশাখ। সারা পাড়ার সাহিত্য প্রেমী ব্যাক্তিরা সারা বছর এই দিনটির অপেক্ষায় থাকে। সুনয়নার ক্ষেত্রেও তাই। সেও আজ ভীষণ খুশি মনে মনে। তবে প্রকাশ তো নেই তার। সকাল থেকেই স্নান পূজা সেরে রান্না ঘরে আসতেই পুরনো চাকর রঘু বলে উঠল – ‘ আজ আপনার  ছুটি। দাদা বাবু বলে গেছেন আজ ডাল, আলু পোস্তো আর ডিম ভাজা রান্না করতে। বেশি কিছু রান্না আজ করতে হবে না।‘

ভুতের মুখে রাম নাম শুনে সুনয়না একেবারে থ। সে রঘুকে প্রশ্ন করলো – ‘ কারণটা কী? আজ হঠাৎ এই প্রস্তাব? ‘

রঘু বলে ওঠে – ‘ আজ আপনার প্রোগ্রাম আছে না, বিকেলে পাড়ার মিলনী ক্লাবে।‘

তখন সুনয়না মনে মনে ভাবে একটি বারের জন্যও সুশোভনকে সে আজকের অনুষ্ঠানের কথাটা বলেনি। বলেনি তার কারণও আছে। সর্বদা অপমানিত হতে আর ভালো লাগে না তার। বিয়ের পর থেকে তার কবিতা নিয়ে অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছে তাকে। থেকে থেকেই সে চুপ হয়ে গেছে। কিন্তু কবিতা তাকে ছাড়েনি। তাই এখনও সে সময় পেলেই লেখালেখি করে। পাড়ার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠে তার নাম ডাকও আছে। কিন্তু আজ একটি বারের জন্য সে বাড়ির কাউকে বলেনি আজ অনুষ্ঠানের কথা। তাহলে সুশোভনের মনে আছে আজ পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানের কথা? অবাক শুধু নয়, আকাশ থেকে পড়লো সুনয়না। তাহলে এতো দিন মনে মনে কষ্ট কি সে মিছেই পেয়ে এসেছে? আনন্দে চোখে জল এসে গেলো তার। শাড়ির খুঁটে চোখের জল মুছতে দেখে রঘু বলে – ‘ আপনি এখন ঘরে যান। আমি এদিকটা সামলে নিচ্ছি। আপনি বিকালের জন্য বরং প্রস্তুত হন।‘

আস্তে আস্তে বিকেলে পাড়ার সব সাহিত্য প্রেমী মানুষেরা মিলনী ক্লাবে মিলিত হতে থাকে। সবাই ব্যস্ত হয়ে ওঠে সুনয়না এখনও কেন এসে পৌঁছল না। হঠাৎ সবাই বলে উঠল – ‘ ওই তো আসছে সুনয়না কাকিমা।‘

অন্য দিকে সুপ্রতীক রেডি হয় তার বন্ধুর দেওয়া পার্টিতে যাওয়ার জন্য। কিন্তু বাধ সাধে তার বাবা। সুশোভন বলে – ‘ আজ তোর মায়ের প্রোগ্রাম বিকেলে। আর তুই পার্টিতে চলে যাবি? মায়ের মনটা কতটা খারাপ হবে ভেবে দেখ।‘

বাবার উত্তরে সুপ্রতীক বলল – ‘ আমি ওই সব বাংলা অনুষ্ঠান কী বুঝবো বাবা? আমার ওসব ভালোও লাগে না।‘

এই বলে সে দোনামনা করে বেরিয়ে যায় বন্ধুর পার্টিতে।

একে একে রবীন্দ্রনাথের গান, আবৃত্তি, নাচ প্রভৃতি দিয়ে পয়লা বৈশাখের ‘ নববর্ষ পূর্তি‘ অনুষ্ঠান পরিপূর্ণতা পেতে  লাগলো। সুনয়না প্রায় সবেতে অংশ নিয়েছে আজ। এর পর এল স্বরচিত কবিতা পাঠের পর্ব। একে একে কবিতা পাঠ করতে করতে এলো সুনয়নার পালা। স্টেজে উঠেই দেখে সামনের সারিতে সুশোভন। প্রথমে সে তো নিজের চোখ কে বিশ্বাসই করতে পারছিল না। ও এসেছে কবিতা শুনতে? মনে মনেই প্রশ্নটা সে নিজেকে করলো। বুকে বল নিয়ে সে চোখ বন্ধ করে বলতে শুরু করলো তার স্বরচিত কবিতা।

কবিতা কখন শেষ হয়ে গেছে তার মনেই নেই। চোখ তুলল সে করতালির আওয়াজে। তাকিয়ে দেখে তার ছেলে সুপ্রতীক একেবারে শেষে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়েই যাচ্ছে, সাথে অন্যরাও। এর পর যা ঘটলো তার জন্য সুনয়না একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। সুপ্রতীক তাঁকে ও নিজের বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল – ‘ তোমার প্রোগ্রামের থেকে কি আমার বন্ধুর পার্টি আগে মা? তাই আমি মাঝ রাস্তা থেকে ফিরে এসেছি। লাইফে অনেক ওসব করলাম, কিন্তু তোমার কবিতার কাছে সব কিছুই ম্লান হয়ে গেলো।‘

নিজের ছেলেকে দেখে সত্যি চিনতে পারছিল না সুনয়না। যাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল এতো দিন। সে মনে মনে ভাবে, ছেলে মানুষে সে অকৃতকার্য হয়নি তাহলে, কৃতকার্যই হয়েছে। সুনয়না আজ এ ভাবেই সফল নববর্ষ কাটালো।

One thought on “কৃতকার্য

  • April 19, 2019 at 8:30 am
    Permalink

    বাহ্ ! সুনয়না সত্যই কৃতকার্য ।
    অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই ।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nine − 8 =