যাপনের অন্তরালে

মোনালিসা পাহাড়ী, গড় মনোহরপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর ##

একফালি বারান্দায় ঝিম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝিমলি। তার দুটো চোখের দৃষ্টিতে কখনো শূন্যতা ভরা হাহাকার, কখনো আগুন ঠিকরে পড়া ক্রোধ, কখনো সজল মেঘের আনাগোনা। সামনে তখন রক্তিম আকাশ জুড়ে সূর্যাস্তের খেলা….. কিচিরমিচির করে পাখিরা ফিরছে ঘরে।অদ্ভুত আবেগ ঘিরে ধরেছে ঝিমলিকে।তার ও খুব ইচ্ছে করে ফিরে যেতে, কোথাও একটা।’কোথায়’ সে সেটা বুঝতে পারেনা। শুধু এটুকু বোঝে মনযমুনার দুকূল জুড়েই উথাল পাথাল ঝড়। সেই ঝড় তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে একটু শান্তির ঠিকানায়।

অথচ বহুদিন আগেই তো সে ঠিকানা সে তার নিজের হাতেই মুছে দিয়ে এসেছে। চয়নকে ভালোবেসে কতখানি স্বার্থত‍্যাগই না সে করেছিল, সে কথা চয়ন আজ ভুলে গেছে ঠিকই কিন্তু সে তো ভোলেনি। ভোলার কথাও নয়। রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলোকে ছেড়ে এসে সে যে কতটা দুঃখ মনের মধ্যে হজম করেছে তা শুধু সেই জানে। অথচ যার জন্য সে এতটা দুঃখ হজম করেছিল সেই চয়ন তো কোনও কালেই তার মনের ঘরে ডুব দিয়ে দেখলো না।

আজকাল যখন তখনই এরকম মনখারাপ করে তার। হঠাৎ করে মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়, কিছুতেই ঘুম আসতে চায়না, যত অভিমান বুকের কাছে দলা পাকিয়ে যায়, দুচোখ দিয়ে অঝোর ধারা ঝরতে থাকে, পৃথিবীর কেউ কোথাও টের পায়না তার এই অশ্রুসিক্ত জীবনের রাত্রিগুলোর কথা, পাশে শুয়ে থাকা মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে উগরে দিতে ইচ্ছে করে সমস্ত অভিমানগাথা…. কিন্তু পারেনা, শুধু রাতবাতির আলোয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে চয়নের মুখ, আর নিজেকে পোড়ায়, আর ঠিক তখনই মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে, উথলে ওঠে কান্নার সাগর। সারাদিন সংসার, চাকরি নিয়ে, রান্নাবান্না নিয়ে অবসন্ন শরীর একটু শান্তি খোঁজে, কিন্তু মনের মধ্যে জেগে থাকা তপ্ত মরুভূমি তাকে তিষ্ঠোতে দেয়না। সারা রাত জেগে সকালেই নিজেকে ডুবিয়ে দেয় কাজের পাহাড়ে।

হঠাৎ সামনের রাস্তায় চোখে পড়ে সাঁওতাল পুরুষ রিক্সা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, রিক্সায় বসে আছে সাঁওতাল রমণী। দুজনেই গান ধরেছে মনের সুখে, কোন আড়ম্বর নেই, অথচ নির্মেঘ ভালোবাসা ছেয়ে আছে দুটো মানুষের প্রাণে….

বড় একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে ঝিমলি। চোখের কোণে উঁকি মারে জলের রেখা। ঠিক কতকাল সে আর চয়ন একসাথে কোথাও বেরোয়নি মনে করার চেষ্টা করে।কতদিন  হয়ে গেল চয়ন তাকে আই লাভ ইউ বলেনি, তার দুঃখ কষ্টের কথা জানতে চায়নি….

অথচ এই চয়ন প্রায় চার বছর তার পেছনে ঘুরেছিল ভালোবাসার জন্য। প্রথম প্রথম তো প্রচুর অপমান করতো ঝিমলি তাকে, কিন্তু একসময় সেও মন হারিয়ে ফেললো, বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে সে,ব্রাহ্মণ কন্যা, অব্রাহ্মণ চয়নের সঙ্গে বাবা মা কিছুতেই  বিয়ে দিতে রাজী ছিলেন না, এদিকে চয়ন বিয়ে না করলে বারবার সুসাইডের হুমকি দিল, একদিন তো সুইসাইড করতেও গেল কিন্তু কোনক্রমে প্রাণে বেঁচে ফিরল, বাধ্য হয়ে ঝিমলি পালিয়ে এসে বিয়ে করলো চয়নকে। কিন্তু বিয়ের পর চয়নের আসল রূপ বেরিয়ে পড়লো। একগুঁয়ে, বদমেজাজি, জেদি ,স্বার্থপর, অসভ্য এই চয়নকে সে যেন চিনতেই পারছিল না। তাও ভালোবাসার তীব্র আশ্লেষে যথাসম্ভব জড়িয়ে ধরতে চেয়েছে সে নিজের স্বামীকে। বিনিময়ে ফিরে পেয়েছে অপমান, তাচ্ছিল্য, যন্ত্রণা আর হাহাকার…

অনেকবার ভেবেছে পালিয়ে যাবে সবকিছু ছেড়ে, আলাদা থাকবে, কিন্তু একা একা বেঁচে থাকবে কি করে সে, একা একা কি বাঁচা যায়, তার থেকে তো মরে যাওয়াও অনেক সুখের….

কিন্তু মরে যেতে ভীষণ ভয় করে তার, সে শিক্ষিতা, সুন্দরী, চাকুরীরতা  একটা মানুষের জন্য সে কেন এই সুন্দর জীবন ছেড়ে চলে যাবে মনে মনে যুক্তি সাজায় সে।

হঠাৎ তার খেয়াল হয় কখন সন্ধ্যা হয়ে রাত হয়ে গেছে। তড়িঘড়ি চোখের জল মুছে চয়নের জন্য রান্না বসাতে আসে সে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 × 5 =

preload imagepreload image