রত্নগর্ভা রাউতপাড়া

পলাশ মুখোপাধ্যায় ##

তারকেশ্বর স্টেশন ছাড়াতেই বদলে গেল দৃশ্যপট। চারপাশের আবহ হয়ে উঠল আরও মনোরম, আরও চিত্তাকর্ষক। পরপর দুটি নদী পেরিয়েছি, দামোদর এবং মুণ্ডেশ্বরী। নতুন রেলপথ ধরে ছুটে চলেছে গোঘাট লোকাল। আমি জানালার ধারে বসে পিপাসার্তের জলপানের মত আকন্ঠ পান করে চলেছি বাইরের সবুজ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সুধারস। এই ট্রেনে আমার গন্তব্য আরামবাগ। স্টেশনে নেমেই টোটোয় চেপে আরামবাগ বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। এবার কিছু খেয়ে নেওয়ার পালা। বাসস্ট্যান্ড চত্বরে প্রচুর হোটেল, জলখাবারের দোকান। লুচি তরকারি মিষ্টি উদরস্থ করে এবার বাসে চাপার পালা। খোঁজ খবর করে শেষমেশ বালি দেওয়ানগঞ্জ যাওয়ার বাসে চেপে বসলাম। আমায় নামতে হবে হালদার পাড়া।

মিনিট পয়তাল্লিশ পরে বাস নামিয়ে দিল হালদারপাড়ায়। এবারে হাঁটাপথ। পাড়ার মধ্যে দিয়ে সরু পথ। একে ওকে জিজ্ঞাসা করে এগোতে লাগলাম সামনের দিকে। এবারে বলি আমার মূল গন্তব্য আসলে রাউতপাড়া। হুগলীর অখ্যাত এই গ্রাম কিন্তু রত্নগর্ভা। দারকেশ্বরের পাড়ে এই গ্রামে আছে বেশ কয়েকটি প্রাচীন মন্দির যাদের টেরাকোটার কাজ বিস্মিত করবে আপনাকে। ছায়ায় ঘেরা শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ,  রাস্তা দুপাশে প্রচুর সবুজ। মিনিট দশেক হাঁটার পর কয়েকজন যুবকের জটলা দেখে এগোলাম সেদিকেই। শিব দুর্গা মন্দিরের কথা জিজ্ঞাসা করতেই ইশারায় সামনে এগোতে বলল তারা।     

সামান্য এগোতেই আমি গন্তব্যের সামনে। একলহমায় দেখেই দুয়োরানির কথা মনে হল। রূপকথার রাজাদের যে দুয়োরানি থাকত অনাদর অবহেলায় অথচ অপরূপ সৌন্দর্য এবং অতুলনীয় গুণ নিয়ে, সেই দুয়োরানি। অসাধারণ ৫টি অতি প্রাচীন মন্দির(আনুমানিক ২০০ থেকে ৪০০ বছরের পুরোনো) আমার চোখের সামনে। অধিকাংশের অবস্থাই সঙ্গিন, কিন্ত একটির দশা দেখে চোখে জল এল প্রায়।

টেরাকোটার  এত সুন্দর মন্দিরগুলো আজ ভগ্নপ্রায়, আগাছার জটায় ডাকা মস্তিস্ক বা শরীর! একই চত্বরে রয়েছে মঙ্গলচন্ডী মন্দির, নারায়ণ মন্দির, শিবদূর্গা মন্দির, শীতলা মন্দির ইত্যাদি। অতি প্রচীন মঙ্গলচন্ডী মন্দিরের মাথায় ছিল ১৩টি চূড়া বা রত্ন। কিন্তু আজ তার স্হান দখল করেছে ঝোপ আর আগাছা! নারায়ণ মন্দিরের অবস্হাও তথৈবচ।

 সামান্য হলেও ভাল অবস্থা শীতলা এবং শিব দুর্গা মন্দিরের। পুজো হয়, তাই রক্ষণাবেক্ষণও কিছুটা হয়। এই মন্দিরগুলির মধ্যে এখন সব চেয়ে ভাল অবস্থায় আছে শিবদূর্গা মন্দির। শিবদূর্গা মন্দিরের কারুকার্য ও উপরের চার সন্তান সহ মা দুর্গার মূর্তি অসাধারণ!  জোড়বাংলা এবং নবরত্ন স্থাপত্যরীতির মিশেল এমন মন্দির বাংলায় দুস্প্রাপ্য বলা যায়।  প্রতি বছর এ মন্দিরে মা দুর্গার পূজো হয়, গোটা গ্রাম মেতে ওঠে উৎসবে! পাশাপাশি দশদুর্গা মন্দিরের অবস্হা খুবই শোচনীয়, তার দরজার সামনে কাঁঠাল গাছ ও আগাছার সংসার আর মন্দিরের ভিতরে নানান পোকামাকড়ের উৎপাতে অস্তিত্ব আজ সংকটে।

মন্দিরগুলি একেবারে পাড়ার মধ্যে, কয়েকটি মন্দিরের প্রায় সঙ্গে লাগোয়া বাড়ি। এখানে প্রায় সকলেই পিতলের কাজ করেন। কথা হচ্ছিল তাদের সঙ্গে, কলকাতা থেকে তাদের গ্রামে মন্দির দেখতে এসেছি শুনে খুব খাতির যত্ন করলেন। শিব দুর্গা মন্দিরের তালা খুলে দেখালেন। সকলেই জানালেন বেশ কয়েকবার সরকারী লোকজন এসেছেন বটে কিন্তু মন্দিরের হাল যেমন ছিল তেমনই রয়ে গিয়েছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল, আর কয়েক বছর পরে এলে তো দেখতেই পেতাম না, এত সুন্দর কাজ, এতগুলি মন্দির একই চৌহদ্দির মধ্যেই বলা যায়, একটু সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলে এগুলি আমাদের সম্পদ হতে পারত। আমরা বিষ্ণুপুরে ছুটি, কিন্তু এই মন্দিরের কাজগুলি বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার কাজের চাইতে কোনও অংশেই কম নয়। তবে এত দূরে এত কষ্ট করে এসেও মন ভরে গেল।

এবার ফেরার পালা। সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভারাক্রান্ত অথচ পরিতৃপ্ত হৃদয়ে রওনা দিলাম রাউতপাড়া থেকে। এবারে বাসে নয় ট্রেকারে চাপলাম কালীতলা মোড় যাব বলে। কারন আরামবাগ শহরের ঠিক বাইরে কালীতলায় একটি মিষ্টির দোকান আছে যার মিষ্টির সুখ্যাতি গোটা এলাকা জুড়ে। তাই সেখান থেকে মিষ্টি খেয়ে এবং নিয়ে ফিরবার ইচ্ছা। পথিমধ্যে এক জায়গায় দেখলাম রাস্তার পাশেই একটা বড় বাঁধের মত। ট্রেকার চালককে জিজ্ঞাসা করে জানলাম এটা দারকেশ্বর নদীর বাঁধ। মানে? ওপাশে নদী? ব্যস আমায় আর পায় কে? ট্রেকার থামিয়ে নেমে গেলাম সেখানেই। নদীর সঙ্গে দেখা না করে যাওয়ার কথা আমি অন্তত ভাবতেই পারি না।

দারকেশ্বর এখানে একটা বাঁক নিয়ে সামনে এগিয়েছে। দুপাশেই সবজির ক্ষেত। সেই সবুজের বুক চিরে রূপোলী জলধারা। আমার তো ভারি মজা লাগছিল। দুপুরের খাঁ খাঁ রোদ, তার মাঝেই একটা ঝিঙে ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে পৌঁছে গেলাম নদী থুড়ি নদের কাছে। ডিঙি নৌকায় ফেরি চলছে সামনে। এই সুযোগ কেউ ছেড়ে দেয়? চার টাকা দিয়ে এপার ওপার। সুন্দর নৌকা ভ্রমণও হয়ে গেল। একটা গাছের ছায়ায় নদীর ধারে খানিক ক্ষণ বসে এবার দেখলাম পেটে আন্দোলন কোলাহল শুরু হয়েছে।  

ফের একটা ট্রেকার ধরে কালীতলা মোড়। এখানেই আছে জগবন্ধু সুইটস্‌। আর পাঁচটা গঞ্জের মিষ্টির দোকানের মতই জগবন্ধুও দেখতে ছোটখাটো। কিন্তু তাদের মিষ্টির সম্ভার দেখলে চোখ ছানাবড়া হতে বাধ্য। নানা রকমের বৈচিত্রে ভরপুর এই মিষ্টির দোকানে দিনভর উপচে পড়ে ভিড়। আমি আরামবাগে বহুবার এসেছি, কালীতলা মোড় দিয়ে গিয়েছি অনেকবার। কিন্তু কোনওদিনই জগবন্ধুকে ফাঁকা দেখিনি। আজও ফাঁকা নেই, তাই আমার প্রিয় তৃপ্তিমালাই দুটো খেয়ে এবং বাড়ির জন্য কিছুটা নিয়ে রওনা দিলাম আরামবাগের দিকে। বাসস্ট্যান্ডে প্রচুর হোটেল ভাত মাছের ঝোল দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজন থুড়ি প্রায় বৈকালিক ভোজন সেরে ফের আরামবাগ লোকালে চেপে বসা। 

প্রয়োজনীয় তথ্যঃ কলকাতা থেকে ট্রেনে গিয়ে আরামবাগ অথবা তারকেশ্বর দু জায়গা থেকেই বালি দেওয়ানগঞ্জের বাস মেলে। এই সফরে রাত্রিবাসের প্রয়োজন হয় না, তবে এর আশেপাশেই আছে গড় মান্দারণ, কামারপুকুর, জয়রামবাটির মত বহুল পরিচিত পর্যটন ক্ষেত্র। সেগুলি ঘুরতে হলে আরামবাগে থাকতে পারেন, জয়রামবাটি বা কামারপুকুরেও থাকা চলে। রাউতপাড়া বা দেওয়ানগঞ্জে খুব ভাল হোটেল বা রেস্টুরেন্ট নেই, আরামবাগে এসে খাওয়া দাওয়া করাই ভাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × five =

preload imagepreload image