প্রিয় বর্ষা ঋতু

বটু কৃষ্ণ হালদার ##

“নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে/ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।” বর্ষা ঋতুর আগমনই কবি সুনির্মল বসু এঁকেছেন প্রকৃতির মায়াবী রূপের ছবি। বর্ষা সবচেয়ে আদরের ঋতু। সজল মেঘ মেদুর এর অপরূপ বর্ষার সঙ্গে রয়েছে বাঙালি জাতির আজন্ম কাল হৃদয়ের বন্ধন। কৃষিপ্রধান ভাইদের জীবনে এনে দেয় অর্থনৈতিক সচ্ছলতা। বজ্রবিদ্যুৎ ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে রুক্ষ অবক্ষয় শুষ্ক মরু প্রান্তরে এনে দেয় সবুজ সতেজ প্রাণের সঞ্চার ।রৌদ্র জলের মাখামাখি তে প্রকৃতি রানী সেজে ওঠে নবরূপে। শস্য শিশুর কল কল উচ্ছ্বাসে তার চোখে লাগে অনাগত দিনের বিভোর স্বপ্নের নেশা। প্রকৃতি রানীর আঁচলভরে ওঠে নতুন দিনের স্বপ্ন বিভোর হয়ে।বর্ষাকাল শস্য-শ্যামলা আনন্দঘন নবান্ন উৎসব এর নেপথ্য মঞ্চ। আবার তারই অপ্রসন্ন অভিমানী দৃষ্টিতে ঘরে ঘরে অন্তহীন সংহার রূপে মানুষ আতঙ্কিত ভীতসন্ত্রস্ত।শ্যাম ঘন বরষা একদিকে যেমন গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে আশীর্বাদ, অন্যদিকে আবার দরিদ্র পল্লীবাসী অনাহারী ফুটপাতবাসীদের কাছে দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ জীবন প্রবাহের এক অপরিহার্য কল্যাণী ঋতু।

কবিগুরু লিখেছেন “এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়” কবির দৃষ্টিতে বর্ষা গভীর অর্থ ব্যঞ্জনাময় বিস্তৃত। বর্ষাকাল হলো অবকাশের নিষ্প্রয়োজন ঋতু। ঋতু শুধু অর্থনৈতিক জীবনে নয় সাংস্কৃতিক ভাগবত জীবনের ও বর্ষা ঋতু রয়েছে এক অনন্য ভূমিকায়। বর্ষার সরস সজল স্পর্শ শুধু রুক্ষ ধূসর প্রান্তকে অসীম কানে স্পন্দিত করে নি প্রেমিক মনকে দুর্বল করে তোলে। প্রেমিকার নিঠুর ঠোঁটের ভাজে উর্বর ভাষায় উন্মাদনার চেতনা সঞ্চারিত হয় ক্ষণে ক্ষণে। বর্ষা উৎসব আনন্দে রচিত হয়েছে কাব্য, গান, উপন্যাস ও অজস্র প্রেমের কবিতা  আলো আঁধারের খেলা অনুষ্ঠিত হয়  বিমোহিত করে প্রকৃতি রানীকে। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের ৮০ ভাগের অধিক বর্ষাকাল সংঘটিত হয়। নদী নালা খাল বিল পুকুর ডোবা কানায় কানায় ভরে ওঠে। বিলে বিলে হেলেঞ্চা, কলমি লতা, শাপলাদের সমাবেশে সেজে ওঠে প্রকৃতি কন্যা।

বর্তমানে আমাদের দেশে ঋতুচক্র আবর্তিত হয়। ছয়টি ঋতুর সমাহার। দ্বিতীয় এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঋতু হলো বর্ষাকাল। গ্রীষ্মের দাবদাহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চাতক পাখির মতো এক পশলা বৃষ্টির জন্য তাকিয়ে থাকে ঐ দূর আকাশের দিকে ।

বর্ষার আগমনী গান “আমি বর্ষা অমলিন গ্রীস্মের প্রদাহ শেষ করি,  মায়ার কাজল চোখে, মমতার বর্ম পুট ভরি”।প্রকৃতি যেন নিজের তিস্নার্ত বুক ভরানোর জন্য বর্ষাকে আহবান করে।জেলেদের মাতান উল্লাসে জাল ফেলে নদীতে ।জল ভরে উঠে আসে রুপালি মাছ। জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, কলা গাছ কেটে ভেলা বানায় ছোট্ট শিশুর। কলার ভেলায় চড়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে শৈশব। ডুব দিয়ে হার মানায় পানকৌড়িকে। এই বর্ষা প্রকৃতিকে নতুন রূপে সাজিয়ে তোলে বৃষ্টির ।ফলে সতেজ হয়ে ওঠে গাছপালা। এ সময় নানা ধরনের ফুলের ফুল ও ফলের সমারোহ সেজে ওঠে প্রকৃতি রানীর প্রাণের ডালা। কদম, রজনীগন্ধা , কেয়া , জুই , গন্ধরাজ, হাসনুহানার গন্ধে প্রকৃতিকে বিমোহিত করে তোলে। আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা সহ বিভিন্ন হলে সম্মোহিত হয় প্রকৃতি।বাংলা মাস অনুযায়ী আষাঢ় শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল।  

যতদূর দৃষ্টি যায় পাংশুটে আকাশে মেঘের জাল বোনা ।প্রকৃতির নিথর নিস্তব্ধ তৃণভূমিতে জেগে ওঠে প্রাণের হিল্লোল।আকাশ দিগন্ত বিস্তার ধূসর মেঘ পুঞ্জিতে।সজল দিগন্ত ভেসে চলে বলাকার সারি। কুলায় কাঁপিছে কাতর কপোত। আসন্ন বৃষ্টির আশঙ্কায় জনহীন পথঘাট ক্ষুদ্র পবনের মত্ততা ভবনে ভবনে রুদ্ধ দুয়ার।থেকে থেকে দীপ্ত দামিনীর চমক উদ্ভাস কাঁপিছে কানন ঝিল্লির রবে চারিদিক গতিময় আর্তিকার মহা উল্লাস।

বর্ষাকাল রূপ-বৈচিত্র্যে তুলনাহীন মানুষের মনে সঞ্চয় করে অনন্ত বিরাজময় বেদনা। বর্ষার এক হাতে বরাভয় অন্য হাতে ধ্বংসের প্রলয় ডমরু। এক পদপাতে সৃজনের প্রাচুর্য অন্য পাতে ধ্বংসের তাণ্ডব। এক চোখে অশ্রু অন্য চোখে হাসি। বর্ষা আমাদের কাছে অতি আদরের ও অনন্ত বেদনার ঋতু রূপে পরিচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nineteen + eight =

preload imagepreload image