অনাঘ্রাত পুরুলিয়া

পলাশ মুখোপাধ্যায় ##

দুর্গাপুজো এবারে নমো নমো সব জায়গাতেই। তাই উৎসবের আমোদ আহ্লাদের ছুটিই ছিল এবারে।  সপ্তমীর দিন তাই সপরিবারে বেরিয়ে পড়লাম জয় দুগগা বলে। কোথায় যাব ঠিক ছিল না। মনে মনে ভেবেছিলাম পুরুলিয়ার দিকেই যাই, তারপরে দেখা যাবে। পুরুলিয়া শহরে আমার পরিচিতদের দু একজনকে বলেও রেখেছিলাম হোটেলের কথা। তবে শহরে রাত্রিবাসের ইচ্ছা আমাদের কারোরই ছিল না। রুট ম্যাপটা দেখতে দেখতে মনে পড়ল বাঁকুড়া পুরুলিয়ার সীমানায় ধবনী গ্রামের আশিস মাহাতর কথা। আশিস আমাকে জানিয়েছিল সে একটা ছোটখাটো হোম স্টে বানিয়েছে তার গ্রামে। একবার সেটাও দেখে গেলে হয়।

ধবনী গ্রামের আগে পৌঁছে আশিসকে ফোন করতেই সে বাইক নিয়ে এসে নিয়ে গেল তার গ্রামের বাড়িতে। গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে ওদের বাড়ি, পলাশ সোনাঝুরির বন চারিপাশে, গাছপালায় ছাওয়া চমৎকার পরিবেশ। খুব পছন্দ হয়ে গেল জায়গাটা। আশিসের মূল বাড়ির লাগোয়া দু তিনটি ঘরকে সে থাকার জায়গা বানিয়েছে। সে বাড়ির পিছনে তখন ধান ঝাড়াইয়ের কাজ চলছে। আরও পিছনের দিকে সোনাঝুরি বনের মধ্যে দিয়ে আঁকা বাঁকা রাস্তা চলে গিয়েছে পাশেই থাকা একটা পাহাড়ের দিকে।

থাকার ঘর যে খুব আহামরি তা নয়, কিন্তু আশিসের হাসিমুখ, আর এলাকার সবুজ জড়ানো পরিবেশ, আমাদের তিনজনেরই ভাল লেগে গিয়েছিল। সেখানেই রাতে থাকা যায় কিনা সে আলোচনাও নিজেদের মধ্যে শুরু করে দিয়েছিলাম। ঘর, খাট বিছানা এসব নিয়ে আমাদের কোনও অভিযোগ নেই, এর চাইতেও ঢের খারাপ ঘরে বা বিছানায় আমরা রাত কাটিয়েছি।  কিন্তু গোল বাধল, শৌচাগার নিয়ে। শৌচাগারটি বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে, আমার স্ত্রী দেখলাম এই ব্যাপারটি নিয়ে বেশ সংশয়ে বা অস্বস্তিতে। আশিস কিন্তু সমস্যাটা বুঝল, সেই পরামর্শ দিল একটু দূরেই একটা পথসাথী আছে, সরকারী মোটেল। সেখানে থাকতে পারেন, সে জায়গাটাও ভাল।

আশিসই নিয়ে গেল পথসাথীতে। গিয়ে দেখলাম বড় রাস্তার ধারে হলেও সত্যিই জায়গাটা বেশ মনোরম। আশেপাশে লোকালয় নেই। সামনেই  বড় রাস্তাটা পার হলেই একটা বড় দীঘি, দীঘির ওপাশেই পাহাড়। পিছনে অনেকটা জুড়ে পলাশ বন, সেটা পেরলে মাঠ, মাঠ পেরোলে আরও একটা পাহাড়। এক কথায় একদিন নিরিবিলি থাকার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ।  সব দেখেশুনে ঠিক হল এখানে রাত্রিবাস করা যায়। পুরুলিয়া শহরে আর যাওয়ার দরকার নেই।

হুড়ার একটু আগে সেই পথসাথীতে খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা বেরোলাম আশপাশ ঘুরে দেখতে। আশিসের কথা মত আমরা চললাম পাকবিড়রার দিকে। বেশ কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পরেই হঠাৎ গাড়ি থামাতে বলল আশিস। কৌতূহলী চোখে তাকাতেই জানাল শিলাবতী নদীর উৎসস্থল নাকি এখানেই। অবাক হলাম, দুটি মন্দির আছে দেখলাম। কিছু না বলে একটু এগোতেই একটা মজা পুকুর। আশিস বলল সেটাই নাকি শিলাবতীর উৎস। শিলাবতী নদী, রূপসী, তার বিভিন্ন জায়গায় আমি বিভিন্ন রূপ দেখেছি। ঘাঘরা, গনগনি সেখানে শিলাবতীর এক অন্য রূপ। ঘাটালে বন্যায় ভয়ংকর রূপ। সেই নদী এমন একটা মজা পানা পুকুর থেকে তৈরি হয়েছে এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। পুকুর থেকে একটা ছোট নালা বেরিয়েছে, তা ধরে প্রায় হাফ কিলোমিটার হেঁটে গেলাম আমরা, পরে একটু একটু করে বড় হতে হতে নাকি তা নদীর রূপ নিয়েছে। স্থানীয় দুএকজনও সেই কথায় সায় দিলেন, তাতেও মন ভরল না। পরে অবশ্য দেখলাম গুগলও ওই পুকুরকেই শিলাবতীর উৎস বলেই দেখিয়েছে। ওই নালাটিকেই নদী বলে দেখাচ্ছে এখনও। যাই হোক মন না ভরলেও জানার ভান্ডার কিছুটা ভরেছে এই ভরসাতেই ফের গাড়ি স্টার্ট দিলাম।     

শিলাবতীর উৎসস্থল

 পুঞ্চা শহরে ঢোকার একটু আগে বাঁ দিকে বেঁকে যেতে বলল আশিস। খানিক পরেই শুরু হল পলাশের জঙ্গল। কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সেই পলাশের জঙ্গল পেরিয়ে পৌঁছলাম পাকবিড়রায়। মন্দির, স্থাপত্য এবং প্রত্নতত্বের স্বর্গ এখানে। স্থানীয় একজন এই মন্দির এবং সংগ্রহশালা দেখাশোনা করেন।

পাকবিড়রার সংগ্রহশালা

পাকবিড়রার ইতিহাস একটু না জানলে এখানকার রস আস্বাদন সম্ভব হবে না। তাই আগে একটু ইতিহাসে নজর দেওয়া যাক। অনুমান করা হয় যে সংসার ত্যাগের পর দীক্ষা নিয়ে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ অব্দে শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীর পশ্চিমে ছোটনাগপুর মালভুমি আর পূর্বে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের মধ্যবর্তী অঞ্চলের বিস্তীর্ণ জায়গা ঘুরে বেড়ান যা তখন রাঢ় প্রদেশ নামে খ্যাত ছিল। অধুনা বাংলা, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশার কিছুটা অংশ নিয়ে গঠিত ছিল এই অঞ্চল। পরে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে উত্তর ও মধ্য ভারতের জৈনরা বাণিজ্য সূত্রে এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে যাতায়াত শুরু করে। এই অঞ্চলের বিভিন্ন নদী যেমন দামোদর, সুবর্ণরেখা, কংসাবতী, শিলাবতী ইত্যাদির ওপর দিয়ে তাদের নৌবহর বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ত। ঘটনাক্রমে তারাই এখানকার মাটির নিচে মূল্যবান সব আকরিকের সন্ধান পায় এবং সে’সব উত্তোলন করে বাণিজ্যের কাজে লাগাতে থাকে। শুরুতে বেশ কিছু টানাপোড়েন হলেও পরে স্থানীয় মানুষও তাদের সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করতে থাকে এবং ক্রমশ জৈনধর্ম ও সংস্কৃতিকে ব্যাপক হারে গ্রহণ করতে থাকে। পরে জৈনদের বেশিরভাগ ফিরে গেলেও একটা বড় অংশ এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। সেই সূত্রে, পূর্ব গাঙ্গেয় অঞ্চলের শাসক অনন্তবর্মনের আমলে কিছু ধনী জৈন ব্যবসায়ী, স্থানীয় কিছু দলনেতার সাহচর্যে বর্তমান পুরুলিয়া জেলার বিভিন্ন অংশে প্রচুর সংখ্যক জৈন মন্দির স্থাপন করে। অনুমান, পাকবিড়রা তেমনই একটি জায়গা।

পাকবিড়রার মন্দির

মন্দিরগুলির নির্মাণ হয় নবম ও দশম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়কালে। আজ থেকে একশো বছর আগেও মন্দির ও তৎসংক্রান্ত মুর্তিগুলির বেশ কিছু অবশিষ্ট এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকতে দেখা যেত। কিন্তু সময়ের অবহেলায় অধিকাংশই আজ ধূলিসাৎ। আপাতত দাঁড়িয়ে রয়েছে বাকি আছে মাত্র তিনটি মন্দির। সবগুলিই রেখ দেউল প্রকৃতির এবং সবুজ ক্লোরাইট পাথর দ্বারা নির্মিত। প্রথম ও দ্বিতীয়টি উত্তরমুখী। এদের একটিতে আছে মহাবীর এবং অন্যটিতে আছে আদিনাথের মূর্তি। তৃতীয়টি সব থেকে ছোট, পূর্বমুখী, এর মধ্যে রয়েছে চন্দ্রপ্রভু স্বামীর একটি মূর্তি। খননকার্যের সময় এই জায়গায় সব থেকে উল্লেখযোগ্য যেটি পাওয়া যায় তা হল প্রায় আট ফুট দীর্ঘ শীতলনাথের মূর্তি, যাঁকে পদ্মপ্রভু নামেও ডাকা হয়। যেহেতু দিগম্বরেরা ছিলেন বস্ত্র পরিধানের বিপক্ষে সংগৃহীত মূর্তিতে শীতলনাথও বিবস্ত্র। মন্দির চত্বরে রাখা এই মূর্তিকে স্থানীয়রা ভৈরবনাথ দেবতা মেনে পুজো করেন, তাই অনেকে এই জায়গাকে ভৈরবস্থান নামেও ডাকেন। এছাড়াও সেই সময়ের বিভিন্ন আকৃতি ও কারুকার্যের আরও অনেক মূর্তি পাওয়া গেছে, যার অধিকাংশই তৎকালীন স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের বহুল নিদর্শনে সমৃদ্ধ। মেইন গেট দিয়ে ঢুকে বাঁদিকেই নবনির্মিত একটি মিউজিয়াম রাখা আছে সে’সব। মন্দিরগুলির নির্দিষ্ট কোনও প্রতিষ্ঠাতার নাম পাওয়া যায় নি। তবে উদ্ধার হওয়া কিছু শিলালিপি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে সঙ্গে নিয়ে গেছে এবং তা থেকে তথ্য সংগ্রহের কাজও চলছে।

পাকবিড়রা থেকে আমাদের ফিরে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সংগ্রহশালার কেয়ারটেকার আমাদের টুশ্যামা ঘুরে যেতে বললেন। টুশ্যামা এখান থেকে আরও প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে। চললাম সেই দিকে। টুশ্যামা অবশ্য আশিসও জানে না। তাই একটু জিজ্ঞাসা করে এগোলাম আমরা। আধঘন্টা পরে পৌঁছলাম কংসাবতীর ধারে টুশ্যামাতে। এ জায়গাটি প্রাকৃতিক দিক থেকেও ভারি চমৎকার।  নির্জন নদী তীরে একটি জৈন মন্দির। সামনেই ঝিরিঝিরি জলধারা কাঁসাইয়ের। আমাদের দেখে আলাপ করতে এগিয়ে এল এক ঠাকুমা। কলকাতা থেকে এসেছি শুনে তো অবাক ঠাকুমা গল্পের ঝুলি খুলে বসল সেখানেই।

টুশ্যামার মন্দির চত্বরে
টুশ্যামার আদিনাথের মন্দির

 কাঁসাই বা কংসাবতী বা পূর্বতন ‘কপিশা’ নদীর তীরে বুধপুর গ্রামের পশ্চিমে টুশ্যামার অবস্থান। ঐতিহাসিকদের অনুমান, নবম – দশম শতকে কাঁসাই নদীর উত্তরে এবং দামোদর নদীর দক্ষিণে জৈন ধর্মের কিছু মানুষ বসবাস করতেন। কিংবা তাম্রলিপ্ত (তমলুক) থেকে দামোদর – কাঁসাই নদীপথে জৈন ব্যবসায়ীরা তামা আমদানি রফতানি করতেন। ফলে, সেকালের তামার ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই হয়তো বুধপুর, টুশ্যামা, পাকবিড়রা গ্রামের প্রত্নস্থলগুলি নির্মিত হয়েছিল। ভিন্নমতও আছে। টুশ্যামা গ্রামে কাঁসাই নদীর পূর্ব পাড়ে পাথরের একাধিক দেব দেউল, আর আদিনাথের মূর্তি রয়েছে। এটিও রেখ দেউল রীতিতে নির্মিত, প্রায় তিরিশ ফুট উঁচু। গর্ভগৃহে কালো পাথরের শিবলিঙ্গাকৃতি মুর্তি থাকায় স্থানীয়রা এটিকেও শিব জ্ঞানেই পুজো করেন। মন্দির চত্বরে অগুন্তি আয়তাকার শিলাদন্ড পড়ে আছে, সেগুলির মাঝখানে খোদাই করা মুর্তি।

বুধপুর মন্দির চত্বরে

ফেরার পথে ঘুরে এলাম বুধপুরে বুধেশ্বর মন্দির। সেখানেও রয়েছে বেশ কিছু প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন। এবারে রাত্রিবাস সেই পথসাথীতে। রাতে একবার বেরিয়েছিলাম আমরা পিছনে পলাশবনের পথ ধরে। হালকা আলোয়, বন পেরিয়ে মাঠের মাঝে সেই পথচারণা ভাল লাগার অন্য রসায়ন এনে দিয়েছিল। দূরে অস্পষ্ট পাহাড়ের আভাষ, বাড়িয়ে দিয়েছিল সেই রহস্যকে। বড় ভাল সে মুহূর্ত। তেমনই ভাল ভোরে সামনের বড় পাহাড়ের কোল ঘেঁসে প্রাতঃভ্রমণের অভিজ্ঞতাও। নিরিবিলিতে পাখির ডাকের আবহে বাবা ছেলের সেই পাহাড় অভিযানও বেশ সুখকর ছিল।  সব মিলিয়ে এই অচেনা পুরুলিয়াও মুগ্ধ করেছে আমাদের হঠাৎ সফরে। মনে হয়েছে সব থাকা স্বত্বেও কিছু না পেয়ে উপেক্ষিত হলেও এই পুরুলিয়াও তার আলাদা সুন্দরে অনন্য। ধন্যবাদ আশিসকে, নিঃস্বার্থ ভাবে আমাদের সঙ্গে থেকেছে সে। তার বাড়িতে না থাকাতেও সে রাগ তো করেইনি, উল্টে আমাদের আরও সহযোগিতা করেছে যা এখনকার দিনে দুর্লভ। এটাও তো এই সফরের পাওনাই বলা যায়।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × 1 =

preload imagepreload image