অমৃতের বিষ পান 

বিশ্বদীপ মুখোপাধ্যায়, নবদ্বীপ, নদিয়া

 

পর্ব – ১
          

অমল হালদারের নিমন্ত্রণটা অমান্য করতে পারলো না মৃত্যুঞ্জয়। কলকাতা তার জীবনের অতীত, এক এমন অতীত যার ছায়া সে নিজের বর্তমান জীবনে পড়তে দিতে চায় না। নর্থ বেঙ্গলে থাকাকালীন এক রহস্যের সমাধান করার জন্য তাকে কলকাতা যেতে হয়েছিল। কিন্তু সেটাও অনিচ্ছা সত্বেও। আরও এক বার তাকে যেতে হবে কলকাতা। অমলবাবুর অনুরোধ সে অমান্য করবে কী করে?
মৃত্যুঞ্জয় যখন সিআইডি তে কাজ করতো, অমল হালদার ছিলেন তার সিনিয়ার। বয়স জ্যেষ্ঠ অমল হালদারকে মৃত্যুঞ্জয় নিজের গুরু বলে মানতো। অমল বাবু চাকরী থেকে অবসর পেয়েছেন প্রায় দু  বছর হলো। থাকেন কলকাতাতেই, নিজের বাড়িতে। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে অরূপ হালদার পুলিশেই কাজ করে। দমদম থানার বড়বাবু সে এখন। মেয়ে অর্পিতা হালদার পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর এক প্রাইভেট কোম্পানীতে কাজ করে। তারই বিয়ের উপলক্ষ্যে মৃত্যুঞ্জয়কে কলকাতা  আসার নিমন্ত্রণ করলেন অমল হালদার।
আজকের দিনে মৃত্যুঞ্জয়ের গোপন ঠিকানার বিষয় যারা জানে, তাদের মধ্যে এক জন অমল বাবু। নর্থ বেঙ্গল ছাড়ার পর মৃত্যুঞ্জয় যে বাঁকুড়াতে আছে, সেটা তিনি বেশ ভালো করেই জানতেন। মৃত্যুঞ্জয়ের চাকরী ছাড়ার পর তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিলেন তিনি। মৃত্যুঞ্জয় বহুবার পরিবর্তন করেছে নিজের মোবাইল নম্বর। কিন্তু প্রতিবারই নিজের নতুন নম্বর অমল বাবুকে দিয়েছে। পুলিশ ডিপার্টমেন্টের অনেকেই জানে যে অমল বাবুর যোগাযোগ আছে মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে। অনেকে অমল বাবুর থেকে মৃত্যুঞ্জয়ের নম্বরও চেয়েছে। কিন্তু নম্বর দেননি অমল হালদার। বিশ্বাস রক্ষা করতে তিনি খুব ভালোই জানেন।

অমল বাবুর ডাকে কলকাতা এলো মৃত্যুঞ্জয়। বিয়ের অনুষ্ঠান, অমল বাবুর লেক টাউনের দোতলা বড় বাড়িতে আত্মীয়র প্রাচুর্য। অমল হালদার প্রত্যেককে মৃত্যুঞ্জয়ের পরিচয় দিলেন নিজের এক বন্ধুর ছেলে বলে। মৃত্যুঞ্জয়ের আসল পরিচয় যদি কেউ জানতো, সে হলো অমল বাবুর স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে এবং নিমন্ত্রিত কিছু পুলিশ অফিসার।
বিয়ের দিন সকালে অরূপ কাজে বেরিয়ে গেলো। ছুটি তো সে নিয়েছিল, কিন্তু থানা থেকে ফোন আসাতে তাকে চলে যেতে হলো। শুরুতে একটু গজগজ করলেন ঠিকই অমল বাবু, কিন্তু তিনি জানেন পুলিশের চাকরীর কোনো বাঁধাধরা সময় হয় না। বিকেলে ফিরে এলো অরূপ। বরযাত্রী আসতে এখনও প্রায় দু’ঘন্টা দেরি। ইতিমধ্যেই থানায় যাবার কারণটা মৃত্যুঞ্জয়কে বলল অরূপ। বরযাত্রীর আপ্যায়নের সরঞ্জাম করতে – করতে অরূপ মৃত্যুঞ্জয়কে বলল – ‘ আজ সকালে দমদমের এক হোস্টেলে একটা ছেলে খুন হয়েছে। ‘
‘ হোস্টেলে খুন? ‘ জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ না, ঠিক হোস্টেলে না। রাস্তায়। ‘
‘ রাস্তায়? কেউ প্রত্যক্ষদর্শী ছিলো না ? ‘
‘ না, এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আসলে ঘটনাটা ঘটেছে ভোর পাঁচটা নাগাদ। রাস্তা সুনসান ছিলো সে সময়। কেউ তাকে ফোন করে হোস্টেলের বাইরে ডাকে। ‘
‘ কার নম্বর পাওয়া গেলো ফোন চেক করে ? ‘
‘ আননোন নম্বর। স্যুইচ অফ। নম্বর ট্রেস করতে দেওয়া হয়েছে। কাল রিপোর্ট আসবে। ‘
‘ কী দিয়ে খুন করা হয়েছে ? ‘
‘ ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে। সম্ভবত চাকু। কিন্তু সেটা পাওয়া যায়নি। ‘
‘ লেগে পড়, অরূপ। মনে হয়ে এই কেসটা তুমি অ্যাজ সুন অ্যা্জ পসিবল সল্ভ করে নেবে। ‘

বিয়ে চলা কালিন বহু বার অরূপের ফোন বেজে উঠল। বেশ চিন্তাগ্রস্ত ছিলো অরূপের মুখমন্ডল। সে সশরীরে তো বিয়ের অনুষ্টানে, কিন্তু মনটা যেন অন্যত্র। মৃত্যুঞ্জয় বুঝতে পারলো কেসের চাপটা হয়তো বাড়ছে। অরূপের কাছে এসে সে জিজ্ঞেস করলো – ‘ কী হলো, অরূপ ? বেশ চিন্তায় আছো মনে হচ্ছে ? ‘
‘ কল ট্রেসিং – এর রিপোর্ট এসেছে, মৃত্যুঞ্জয়দা। ওই নম্বরটা অমৃতের নামেই নেওয়া। ‘ অরূপ বলল।
‘ কোন নম্বরটা ? ‘
‘ যে নম্বর দিয়ে লাস্ট কল এসেছিল। ‘
‘ অমৃতটা কে ? ‘
‘ যে খুন হয়েছে, তার নাম অমৃত। অমৃত সামন্ত। ‘
‘ কলটা কোথায় থেকে করা হয়েছিল জানা গেলো ? ‘
‘ হুম। দমদম থেকে। ভোর চারটে বেজে পঞ্চাশ মিনিটে। বাড়ির লোককে খবর দেওয়া হয়েছে। তারা থানায় এসে বসে আছে।’ অরূপ বলল।

হাতে কোনো কেস পেলে রাতের ঘুম শেষ হয়ে যায়, সেটা জানে মৃত্যুঞ্জয়। তার সাথেও এমনই হতো। অরূপ দমদম থানার বড় বাবু। হয়তো অনেক রহস্যের সমাধান সে করেছে। কিন্তু এখন সে নার্ভাস কেন? কারণটা জানতে পারলো মৃত্যুঞ্জয় পরের দিন। অর্পিতার বিদায়ের পরে অরূপ মৃত্যুঞ্জয়কে বলল – ‘ যার সামনে এতো বড় এক আইপিএস অফিসার থাকবে, সে তো একটু হলেও নার্ভাস হবে। খুব বড় কমপ্লিকেটেড কেস আমি আজ পর্যন্ত হ্যান্ডেল করিনি। জানি না এই কেসটা কতোটা কমপ্লিকেটেড হবে। ‘
‘ আমি আর আইপিএস নয়, অরূপ। ভুল করছো তুমি। আমাকে দেখে নার্ভাস হবার কিছুই নেই। ‘ মৃত্যুঞ্জয় বলল।
‘ সত্যি বলতে এই প্রথম পুরোপুরি কোনো কেস আমার হাতে এলো। এর আগে কোনো থানার ইনচার্জ আমি ছিলাম না। কিছু দিন হলো দমদম থানার ইনচার্জ হয়ে আমি এসেছি। মৃত্যুঞ্জয় দা, একটা রিকোয়েস্ট করবো ? ‘
‘ কী ? ‘
‘ ক্যান উ হেল্প মি টু সল্ভ দিস কেস ? তোমার সান্নিধ্যে কিছু শেখার এর থেকে বড় সুযোগ আর কী কোনো দিন পাবো ? ‘

  পর্ব –  ২

‘ আমি অফিসিয়ালি তো তোমাকে সাহায্য করতে পারবো না, অরূপ। কিন্তু আনঅফিসিয়ালি তোমার সাথে আছি। ‘ অরূপের কাজে বেরোবার আগে মৃত্যুঞ্জয় তাকে বলল।

সারা দিন মৃত্যুঞ্জয় বাড়িতেই থাকলো। অধিকাংশ সময় সে কাটালো অমল বাবুর সাথে। কিছু পুরোনো কথা যে উঠল সেটা বলাই বাহুল্য।
অমল বাবু বললেন – ‘ মৃত্যুঞ্জয়, তখন তোমার মাথার ঠিক ছিলো না। প্রভার চলে যাওয়া তোমায় ভেঙ্গে দিয়েছিল। তখন তুমি যা করতে যাচ্ছিলে, তাতে তোমাকে বাঁচানো কঠিন হয়ে যেতো। ডিপার্টমেন্টে তোমার প্রয়োজন ছিলো। ‘
‘ প্রবলেম তো সেখানেই, স্যার। আপনারা শুধু ডিপার্টমেন্টের বিষয় ভেবে গেলেন। ডিপার্টমেন্টের এক অফিসারের মনে কী ঝড় চলছে সেটা আপনারা বুঝলেন না। আমার স্ত্রী ও তার গর্ভে থাকা ছ ‘ মাসের সন্তানকে যারা মেরেছে, তারা পলিটিক্যাল লিডারের ডান হাত ছিলো। তাই আমি যদি তাদের প্রাণের শত্রু হয়ে যেতাম, তাহলে আমার জীবিত থাকায় প্রশ্ন চিহ্ন উঠে যেতো। ডিপার্টমেন্ট চাইতো আমি অনবরত ডিপার্টমেন্টের হয়ে জটিল থেকে জটিল রহস্যের সমাধান করে যাই। তার জন্য আমার জীবিত থাকার প্রয়োজন ছিলো। স্যার, আজকের দিনে আমার এটা বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয়ে না, যে ডিপার্টমেন্ট আমার সাথে স্বার্থপরের মতো ব্যবহার করেছে। আমার আজও রাতে ঘুম হয় না, স্যার। ততো দিন রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবো না, যতো দিন না আমি নিজের স্ত্রী ও সন্তানের খুনিদের শাস্তি না দি। ‘
মৃত্যুঞ্জয়ের কথা গুলো চুপচাপ শুনলেন অমল হালদার।
‘ তাই আমিও চাকরী ছাড়তে বাধ্য হলাম স্যার। যদি ডিপার্টমেন্ট আমার প্রতি স্বার্থপর হয়ে, তাহলে আমিও তার প্রতি স্বার্থপরই হবো। ‘
‘ গ্লানি আমারও আছে, মৃত্যুঞ্জয়। প্রভা আমার মেয়ের মতো ছিলো। তার অসময় চলে যাওয়া আমায় কতোটা আঘাত দিয়েছে সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। কিন্তু তুমি সে সময় নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলে। সে সময় তোমাকে সামলানো দরকার ছিলো। যদি স্বার্থপরের কথা বলো, সেটা শুধু ডিপার্টমেন্ট নয়, স্বার্থপর আমিও। আমি প্রভার মতো মেয়েকে হারিয়েছিলাম, মৃত্যুঞ্জয়ের মতো ছেলে হারানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। ‘দু’চোখ ছলছল করে উঠল অমল বাবুর।

রাত দশটার পর বাড়ি ফিরলো অরূপ। ডিনার শেষ করে ছাদে গিয়ে কথা হলো মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে তার। সিগারেটের ডিবে থেকে মৃত্যুঞ্জয়কে একটা সিগারটে দিয়ে একটা নিজে ধারালো সে। একটা টান দিয়ে বলল – ‘ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট চলে এসেছে। ‘
‘ কী বেরোলো তাতে? ‘
‘ সেটাই, যা আন্দাজ করেছিলাম। ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে গলার নলি কাটা হয়েছে। ‘
‘ ফোন লিস্ট চেক করা হয়েছে? ‘ মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
‘ হ্যাঁ। শেষ কলটা দমদম থেকেই এসেছিল। নম্বরটা অমৃতের নামেই নেওয়া। বাকি কল হিস্ট্রি যা বেরলো তাতে বেশিরভাগ তার বন্ধুবান্ধবের নম্বর। পায়রাডাঙ্গাতে অমৃতের বাড়ি। বেশিরভাগ কল সেখানেই করা হয়েছে। কিছু কল করা হয়েছে কলকাতায়। নিজের রুমমেটকে আর যেখানে টিউশন পড়াতো  সেখানে। ‘
‘ টিউশন পড়াতো অমৃত? ‘
‘ হ্যাঁ, হাত খরচার জন্য। তার রুমমেট রাহুলের থেকে আমরা জানাতে পেড়েছি। অমৃত কলকাতায় থেকে ব্যাংক, রেল ইত্যাদি পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করতো। খরচা বাবদ কিছু টাকা তার বাবা পাঠাতো, বাকি টাকা সে টিউশন করে রোজগার করতো। ‘
সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো – ‘ রাহুল কী করে? ‘
‘ একটা প্রাইভেট কোম্পানী তে চাকরী করে সে। অফিস সল্টলেকে। ‘
‘ হোস্টেলের রুম থেকে কী – কী জিনিস পাওয়া গেলো অমৃতের? ‘
‘ বিশেষ কিছুই না। কিছু জামা – কাপড় আর বইপত্র। ‘
সিগারট ফেলে দিয়ে খানিক চোখ বন্ধ করে চিন্তা করলো মৃত্যুঞ্জয়। তার পর জিজ্ঞেস করলো – ‘ অমৃতের বাবা কী করেন? ‘
‘ পায়রাডাঙ্গা তে তাঁর মুদির দোকান আছে। ‘ অরূপ জবাব দিলো।
‘ অমৃতের কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে কি না খোঁজ নিয়েছ? ‘
‘ আছে একটা। তার ওয়ালেট থেকে এটিএম পাওয়া গেছে। কিন্তু তার ব্যাগ সার্চ করে কোনো ব্যাংকের পাসবুক পাওয়া যায়নি। ‘
‘ খোঁজ নিয়ে দেখো। কোন ব্যাংকের কোন ব্রাঞ্চে তার অ্যাকাউন্ট, আর সেই অ্যাকাউন্টে এই মুহূর্তে কতো ব্যালেন্স আছে। ‘
‘ ঠিক আছে, মৃত্যুঞ্জয়দা। ‘
‘ অমৃতের কলকাতায় পরিচিত কেউ আছে কী? ‘
‘ এখন পর্যন্ত তো কাউকে পাওয়া যায়নি। ‘
‘ তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে কলকাতায় কে আছে? ‘
মাথা নেড়ে ‘ না ‘ বলল অরূপ – ‘কেউ না।’
‘ দিনে কটা টিউশনি করতো সে? ‘
‘ এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বলতে গেলে, দুটো। রোজ সন্ধ্যা ছ’টায় বেরোতো, রাত দশটায় ফিরতো। ‘ অরূপ বলল।
‘ তার মানে এই দুটো টিউশনি থেকে রোজগার বেশ ভালোই হতো তার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যখন কলকাতায় তার বিশেষ পরিচিতি কেউ ছিলো না, তখন তাকে এই টিউশনগুলো কে ধরিয়ে দিয়েছিল? ‘
মৃত্যুঞ্জয়ের প্রশ্নে চুপ থাকলো অরূপ। নিরুত্তর সে।
‘ এই প্রশ্নের উত্তর সেখানে গিয়েই পাওয়া যাবে, যেখানে অমৃত টিউশন পড়াতো। অরূপ, তুমি এক কাজ করো, আগামী কাল তুমি অমৃতের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ডিটেল্স বার করো। আমি বরং তার টিউশন বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নিই। তার টিউশন বাড়ির ঠিকানা দাও।’

বাঘাযতীনের এক বহুতল অট্টালিকা। তারই আট তলায় 712/B নম্বর ফ্ল্যাটে থাকেন মিতালী গাঙ্গুলী। বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি, সুগঠিত সুন্দর চেহারা এবং উপস্থিত বুদ্ধি রাখেন খুব বেশি। কলিং বেল টিপতে পরিচারিকা দরজা খুলল।
‘ ম্যাডাম আছেন? ‘ পরিচারিকাকে জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ আপনি? ‘ জবাব দেওয়ার বদলে পরিচারিকা ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলো।
‘ ম্যাডামকে বলুন পুলিশের লোক এসেছে।’
পুলিশের নাম শুনে পরিচারিকার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো।
‘ কে এসেছে রে? ‘ ইতিমধ্যেই মিতালী ভেতর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। কিছু সেকেন্ড মৃত্যুঞ্জয়কে অবাক দৃষ্টিতে দেখার পর জিজ্ঞেস করলো – ‘ আপনি?
‘ হ্যাঁ আমি। আমি এসিপি মৃত্যুঞ্জয় মজুমদার, সি আই ডি। ‘
‘ সি আই ডি! সি আই ডি হঠাৎ আমার বাড়িতে কেন জানতে পারি? ‘
‘ নিশ্চই জানতে পারেন ম্যাডাম। আসলে আমাদের কাছে সময়ের খুব অভাব। তাই ফালতু ঘুরে বেড়ানো আমাদের পোষায় না। যেখানে যাই, কাজেই যাই।’
পরিচারিকাকে চা করতে বলে মৃত্যুঞ্জয়কে হল ঘরের সোফাতে বসতে দিলেন মিতালী। হল ঘরটা ভালো করে এক বার চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো মৃত্যুঞ্জয়। বেশ সুন্দর সাজানো ঘর। দামী সোফাসেট, মাটিতে দামী কার্পেট, দেয়ালে ঝুলছে বেশ সুন্দর কিছু ওয়েল পেন্টিং। তাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের কারণে ঘরটা বেশ ঠান্ডা। ঘর সাজাবার জন্য প্লাস্টার অফ পেরিসের বেশ কিছু মূর্তি এবং কিছু শোপিস দেখতে পেলো মৃত্যুঞ্জয়।
মৃত্যুঞ্জয়ের সামনের সোফাতে বসে মিতালী বলল – ‘ বলুন, আজ হঠাৎ সি আই ডি আমার ফ্ল্যাটে আসার প্রয়োজন বোধ করলো কেন? ‘
‘ আপনি অমৃত সামন্তকে কী ভাবে চেনেন? ‘
অমৃতের নাম শুনে মুখটা ঈষৎ শুকিয়ে গেলো মিতালীর।
‘ আমার মেয়ে রিয়াকে টিউশন পড়াতো অমৃত, প্রায় এক বছর ধরে। খুব ভালো পড়াতো সে। সত্যি বলতে এখন চিন্তায় পড়ে গেলাম। রিয়ার জন্য নতুন টিউটার খুঁজতে হবে। সামনে পরীক্ষা তার। কী যে করি, কিছুই বুঝতে পারছি না। ‘ বিষন্নতা ভরা মুখে মিতালী বলল।
‘ তার মানে আপনি প্রায় এক বছর ধরে চেনেন অমৃতকে ? ‘
‘ হ্যাঁ। ‘
‘ কী করে পরিচয় হয়ে তার সাথে আপনার ? ‘
‘ আমার এক বান্ধবীর মাধ্যমে। তার ছেলেকেও অমৃত টিউশন পড়াতো। ‘
‘ কী নাম আপনার বান্ধবীর? ‘
‘ রুবি দে। বালিগঞ্জে থাকে।’

পর্ব –  ৩

‘ আপনি আর আপনার মেয়ে থাকে এই ফ্ল্যাটে? ‘ মৃত্যুঞ্জয়ের আরেকটা প্রশ্ন।
‘ হ্যাঁ। ‘
‘ আপনার হাসবেন্ড ? ‘
‘ মারা গেছেন, প্রায় দু ‘ বছর হলো। ‘
‘ ওঃ ! সরি। এই ফ্ল্যাটটা আপনার নামে না আপনার হাসবেন্ডের নামে? ‘
এই প্রশ্ন অল্প বিরক্ত হলো মিতালী। বলল – ‘ এর উত্তরের সাথে কি এই কেসের কোনো যোগাযোগ আছে? ‘
মৃদু হেসে মৃত্যুঞ্জয় বলল – ‘ যোগাযোগ আছে কি না সেটা আমরা বুঝে নেবো, ম্যাডাম। আপনি শুধু আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যান। ‘
চা চলে এলো। চা দিয়ে পরিচারিকার ভেতরে চলে যাওয়ার পর মিতালী বলল – ‘ এই ফ্ল্যাটটা আমার। হাসবেন্ড মারা যাওয়ার ছ’ মাস পর আমি কিনেছি। আমার শ্বশুর বাড়ি বেহালাতে। স্বামী মারা যাওয়ার পর সেখানে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাই ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে এই ফ্ল্যাটটা কিনি। ‘
‘ আপনার মেয়েকে দেখছি না। ‘
‘ সে স্কুলে। সকাল আটটা থেকে দুপুর দু’টো পর্যন্ত তার স্কুল থাকে। ‘
‘ আপনার অফিসের টাইম কী? ‘
‘ এগারোটা থেকে পাঁচটা। ‘
‘ আপনার মেয়ে যখন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে তখন বাড়িতে কে থাকে ? ‘
‘ আমার কাজের লোক। যে বৌটা চা দিয়ে গেলো, সে। তার ডিউটি সকাল সাতটা থেকে সন্ধে  ছ’টা অবধি।’
‘ কতো দিন ধরে কাজ করছে সে? ‘
‘ আমার এখানে আসার পর থেকেই। ‘
‘ তার সাথে কি কথা বলা যেতে পারে? ‘
‘ হ্যাঁ। কিন্তু এখন না। আমার অফিসের দেরি হচ্ছে। আপনি বরং কাল আসুন। কাল আপনি তার সাথে কথা বলে নেবেন। ‘
মৃত্যুঞ্জয় ঘড়ি তে সময় দেখলো। সকাল প্রায় দশটা।
‘ কাল যদি আপনার পরিচারিকা না আসে? ‘
‘ সন্দেহ করছেন? ‘
‘ সন্দেহ করা তো আমাদের কাজ, ম্যাডাম। আমরা প্রত্যেককে সন্দেহ করি। ‘
‘ আপনি আজ আমায় যেখানে পেলেন, কালও সেখানেই পাবেন। আমার পরিচারিকাও আগামী কাল থাকবে। ‘ দৃঢ় কন্ঠে মিতালী বলল।
‘ বেশ। যাওয়ার আগে আপনার থেকে তিনটে জিনিস চাইবো। ‘ মৃত্যুঞ্জয় বলল।
‘ কী ? ‘
‘ আপনার শ্বশুর বাড়ির ঠিকানা, আপনার অফিসের ঠিকানা এবং রুবি দে-র বাড়ির ঠিকানা। আশা করি আপনার আপত্তি হবে না। ‘
‘ না, আপত্তি নেই। তবে আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেদের বিরক্ত না করাই ভালো। তাদের সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই। ‘
‘ চিন্তা করবেন না। খুব একটা বিরক্ত করবো না। আর হ্যাঁ, আপনার স্বামীর নামটা আপনি বললেন না।’
‘ দিবাকর গাঙ্গুলী। বিজনেসম্যান ছিলো, ক্যান্সারে মারা যায়। ‘

মিতালী গাঙ্গুলীর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে মৃত্যুঞ্জয় ফোন করলো অরূপকে। মিতালীর শ্বশুর বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বলল – ‘ খোঁজ নাও বাড়িতে কে – কে থাকে এখন। নিজের শ্বশুর বাড়ির লোকেদের সাথে মিতালীর সদ্ভাব ছিলো কি না। বিশেষ করে নিজের স্বামীর সাথে।’
আগামী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য মৃত্যুঞ্জয় বাঘাযতীন থেকে গিরিশ পার্ক গেলো। অমৃত নিজের দ্বিতীয় টিউশন সেখানেই করতো। প্রশান্ত বাগচী নামের এক জনের ছেলেকে পড়াতো সে। প্রশান্ত বাগচীর বাড়ি খুঁজে পেতে অল্প বেগ পেতে হলো তাকে। ভাড়া বাড়িতে থাকেন তিনি। বাড়ি খুঁজে পেয়েও কোনো লাভ হলো না মৃত্যুঞ্জয়ের। দরজায় তালা দেওয়া। খবর নিয়ে জানতে পারলো যে প্রশান্ত বাগচী স্বপরিবার কোনো এক আত্মীয়র বিয়েতে কলকাতার বাইরে গেছেন। যে কোনো তদন্তের জন্য সময়ের মূল্য সব থেকে বেশি হয়ে। এখানে আসাতে সময় নষ্ট হলো মৃত্যুঞ্জয়ের। ঘড়িতে সময় দেখলো সে, বেলা বারোটা বেজে গেছে। আর বেশি সময় নষ্ট না করে সে বেরিয়ে পড়লো বালিগঞ্জের দিকে। তার আগে রুবি দে কে ফোন করলো সে। মিতালী দিয়েছিলেন রুবি দের নম্বর।
‘ হ্যালো!’ এক মিহি কন্ঠ ভেসে এলো মোবাইলের ওপার থেকে।
‘ আমি কি রুবি দের সাথে কথা বলতে পারি ? ‘ মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
‘ বলছি। আপনি ? ‘
‘ আমি সিআইডি থেকে এসিপি মৃত্যুঞ্জয়। ‘
খানিক নিস্তব্ধতা পর ওপার থেকে আওয়াজ এলো – ‘ বলুন। ‘
‘ আপনার সাথে দেখা করতে চাই? ‘
‘ কারণ জানতে পারি কী? ‘
‘ অবশ্যই পারেন। কিন্তু কারণটা ফোনে বলা যাবে না। অত্যন্ত কনফিডেন্সিয়াল। ‘
রুবি দে বলল – ‘ দেখুন, আমি এই মুহূর্তে নিজের পার্লারে আছি। এখানে পুরুষ মানুষের প্রবেশ নিষেধ। সে কোনো পুলিশ অফিসারই কেননা হোক। আপনি বরং এক কাজ করুন, সন্ধে  ছ ‘ টার পর আমার বাড়ি তে আসুন। সেখানে নিশ্চিন্তে কথা হতে পারবে। ‘
মাথা গরম হলো মৃত্যুঞ্জয়ের। একে এমনিতেই সময় নষ্ট হয়েছে, এর থেকে বেশি সময় নষ্ট করতে সে নারাজ। বেশ উচ্চ গলায় সে বলল – ‘ আপনার সময়ের মতো আমরা চলতে পারবো না, ম্যাডাম। আমাদের প্রতিটা সেকেন্ড মূল্যবান। তাই সন্ধে  ছ’টা পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব না। আমি এক ঘন্টার ভেতর বালিগঞ্জ চৌমাথায় পৌঁছাবো। আপনি সেখানে দেখা করবেন আমার সাথে। ‘

এক ঘন্টার থেকে অল্প বেশি সময় লাগলো মৃত্যুঞ্জয়ের বালিগঞ্জ চৌমাথায় পৌঁছাতে। সে দেখলো বেশ ফরসা এক মহিলা, পরনে লাল শাড়ি, এদিক – ওদিক তাকাচ্ছে এবং বার – বার কাউকে ফোন করছে। মৃত্যুঞ্জয়ের মোবাইলে রিং হচ্ছিলো। সে বুঝতে পারলো লাল শাড়ি পরা মহিলাটি রুবি দে। ফোন কেটে এগিয়ে গেলো সে দিকে।
‘ আপনি কি রুবি দে ? ‘ মহিলা টির পেছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
মহিলা টি ঘুরে দেখলো তাকে।
‘ হ্যাঁ। আপনি সি আই ….’
‘ হ্যাঁ আমি। ‘
মুখে কৃত্রিম হাসি নিয়ে রুবি দে বলল – ‘ আপনি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন আমায়। আসুন, এখানে দাঁড়িয়ে তো কথা হবে না। আমার পার্লারেই চলুন। ‘
‘ কিন্তু সেখানে তো পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। ‘ মৃত্যুঞ্জয় বলল।
‘ আপনি যে ভাবে ফোনে কথা বললেন তাতে এটা পরিস্কার হয়ে গেছে যে ব্যাপার খুবই গুরুতর। আর গুরুতর ব্যাপারের আলোচনা রাস্তায় হয়ে না। তাই না? কেউ যদি কোনো জরুরি ব্যাপারে আমার সাথে দেখা করতে আসে, তাহলে তার জন্য আমার পার্লারের দরজা অবশ্যই খোলা আছে। চলুন, বেশি দূর না, পাশেই। ‘

রুবি দের পার্লার তার বাড়ির সাথে লাগোয়া, এক তলায়। একটা বোর্ড লাগানো আছে ‘ দে বিউটি পার্লার’। পার্লারে দুটো ঘর। সামনের ঘরে পার্লারের কাজ হয়ে। মৃত্যুঞ্জয় দেখলো কোনো গ্রাহক নেই। দুটো অল্প বয়সী মেয়ে এক সাথে বসে টিফিন করছে। বোধহয় এই পার্লারেই কাজ করে তারা। ভেতরের ঘরটা তুলনামূলক ছোটো। ছোটো আকারের গোল করে এক সোফাসেট পাতা আছে, মাঝখানে একটা গোল সেন্টার টেবিল। মৃত্যুঞ্জয়কে সেই ঘরে নিয়ে গেলো রুবি দে। রুবি দের বয়স মিতালীর বয়সের কাছাকাছি হবে। রুবি দে কেও দেখতে মন্দ না। গায়ের বর্ণ মিতালীর থেকে বেশি পরিস্কার হবে। কাঁধ পর্যন্ত চুল কাটা। চেহারার গঠন অল্প ভারিক্কি। কথা বলার পটুতা যেন মিতালীর থেকে বেশি রুবির। মৃত্যুঞ্জয়কে বসতে দিয়ে বলল – ‘ বাইরে প্রচন্ড রোদ, তায় আপনারা আবার পুলিশের লোক। মাথা সবসময় গরমই থাকে আপনাদের। বসুন, আপনার জন্য শরবত নিয়ে আসি। ‘
‘ ধন্যবাদ। শরবত লাগবে না আমার। এক গেলাস জল হলেই হবে। ‘
জল পান করার পর মৃত্যুঞ্জয় রুবিকে জিজ্ঞেস করলো – ‘ আপনি মিতালী গাঙ্গুলী কে চেনেন ? ‘
‘ মিতালী গাঙ্গুলী ? যে বাঘাযতীনে থাকে ? ‘
‘ হ্যাঁ। ‘
‘ খুব ভালো করে চিনি। সে তো আমাদের সমিতির এক সদস্য। ‘ রুবি জবাব দিলো।
‘ কিসের সমিতি ? ‘
‘ আমাদের এক মহিলা সমিতি আছে। নাম দিয়েছি, ” মহিলা উন্নয়ন সমিতি “। এই ঘরটা আসলে সমিতির মিটিংএ কাজে আসে। সমিতিতে যত সদস্য আছে সবার বাড়িতে এক বার – এক বার করে মিটিং হয়ে। আমার বাড়ি তে মিটিং হলে সেটা এখানেই হয়। হঠাৎ মিতালীর বিষয় জিজ্ঞেস করলেন? ও ভালো আছে তো ? ‘
‘ হ্যাঁ, সে ভালো আছে। আচ্ছা, আপনি অমৃতকে চেনেন ? ‘ মৃত্যুঞ্জয় আরেকটা প্রশ্ন করলো।
‘ কে অমৃত ? ‘
‘ অমৃত সামন্ত। দমদমে থাকে। বয়স প্রায় তেইশ – চব্বিশ। ‘
মনে পড়লো রুবির – ‘ ও হ্যাঁ, চিনি বৈকি। আমার ছেলেকে টিউশন পড়াতো। ‘
‘ টিউশন থেকে তাকে সরিয়ে দিলেন কেন ? ‘
‘ কারণ ছিলো। আমার ছেলে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। অমৃত ইংলিশে কাঁচা ছিলো একটু। অসুবিধে হচ্ছিলো। তাই তাকে সরিয়ে অন্য টিচার নিতে বাধ্য হলাম। ‘ রুবি বলল।
‘ কতো দিন আপনার ছেলে কে পড়িয়েছে সে? ‘
একটু চিন্তা করে রুবি বলল – ‘ প্রায় ছ’মাস। ‘
‘ আপনার সাথে অমৃতের পরিচয় কী করে হয়ে ? ‘
‘ অমৃতের মায়ের সাথে আমার পরিচয়। সে আমার বান্ধবী নয়, আমার থেকে বয়সে তিনি বড়। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের। অমৃতের বাবা তার মায়ের ওপর অত্যধিক টর্চার করতো। সেই টর্চার সহ্য না করতে পেয়ে এক দিন অমৃতের মা বাড়ি ছেড়ে কলকাতা চলে আসে। শেয়ালদা স্টেশন থেকে আমরা তাকে উদ্ধার করি এবং বাড়ি ফেরত নিয়ে যাই। তবে থেকে অমৃতের সাথে পরিচয় আমার।’
খানিক বিরতি নিয়ে রুবি দে আবার বলল – ‘ কেন বলুন তো? হঠাৎ অমৃতের বিষয় প্রশ্ন। সে ভালো আছে তো? অনেক দিন তার খোঁজ নেওয়া হয়নি। ‘
‘ না। সে ভালো নেই। তাকে খুন করা হয়েছে। ‘

পর্ব –  ৪
‘ কী! খুন করা হয়েছে? ‘খুনের কথা শুনে আঁতকে উঠল রুবি দে।
‘ হ্যাঁ, খুন করা হয়েছে তাকে। ‘ মৃত্যুঞ্জয় বলল।
‘ কিন্তু কেন? কী দোষ করেছিল সে? ‘
‘ সেটারই তো তদন্ত করছি ম্যাডাম। ‘
বিষন্নতার কালো ছায়া রুবির মুখের ওপর স্পষ্ট ফুটে উঠল। খানিক ঘাড় হেঁট করে বসে রইল সে।
‘ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার কথায়। অমৃত এক সাধারণ ছাপোষা ছেলে, কেউ অকারণে তাকে খুন করবে কেন ? ‘
‘ ম্যাডাম, মাঝে – মাঝে সাধারণ ছেলেও কিছু অসাধারণ কাজ করে ফেলে, যার ফলে তাকে নিজের প্রাণ দিতে হয়। ‘
‘ কবে হলো খুনটা? ‘ রুবি জিজ্ঞেস করলো।
‘ দু ‘ দিন হলো। আপনি অমৃতের বিষয় আরও কী – কী জানেন? ‘
‘ খারাপ কিছুই জানি না। তাকে টিউশনি থেকে বার করতে খারাপ লেগেছিল আমার। দু’পয়সা রোজগার তো হতো। তার রোজগার বন্ধ করতে আমি চাইনি। তাই একটা পার্ট টাইম জবের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম তাকে। কিছু দিন সেখানে কাজ করলো সে। তার পর ছেড়ে দিলো। বলল যে সে পড়াশোনা করতে চায়। সরকারী চাকরী পাওয়া তার লক্ষ্য। ‘ কাঁপা – কাঁপা কন্ঠে রুবি বলল।
‘ পার্ট টাইম কাজটা কোথায় করতো সে ? ‘
‘ পার্ট টাইম কাজ বলতে আমাদের মহিলা উন্নয়ন সমিতির কাজ দেখাশোনা করতো। হাত খরচা বাবদ কিছু টাকা তাকে দিতাম। ‘
বাইরের ঘরে বসে থাকা দুটো মেয়ের মধ্যে এক জন আওয়াজ দিলো – ‘ দিদি, কেউ এসেছে। ‘
‘ যাই। প্লিজ, আপনি বসুন, আমি এখনই আসছি। ‘ কথা বলে বেরিয়ে গেলো রুবি।
ঘরটাকে ভালো করে দেখলো মৃত্যুঞ্জয়। দেওয়ালে শোকেস ঝুলছে। বেশ কিছু পত্রিকা সাজানো তাকে।
বাইরের ঘর থেকে এক পুরুষের কন্ঠস্বর ভেসে এলো – ‘ আমি তাহলে আসি এখন। এক ঘন্টা পরে আসবো তোমায় নিতে। ‘
মৃত্যুঞ্জয় উঁকি মেরে দেখলো মেকআপের একটা চেয়ারে এক মহিলা বসে আছে, এবং দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে এক পুরুষ। সেই মহিলাটির স্বামী হয়তো। এবার এখানে থাকা সম্ভব না। রুবি দে এবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবে। মৃত্যুঞ্জয় ভেতর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
‘ আমি এবার আসি। শুধু একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার ছিলো আপনাকে। ‘
‘ করুন। ‘ বিনম্র কন্ঠে রুবি দে বলল।
‘ আপনার বাড়িতে কে – কে থাকেন ? ‘
‘ আমি, আমার ছেলে আর বৃদ্ধ শ্বশুর। বর বিদেশে থাকে। শাশুড়ি মারা গেছেন প্রায় পাঁচ বছর হলো। ‘

রাত্রে অরূপের ঘরেই কথা হলো দুজনের। অরূপ বলল – ‘ অমৃতের ব্যাংক ডিটেল্স চেক করা হয়েছে। তার ব্যাংক ব্যালেন্স শুনলে চমকে যাবে। ‘
‘ কতো? ‘ মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
‘ এই মুহূর্তে তার অ্যাকাউন্টে বাষট্টি হাজার টাকা আছে। ‘
‘ হুম, বুঝলাম। টিউশন থেকে এতো টাকা রোজগার সম্ভব না। ‘ কথা শেষ করে একটা সিগারটে ধারালো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ কোনো দু নম্বর ধান্দাও হতে পারে। সারা দিন না হোক, অমৃতের সাথে সারা রাত থাকতো তার রুমমেট রাহুল। সব না হোক, কিছু তো জানে সে নিশ্চই। আজ সন্ধেতে আবার সেই হোস্টেলে গিয়েছিলাম। রাহুলের সাথে দেখা করতে। ‘
‘ দেখা হলো তার সাথে? ‘ মৃত্যুঞ্জয় প্রশ্ন করলো।
‘ না, হয়নি। সে নাকি হোস্টেল ছেড়ে দিয়েছে। ‘
কথাটা শুনে একটুও আশ্চর্য হলো না মৃত্যুঞ্জয়। মৃদু হেসে বলল – ‘ সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? তোমরা দেরি করলে, তার লাভ উঠিয়ে নিলো সে। যে দিন অমৃতের খুন হয়েছিল, সে দিনই রাহুলকে জেরা করা দরকার ছিলো। সে কোথায় গেছে জানতে পারোনি নিশ্চই। ‘
‘ না। ‘
‘ জানতে পারবে, রাহুলের অফিস থেকে। কাল তার অফিসে যাও। সেখানে দেখা করো রাহুলের সাথে। বেহালার যে বাড়ির ঠিকানা দিয়েছিলাম, সেখানে খোঁজ করেছিলে? ‘
অরূপ বলল – ‘ হ্যাঁ, করেছিলাম। বাড়িতে মিতালী গাঙ্গুলীর শ্বশুর, শাশুড়ি, দেওর এবং দেওরের বৌ থাকে। ‘
‘ তার পর। ‘
‘ দিবাকর গাঙ্গুলী, মানে মিতালীর স্বামী এবং দিবাকরের ভাই ভাস্কর গাঙ্গুলী মিলে এক সাথে একটা দোকান চালাতো। হার্ডওয়ারের দোকান, বেশ বড়, বেহালাতেই। দিবাকর গাঙ্গুলী ছিলো এক নম্বরের মাতাল। খবর নিয়ে জানা গেলো সে নাকি কুড়ি বছর বয়স থেকে মদ ধরেছে। শেষের দিকে মদ্যপান নাকি অসম্ভব বাড়িয়ে দিয়েছিল। দোকানের দিকে মন ছিল না তার। দোকানটা প্রায় ভাস্কর গাঙ্গুলী চালাতো। এই নিয়ে বাড়িতে রোজ চরম অশান্তি। লিভার সিরোসিস হয়ে মারা যায় দিবাকর। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি কি দিবাকরের গত হওয়ার আগে থেকেই মিতালীর চালচলন খুব একটা ভালো ছিলো না। ‘
‘ মানে? ‘
‘ মানে, মিতালীর নাকি কুদৃষ্টি ছিলো নিজের দেওর ভাস্করের ওপর। ভাস্করকে দু – এক বার নাকি সিড্যুস করার চেষ্টাও সে করেছে। ‘
‘ আই সি …. তার পর? ‘
‘ পারিবারিক অশান্তি, যা হয় আর কি। দিবাকর মারা যাওয়ার পর নাকি মিতালী এক বিন্দু চোখের জল ফেলেনি। উল্টে ভাস্করকে আরও বেশি করে সিড্যুস করতে শুরু করলো। ‘
সিগারেটের শেষটা অ্যাশট্রে তে ফেলে মৃত্যুঞ্জয় বলল – ‘ আমার যতো দূর মনে হয়ে মিতালীর কাজের বৌ-এর থেকে বেশ কিছু ইনফরমেশন পাওয়া যেতে পারে। অনেক সময় তারা ভেতরের খবর একটু বেশিই রাখে। কিন্তু মিতালীর সামনে তাকে জেরা করে লাভ নেই। মুখ খুলবে না সে। তাকে আলাদা করে জেরা করতে হবে। ‘
‘ তাকে কি থানায় উঠিয়ে নিয়ে আসবো ? ‘
‘ না, থানায় না। চারিদিকে পুলিশ দেখলে সে ঘাবড়ে যেতে পারে। আগামী কাল সন্ধে সাতটা, যখন সে মিতালীর ফ্ল্যাট থেকে বেরোবে, তখন। তার আগে আমাকে পাপিয়ার সাথে দেখা করতে হবে। কিছুক্ষণের জন্য মরতে হবে মৃত্যুঞ্জয়কে। ‘

পাপিয়া মুখার্জী বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তে মেকআপ আর্টিস্টের কাজ করে। মৃত্যুঞ্জয়ের বহু পুরনো পরিচিত। টালিগঞ্জে একটা ফ্ল্যাটে থাকে সে। সকাল – সকাল বেরিয়ে গেলো মৃত্যুঞ্জয় তার সাথে দেখা করার জন্য। বহু দিন পর দেখা হবে পাপিয়ার সাথে। বহু রহস্য সমাধান করতে মৃত্যুঞ্জয়কে পাপিয়ার সাহায্য নিতে হয়েছে। কখনও চার্চের ফাদার, কখনও মসজিদের শেখ কিম্বা মন্দিরের পুরোহিত …. নিখুঁত মেকআপ দিতো পাপিয়া। মৃত্যুঞ্জয়কে মৃত্যুঞ্জয় বলে চেনাই যেতো না। পাপিয়ার সাথে শেষ দেখা হওয়ার কথা মনে পড়লো মৃত্যুঞ্জয়ের। মৃত্যুঞ্জয়ের জীবনে তখন প্রভা নেই। চারিদিক দিয়ে অন্ধকার বিষন্নতায় ঢাকা মৃত্যুঞ্জয়ের জীবন। চাকরী ছাড়ার পর কলকাতা ছাড়ার আগে পাপিয়ার সাথে দেখা করেছিল সে। পাপিয়ার দু’চোখে ছিলো জল। মৃত্যুঞ্জয়কে যেতে দিতে চায়নি সে। চেষ্টা করেছিল যাতে সে না যাক। কিন্তু নিজের চেষ্টায় বিফল হয়েছিল সে। এই মুহূর্তে মৃত্যুঞ্জয়কে নিজেকে বড্ড স্বার্থপর মনে হলো। এক সময় পাপিয়ার অনুরোধ সে রাখেনি। পাপিয়া হাত জোর করে অনুরোধ করেছিল – ‘ যেও না মৃত্যুঞ্জয়। তুমি চলে যাওয়াটা সমস্যার সমাধান নয়। তুমি কিছু দিন চাকরী থেকে ছুটি নিয়ে নাও। কোথাও ঘুরে এসো। জানি, এ গুলো ভোলা এতো সহজ না। কিন্তু মানুষকে ভুলে থাকতে হয়ে। ‘
রাখতে পারেনি সে পাপিয়ার অনুরোধ। আজ সেই পাপিয়ার সাথে আবার সে যাচ্ছে, সাহায্য চাইতে। সত্যি, পরিস্থিতি মানুষ কে মাঝে – মাঝে স্বার্থপর করে দেয়।

পর্ব –  ৫

পাপিয়ার ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ কে? ‘ পাপিয়ার সে চেনা কন্ঠস্বর ভেসে এলো মৃত্যুঞ্জয়ের কানে।
জবাব দেওয়ার বদলে এক বার আরও বেল টিপলো সে।
কিছু সেকেন্ড পর মৃত্যুঞ্জয়ের সামনের বন্ধ দরজাটা খুলে গেলো। দরজা খুলে মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল পাপিয়া।
‘ মৃত্যুঞ্জয়! ‘ অবাক কন্ঠে পাপিয়া বলল।
‘ চিনতে পারলে তাহলে। ‘
মৃত্যুঞ্জয়কে ভেতরে নিয়ে গেলো পাপিয়া। দুজনেরই এক – অপরকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার ছিলো, অনেক কিছু বলার ছিলো। সংক্ষেপে নিজের কথা পাপিয়ার সামনে পরিবেশন করলো মৃত্যুঞ্জয়। কলকাতা আসার কারণ বলল, অমৃত হত্যার ঘটনা বলল এবং অবশেষে পাপিয়ার কাছে আসার কারণটাও সে বলল।
‘ তুমি রহস্যকে ছেড়ে দিলে কী হবে মৃত্যুঞ্জয়, রহস্য তোমায় ছাড়বে না। আমি সেই রহস্যের প্রতি কৃতার্থ যার কারণে তুমি আমার কাছে এলে তো, মনে পড়লো তো আমার কথা। বলো, আজ কী সাজে সাজাবো তোমায় ? ‘
‘ তোমার ইচ্ছে, পাপিয়া। তোমার যেমন ইচ্ছে, তেমন আমাকে সাজিয়ে দাও। ‘

মাথায় ঝাঁকড়া – ঝাঁকড়া চুল, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, পরনে গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবী ও সাদা পায়জামা। কাঁধে এক কাপড়ের ব্যাগ। মৃত্যুঞ্জয়কে চেনা দুস্কর। বাঘাযতীনের এক চায়ের দোকানে বসে চা পান করছে মৃত্যুঞ্জয়। তার হাত ঘড়িতে বাজে ঠিক সন্ধে  সাতটা। মিতালী গাঙ্গুলীকে অ্যাপার্টমেন্টে প্রায় আধ ঘন্টা আগে সে ঢুকতে দেখেছে। মিতালীর পরিচারিকার এবার বেরোবার সময় হয়ে এসেছে। চা শেষে করে দোকানিকে টাকা দিতে যাবে সে, ঠিক সেই সময় পরিচারিকার ওপর নজর গেলো মৃত্যুঞ্জয়ের। চায়ের মূল্য দিয়ে অতি সন্তর্পণে পরিচারিকার পিছু নিলো সে। পরিচারিকা ধীরে – ধীরে বাঘাযতীন রেলওয়ে স্টেশনের দিকে এগিয়ে চলেছে। তার থেকে প্রায় কুড়ি হাত দূরে মৃত্যুঞ্জয়। পরিচারিকা স্টেশনে ঢুকে সব থেকে আগে কাটলো একটা টিকিট। না, আর বেশি সময় নষ্ট করা চলবে না। এ সময় ট্রেনে ভিড় খুব হয়ে। ট্রেনে এক বার চড়ে গেলে পরিচারিকাকে খুঁজে বার করা খুব কঠিন। পরিচারিকা এগোলো প্ল্যাটফর্মের দিকে, মৃত্যুঞ্জয় ভিড় ঠেলে এগোলো তার দিকে। শেয়ালদা যাওয়ার এক ট্রেনের ঘোষনা হলো। মৃত্যুঞ্জয় এগিয়ে গিয়ে পরিচারিকার কাঁধে হাত দিলো। পরিচারিকা ঘাবড়ে গিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো।
‘ বেশি প্রশ্ন না। ব্যাগে বন্দুক আছে। আসুন আমার সাথে। ‘ পরিচারিকার কানে ফিসফিস করে বলল মৃত্যুঞ্জয়।
‘ আ – আ – আপনি ….’
পরিচারিকা কিছু বলতে যাচ্ছিলো, তার মুখ নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ বেশি কথা নয় বললাম না। ‘
পরিচারিকাকে টানতে – টানতে স্টেশনের এক ধারে নিয়ে গেলো সে। একটা বড় গাছের আড়ালে দাঁড়ালো তারা। পরিচারিকার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল – ‘ আমি গত কাল সকালে মিতালীর ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম। সেই পুলিশের লোক আমি।’
‘ পুলিশের লোক!’ আরও ঘাবড়ে গেলো পরিচারিকা।
‘ হ্যাঁ। যা – যা জিজ্ঞেস করবো, সঠিক উত্তর দেবে। ‘
‘ আ – আমি তো জানি না কিছু। ‘ পরিচারিকার কন্ঠে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।
‘ বলতে গেলে সারা দিন তুমি মিতালী গাঙ্গুলীর বাড়িতে থাকো। কিছু জানি না বললেই যে আমি বিশ্বাস করে নেবো তোমার কথায়, সেটা ভাবলে কী করে ? যতটুকু জানো, ততোটুকুই বলো। ‘
পরিচারিকা হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল। অশ্রু ভেজা কন্ঠস্বরে বলল – ‘ আমি সাধারণ মানুষ বাবু। বাড়িতে স্বামী আর দুটো বাচ্চা আছে। আমাকে কেন এই ঝঞ্ঝাটে ….’
‘ তোমার কোনো অসুবিধে হবে না। আমি যে তোমার থেকে কিছু জানতে পেরেছি, সেটা কাউকে বলবো না। বিশ্বাস রাখতে পারো আমার ওপর। আমি শুধু অমৃত আর মিতালীর বিষয় কিছু জানতে চাই। ‘
‘ আমি বেশি কিছুই জানি না বাবু। অমৃত সন্ধে সাড়ে ছ’টায় পড়াতে আসতো আর আমি সাতটায় বেরিয়ে পড়তাম। ‘ পরিচারিকা বলল।
‘ মিতালী বাড়ি ফেরে কটায় ? ‘
‘ ছ’টা থেকে সাড়ে ছ’টার ভেতর। মিতালীদি’র ঢুকবার কিছুক্ষণ পরেই অমৃত আসতো বিটিয়াকে পড়াতে। ‘
‘ তোমার মিতালীদি’র সাথে অমৃতের সম্পর্ক কেমন ছিলো ? মানে, মিতালী কোনো দিন তোমার সামনে অমৃতের প্রশংসা বা নিন্দে করেছে ? ‘ প্রশ্ন করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ না, কোনো দিন কিছু বলেনি। তবে এক দিন ..’
যেন কিছু মনে পড়লো পরিচারিকার। কিছু বলতে গিয়েও যেন সে থেমে গেলো।
‘ কী বলো। তবে এক দিন কী ? ‘ মৃত্যুঞ্জয় জোর দিলো।
‘ এক দিন …. এক দিন সন্ধে সাতটায় আমি বেরিয়ে পড়লাম। আমার অদ্ভুত লাগতো যে সাতটা বাজাতে না বাজতেই মিতালীদি আমায় চলে যেতে বলতো। যদি আমার কোনো কাজ বাকি রয়ে যেতো তাহলে মিতালীদি বলতো যে সে কাজটা সে নিজেই করে নেবে। সে দিনও আমি ঠিক সাতটায় বেরিয়ে গেলাম। কিছু দূর এগোবার পর আমার মনে হলো, মিতালীদি’র কাছ থেকে টাকা চাইতে আমি ভুলে গেছি। টাকার প্রয়োজন ছিলো সে দিন। মিতালীদিকে আমি সকালেই টাকার কথা বলেছিলাম। দিদি বলেছিল যে সন্ধে বেলায় এসে দেবে। আমি ফিরে গেলাম টাকা চাইতে। ফ্ল্যাটের দরজা খোলা ছিলো। দিদি হয়তো বন্ধ করতে ভুলে গেছিলো। দরজার ফাঁক দিয়ে যা দেখলাম, সেটা কোনো দিন ভুলবো না। ‘ এতো দূর বলে বিরাম নিলো পরিচারিকা।
কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় তাকে বিরাম দিতে নারাজ।
‘ কী দেখলে? ‘
‘ দেখলাম …. দেখলাম, অমৃত বিটিয়াকে পড়াচ্ছে, আর আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে দিদি। একটা নাইটি পরে। খুবই খোলামেলা নাইটি। মাঝে – মাঝে এমন ভাবে অমৃতের সামনে আসছিলো যে ….’
কথাটা বলতে গিয়ে পরিচারিকা থেমে গেলো। চোখে – মুখে একরাশ ঘৃণার ছাপ। খানিক চুপ থাকার পর পরিচারিকা আবার বলল – ‘ আগে আমি দিদিকে ভালবাসতাম, সম্মান করতাম। কিন্তু সে দৃশ্য দেখার পর ভালোবাসা, সম্মান সব চলে গেছে। পেটের দায়ে পড়ে আছি বাবু। ‘
‘ কতো দিন আছো মিতালীর সাথে ? ‘
‘ শুরু থেকে। তার শ্বশুর বাড়ির চাকরানি আমি। মিতালীদি’র চলে আসাতে আমিও চলে আসি।’
‘ নিজের দেওরের সাথে ….’
‘ না বাবু ..’ মৃত্যুঞ্জয় কে মাঝপথে থামিয়ে পরিচারিকা বলল – ‘ আমি আর কিছু জানি না বাবু। আমায় খ্যামতে দিন। ‘
পরিচারিকা চলে গেলো। শেয়ালদা যাওয়ার একটা আরও ট্রেন চলে আসছিলো। ট্রেনের অপেক্ষা করছিলো পরিচারিকা। একটা সিগারটে খাওয়ার জন্য মৃত্যুঞ্জয় স্টেশনের বাইরে ঠিক তখনই এক বিকট চিৎকার শুনতে পেলো সে। প্ল্যাটফর্মের দিকে দৌড় দিলো মৃত্যুঞ্জয়। ট্রেন ততক্ষণে ঢুকে গেছে, সাথে শুরু হয়েছে হইহল্লা।
‘ বাঁচা – বাঁচা। ‘
‘ ট্রেন থামা। ‘
‘ ধর – ধর পালিয়ে গেলো। ‘
নানাবিধ কথা।
মৃত্যুঞ্জয় কাছে গিয়ে দেখলো, প্রায় দু’টুকরো হয়ে পড়ে আছে মিতালীর পরিচারিকা।
‘ কেউ ধাক্কা দিলো, দাদা। অন্ধকারে ঠিক দেখতে পেলাম না তাকে। ধাক্কা দিয়ে ঝড়ের বেগে পালিয়ে গেলো। ‘ এক জনকে বলতে শুনলো মৃত্যুঞ্জয়।

পর্ব –  ৬

রাহুল ব্যানার্জী রুমমেট ছিলো অমৃতের। অমৃতের হত্যার পর সেও নিজের পুরনো রুম ছেড়ে দেয়। কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। দমদমের হোস্টেলের বাকি ছেলেদের মধ্যে কেউ জানে না যে রাহুল গেলো কোথায় ? রাহুলের বাড়ি দুর্গাপুরে। একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে কাজ করে কলকাতায়। রাহুলের অফিস গিয়ে তার বাড়ির ঠিকানা পেলো অরূপ, সাথে পেলো তার কলকাতার বাসার ঠিকানা। আশ্চর্য ব্যাপার এটা যে, অমৃতের হত্যার দিন থেকে রাহুল অফিসে যায়নি। কলকাতার নিজের নতুন আশ্রয়ের ঠিকানা রাহুল অফিসে দেয়নি। সে ঠিকানা অরূপ পেলো রাহুলের এক বান্ধবীর কাছ থেকে, যে রাহুলের সাথে একই অফিসে কাজ করে। রাহুলের নতুন বাসার ঠিকানা পেয়ে অরূপ নিজের বাকি পুলিশ দলের সাথে সেখানে গেলো। পুলিশ দেখে রাহুলের বাড়িওয়ালা অবাক। রাহুলের ঘরে তালা দেখে অরূপ বাড়িওয়ালা কে জিজ্ঞেস করলো – ‘ চাবি কি আপনার কাছে আছে? ‘
‘ আ…. আজ্ঞে না বাবু। ‘ আমতা – আমতা করে বাড়িওয়ালা বলল।
অতঃপর তালা ভেঙ্গে দিতে বাধ্য হলো অরূপ। শুরু হলো সে ঘরের খানাতল্লশী।

আকাশে হঠাৎ করে নিজের বাসা বেঁধে নেওয়া মেঘের দারুণ চাঁদ ও তারা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুরু হয়েছে অল্প – অল্প বৃষ্টিও। নিজের ঘরের সাথে লাগোয়া ব্যালকনির এক আরাম কেদারায় বসে সিগারেটে সুখ টান দিচ্ছে মৃত্যুঞ্জয়। আচমকা ঘরের দরজা খোলার শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকালো সে। ঘরে ঢুকেছে অরূপ, হাতে কিছু খবরের কাগজ নিয়ে। মৃত্যুঞ্জয়ের পাশের চেয়ারে বসে সামনের সেন্টার টেবিলে খবরের কাগজগুলো রেখে অরূপ বলল – ‘ এ গুলো সেই খবরের কাগজ, যে গুলো রাহুলের রুম থেকে পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে মোট বারোটা। শেষ খবরের কাগজ প্রায় এক বছর আগেকার। ‘
সিগারেটের শেষ অংশটা অ্যাশ ট্রেতে ফেলে মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো – ‘ আরও কিছু পাওয়া গেলো?’
‘ হ্যাঁ। কিছু ক্রাইম থ্রিলার নভেল, কিছু ডক্টরের প্রেসক্রিপশন আর কিছু ঘুমের ট্যাবলেট।’
খবরের কাগজগুলো পুঙ্খানুপঙ্খ ভাবে দেখতে শুরু করলো মৃত্যুঞ্জয়। আধ ঘন্টার ওপর সময় লাগলো খবরের কাগজগুলো পড়তে। তার পর অরূপকে সে বলল – ‘ ডক্টরের প্রেসক্রিপশন গুলো আছে? ‘
‘ হ্যাঁ, নিয়ে আসছি। ‘
খানিক পর কিছু প্রেসক্রিপশন নিয়ে এলো অরূপ, সাথে নিয়ে এলো রাহুলের ঘর থেকে পাওয়া কিছু ট্যাবলেটের পাতা। সব গুলো ভালো করে দেখে মৃত্যুঞ্জয় বলল – ‘ বড় থেকে ছোটো। এই খবরের কাগজ গুলোর মধ্যে একটা খবরে নজর দিয়েছো ? ‘
‘ না। এখন অবধি পড়ে উঠতে পারিনি। সময় আর পেলাম কই ? ‘
‘ প্রায় দেড় বছর আগে যাদবপুর থেকে রিতিকা ব্যানার্জী নামের এক মেয়ে নিখোঁজ হয়ে। যাদবপুরের এক হোস্টেলে থাকতো সে। বাড়ি ছিলো দুর্গাপুরে। এক প্রাইভেট কোম্পানীতে কাজ করতো সে। পুলিশ কিছু দিন খোঁজার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু নিজের কাজে তারা সফল হয়েনি। ফাইল বন্ধ হয়ে যায়। খবরের কাগজ কিছু দিন উৎসাহ দেখলো। ধীরে – ধীরে খবরের কাগজে এই খবরটা কম স্থান পেতে শুরু করলো। ‘
‘ ঘটনাটা শুনেছি। তখন আমি ঠাকুরপুর থানায় ছিলাম। ‘ অরূপ বলল।
‘ হুম। কিন্তু ব্যাপারটা হলো সেই মেয়েটির মানে রিতিকা ব্যানার্জীর মানসিক অবস্থা নাকি ভালো ছিলো না। ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী নামের এক সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে সে চিকিৎসা করাতো। ডক্টর চক্রবর্তীর কাছে জেরা করে জানা গিয়েছিলো যে রিতিকা নাকি ডিপ্রেশনে ভুগছিলো। তার নাকি ভয় ছিলো, কেউ তার মার্ডার কিম্বা রেপ করতে পারে। রিতিকা পুলিশকে ভয় পেতো। ভেবেছিলো তার ভয়টা হয়তো নিছকই মনের ব্যামো। সাইক্রিয়াটিক কাউন্সেলিং নিলে হয়তো ঠিক হয়ে যেতে পারে। এবার একটা জিনিস এখানে লক্ষ্য করবার। রিতিকা থাকতো দুর্গাপুরে, রাহুলের বাড়িও সেখানেই। দুজনেরই পদবী ব্যানার্জী। রাহুলও সাইক্রিয়াটিক ট্রিটমেন্টে আছে। এবং সব থেকে বড় ব্যাপার হলো দুজনেরই ডক্টর একই। আমার বিশ্বাস রাহুল শুধু চাকরী করতে কলকাতা আসেনি, অরূপ। চাকরীর আড়ালে সে রিতিকা অন্তর্ধান কেসের তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। ‘
‘ তাহলে অমৃতের খুনের পর রাহুল সেই রুম ছেড়ে পালিয়ে গেলো কেন ? ‘ প্রশ্ন করলো অরূপ।
‘ একটা কারণ এটা হতে পারে যে নিজের তদন্তে কোনো প্রকারে বাধার আশংকা অনুভব করেছিলো সে। কিম্বা ……’
‘ কিম্বা কী, মৃত্যুঞ্জয় দা? ‘
‘ অরূপ, অনেক সময় এমন হয়ে যে একটা কেসের তদন্ত করতে গিয়ে আমাদের সামনে অন্য কোনো রহস্য চলে আসে। রহস্যের ইন্টারলিংক। হতে পারে রাহুল রিতিকা ব্যানার্জীর কেস হ্যান্ডেল করতে গিয়ে অমৃতের কিছু গোপন তথ্য জানতে পেরেছিলো। অমৃতের খুনের পর তার নিজের প্রাণের ভয় ঢুকেছে। এবার এটাও সম্ভব যে অমৃতের খুনের পেছনে রাহুলের যোগদান আছে। এভরিথিং ইস পসিবল মাই ডিয়ার। রাহুলকে খুঁজে বার করো, অরূপ। রাহুলকে খুঁজে বার করা খুব দরকার। ‘
‘ লোক লাগিয়ে দিয়েছি। দুর্গাপুরে গিয়েও তাকে খোঁজা হবে। লোক লাগাবার কথায় মনে পড়লো, মিতালীর পেছনেও লোক লাগানো হয়েছে। তার সারা দিনের খবর আমরা পাবো এবার। একটা কথা জিজ্ঞেস করা ছিলো, মৃত্যুঞ্জয়দা। ‘
‘ কী? ‘
‘ মিতালী গাঙ্গুলীকে আমরা অ্যারেস্ট করতে পারি না? জানি, তার এগেনস্টে কোনো প্রমাণ নেই আমাদের কাছে, কিন্তু তবুও আন্ডার বেসিস অফ সস্পিশন। ‘
মৃত্যুঞ্জয় বলল – ‘ পারি। কিন্তু করে লাভ নেই। পাকাপোক্ত প্রমাণ থাকলে অ্যারেস্ট করে লাভ আছে। তার পর অমৃতকে আর পরিচারিকাকে খুন করার পেছনে মিতালীর মোটিভও তো পরিস্কার নয়। ‘
‘ এটা তো পরিস্কার যে মিতালীর সাথে অমৃতের একটা অবৈধ সম্পর্ক ছিলো। হতে পারে, তাদের ঘনিষ্ঠ কিছু মুহূর্তের ভিডিও বানিয়ে মিতালীকে ব্ল্যাকমেল করছিলো অমৃত। ব্ল্যাকমেলের টাকা দিতে – দিতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলো মিতালী। অমৃতের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা তো কিছু কম নেই। ‘
‘ হতেও পারে। মিতালী কোনো লোক লাগিয়ে খুন করিয়েছে অমৃতের। আচ্ছা অরূপ, খুনের দিন ভোরে অমৃতের কাছে যে নম্বর থেকে ফোন এসেছিলো, সে নম্বরে তার আগেও কি কথা হয়েছে? ‘
‘ না। সেই নম্বর থেকে একটাই কল করা হয়েছে, সে দিন ভারে। নম্বরটা দু’দিন আগেই নেওয়া হয়েছিল। ‘
‘ হুম, বুঝলাম। মিতালী গাঙ্গুলী, রুবি দে আর রাহুল ব্যানার্জী, কেউ সন্দেহের বাইরে নেই, অরূপ। আমার সন্দেহের লিস্টে এরা তিনজনেই আছে। তুমি রাহুলের খোঁজ নাও। এদিকে আমি দেখছি কী করা যেতে পারে। ‘
কথা শেষ করে মৃত্যুঞ্জয় ঘরের ভেতর চলে গেলো।

  পর্ব – ৭
.

প্রায় সারা রাত তুমুল বৃষ্টি হলো। সকালেও বেশ অনেকক্ষণ বৃষ্টি হওয়ার কারণে বাড়ি থেকে বেরোতে পারেনি মৃত্যুঞ্জয়। যখন সে বেরলো তখনও কিন্তু বৃষ্টি থামেনি। দেরি করা মৃত্যুঞ্জয়ের পছন্দ না। তাই বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে গেলো সে। হ্যাঁ, অমল বাবুর কাছ থেকে তার হোন্ডা সিটি গাড়িটা নিয়ে নিয়েছিল মৃত্যুঞ্জয়। ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর ঠিকানা তার কাছে আছে। পৌঁছতে প্রায় চল্লিশ মিনিট সময় লাগলো।
ঢাকুরিয়াতে ডক্টর চক্রবর্তীর চেম্বার। একটা বড় চার তলা বাড়ির দু’তলায়। বাড়িটা অ্যাপার্টমেন্ট নয়। নিচের তলায় বাড়িওয়ালা থাকেন। দো’তলা থেকে ফ্ল্যাট টাইপের বানানো। ভাড়া দেন তিনি। দু ‘ তলায় একটা 2 বি এইচ কে ফ্ল্যাট নিয়ে ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর চেম্বার। ঢুকতেই ছোট্টো হল- এ এক অল্প বয়সী মেয়ে বসে। দেখেই বোঝা যায় সে রিসেপশনিস্ট। মৃত্যুঞ্জয় এগিয়ে গেলো তার দিকে। মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে যুবতীটি বলল – ‘ বলুন ? ‘
‘ ডক্টর বাবু আছেন? ‘ জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ দেখানোর আছে কী? ‘ জবাবের বদলে পাল্টা প্রশ্ন। বিরক্ত লাগে মৃত্যুঞ্জয়ের।
‘ হ্যাঁ, দেখাবো তাকে। ‘
‘ 500 টাকা ফি, জমা করে দিন। ‘ রিসেপশনিস্ট যন্ত্রের মতো বলে যাচ্ছে।
‘ সে না হয় করলাম। ডক্টর বাবু আছেন তো? ‘
‘ না। এখনও আসেননি। ‘
অবাক হলো মৃত্যুঞ্জয়। সাড়ে এগারোটা বাজে। ডক্টরের পাত্তা নেই।
‘ কোথায় আছেন তিনি? ‘ মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
‘ হসপিটালে। ‘
‘ হসপিটাল! কোন হসপিটাল ? ‘
রিসেপশনিস্ট হসপিটালের নাম বলে বলল – ‘ কিছুক্ষণের মধ্যেই ডক্টর বাবু চলে আসবেন। আপনি যদি দেখাতে চান, তাহলে টাকা জমা করে দিন। ‘
অগত্যা, উপায় নেই। টাকা জমা করে অপেক্ষা করতে হলো মৃত্যুঞ্জয়কে। প্রায় আধ ঘন্টার অপেক্ষার পর ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর আগমন হলো। বেশ সুপুরুষ চেহারা, মাথার চুল বেশ বড় কিন্তু এলোমেলো। বয়স আন্দাজ চল্লিশের আশেপাশে। ভেলভেট কালারের জামার ওপরে কালো সুট সাথে লাল টাই। কালো বুট এবং কালো প্যান্টের নিচে অল্প – অল্প কাদার দাগ। মার্বেলের ফ্লোরে কাদা লাগা বুটের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। গাড়ির চাবির রিং কে নিজের ডান হাতের আঙ্গুলে নাচাতে – নাচাতে ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী প্রবেশ করলো। মৃত্যুঞ্জয় লক্ষ করলো গাড়ির চাবির রিং টা অডি কোম্পানীর। মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে অল্প দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিজের কেবিনে সে ঢুকে গেলো। খানিক পর ভেতর থেকে তলব আসাতে রিসেপ্সনিস্ট ভেতরে গেলো। প্রায় মিনিট খানেক পর বেরিয়ে মৃত্যুঞ্জয়কে ভেতরে যাওয়ার ইশারা করলো সে। ভেতরে ঢুকেই মৃত্যুঞ্জয় কোনো প্রকারের ভঙ্গিমা না করে ডক্টর চক্রবর্তী কে বলল – ‘ এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর দেরি করে লাভ নেই। সোজা আসল কথায় আসা যাক। ‘
ডক্টর চক্রবর্তী কিছুই বুঝতে পারলো না। খানিক অবাক দৃষ্টে মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে চেয়ে বলল – ‘ মানে, আমি তো কিছুই বুঝলাম না। ‘
সামনের চেয়ারটা টেনে বসলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ আপনি রাহুল ব্যানার্জীর বিষয় কী জানেন? ‘ মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
‘ ম….মানে আপনি ট্রিটমেন্ট করাতে আসেননি? ‘ আবার প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন।
‘ না। আমি এখানে কিছু ইনফরমেশন নিতে এসেছি। আমি এ সি পি মৃত্যুঞ্জয় মজুমদার, সি আই ডি থেকে। ‘
সি আই ডি’র নাম শুনে ডক্টর চক্রবর্তীর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু চকিতে নিজেকে সামলে নিলো সে।
‘ হ্যাঁ….হ্যাঁ বলুন, কী জানতে চান? ‘
‘ আপনার এক পেশেন্টের বিষয় জানতে চাই। রাহুল ব্যানার্জী। ‘
‘ রাহুল….রাহুল….ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ‘
‘ গুড। রাহুল কিসের চিকিৎসা করাচ্ছিলো আপনার কাছে? ‘
‘ ইনসমনিয়া। দিনের পর দিন তার ঘুম হতো না তার। ভোর রাতের দিকে অল্প হলেও যদি চোখ লাগতো, ভয়াবহ কিছু স্বপ্নে তার ঘুম ভেঙ্গে যেতো। ‘
‘ সে কি রোজ আসতো আপনার কাছে? ‘
‘ প্রায়। কিছু বিচিত্র স্বপ্ন নিয়ে। কেউ নাকি তার গলা টিপতে আসছে, সে মরুভূমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ তার পায়ের নিচের মাটি ফেটে জল বেরিয়ে এলো, সেই জলে ডুবে গেলো সে। এবার আপনি বলুন মশাই, মরুভূমিতে এতো জল কোথায় থেকে আসবে যে মানুষ ডুবে যায় ? ‘
‘ আপনি তখন কী করতেন? ‘
‘ ঘুমের অষুধ বদলে – বদলে দিতাম। ‘
‘ শেষ বার কবে আসে আপনার কাছে? ‘
খানিক ভেবে ডক্টর সিদ্ধার্থ বলল – ‘ আজ শুক্রবার, গত শনিবার সে এসেছিলো। ‘
‘ এবার আপনি বলুন রিতিকা ব্যানার্জীর কেস আর রাহুল ব্যানার্জীর কেসের মধ্যে কোনো মিল দেখতে পারছেন কী? ‘
‘ উফ …. আবার সেই রিতিকা ব্যানার্জী। ‘ একরাশ বিরক্তি নিয়ে সিদ্ধার্থ বলল – ‘ দেখুন মিস্টার এ সি পি, রিতিকা ব্যানার্জীর কেস নিয়ে আমি অনেক ঝামেলার সম্মুখীন হয়েছি। আর নয়। অনেক বার স্টেটমেন্ট দিয়েছি পুলিশকে।  বার – বার একই স্টেটমেন্ট দিতে – দিতে মুখে ব্যাথা হয়ে গেছে আমার। সরি এ সি পি। এই বিষয় আমি আর কোনো সাহায্য আপনাকে করতে পারবো না। ‘
‘ বেশ, তাই ভালো। অনেক ধন্যবাদ, ডক্টর। প্রয়োজনে আবার বিরক্ত করতে আসবো। ‘

ঢাকুরিয়ার পর মৃত্যুঞ্জয়ের আগামী গন্তব্য সল্টলেক, সেক্টর 5। মৃত্যুঞ্জয় ঘড়ি তে সময় দেখলো। এখনও অফিসে লাঞ্চ টাইম হতে অল্প দেরি আছে। ঠিক সময় পৌঁছে যাওয়া যাবে। কলকাতার বেশ কিছু রাস্তাঘাট জলমগ্ন। গাড়ির গতি বেশি বাড়াতে পারলো না মৃত্যুঞ্জয়। মিতালীর অফিসের নিচে যখন নিজের গাড়িটা পার্ক করালো মৃত্যুঞ্জয়, তখন তার ঘড়ি তে দুপুর দুটো দশ। গাড়িতে বসেই মিতালীকে ফোন করলো সে।
‘ আপনি নিচে নেমে আসুন। আমি অপেক্ষা করছি আপনার। ‘
বেশ বিরক্তই হলো মিতালী। নিচে নেমেই মৃত্যুঞ্জয়কে বলল – ‘ আপনি কি আমাকে এবার নিশ্চিন্তে চাকরীও করতে দেবেন না ? ‘
‘ ওহঃ .. অতো রাগ করছেন কেন ? এটা তো লাঞ্চ টাইম। তার পর জম্পেস খিদেও পেয়েছে। চলুন, কোথাও বসে খেতে – খেতে কথা বলা যাক। ‘
‘ আমার আপনার সাথে লাঞ্চ করার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই মিস্টার এ সি পি। ‘ রাগে চোয়াল শক্ত হলো মিতালীর।
‘ রাগ করবেন না ম্যাডাম। কেন কি এটা আপনার রাগ দেখাবার সময় নয়। আসুন আমার সাথে। ‘ কথা শেষ করে মৃত্যুঞ্জয় পাশের একটা রেস্তোরাঁর দিকে এগোলো। পিছু নিলো মিতালী।
‘ কী হচ্ছে এটা এ সি পি ? আপনি তো বলেছিলেন পরের দিন সকালে আসবেন, আমার কাজের বৌয়ের সাথে কথা বলতে। ‘ মৃত্যুঞ্জয়ের পাশে হাঁটতে – হাঁটতে মিতালী বলল।
‘ সে কাজ আমার হয়ে গেছে। আপনার বিষয় অনেক কিছুই জানতে পেরেছি ম্যাডাম। ‘
‘ কী জানতে পেরেছেন? ‘
‘ বলবো, সব বলবো। চিন্তা করবেন না আপনি।’
‘ তার মানে আপনি কোথাও বাইরে আমার কাজের বৌয়ের সাথে দেখা করেছেন। আপনি তাকে গান পয়েন্টে রেখে আমার এগেনস্টে কিছু ভুল এবং মিথ্যে স্টেটমেন্ট নিয়েছেন। তাই না মিস্টার এ সি পি? ‘
‘ আপনার মাথা অনেক দূর পর্যন্ত চলে দেখছি। এই মাথাটা কোনো ভালো কাজে লাগলে মন্দ হতো কী? ‘
রেস্তোরাঁর সামনে দুজনে এসে দাঁড়ালো। ভেতরে ঢুকবার আগে মিতালী বলল – ‘ কিছু তো একটা গন্ডগোল আপনি করেছেন। না তো সোনালী আজ দেরি করে আসতো না। সোনালী মানে আমার কাজের বৌ। ‘
‘ সেটা জানি। কিন্তু দেরি করে আসতো না মানে? ‘ এবার মৃত্যুঞ্জয়ের আশ্চর্য হবার পালা।
‘ মানে, আজ সকালে সে আমায় ফোন করে বলল যে তার শরীর ভালো না। দেরি করে আসবে। আমি যেন ফ্ল্যাটের চাবিটা ফ্ল্যাটের দরজার সাথে লাগোয়া লেটার বক্সে রেখে দি। আমি তাই করলাম। লেটার বক্সের এক চাবি তার কাছে থাকে। যখন কোনো দিন সে দেরি করে আসতে, আমি সেটাই করে থাকি। কিন্তু সে কোনো দিনই খুব দেরি করে না। আজ হঠাৎ দেরি করলো কেন …..’
‘ আপনি কি সিওর যে ফোনটা সোনালী করেছিল আপনাকে? ‘
‘ হ্যাঁ। গলার আওয়াজটা চেঞ্জ মনে হলো, কিন্তু তার শরীর খারাপ তাই। ‘
‘ হতেই পারে না এটা? ‘ মৃত্যুঞ্জয়ের গলার আওয়াজটা উচ্চ হলো বিস্ময়ের কারণে।
‘ কী হতে পারে না? ‘
‘ সোনালী আপনাকে ফোন করতেই পারে না। ‘
‘ কিন্তু কেন? ‘
‘ কেন কি গত কাল সন্ধেতেই সোনালীকে হত্যা করা হয়েছে। ‘
‘ কী? সোনালীর হত্যা? ‘ ইলেকট্রিকের বড় শক লাগলো যেন মিতালীর।
‘ হ্যাঁ, কাল সন্ধেতে আপনার ফ্ল্যাট থেকে বেরোবার পর বাঘাযতীন স্টেশনে কেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেনের সামনে ফেলে দেয়। আততায়ী এখনও ধরা পড়েনি। ‘
‘ তাহলে আজ আমাকে ফোন করলো কে ? তার পর আমার মেয়ে তো আজ বাড়িতেই আছে। ‘ ভয়ের সাথে কান্না মেশানো কন্ঠস্বর মিতালীর।
‘ দেরি করা যাবে না। চলুন আপনার ফ্ল্যাটে। ‘
গাড়ি করে মৃত্যুঞ্জয় ও মিতালী বাঘাযতীনের দিকে এগিয়ে গেলো।

ফ্ল্যাটের দরজা অল্প খোলা। ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো মৃত্যুঞ্জয় ও মিতালী। মিতালী তারস্বরে ডাকতে থাকে নিজের মেয়ে কে – ‘ রিয়া …. রিয়া …. ও রিয়া …. রিয়া ! ‘
এ ঘর – ও ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়ায় নিজের মেয়ে কে। কোত্থাও নেই রিয়া।
‘ মৃত্যুঞ্জয়, আমার মেয়ে কোথায় গেলো ? ‘ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মিতালীর গলা।
মৃত্যুঞ্জয়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঘুরতে থাকে চারিদিকে। ঠিক তখনই তার নজর যায় একটা জিনিসে।

পর্ব –  ৮

মাটির দিকে বেশ কিছুক্ষণ এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল মৃত্যুঞ্জয়। তার ঠোঁটে মৃদু হাসি। তাকে হাসতে দেখে আরও খেপে গেলো মিতালী।
‘ হোয়াট দ হেল ইউ আর দুইনং এ সি পি ? আমার মেয়ে কিডন্যাপ হয়েছে আর আপনি এখানে দাঁড়িয়ে হাসছেন ? ‘
মিতালীর কথার জবাব না দিয়ে একটা ফোন করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ হ্যালো, অরূপ? যা বলছি খুব ভালো করে শোনো। আমার ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর জুতো চাই। হ্যাঁ, জুতো, বুট …. সে সব পরে বলবো। সে নিজের চেম্বারে আছে। কালো বুট সে পরে আছে …. সে তোমার যেমন সুবিধে হোক, তেমন করো। তার বুট নিয়ে তুমি মিতালী গাঙ্গুলীর ফ্ল্যাটে এসো। তোমার অপেক্ষা করছি আমি। আর হ্যাঁ, এক ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টকে নিয়ে এসো। ‘
কথা শেষ করে ফোন কেটে দিলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী কে ? ‘ মিতালী প্রশ্ন করলো।
‘ জানতে পারবেন ম্যাডাম। সব জানতে পারবেন। ‘
মৃত্যুঞ্জয় এবার পুরো ফ্ল্যাটটা পুংখানুপুঙ্খ ভাবে দেখতে লাগলো। ড্রয়িং রুমের প্রতিটি জিনিস বিনা ছুঁয়ে ভালো ভাবে নিরীক্ষণ করলো। ফ্ল্যাটে দুটো বেডরুম, দুটোতেই ঢুকলো সে।
‘ ফ্ল্যাটে বলতে আপনারা তিন জন। আপনি, আপনার মেয়ে এবং কাজের বৌ। কাজের বৌ রাতে থাকে না। আপনি তো এক বেডরুমের ফ্ল্যাট নিতে পারতেন। মাস্টার বেডরুম ছাড়া পাশের বেডরুম কোন কাজে আসে? ‘
খানিক চুপ থেকে মিতালী বলল – ‘ কোনো দিন যদি ….’
তার কথাকে মাঝ পথে থামিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল – ‘ যদি কোনো আত্মীয় স্বজন আসে …. তাই না? বেশ। ‘
দ্বিতীয় বেডরুমের ভেতরে ঢুকলো সে। কাঁচের জানালার ধারে খাট পাতা। সুন্দর বিছানা করা, দুটো বালিশ পরিপাটি করে সাজানো। খাটের পাশে এক ড্রেসিং টেবিল। সে দিকে এগোলো মৃত্যুঞ্জয়। ড্রেসিং টেবিলের ওপর সাজগোজের বেশ কিছু কসমেটিক্স রাখা। অতি সন্তর্পণে নিচের ড্রয়ারটা মৃত্যুঞ্জয় খুললো। কিছু রিক্ত সিগারেটের ডিবে পেলো সে। একটা ডিবে তে এখনও দুটো সিগারেট ভরা। আড়চোখে মিতালীর দিকে তাকিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল – ‘ এ গুলো নিশ্চই আপনার নয়। ‘
‘ আপনি ফালতু সময় নষ্ট করছেন এ সি পি। ‘
‘ আমি সময় নষ্ট করছি ? আমি এখানে আছি অমৃতের খুনের তদন্ত করতে। আপনার মেয়ের সন্ধান করতে নয়। ‘ মৃত্যুঞ্জয়ের কন্ঠস্বর বেশ উচ্চ হলো – ‘ আপনি কি শুরু থেকে আমাকে কো – অপারেট করেছেন ? করেননি। আপনি কি আমায় বলেছেন যে অমৃতের সাথে আপনার ইল্লিগাল রিলেশন ছিলো। আপনার কুদৃষ্টি ছিলো তার ওপর। শুধু অমৃত না, আপনার কুদৃষ্টি ছিলো আপনার দেওরের ওপর। তাই আপনি স্বামী মারা যাওয়ার পর নিজের শ্বশুর বাড়ি ত্যাগ করতে বাধ্য হোন।’
মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে বিস্ফোরিত নেত্রে চেয়ে রইল মিতালী। তার দু’চোখ লাল, জলে ভেজা।
‘ কী বললেন? দেওরের ওপর কুদৃষ্টি? আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন নাকি? আমি নিজের দেওরের ওপর কুদৃষ্টি দিয়েছি? এ সব তথ্য আপনারা পান কোথা থেকে? মানে …. মানে যে দোষী তাকে বেকুসুর খালাস করে, যে বেকুসুর তাকে দোষী করবেন ? বাঃ এ সি পি, বাঃ। এই আপনাদের ইনভেস্টিগেশন ? কে কার ওপর কুদৃষ্টি দিয়েছিল, সেটা বুঝবার ক্ষমতা আপনারা হারিয়ে ফেলেছেন। এখন যদি আমি কিছু বলি আপনাকে তাহলে আপনি কস্মিনকালেও বিশ্বাস করবেন না। শরীরে দাগ নেই এ সি পি। এতো দিনে সব দাগ মুছে গেছে। যদি থাকতো তাহলে নিজের সমস্ত কাপড় খুলে আপনাকে দেখিয়ে দিতাম। সেটাই হতো সেই শুওরের বাচ্চা ভাস্কর গাঙ্গুলীর বিরুদ্ধে আমার প্রমাণ। শরীরের দাগ মুছে গেলে কী হবে, মনের ভেতরকার ক্ষত এখনও রয়ে গেছে। সেটা কোনো দিন মুছবে না। আপনারা অন্ধ এ সি পি, আপনারা অন্ধ। ‘ কথা শেষ করে ডুকরে কেঁদে উঠলো মিতালী।
মৃত্যুঞ্জয় নিস্তব্ধ। মিতালীর কথাগুলো যদি সত্যি হয়, তাহলে নিজের করা এই ভুলের ক্ষমা নেই। খানিক পর নিজেকে সামলে নিয়ে মিতালী পুনরায় বলতে শুরু করলো – ‘ আমারও ভালোবাসার অধিকার আছে। স্বামীকে ভালবাসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে ভালোবাসার মর্ম বুঝতে পারলো না। স্বামী মারা যাওয়ার পর ভাস্করের হাত থেকে কোনো ক্রমে নিষ্কৃতি পেয়ে আমি যখন এখানে আসি, তখন আমি মানসিক দিক থেকে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে গেছি। আমি আর আমার মেয়ে, এটাই ছিলো আমার সংসার। তার পর হঠাৎ করে আমার জীবনে আসে অমৃত। ছেলেটা ছিলো খুব শান্ত, কিন্তু কথা বলতে বেশ ভালোবাসতো। আস্তে আস্তে তার সাথে গল্প করা শুরু করলাম। নিজের অতীতের কথা তাকে বলতাম। মনটা বেশ হালকা হতো আমার। হ্যাঁ, আমি ভালবেসেছি, ভালবেসেছি অমৃতকে। নিজের থেকে বয়সে ছোটো কোনো ছেলেকে ভালোবাসা যদি অপরাধ হয়ে, তাহলে সেই অপরাধ করেছি আমি। আর আমার তাতে কোনো আফসোস নেই। ‘
মৃত্যুঞ্জয় পুনরায় ঘরের এদিক – ওদিক ঘুরতে শুরু করলো। এবার সে মাস্টার বেডরুমে গেলো। প্রতিটি জিনিস অতি সন্তর্পণে নিরীক্ষণ করছিলো সে। হঠাৎ তার নজর গেলো শোকেসে রাখা এক ফটো ফ্রেমের ওপর। হাতে নিয়ে ভালো দেখলো। এক পরিবারের গ্রুপ ফটো। এটা যে গাঙ্গুলী পরিবার সেটা বুঝতে দেরি হলো না তার।
‘ কে – কে আছে এই গ্রুপ ফটোতে? ‘ মিতালী কে জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
মিতালী আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে শুরু করলো – ‘ ইনি আমার শ্বশুর, আমার স্বামী, আমার দেওর, দেওরের স্ত্রী ….’
হাত দেখিয়ে থামবার ইশারা করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ এটা আপনার দেওর? ‘ ভাস্কর গাঙ্গুলীর ছবির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
‘ হ্যাঁ, এটাই সেই পিশাচ। ‘ রক্তবর্ণ নেত্রে মিতালী বলল।
মৃত্যুঞ্জয় আর কিছু বলল না। ভ্রুকুটি করে সে দিকে একাগ্রচিত্তে চেয়ে রইল।
ইতিমধ্যেই মৃত্যুঞ্জয়ের মোবাইলটা বাজলো। অরূপের ফোন।
‘ হ্যাঁ অরূপ, বলো। ‘
‘ দুটো খবর আছে। প্রথম খবর হলো ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টকে পাঠিয়ে দিয়েছি অনেকক্ষণ আগে, আর দ্বিতীয় খবর হলো ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর জুতো পাওয়া গেলো না। সে নিজের চেম্বারে নেই। চেম্বার বন্ধ, তালা লাগা। ‘
মৃত্যুঞ্জয় বলল – ‘ তুমি এই মুহূর্তে একটা কাজ করো অরূপ। কিছু ফোর্স নিয়ে পার্ক সার্কাসের দিকে রওনা দাও। সেখানে ‘ কেয়ার ফর ইউ ‘ নামের এক নার্সিং হোম আছে, সেখানে যাও। যত দূর সম্ভব সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীকে সেখানেই পাবে। একটা আরও কথা, আজ সকালে মিতালী গাঙ্গুলীর মেয়ে রিয়াকে তার ফ্ল্যাট থেকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। ফ্ল্যাটের মেঝেতে কাদা মাখা জুতোর ছাপ রয়েছে। আমার বিশ্বাস সে জুতোর ছাপ ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে অ্যারেস্ট করো। ‘
মৃত্যুঞ্জয় ফোন কেটে দিয়ে মিতালীকে বলল – ‘ আপনি যে মহিলা উন্নয়ন সমিতির এক সদস্য, সেটাও আপনি বলেননি। ‘
মিতালী নিরুত্তর।
‘ রিতিকা ব্যানার্জীকে আপনি চেনেন? ‘
মিতালী চমকে তাকালো মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে।
‘ রিতিকা ব্যানার্জী? ‘
‘ হ্যাঁ। যাদবপুরে থাকতো। প্রায় বছর খানেক আগে থেকে নিখোঁজ। ‘
চাপা কন্ঠে মিতালী বলল – ‘ চিনি। আমাদের সমিতিরই এক সদস্য ছিলো সে। ‘
‘ সে কোনো ডক্টরকে দিয়ে নিজের চিকিৎসা করাচ্ছিল সেটা জানতেন? ‘
‘ না। জানতাম না। ‘ দৃঢ় কন্ঠে মিতালী বলল।
‘ আচ্ছা, একটা কথার জবাব দিন। আপনি তো বেহালা তে বহু দিন থেকেছেন। সেখানে কি কোনো বিউটি পার্লার নেই? ‘
মৃত্যুঞ্জয়ের এই বিচিত্র প্রশ্নে অবাক হলো মিতালী।
‘ থাকবে না কেন? অনেক আছে। ‘ জবাব দিলো সে।
খানিক শূন্যের দিকে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে চিন্তা করলো মৃত্যুঞ্জয়, তার পর বলল – ‘ ঠিক আছে, আমি তাহলে এবার আসি। আপ্রাণ চেষ্টা করবো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার মেয়েকে আপনার কাছে ফিরিয়ে দিতে। ‘
কথা শেষ করে হনহন করে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেলো সে।

পর্ব –  ৯
মিতালীর ফ্ল্যাট থেকে বেরোতেই সামনের সিঁড়িতে কিছু আবছা দেখতে পেলো মৃত্যুঞ্জয়। যেন সিঁড়ি দিয়ে কেউ ওপরে উঠছিল, মৃত্যুঞ্জয়কে দেখতে পেয়ে দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেলো। কে হতে পারে ? আজ লিফ্ট খারাপ, তাই হয়তো সে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এসেছে। মৃত্যুঞ্জয়ও দ্রুত পায়ে পিছু নিলো তার। চারিপাশে অকারণ কিসের যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসা দুজনের পদধ্বনি ভিন্ন অতিরিক্ত কোনো শব্দ নেই। মৃত্যুঞ্জয় বুঝতে পারলো যার পিছু সে নিচ্ছে সে অতি তীব্র গতিতে দৌড়াতে সক্ষম। খানিক পর আগুন্তুক দ্রুত বেগে মুখ্য ফটক দিয়ে বেরিয়ে গেলো। দারোয়ানের পাত্তা নেই। সেই লোকটির ফটক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রায় পাঁচ সেকেন্ড পর মৃত্যুঞ্জয় ফটক পার করলো। রাস্তাঘাটে লোকজনের চলাচল বেশ ভালোই। সেই লোকটি এগিয়ে চলল বাঘাযতীন স্টেশনের দিকে। দুজনের দূরত্ব প্রায় কুড়ি হাত। ক্রমে সেই দূরত্ব কমছে। পনেরো হাত …. দশ হাত …. পাঁচ হাত …. দু হাত …. অবশেষে তাকে নিজের নাগালে পেলো মৃত্যুঞ্জয়। সেই লোকটির জামার কলারে মৃত্যুঞ্জয়ের হাত গেলো। মৃত্যুঞ্জয়ের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে গেলো সে। বিফল হলো। সামনের দিকে মুখ থুবড়ে পড়লো। অল্প আঘাত পেলো, সেটা বলাই বাহুল্য। তাকে সামনের দিকে ঘুরিয়ে তার ওপর চড়ে বসলো মৃত্যুঞ্জয়। দু হাতের মুঠোয় তার জামার কলার ধরে মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো – ‘ আমাকে ফলো করা হচ্ছে? কে তুই? ‘
সে চুপ করে থাকলো। দু গালে দুটো কষিয়ে থাপ্পড় কোষালো মৃত্যুঞ্জয়। চোট ও থাপ্পড়ের দরুণ তার ঠোঁট দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত।
‘ যদি আরও মার না খেতে চাস তাহলে বল তুই কে আর কেন আমাকে ফলো করছিস? ‘ মৃত্যুঞ্জয় প্রায় চিৎকার করে কথাগুলো বলল।
অল্প কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সে ছেলেটা বলল – ‘ আমি …. আমি রাহুল, রাহুল ব্যানার্জী। ‘

অরূপ হালদার বেশ কিছু পুলিশ ফোর্স নিয়ে পৌঁছালো পার্ক সার্কাস অবস্থিত কেয়ার ফর ইউ নার্সিং হোমে। তার আগে লোকাল থানার বড়বাবু সমেত কিছু কনস্টেবলকে সে নিয়ে নিয়েছে। লোকাল থানার বড়বাবুর নাম শ্রীধর হাজরা। বেশ মোটাসোটা লোক, বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছে।
‘ কী ব্যাপার অরূপ বাবু? অতো হন্তদন্ত কেন? ‘
অরূপ হালদার সংক্ষিপ্তে পুরো ঘটনাটা বলে শেষে বলল – ‘ আমার মনে হয়ে কোনো বড় স্ক্যান্ডালের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। ‘
‘ আর যদি কিছু না পাওয়া যায়? ‘ হাজরা বাবু সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখলেন অরূপকে।
‘ কিছু না পাওয়া গেলে ডক্টর সিদ্ধার্থকে অ্যারেস্ট করবো। ‘ অরূপ বলল।
‘ বিনা কোনো প্রমাণে? ‘
‘ আন্ডার সস্পিশন।’

নার্সিং হোমে বেশ কিছু পুলিশকে এক সাথে ঢুকতে দেখেই রিসেপশনিস্ট ঘাবড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
‘ ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী আছে? ‘ জিজ্ঞেস করলো অরূপ।
‘ না….মানে….মানে…হ্যাঁ ….’ মেয়েটি সংলগ্ন কিছুই বলতে পারলো না।
‘ কী হলো? আছে কি না বলতে এতো সময় লাগে ? ‘ বড়বাবু হাজরা এক ধমক দিলেন।
‘ হ্যাঁ, আছেন। ‘ মেয়েটি জবাব দিলো।
‘ কোথায়? ‘ প্রশ্ন করলো অরূপ।
‘ ওপরে …. ওপরে। ‘

চার তলা নার্সিং হোম। প্রতিটি ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজলো তারা। নার্সিং হোমর মালিকের কেবিনে তালা। শেষে তারা পৌঁছালো চার তলায়। সেখানে আছে দুটো অপারেশন থিয়েটার, একটা বড় আই সি ইউ এবং একটা হল ঘর। হল ঘরের দরজাটা অল্প খোলা ছিলো। ধাক্কা দিয়ে সেটা পুরো খুলে দিয়ে ভেতরে ঢুকলো অরূপ। ঘরে দুজন ভদ্রলোক।
‘ আপনাদের মধ্যে সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী কে? ‘
সিদ্ধার্থ গোলগোল চোখে অরূপকে দেখলো। তরতর করে ঘামছে সে। তার হাবভাব দেখে অরূপের বুঝতে অসুবিধে হলো না যে এই সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী। অরূপ এগিয়ে গেল তার দিকে।
‘ আপনি কিছু নিলেন এনার কাছ থেকে। তাই না? ‘
অরূপের সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোকটি বলল – ‘ না – না, আ..আমি তো কিছুই দিইনি একে। ‘
‘ সার্চ করে দেখবো? ‘
সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর কোর্টের পকেট থেকে বেরোল নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা।
‘ এবার বলুন চক্রবর্তী বাবু, মিতালী গাঙ্গুলীর মেয়ে রিয়া কোথায় ? ‘
অরূপের এই প্রশ্নে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধে  নেমে এসেছে। আকাশে আর মেঘ নেই। দিনের শেষে বিদায় নেওয়ার পূর্বে নিজের দর্শন দিয়েছেন সূর্য দেবতা। বালিগঞ্জে রুবি দে’র বিউটি পার্লার উক্ত বাড়ির সামনে এক হোন্ডা সিটি গাড়ি এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে নেমে পার্লারের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো মৃত্যুঞ্জয়। পার্লারে কাজ করা দুই মেয়ের মধ্যে একজনও নেই। দরজা খোলার শব্দে ভেতর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো রুবি দে। নিজের সামনে আচমকা মৃত্যুঞ্জয়কে দেখে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল তার। চকিতে নিজেকে সামলে মুখে কৃত্রিম হাসি নিয়ে বলল – ‘ আপনি এখানে? এই সময়? ‘
‘ আমাদের সময়ের ঠিক থাকে না ম্যাডাম। আমাকে দেখে ঘাবড়ে গেলেন দেখছি। ‘
‘ না – না, ঘাবড়াবার কী আছে ? বলুন। ‘
‘ ভেতর ঘরে বসতে পারি কী ? ‘
মুখটা পুনরায় ফ্যাকাসে হয়ে গেলো রুবি দে’র।
‘ মানে….মানে….লোক আছে আর কি। জরুরি মিটিং চলছে। ‘ আমতা – আমতা করে বলল রুবি দে।
‘ চলুন, আমিও দেখি কার সাথে আপনার এই জরুরি মিটিং। ‘
কথা শেষ করে ঘরের ভেতর ঢুকলো মৃত্যুঞ্জয়। ভেতর ঘরের সোফাতে বসে এক ভদ্রলোক। বয়স চল্লিশ ঊর্ধে। গায়ের রং পরিস্কার না বললেই চলে। এক মাথা চুল, ব্যাক ব্রাশ করা, জামাকাপড় দেখে বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের বলেই অনুমান করা যেতে পারে।
‘ ওঃ! তাহলে আপনিও এখানেই আছেন? ‘ সেই ভদ্রলোককে মৃত্যুঞ্জয় বলল।
রুবি দে পাথরের মূর্তির ন্যায় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চাইলে। মৃত্যুঞ্জয় তার দিকে ইশারা করে বলল – ‘ বসুন আপনি। দাঁড়িয়ে কেন? ‘
রুবি দে তাও বসলো না।
‘ আপনার পরিচয়? বিনা অনুমতিতে এখানে ঢোকার কারণ? আপনি কি জানেন না যে এটা লেডিস বিউটি পার্লার, পুরুষের বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ। ‘ সেই ভদ্রলোকটি এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো মৃত্যুঞ্জয়কে বলে গেলো।
‘ আপনার কোন প্রশ্নের জবাব আগে দেবো? আমার পরিচয়? আমি আই পি এস মৃত্যুঞ্জয়। বিনা অনুমতিতে ঢুকবার কারণ? তদন্ত চলাকালীন আমাদের অনুমতির প্রয়োজন হয়ে না।’
মৃত্যুঞ্জয় এবার দেয়ালের শোকেশের কাছে গেলো। যে পত্রিকাগুলো সাজানো ছিলো সেগুলো একে – একে বার করে সেন্টার টেবিলের ওপর ফেলল।
‘ ম্যাডাম, এ পত্রিকা গুলো এখানে সাজিয়ে রাখবার কথা না। এ গুলো তো গোপন জিনিস। তাই নয় কি? এ গুলো তো নিজের বেড রুমে বালিশের তলায় লুকিয়ে রাখতে হয়। ‘
লজ্জা এবং ক্রোধে রুবি দে’র মুখমন্ডল রাঙা হয়ে উঠলো।
‘ আচ্ছা ম্যাডাম, আপনি নিম্ফোমেনিয়ার বিষয় কী জানেন ? ‘ রুবি দে কে প্রশ্ন করলো মৃত্যুঞ্জয়।
রুবি দে’র মুখে কথা নেই।
‘ কী হলো ম্যাডাম? এই ম্যাগাজিনগুলো তো বেসিকালি নিম্ফোমেনিয়ার ওপরেই। তাই নয় কী ? ‘
ভদ্রলোকটি এবার উঠে দাঁড়ালেন।
‘ আপনি এক ভদ্রমহিলার সাথে অসভ্য ব্যবহার করছেন। ‘ কর্কশ গলায় বললেন মৃত্যুঞ্জয়কে।
‘ করতে বাধ্য হয়েছি মিস্টার। কেন কি এই নিম্ফোমেনিয়াই হলো অমৃত সামন্তের মৃত্যুর মুখ্য কারণ। কেন ম্যাডাম, আমি কি ভুল বলছি কিছু ? যদি কিছু ভুল বলি তাহলে শুধরে দেবেন। আপনি বেশ বহু দিন ধরে নিম্ফোমেনিয়া নামের এক সাইকোলজিকাল রোগে আক্রান্ত। সেই রোগের কারনেই আপনার নজর পড়েছিলো অমৃত সামন্তের ওপর।’
‘ আপনি খামোখা এক ভদ্রমহিলাকে অপমান করছেন। ‘ ভদ্রলোকটি চিৎকার করে উঠলো। ক্রোধে দিশাহারা হয়ে রক্তবর্ণ নেত্রে এগিয়ে এসেছিলেন মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে। মৃত্যুঞ্জয় তার ডান গালে সজোরে একটা থাপ্পড় লাগাতে তিনি ছিটকে পড়লেন সোফাতে গিয়ে।
‘ আপনি কি রুবি দে’র প্রেমে পড়েছেন নাকি মিস্টার ভাস্কর গাঙ্গুলী? দুঃখের বিষয় তো এটা যে রুবি দে আপনার সাথে শুধু নিজের স্বার্থের জন্য সম্পর্ক রেখেছে। নিজের শারীরিক স্বার্থের জন্য।’
রুবি দে’ র দিকে ফিরে মৃত্যুঞ্জয় বলল – ‘ ম্যাডাম রুবি, আপনি রিতিকা ব্যানার্জীর নাম তো নিশ্চই শুনে থাকবেন? ‘
এতক্ষণ ঘাড় হেঁট করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো রুবি দে। মৃত্যুঞ্জয়ের মুখে রিতিকা ব্যানার্জীর নাম শুনে চমকে উঠলো সে।

পর্ব –  ১০

রাত প্রায় সাড়ে দশটা। আকাশ পুনরায় মেঘাচ্ছন্ন। আজ অরূপের ঘরে শুধু অরূপ এবং মৃত্যুঞ্জয় নেই, আছে আরেক জন। অরূপ আজ খুশি। থানার বড় বাবু হিসেবে তার প্রথম কেস সফল। এই সফল কেসের জন্য সে মৃত্যুঞ্জয়ের চিরকৃতজ্ঞ। অরূপের কথায়, আজকের রাতটা সেলিব্রেট করার। তাই বাড়ির প্রত্যেকে শুতে যাওয়ার পর তিন জনে মিলে রাত সেলিব্রেট করা শুরু করলো। হ্যাঁ, এখনও তো তৃতীয় ব্যক্তির কথা বলাই হয়েনি। সে হলো, রাহুল ব্যানার্জী।
সবার গেলাসে পেগ ঢালার পর অরূপ মৃত্যুঞ্জয়কে বলল – ‘ তুমি না থাকলে এতো সহজে এই কেসের মিটমাট হতো না, মৃত্যুঞ্জয়দা। ‘
পাশে বসে থাকা রাহুল ব্যানার্জী অরূপের উদ্দেশে বলল – ‘ মৃত্যুঞ্জয়দা যে কষিয়ে থাপ্পড় মারলো আমায়, ব্যথা এখনও আছে। এক আই পি এস – এর থাপ্পড়, চিরকাল মনে থাকবে। ‘
অট্টহাস্য করলো সবাই।
প্রথম পেগে এক চুমুক দিয়ে রাহুল আবার বলল – ‘ দুর্গাপুর থেকে আমি এখানে গোপনে গোয়েন্দাগিরি করতে আসি। বেশ কিছু দূর এগিয়ে অবশেষে নিজের খেই হারিয়ে ফেললাম। আচ্ছা মৃত্যুঞ্জয়দা, তুমি এতো সহজে কী করে সব কিছুর কূলকিনারা বার করলে? ‘
মৃত্যুঞ্জয়ের প্রথম পেগ শেষ হয়ে গেছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে সে বলল – ‘ শুরুর দিকে কূলকিনারা আমিও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তবে অমৃত যে কলকাতায় এসে সোজা পথে এগোচ্ছিল না সেটা তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ব্যালেন্স দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। সে এখানে টিউশনি করতো, দুটো। দুটো টিউশনি থেকে মাসে কতো রোজগার হতে পারে? দেড় হাজার, দু হাজার, তিন হাজার? বাড়ির আর্থিক অবস্থা ঠিক না। বাড়ি থেকে ধরে নিলাম মাসে চার হাজার টাকাই আসে। সব মিলিয়ে মাস গেলে হাতে সে ছ’ – সাত হাজার টাকা পায়। কলকাতায় থাকার খরচও আছে। দমদমে প্রায় প্রতিটি হোস্টেলে থাকা খাওয়ার খরচ মাস গেলে প্রায় চার হাজারের ওপরে। কতই বা বাঁচতো তার হাতে? কিন্তু তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ছিলো বাষট্টি হাজার টাকা। রুটিন এনকোয়ারি শুরু করলাম। রুবি দে’র বাড়ি পার্লারে প্রথম দিন গিয়েই আমি নিম্ফোমেনিয়ার বিষয় কিছু ম্যাগাজিন দেখতে পেয়েছিলাম। এটা একটা সাইকোলজিকাল রোগ। একে হাইপার সেক্সসুয়ালিটিও বলা হয়। শরীরে অতিরিক্ত সেক্সের কারণে রুগীরা সর্বক্ষণ নিজেদের সেক্স পার্টনার খুঁজে বেড়ায়। ভাস্কর ব্যানার্জীর সাথে রুবি দে’র সম্পর্ক বহু দিনের। মিতালী বহু দিন ধরে মহিলা উন্নয়ন সমিতির এক জন সদস্যা। মিতালীর বাড়িতেও মাঝে – মাঝে মিটিং হতো। সেখানেই ভাস্কর গাঙ্গুলী ও রুবি দে’র পরিচয়। ভাস্কর যখন দেখলো মিতালীকে নিজের বশে আনা তার  পক্ষে সম্ভব হলো না, তখন সে এগোলো রুবি দে’র দিকে। রুবি দে’র তো বলতে গেলে মনের ইচ্ছাপূরণ হলো। একে তো তিনি  নিম্ফোমেনিয়ার পেশেন্ট, তায় আবার স্বামী বিদেশে। কিন্তু অসুবিধে হলো ভাস্কর সারা দিন নিজের কাজে ব্যস্ত। রুবি দে কে সময় দিতে পারতো না সে। ঠিক সে সময় রুবি দে’র নজর পড়লো অমৃত সামন্তর ওপর। অমৃতের মাকে তার বাড়ি পৌঁছাতে গিয়ে অমৃতের সাথে আলাপ তার। অমৃত জানায় যে তার কলকাতায় গিয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছে। উৎসাহ দেয় রুবি দে। তার পর আর কী? কলকাতায় এসে শুরু পায়রাডাঙ্গাতে থাকা অমৃতের জীবনের নতুন অধ্যায়। ‘
ইতিমধ্যেই দু পেগ শেষ হয়ে গেছে প্রত্যেকের। তৃতীয় পেগে এক চুমুক দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল – ‘ সত্যি বলতে অমৃতের জীবনটা এখানে বেশ ভালোই কাটছিলো। সে উপভোগ করছিলো দু’দুটো নারীর সংসর্গ। সময়ে – সময়ে আর্থিক সাহায্যও হয়ে যাচ্ছিলো তার। মিতালীর ওপরেও আমার সন্দেহ ছিলো। সন্দেহটা প্রবল হয়ে যখন জানতে পারি সে দুশ্চরিত্রা। কিন্তু তখনও আমি ভুল পথেই হাঁটছি। এবার রাহুলের কথায় আসি। অমৃতের হত্যার পর থেকেই সে উধাও। খুঁজে পাওয়া যায় না তাকে। সেটার কারণ জানার প্রবল ইচ্ছে হয়। রাহুলের রুম থেকে পাওয়া খবরের কাগজ আমায় হেল্প করেছিলো। সেখান থেকেই জানতে পাই রিতিকর বিষয়, জানতে পাই ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর বিষয়। রাহুলের বিষয় বিশদ ইনফরমেশন নেওয়ার উদ্দেশে আমি সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর কাছে যাই। জানতে পারি রাহুলের কোনো রোগ নেই। নিছকই ইনসমনিয়ার বাহানা করে রাহুল যায় সেখানে। তার উদ্দেশ্য নিজের নিরুদ্দেশ বোনের তদন্ত করা। ডক্টর সিদ্ধার্থর হাতে আমি অডি গাড়ির চাবির রিং দেখি। তার পেশা খুব একটা চলে না, সেটা তার রিক্ত চেম্বার দেখেই মনে হয়। তার পর অডি গাড়ি। মিতালীর ফ্ল্যাটের জুতোর ছাপ ও ডক্টরের চেম্বারের জুতোর ছাপ মিলে যায়। রিয়ার কিডন্যাপিং আমার সন্দেহকে আরও প্রবল করে। রিয়ার কিডন্যাপিংএর পেছনে উদ্দেশ্য কী হতে পারে? জানবার জন্য ডক্টর সিদ্ধার্থকে নাগালে পাওয়া দরকার ছিলো। গুড জব অরূপ। প্রকাশ্যে এলো অরগ্যান ট্রাফিকিংএর স্ক্যান্ডাল। হসপিটালের অপারেশন থিয়েটার থেকে উদ্ধার করা হলো অচেতন রিয়াকে। রিতিকা মহিলা উন্নয়ন সমিতির সাথে উক্ত ছিলো। সেই সমিতির দারুণ রুবি দে’র সাথে যে সিদ্ধার্থর পরিচয় হয়েছিল সেটা সেটা হয়তো জানতো রিতিকা। কোনো এক ভয় তার মনে বাসা বেঁধেছিলো। তাকে ডক্টর সিদ্ধার্থর কাছে চিকিৎসার জন্য রুবি দে পাঠায়। অরগ্যান ট্রাফিকিং এর শিকার হয়ে রিতিকা। ‘
‘ অমৃত হত্যার পেছনে উদ্দেশ্য? ‘ জিজ্ঞেস করলো রাহুল।
‘ উদ্দেশ্যটা থানাতে গিয়ে রুবি দে নিজেই পরিস্কার করেছে। অমৃতের সাথে দুর্বল মুহূর্তের সময় কিছু গোপন তথ্য সে ফাঁস করে। অমৃতের সাথে মিতালীর যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠছে সেটা রুবি দে অনুমান করতে পারে এবং সহ্য করতে পারে না। অমৃতকে গোপন তথ্য জানিয়ে তার মনে ভয় জন্মায়। সে ভাস্করের সাহায্য নেয় অমৃতকে পথ থেকে সরাতে। যে নম্বর দিয়ে অমৃতকে শেষ কল করা হয়েছিল সেটা অমৃত কিনে রুবি দে কে দিয়েছিল। কেন সেটা রুবি দে’ই ভালো বলতে পারবে। আগে অমৃত, তার পর মিতালীর পরিচারিকা। আমার বিশ্বাস মিতালীর পরিচারিকা রুবি দে’র গুপ্তচর ছিলো। যাই হোক, মামলা শেষ। অরূপ, মিতালীর বাড়ি থেকে কার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেলো? ‘
অরূপ বলল – ‘ ডক্টরের আর রুবি দে’র। ‘

একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিয়ে সিগারেটের শেষ অংশটা অ্যাশ ট্রেতে ফেলে দিলো মৃত্যুঞ্জয়।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × 5 =