সম্পাদকীয়

আজ এক নির্যাতিতার পাশে দাঁড়িয়ে কলকাতা সহ গোটা রাজ্য, দেশ এমনকি বিদেশের মাটিতেও আন্দোলনের অনুরণন ছড়িয়ে দিতে পেরেছে বাঙালি। নারীত্বের এই অবমাননার প্রতিবাদে একই গণআন্দোলন বছর খানেক আগেই ছড়িয়ে দিতে পারত দিল্লী। সেটা হয়নি, আমাদের দুর্ভাগ্য, ভারতের দুর্ভাগ্য। না আমি অভয়া কাণ্ডের কথা বলছি না। বলছি ভারতীয় কুস্তিগিরদের কথা। এক বিজেপি নেতা তথা ভারতীয় কুস্তি সংস্থার কর্তা ব্রিজভূষণ সিং দিনের পর দিন মহিলা কুস্তিগিরদের শ্লীলতাহানি করেছেন, এই অভিযোগে প্রতিবাদে নামে কুস্তিগিরেররা। সেই প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন যারা তারা কেউ সাধারণ মানুষ নন। তাদের মধ্যে অলিম্পিক পদক জয়ীর পাশাপাশি এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমস, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে মেডেলজয়ী একাধিক কুস্তিগির ছিলেন। যারা আক্ষরিক অর্থেই দেশের গর্ব। যারা নিজেদের কৃতিত্বে বহুবার হেডলাইনে এসেছেন। দেশবাসী এই ঘটনার নিন্দে করেছে, সহানুভূতি দেখিয়েছে কুস্তিগিরিদের প্রতি। কিন্তু আন্দোলনকারীদের পাশে গিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ে সামিল হয়নি। দিল্লীর মানুষ পথে নামেননি এর প্রতিবাদে। সেভাবে গণ আন্দোলন তৈরিই হয়নি। অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু, স্পর্শকাতর বিষয়। এত গুণী মানুষ পথে নেমেছেন দেখেও দিল্লী নিরবই ছিল। নাহলে কলকাতার মতই একটা গণ আন্দোলন বছর খানেক আগেই উপহার পেত দেশ।

এই আন্দোলনেই পুলিশের হাতে মার খেয়েছেন ভিনেশ ফোগট, সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়া। কি নামগুলি মনে পড়ছে। একশো ত্রিশ কোটির দেশে দুই চারটে যা অলিম্পিক পদক এসেছে তাঁর অধকাংশটাই এই কুস্তিগিরিদের হাত ধরে। তার পরেও এদের মর্যাদা কোথায়? কেন আগামী প্রজন্ম খেলাধূলায় উৎসাহ পাবে? কেন ভারতে মেডেল আসবে? যখন দেখা যায় অলিম্পিক মেডেল জয়ীদের শ্লীলতাহানির প্রতিবাদ করতে গেলে পুলিশের লাঠির বাড়ি খেতে হয়। এই লজ্জার বিরুদ্ধে গর্জে উঠতেই পারত দিল্লী, সোচ্চার হয়ে উঠতে পারত গোটা দেশ। কিন্তু তা হয়নি। ভিনেশ যখন অলিম্পিকে পদক জয়ের দোরগোড়ায় তখন ভারতবাসীর প্রবল সমর্থন, সহানুভূতি, আক্ষেপ চুড়ান্ত আদিখ্যেতা। কিন্তু এই মেয়েটিই যখন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের হাতে মার খাচ্ছে তখন দেশ নীরব। সত্যিই সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ।

সম্প্রতি হরিয়ানায় নির্বাচনে কংগ্রেসের ভাল ফলের ইঙ্গিত মিলেছে। আমি একেবারেই কংগ্রেসের ভক্ত নই, রাহুল গান্ধী বা অন্য কোনও কংগ্রেস নেতা আমার সামান্যতমও প্রিয় ব্যক্তি নন। কিন্তু বিজেপির এই পরাজয়টা খুব প্রয়োজন ছিল। আমরা বাংলার মানুষ, দেখেছি আমাদের রাজ্যের সরকার কিভাবে তার দলের কর্মী বা নেতাদের বাঁচাতে পক্ষপাত নেয়, একই ভাবে দিল্লীতে বিজেপিও বরাবর এই ইস্যুতে নীরব থেকে ব্রিজভূষণকে সমর্থন করে গিয়েছে। এতগুলি ছেলেমেয়ে একযোগে অভিযোগ করছে, তাতে সামান্যতম বিচলিত হয়নি বিজেপি নেতৃত্ব। গোটা ঘটনায় আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কুস্তিগিরিদের সিংহ ভাগই হরিয়ানার মানুষ। তাদের আত্মীয় পরিজন, শুভানুধ্যায়ী পরিচিত সকলেই দেখেছেন বিজেপির এই একচোখোমি। সেই সঙ্গে জড়িয়ে ছিল কৃষক আন্দোলনেও বিজেপির অসহযোগিতার স্মৃতি। তাই এবারের নির্বাচনেও যদি হরিয়ানা বিজেপিকেই ফের নির্বাচিত করত তাহলে বোধহয় তারা ঘরের ছেলেমেয়েদের কাছেই মুখ দেখাতে পারত না।

ক্ষমতায় এলে কংগ্রেসের শাসন কেমন হবে তা অনুমেয়। রাজনৈতিক দল মোটামুটি একই ধরনের হয়, মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। ভিনেশ এবারে কংগ্রেসের প্রার্থী, তিনি জিতলে মন্ত্রী হতে পারেন বলেও শোনা যাচ্ছে। সে যাই হোক, তাদের শাসনকাল নিয়ে আলোচনা সমালোচনা আগামীতে উপজীব্য। কিন্তু যে আন্দোলন এক বছর আগেই বিজেপির ভিত নড়িয়ে দিতে পারত, সেই আন্দোলনকে মর্যাদা দিতে হরিয়ানায় বিজেপির পরাজয় কাঙ্ক্ষিত ছিল। এই লড়াইয়ে তাই হরিয়ানার মানুষ, দেশের গর্ব কুস্তিগিরেরা তাই নিজেদের জয় দেখছেন। কংগ্রেস উপলক্ষ মাত্র।

পলাশ মুখোপাধ্যায়

প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

17 + seventeen =