উপলব্ধি

 

বিশ্বজিৎ রায়, বালুরঘাট, দক্ষিণ দিনাজপুর ##

“What is in name ? That which we call a rose

By any other name would smell as sweet.”

(“Romeo and Juliet”, Act II, Scene II : William Shakespeare.)

আপাতদৃষ্টিতে  হাস্যকর মনে হলেও আজ এক  শিক্ষানীয় ঘটনার সম্মুখীন হলাম। যাদেরকে আমরা  আমাদের তথাকথিত পুথিগত শিক্ষার ঢাকঢোল বাজিয়ে সমাজে অপাংক্তেয় উচ্ছিষ্ট বলে গন্য করে থাকি, তাঁরাই  কখনও কখনও তাদের অতি সরল উপেক্ষিত  জীবন দর্শন দ্বারা আমাদেরকে দুচোখে আঙুল দিয়ে চরম সত্যকে উপলব্ধি করিয়ে দেয়।

তখন সকাল ৬টা হবে। প্রাতভ্রমণে বেরিয়েছি। ধরিত্রী মাতার স্নেহমাখা সম্ভাষণে সাড়া দিয়ে সবেমাত্র রাতের ঘুমের আলস্য কাটিয়ে বাধ্য শিশুর ন্যায় সূর্য পুব আকাশে উদিত হয়েছে। উদিত সূর্যের হাস্যময়ী রক্তিম মুখ ও পাখির কলতান শুনে আমি মনে মনে কবিতা বাঁধতে লাগলাম-

“ নিশি অবসানে পাখি কলতানে

নিদ্রিত ধরণী জাগছে ঐ

মাতৃক্রোড়ে শিশুসম রবি হাসে

আমি শুধু চেয়ে রই।

পুষ্প সুভাসিত মলয় বয়

ধানশীষরা ধরেছে তাল

এ কি অপরুপ মোহিত দৃশ্যে !

ভ্রমর হয়েছে মাতাল।

………………………………….”

এমন সময় হঠাৎ দেখি নোংরা জামাকাপড় পরা মাথার চুল ঊসকোখুসকো মধ্য পঞ্চাশের আপাতদৃষ্টিতে পাগলা গোছের এক ব্যক্তি দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে পশ্চিমমুখী হয়ে কিছু একটা প্রণাম করছেন। আমি স্বভাবতই ঈশ্বর বিশ্বাসী। তাই মনে মনে ভাবলাম দৃশ্যটি মন্দ নয়, আমিও একটি প্রণাম সেরে নেই। লোকটি যে দিকে মুখ করে প্রণাম করছিলেন কিছুটা দূর থেকে আমিও সেই দিকে মুখ করে আমার অদৃশ্য কল্পিত দেবতার  উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালাম। ভাবলাম প্রণাম যখন করলাম একবার না হয় দেবতার দর্শনই করা যাক।   এই ভেবে  লোকটির কাছে গিয়ে আমি স্তম্ভিত ! আমি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম আশেপাশে একটিও মন্দির বা দেবতার কোনো বেদিস্থল নেই। বিষয়টি আমার কাছে বড়ই কৌতূহলজনক মনে হলো। মনে মনে ভাবলাম , আশাপাশে একটিও মন্দির  বা বেদিস্থল নেই অথচ ব্যাটা প্রণাম করছে কাকে ? আর আমিও বা ওর দেখাদেখি কাকে প্রণাম করলাম ? কৌতূহল আর চেপে রাখতে পারলাম না। উৎসুক হয়ে লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম-

“ আপনি কাকে প্রণাম করছেন , কোথাও তো মন্দির নেই ?

প্রণাম সেরে পিছন ফিরে আমার দিকে তাকালেন এবং স্মিত হাস্যে ইশারায় একটি পাকা বাড়ি দেখিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে চলে গেলেন। বাড়িটির দিকে তাকিয়ে দেখি বাড়ির ওপরের দিকে বাড়ির নামটি বড় বড় করে লেখা আছে-

“ কাশীধাম”।

একেবারে বোকা হয়ে গেলাম। দেখো কান্ড ! ও যে বাড়িটিকে প্রণাম করছেন কল্পনাও করতে পারি নি। আমি ভেবেছিলাম সেখানে হয়তো কোনো দেবতা থাকায় তিনি প্রণাম করছেন আর আমিও তাই প্রণাম করেছি। না জেনেই আমিও ঐ পাগলের মত বাড়িটিকে প্রণাম করে ফেলেছি। ব্যাটা সকাল সকাল আচ্ছা বোকা বানিয়েছে আমায়। পাগল কোথাকার। নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেকেই বড্ড বোকা মনে হতে লাগলো এবং নিজের বোকামীর কথা চিন্তা করে হাসি আর চেপে রাখতে পারলাম না । হো হো করে হেসে উঠলাম। এমন সময় অতীব সাত্ত্বিক কৃষ্ণভক্ত আমার পরিচিত বসন্ত বৈরাগী কৃষ্ণ নাম গাইতে গাইতে সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আশেপাশে  একটিও লোক নেই অথচ আমাকে একাকী এরকম হো হো করে  হাসতে দেখে বসন্ত বৈরাগী আমার দিকে এগিয়ে এলেন আমায় জিজ্ঞাসা করলেন-

“ কি ব্যাপার মাষ্টার ! নিজে নিজেই হেসে চলেছো, বলি মাথা খারাপ হলো না কী ?”

আমি বললাম- “ না না গোসাই, মাথা খারাপ হবে কেন ! নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই হাসছি।“

বসন্ত বৈরাগী আমার হাসির কারণ জানতে চাইলে আমি তাঁকে ঘটনাটি আদ্যোপান্ত খুলে বললাম। আমার মুখে ঘটনাটি শুনে তিনি বললেন-

“ এতে হাসির কিছু নেই মাষ্টার । তুমি শিক্ষিত ব্যক্তি আর এই সহজ হিসাবটা বুঝতে পারলে না ?”

আমি বললাম-

“ এর মধ্যে আবার হিসাব কি আছে গোসাই ? একজন লোক তাঁর সামনে কোনো দেবতা নেই, কোনো  বেদি নেই,   একটি আস্ত ইট কংক্রিটের বাড়িকে প্রণাম করছেন আর আমিও তাঁর দেখাদেখি না বুঝেই বাড়িটিকে প্রণাম করলাম- এ কী বোকার মত কাজ নয় ? আচ্ছা ঠিক আছে গোসাই , আমি তো হিসাব মেলাতে পারছি না, তুমিই বরং হিসাবটা বুঝিয়ে দাও।“

বসন্ত বৈরাগী বললেন-

“ মাষ্টার, ভক্তির জন্য মূর্তি বা বেদি থাকাটা জরুরী নয়, জরুরী হলো বিশ্বাস। তোমরা যাকে পাগল বলছো সেই লোকটি আসলে বাড়িটিকে প্রণাম জানায় নি, প্রণাম জানিয়েছে  “কাশীধাম” শব্দটিকে। ঈশ্বর, আল্লাহ, গড যাই বলো না কেন তিনি অদৃশ্য হয়েও সর্বত্র বিরাজমান। তিনি নির্দিষ্ট গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন না। মন্দির, মসজিদ, গির্জা – শুধু এগুলিতেই ঈশ্বর, আল্লাহ, গড বিরাজ করেন ? তা নয়- সর্বক্ষণ সর্বত্রই তিনি। বিশ্ব ব্রক্ষান্ডের অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষু্দ্র অণু পরমাণুর মধ্যেও তাঁর অবস্থান, এমন কি নামেও তাঁর উপস্থিতি, আর তা উপলব্ধি করবার জন্য আমাদের যে দর্শন প্রয়োজন তা হলো ঐ লোকটির মত – সরল বিশ্বাস।“

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one × 4 =