করম উৎসব

শুভজিৎ দত্ত, আগরপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা ##

পুরুলিয়া বলতেই আমরা যেটা জানি বা বুঝি তা হলো এখানকার পাহাড়, ঝর্ণা, জঙ্গলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তবে পুরুলিয়া শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নয়, এখানকার সংস্কৃতিতেও সমৃদ্ধ। এই সংস্কৃতির একদিকে যেমন ঝুমুর গান ও ছো-নাচ, আবার অন্যদিকে এই এলাকার বিভিন্ন পরব (মনসা, করম, ইঁদ  ভাদু, বাঁদনা, রোহিন, টুসু)।

 পুরুলিয়ার এইসব সংস্কৃতির প্রেমে পড়েই বারবার ছুটে গেছি, নির্যাস নিয়েছি এই পরবগুলোর। তবে আজ আপনাদের বলব করম পরবের কথা।

করম পরব:

১. বিস্তারক্ষেত্র:

এই পরব পালন করা হয় মানভূম এলাকায় (পুরুলিয়া,বাঁকুড়া,পশ্চিম মেদিনীপুর)এমনকি ঝাড়খণ্ডের বুন্ডু তামাড় এলাকার জনজাতির প্রানের উৎসব হল এই করম।এই উৎসবের মাধ্যমে আদিবাসীদের জল-জমিন-জঙ্গল1 কেন্দ্রিক জীবন ধারার প্রতিফলন দেখা যায়।

২.সময়কাল 

এই পরব তিথি নির্ভর।প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে পালন করা হয় এই পরব।এই দিন করম  ডাল পুঁতে করম ঠাকুরের প্রাণ প্রতিষ্টা হয়। অবশ্য এর প্রস্তুতি শুরু হয় প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকে।

৩.করম ব্রত পালনের রীতি

জাওয়া পাতা:

মূলত গ্রামের অবিবাহিত কুমারী মেয়েরাই এই ‘করম’ ঠাকুরের উপাসক। শুক্লা একাদশীর সাত দিন আগে কুমারী মেয়েরা একত্রে বাঁশের বোনা ‘টুপা’ (ডালা), এবং বিভিন্ন ধরণের শস্যবীজ নিয়ে জড়ো হয় পার্শ্ববর্তী কোনো নদী,খাল,বা পুকুরে। সেখানে প্রত্যেকে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে সদ্যস্নাত ভিজে কাপড়ে নিজের নিজের টুপায় নদী খাতের বালি ভর্তি করে বাড়ি থেকে আনা সেই শস্যবীজগুলো বুনে দেয়।তারপর পরস্পরের হাত ধরে এই টুপা কে কেন্দ্র করে গোল হয়ে গাইতে থাকে-

“আইসঅ লো সঙ্গতি সবাই হাত ধইরে নাচি লো-

একমনে জাওয়া দিব,জাওয়া যেমন বাড়হে লো।

কাঁসাই লদির বালি আইনে জাওয়া পাতাব লো-

হামদের জাওয়া উঠে শাল ধুঁধের পারা লো।”

আবার কখনও গাওয়া হয়-

 “কাঁসাই লদির বালিয়ে জাওয়া পাতিব  লো।

আমদে জাওয়া উপারে রণে তাল গাছের পারা লো।।

সুরজ উঠে খিনি খিনি আমার জাওয়া উঠে না।

জাওয়ার লাগি দিন উপাসগো।।

সাত দিনকার জাওয়ার লাগি দিন পালন করি গো।”

তাও আমরা জাওয়া পাতাব গো।

এভাবেই শুরু হয় ‘জাওয়া পাতা’।

ব্রত পালন

এরপর শুরু হয় এই জাওয়া টুপা গুলোর পরিচর্যা।দিন দুয়েক পরই শস্যবীজগুলির অঙ্কুরোদম হয়।জাওয়া পাতানো কুমারী মেয়েরা জাওয়ার শুদ্ধতা বজায় রাখার  সারা সপ্তাহ ধরে পালন করেন কিছু রীতি-নীতি।যেমন- এ কদিন তারা শাক খায় না,খাটিয়ায় ঘুমায় না,মাথায় তেল দেয় না,চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ায় না।এছাড়াও প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় মেয়েরা নিজ নিজ ডালা সহ গ্রামের একজায়গায় জড়ো হয়।জাওয়াকে কেন্দ্র করে সারা সন্ধ্যা চলে করম গান ও নাচ।

সারা সপ্তাহ ধরে এইসব রীতি-নীতি মেনে চলার পর আসে শুক্লা-একাদশী করম পুজোর দিন।এইদিন মেয়েরা সকাল থেকেই  উপবাস থেকে একসাথে জঙ্গলে গিয়ে ফুল তোলে,জাওয়া গীত গাইতে গাইতে সারাদিনব্যাপী চলে নাচ-গান।

সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের লায়া (পুরোহিত) একজায়গায় করম ডাল পুঁতে করম ঠাকুরের প্রাণ প্রতিষ্টা করে।তৈরি হয় পুজার বেদী।গ্রামের ব্রতকারী কুমারী মেয়েরা ‘করম ডালায়’ পুজোর অর্ঘ্য রূপে ঘী,গুঁড়,আতপচাল,মধু,ধুপ,একগাছি ধান আর কাঁকুড় ইত্যাদি নিয়ে সমবেত হয়ে পুজো করে করম ঠাকুরের।কামনা করে সোহাগী স্বামী পাওয়ার ও সন্তানবতী হওয়ার।এই ‘কাঁকুড়’ কে কুমারী মেয়েরা বেটাছিলে হিসেবে কল্পনা করে।ভাবতে কি অবাক লাগে একাদশী মানেই এতদিন জানতাম বিধবাদের ব্রত।কিন্তু এই একাদশী কুমারী মেয়েদের।উদ্দেশ্য সু-স্বামী লাভ,সন্তান লাভ এবং সর্বোপরি স্বামী পুত্র কন্যা সহ সমগ্র পরিবারের মঙ্গল কামনা করা।পরদিন সকালে মেয়েরা জাওয়া থেকে অঙ্কুরিত বীজগুলিকে উপড়ে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়ে বাড়িতে বিভিন্ন স্থানে সেগুলিকে ছড়িয়ে দেন। এরপর করম ডালটিকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।পূজার পরে মেয়েরা পরস্পরকে ‘করমডোর’ বা ‘রাখী’পরিয়ে দেয়।পরে পুকুরে বা নদীতে পূজার অর্ঘ্য সহ ‘কাঁকুড়-বিটা’কেও বিসর্জন দেওয়া হয়।

৪.করম গান ও নাচ

এই পরবের মূল সম্পদ হল জাওয়া-গান।এই গানগুলোর কোনো লিখিত রূপ না পাওয়া গেলেও প্রতিটা গ্রামে বংশ পরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত।এই গানগুলো র মাধ্যমে নারী মনের সূক্ষ্ম অনুভূতির পরিচয় পাওয়া যায়।এই গানের সাথে সাথে চলে করম নাচ।জাওয়াকে কেন্দ্র করে মেয়েরা চক্রাকারে নাচে।এই নাচ গানের মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয় তাদের দৈনন্দিন জীবনের হাসি-কান্না,সুখ-দুঃখ।এই গানগুলো বাংলার লোকসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদও বলা যেতে পারে।

তবে এই গানগুলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এই গানগুলো মূলত ছয়টি পর্যায়ের গান।

২.আচার মূলক,

২.ডহইরা,

৩.আখড়া-বন্দনা,

৪.চাষবাস সম্পর্কিত,

৫.নারী কেন্দ্রিক সমাজ জীবন,

এবং

৬.ভাসান,

উদাহরণস্বরূপ সেরকমই বিভিন্ন পর্যায়ের জাওয়া গানের উল্লেখ করলাম-

আচারমূলক— 

কাঁসাই নদীর বালি নিয়ে জাওয়া পাতাব লো।

আমাদের জাওয়া উঠে যেমন শাল ধুঁধের পারা লো।।

ডহইরা( ডহর এর অর্থ রাস্তা) করমের ব্রতীনীরা যারা ‘পার্বতী’ নামে পরিচিত তারা বাড়ি থেকে আখড়া পর্যন্ত জাওয়া ডালি নিয়ে যাবার সময় রাস্তাতে এই ধরনের গান গাইতে গাইতে যায়।

চল রে সঙ্গতি, সবাই  জাওয়া বেঢ়াতে লো।

বেলা হল্য জইড়(অশ্বত্থ) গাছের আড়ে।।

আখড়া বন্দনা

প্রথমে বন্দনা করি গাঁয়েরি গরাম হরি।

তারপরে বন্দনা করি করম ঠাকুর।।

কিয়া দিঁয়ে বন্দিব গাঁয়েরি গরাম হরি।

কিয়া দিঁয়ে বন্দিব করম ঠাকুর।।

ঘিয়ে দুধে বন্দিব গাঁয়েরি গরাম হরি।

জাওয়া দিঁয়ে বন্দিব করম ঠাকুর।।

চাষবাস সম্পর্কিত

আমরা সবাই চাষার বিটি, তাই কইরেছি চাষ লো।

ডালায় টঁকায় দিঁয়েছি চারা।।

উপর খেতে হাল দাদা নামো খেতে কামিন রে।

কন খেতে লাগাবি দাদা কাজলকাঁঠি ধান রে।।

কাজলকাঁঠি ধান দাদা হেলক্যে যে গেল রে।

টালি বস্যা ঘর দাদা শুধায় রহিল রে।।

দু হাজার চার সনে,

জল হল্য নাই শরাবনে,

হালের গরু পালে চইরে খায়।

যারা বঠে বঢ়ান চাষা,

তাদের আছে আশা ভরসা,

বাইধন চাষার পরাণ উড়্যে যায়।।

নারীকেন্দ্রিক 

আঙিনা কাদা গলি কাদা তাও আস্যেছে লিতে লো।

হারাল্য সিঁদূরের কোঠা মন সরে নাই যাতে লো।।

তাল তলের লাল লট্যা ছনকাঁই রাঁধিব লো।

দাদার বহু মাগত্যে আলে মু মচকাঁই দিব লো।।

বড় বহু যেমন তেমন, মাঝলি বহু চরা লো।

ছুটু বহু দাদাকে গাইল দেই খালভরা লো।।

মাছে ঝিঙায় রাঁধ্যেছিলি ননদিনীর লাগ্যে লো।

হেন বেলা খবর আল্য ননদী মরেছ্যে লো।।

ননদ মরল্য ভালই হল্য কি বল্যে কাঁদিব লো।

ঝুমকাঝুরি কাজলের লতা লো।।

ভাসান

যাও যাও করম ঠাকুর যাও ছয় মাস রে,যাও ছয় মাস।

পড়ত ভাদর মাস আনব ঘুরাঁই।।

সুতরাং এটা বোঝা যায় যে করম প্রধানত সৃষ্টির উৎসব,সৃজনের উৎসব।কর্ম থেকে করমের উৎপত্তি।ঝাড়খণ্ডের কিছু জায়গায় এই উৎসব কর্মা নামেও পরিচিত।আরও ভালো করে দেখলে বোঝা যায় এই পরবের মূল আচার যে জাওয়া পাতা তার মধ্যেও লুকিয়ে আছে এই সৃজনশীলতার ইঙ্গিত।জন্ম>জাত>জাওয়া এইভাবেই এই শব্দের  উৎপত্তি।আর কুড়মালি ভাষায় এর অর্থ ‘অঙ্কুরোদম’। অর্থাৎ কর্ম থেকে করম কর্মের দ্বারা জাত ফসলের জিয়ানোর নামই হল জাওয়া।তাই মানভূমের করম পরব এক অর্থে নবজীবনেরই আরাধনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 + five =