কুহকী বাস্তবের অলীক মানুষ

সৌমেন জানা, মুর্শিদাবাদ

 

“পাতাকুঁড়ুনি বুড়িরও আশা ছিল এবার সে ফসলের শিস কুঁড়ুতে মাঠে যাবে কিন্তু মারাত্মক গাছটা নির্দয় বাতাসের ভাষায় তাকে বলেছিল, মর মর মর। দারুণ ভয় পেয়ে সে মরে গিয়েছিল।

গাছেরা কথা বলে। গাছেরা বাতাস থেকে ভাষা শেখে। তাই বলে মানুষের ভাষা শেখে, কোনও কোনও গা্ছও মানুষের ভাষা শেখে।

কিন্তু সত্যিই কি গাছটা বুড়িকে বলেছিল, মর মর মর? “

মরমী লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কলমে “গাছটা বলেছিল” গল্পের দৃশ্যগুলি পাঠকের মনে কল্পনার মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে ওঠে। তিনি সাধারনত লিখতেন নিজের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে। আধুনিক-মনস্ক লেখকের নাড়ীর টান কিন্তু গ্রামবাংলা। তিনি তাঁর চেতনাকে পাঠকের মগজে এবং হৃদয়ে প্রতিফলিত করতে পেরেছিলেন।

প্রকৃতি প্রেমিক লেখক মৃত্যুর কয়েকদিন আগে বলেছিলেন, “I essentially explore man’s relationship with nature and try to demonstrate that where as trees, rivers, rainfall etc. live out their own course without a obstructing any natural or human cycle, man tries to direct the course of nature by building dams across rivers or curb the freedom of his fellow beings in sundry ways.”

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের জন্ম মুর্শিদাবাদ জেলার খোশবাসপুর গ্রামে ১৯৩০ সালে। বাবা সৈয়দ আব্দুর রহমান ফেরদৌসী ও মা আনোয়ারা বেগমের বড় ছেলে। প্রথম জীবনে বাড়ি থেকে পালিয়ে লোকনাট্য “আলকাপের” সঙ্গে যুক্ত হন। নাচ-গান-অভিনয়ে মেতে ওঠেন৷সেই সূত্রে ঘুরে বেড়িয়েছেন রাঢ বাংলার প্রত্যন্ত প্রান্তে। জীবন দিয়ে চেনা গ্রামবাংলার সেই গন্ধকে এক আলো-আঁধারি ভাষায় নাগরিক পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

তাঁর প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস নীলঘরের নটী (১৯৬৬)। তারপর হিজলকন্যা (১৯৬৭), তৃণভূমি (১৯৭০), মায়ামৃদঙ্গ (১৯৭২), উত্তর জাহ্নবী (১৯৭৪), নিলয় না জানি (১৯৭৬) প্রভৃতি উপন্যাসে রাঢ়-বাংলার নিসর্গপ্রকৃতির উদ্দাম বন্যভাব এবং প্রান্তিক মানুষের বিচিত্র জীবনধারা প্রকাশ পেয়েছে যা তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোয় উজ্জ্বল। তাঁর দেখা দুরন্ত গেছোমেয়ে হিজলকন্যা – যাদের দুরন্ত ভালোবাসার আবেগে ছিল  লজ্জা-দ্বিধাহীন প্রকাশ। ময়নাডাঙা, মরাডুংরি, ধুলোউড়ি, সোনাটিকুরির বিস্তীর্ণ প্রান্তিক জীবন ও নিসর্গ প্রকৃতির সজীবতা তৃণভূমি উপন্যাসে চিত্রিত। নিশানাথের চোখে – ‘সারা তৃণভূমিকে মনে হয় জীবন্ত – কোষে কোষে তাজা রক্তমাংসের মতো অনুভূতি… সজীব সতর্ক সব কিছু। পশুপাখি, কীটপতঙ্গের জীবজগত সেই বিস্তৃত আর সজীব কোষে কোষে বিন্যস্ত সত্তার অংশমাত্র –  গাছের ফুল-ফলের মতো একটা প্রস্ফুটিত পরিণতি।’

“অলীক মানুষ” তাঁর রচিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।উনিশ-বিশ শতকের মুসলিম অন্দর মহলের এক তথ্যপূর্ণ ডকুমেন্টশন।তিনি নিমোর্হভাবে তার সহজাত ভাষায় বুনেছেন অসংখ্য কাহিনী-উপকাহিনীর মধ্যে দিয়ে একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস।এই লৌকিক-অলৌকিকের মন্ময় আখ্যানটি রচিত হয়েছে কোলাজ রীতিতে। কখনো সহজ বয়ানে, কখনো মিথ ও কিংবন্তী আবার কখনো ব্যক্তিগত ডায়েরী, সংবাদপত্রের কাটিং জুড়ে দিয়ে দূর সময় ও বিস্ময়কর মানুষের বৃত্তান্ত। বাঙালি হিন্দু মুসলমান জীবনে এক অনাবিষ্কৃত সত্যের উদ্ভাসন।

উপন্যাস জুড়ে আছে দৃশ্যমান জগৎ ও অদৃশ্য জগতের দ্বন্দ্ব। মানুষ বদিউজ্জামান ও সাধক বদু পীরের দ্বন্দ্ব। বাস্তব-অলীকের সংঘাত, লৌকিক-অলৌকিকের মায়াবী আলো-আঁধারি জগতের দ্বন্দ্ব দেখা যায় এই উপন্যাসে।কখনো শফির আত্মকথন তো কখনো বদিউজ্জামানের বয়ান। শফির ক্রমরূপান্তর।বদিউজ্জামানের ক্রমশ একা হয়ে যাওয়ার নিঃসঙ্গতা; মানুষ থেকে অলীক মানুষ হয়ে ওঠার যন্ত্রণা – ‘উঁচুতে উঠে গেলে যেন মানুষের সবটুকু চোখে পড়ে না নিচে থেকে। ওরা ভাবে আমার ঘর-গেরস্থালি নেই, স্ত্রী-পুত্র নেই, আমি এক অন্য মানুষ। অথচ আমার মধ্যে এই সব জিনিস আছে। টিকে থেকে গেছে সব কিছুই। আমার কষ্ট, আমার মনে খাহেশ। তসবিহ জপে ভুল হয়… আমার চারদিকে তারপর থেকে হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার… অথচ রাত নিশুতি হলে সেই হুঁশিয়ারির মধ্যেও চাপা হাসিকান্নার মানবিক আর্তি ভেসে আসে… সারা রাত ঘুম আসে না দু’চোখে।তাঁর দক্ষ কুশলতায় এই প্রথাবিরোধী উপন্যাসটি পাঠকের মনে সৃষ্টি করে লৌকিক আর অলৌকিকের সীমারেখা।অলৌকিকতাকে পাঠকের সহজাত বোধশক্তির অংশ করে তোলাই তাঁর সাফল্যের পরিমাপ। মায়া ও বাস্তবতার টানাপোড়েনেই রক্তমাংসের মানুষ একসময় পরিণত হয় অলীক মানুষে।’অলীক মানুষের হাত ধরেই ১৯৯৪ সালে পান সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার। তবু বিচিত্র পথে চলা জীবনের অভিজ্ঞতার খুব সামান্যই হয়তো উঠে এসেছিল তাঁর সাহিত্যে।

তাঁর শেষ কবিতা ছাপা হয়েছিল ‘দেশ’-পত্রিকাতে, উনিশশো পঞ্চাশের  সেপ্টেম্বরে। কবিতাটির নাম ‘শেষ অভিসার’। সময়টা ১৯৫৮। গ্রামের বাড়িতে বসেই গল্প লেখা শুরু করেন।

১৯৫৮ তে বহরমপুর থেকে প্রকাশিত ‘সুপ্রভাত’ পত্রিকায় সিরাজের প্রথম গল্প ‘কাঁচি’ প্রকাশিত হয় ‘ইবলিশ’ ছদ্মনামে। পরবর্তী দু’টি সংখ্যায় ঐ ‘ইবলিশ’ ছদ্মনামেই প্রকাশ করেন আরো দু’টি গল্প ‘কুতুবপুরের প্রেতিনী’ ও ‘মিঞাপন্ডিত’।এছাড়াও ‘ইবলিশ’ ছদ্মনামে ‘কালান্তর’ পত্রিকাতে ‘ভূচর’, ‘বীথিকা’ পত্রিকাতে ‘হিজলের ডাক পুরুষ’ এবং ‘সংকেত’ পত্রিকাতে ‘হিজলবিলের গর্ভিনীরা’  এই গল্পগুলি লেখেন।১৯৬২ সালে চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের সময় সিরাজ গ্রামে বসেই সাপ্তাহিক ‘অমৃত’ পত্রিকায় গল্প লিখলেন- ‘সীমান্ত থেকে ফেরা’। গল্পটিতে নেফা ও লাদাখ সীমান্তের বরফাচ্ছাদিত পরিবেশ এবং সেই পরিবেশে সীমান্ত যুদ্ধের নানান ঘটনা-এমন নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছিল, যাতে মনে হয়েছিল লেখক যেন সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এর কিছুদিন পরই সিরাজের একটি বিখ্যাত গল্প ‘ভালোবাসা ও ডাউন ট্রেন’ প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায়। এই গল্পে বিশ্বাস ও নিশ্চয়তা, নিঃশ্বাস ও শূন্যতা মিলিয়ে গড়ে উঠেছে বর্ষাস্নাত পরিত্যক্ত প্রায় এটি স্টেশন এবং পলায়ন তৎপর প্রেমিক-প্রেমিকা। গল্প সামান্যই, দু’টি নর-নারীর আসক্তি, পাপবোধ ও ভয়- এছাড়া কিছু নেই। ‘আস্তে আস্তে ডাউন ট্রেনের সময় নিকটবর্তী। যেন বা স্পষ্টতর ছিল তার ধ্বনি দূরে, যেন বা আমার বোধে স্পন্দিত… নরকে… নরকে থেকে নরকে। আমি ভয় পেলাম, গভীর প্রগাঢ় ভয়। ঘৃণা আমার ভালোবাসাকে।’এই সব গল্প প্রকাশের পর পশ্চিম বাংলার কলকাতাসহ বিভিন্ন জেলায় অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিন থেকে গল্প পাঠানোর অনুরোধ আসতে থাকে। দুই হাতে গল্প লিখতে থাকেন তিনি।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কলমে ধ্রুপদী রহস্য-সাহিত্যের ধারায় এক অনন্য সংযোজন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।যাঁর মাথা জোড়া টাক, ঠোঁটে চুরুট, অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি অফিসার, এখন প্রজাপতি ও পাখি দেখতে ভালোবাসেন।নিজেকে প্রকৃতিপ্রেমিক হিসেবে পরিচয় দিতে ভালবাসেন অথচ তিনি অনেক অপরাধ ও হত্যার কিনারা করে শখের গোয়েন্দাগিরি করেন৷ গোয়েন্দা কর্নেল পাঠকের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।রহস্যরোমাঞ্চ সেই সব গল্পের হাত ধরে প্রতিটি বাঙালি ঘরেই পৌঁছে যান বাঙালির প্রিয় কর্ণেল নীলাদ্রি সরকার আর সাংবাদিক জয়ন্ত।

সামনে চায়ের কাপ আর হাতে যেকোন একটা খণ্ড নিয়ে বসে পড়ুন, আর সোজা ঢুকে পড়বেন পাহাড়-জঙ্গল-পরিত্যক্ত খনি-নদী-ঝিল-কুয়াশা-খুনখারাপি আর অ্যাডভেঞ্চারের জগতে। ঘাবড়াবেন না, কারণ মনে রাখবেন যেখানে বিপদ, সেখানে কর্নেল।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘অলীক মানুষ’ উপন্যাসটি ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্কিম পুরস্কার – এসব ছাড়াও ভুয়ালকা পুরস্কার দ্বারা সম্মানিত। তাঁর ‘অমর্ত্য প্রেমকথা’ বইয়ের জন্য জন্য তিনি পেয়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত নরসিংহদাস স্মৃতিপুরস্কার। এছাড়া ১৯৭৯ সালে পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার । পেয়েছেন বিভূতিভূষণ স্মৃতি পুরস্কার,সুশীলা দেবী বিড়লা স্মৃতি পুরস্কার,শরৎচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার ইত্যাদি আরও অনেক পুরস্কার তিনি তাঁর সামগ্রিক সাহিত্য-কৃতিত্বের জন্য পেয়েছেন। তাঁর অনেক কাহিনী চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে, যেমন ‘কামনার সুখ দুঃখ’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘শঙ্খবিষ”।দীনেন গুপ্তের পরিচালনায় ‘নিশিমৃগয়া’। উত্তমকুমার অভিনীত ‘আনন্দমেলা’। অঞ্জন দাশ পরিচালনা করেছেন সিরাজের ছোটগল্প ‘রানীরঘাটের বৃত্তান্ত’ অবলম্বনে ফালতু। সিরাজের “মানুষ ভূত” কাহিনী চলচ্চিত্র ছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে মঞ্চে ক্রমাগত অভিনীত হয়ে চলেছে। এই স্কুল পালানো মানুষটিই ২০০৯ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট উপাধি পান।

২০১২ সালের ১৪ অক্টোবর তিনি বিরাশি বছর পূর্ণ করতেন। তার আগেই স্বল্প রোগভোগের পর তিনি অমৃতলোকে চলে গেলেন ৪ সেপ্টেম্বর। তিনি চিরশান্তিতে শুয়ে আছেন তাঁর নিজের গ্রামে, কিন্তু তাঁর সাহিত্য আজও অবিনশ্বর। বরেণ্য এই কথাসাহিত্যিক তাঁর বিপুল, বিচিত্র, বিস্ময়কর সৃষ্টি দ্বারা আমাদের মনে চিরস্থায়ী আসন গেড়ে নিয়েছেন।জীবন ও প্রকৃতির সমার্থক- সাহিত্যের এক আশ্চর্য অলীক পুরুষ তিনি।

 

তথ্যসুত্র::

  1. কর্নেল সমগ্র ,দেব সাহিত্য কুটীর, লেখক পরিচিতি।
  2. “ব্যতিক্রমী জীবনের কথাশিল্পী সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ”। কালি ও কলম।
  3. সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ রচিত ‘অলীক মানুষ’।

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × 2 =