চামড়া

কল্লোল চক্রবর্তী, হাওড়া ##

লজ্ঝর মার্কা টেবিল না বলে বলা ভালো দুটো সরু কাঠের পাটি – নড়বড়ে পায়ায় দাঁড়িয়ে যাতে না লড়খড়ায়, তার জন্যে কাপড়ের পাড় দিয়ে বেঁধে দুহাত তুলে দেখে নেওয়া। তখন নিবারণের গায়ে একসময়ের সাদা শার্ট। এখন তার কলার ফাটা, আর রঙ ঘিয়ের মতো। এরপর, কাজ শুরু। সন্ধের মুখ। স্টেশনের দো-চালা। তার একদিকে আলো জ্বলেনা।একটা ছাগল তার পরিবার নিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে সে এসে নিবারণকে আদর করে। আদরটা ঢুঁ হলে ধমকে তাড়ানো।এছাড়া, বেশ ভালোই। টেবিলের সামনে একটা ফ্লেক্স। তাতে লেখা সাপ্তাহিক লটারি। বিক্রিবাটা সেরকম হয়না। কেনে বেশির ভাগ সে লোকগুলো যারা সারাদিন মজুর খাটার পর ট্রেন ধরে ঘরে ফিরছে। তাদের পরনে লুঙ্গি, টেরিকটের শার্ট, গলায় প্যাঁচানো গামছা আর মুখ জুড়ে বোকা বোকা হাসি। ওরা বড়লোক হতে চায় কিনা জানা নেই। এর মধ্যে স্টেশানের আলোগুলো পুটপুট করে জ্বলে ওঠে। তখন একটা কাদারঙের বোতল থেকে টেবিলের ওপর গঙ্গা জল ছিটিয়ে এক কোণে সস্তার ধুপ গোঁজা।

লটারির টিকিট গুলো বেছানোর সময়, নিবারণের মুখে সিরাজি ভাবনার ছবি ফোটে। সেই যেন দীনদুনিয়ার মালিক। আর সামনে এই সন্ধে নামার মুখে আলোর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো, বেচারি সব। নিবারণের বড় মায়া হয়। নয় নয় করে দশ দশটা বছর। বেশ। কতবার আগে খেলার সময় বুক কাঁপত। এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। সে আর কোটিপতির স্বপ্ন দেখেনা। যদি হয় এই হ্যাবলা-ছ্যাবলাগুলোর কেউ একদিন বাদশা বনে যাবে। যাবে যাবে, তাতে তার কী, সে কিছু কমিশন পাবে। যে বনবে, সে এসে তো বলবেনা, ‘দ্যাখো আমি বাদশা বনেছি। বাদশা বেগম ঝম ঝমাঝম…’ আর মনে পড়ছেনা। কত কী মনে পড়েনা। যাক গে। মনে পড়েই বা কী, আর না পড়েই বা কী। কতলোকতো তার মতন, আর কারখানার ভেঁপু তাদের কানে ঢোকেনা। মরে বেঁচে থাকা। রোজ রাতে একবার করে বউয়ের চোখে স্বপ্ন তৈরির চেষ্টা করতে গিয়ে ফাটা গলার গালাগাল সব হজম করতে করতে সে নীলকন্ঠ। না! ডাউন কাটোয়া আসছে। খানিক দূরে প্ল্যাটফর্ম এর মাঝখানে স্টল দেওয়া বিল্টু বলল, ‘কোন গাড়ি আলাউন্স করল।’

‘কেন তুই কি কানে তুলা দিয়ে রাখছিস?’

বল্টুর কড়ে আঙুল, আধো আলো আধো ছায়ার ভেতর স্পষ্ট বোঝালো সে কোথায় গিয়েছিল।

নিবারণ হাল্কা চেঁচিয়ে বলল, ‘ডাউন কাটোয়া।’ বল্টু স্টোভ-এর আঁচ উসকে দিল। আর শরীরটাকে সামনে পেছনে করে হাত মাথার ওপর তুলে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে তেড়ে একটা গান ধরল। এসব দেখে নিবারণের মনটাও ভালো লাগল। ডাউন কাটোয়া থেকে বিস্তর লোক নামে। তবে, বাবুরা নেমেই যেন দৌড় লাগায়। তারা কখনও লটারি নিয়ে মাতামাতি করেনা। আগে করত।এখন তাদের আয়পয়ের সীমা নেই। ভাবতে ভাবতে ডাউন কাটোয়া ঢুকে গেল।

বা-রে! আজ কার মুখ দেখে উঠল? অ, আন্নাকালীর।অন্যদিন বউ ঘুম থেকে তুলে দিয়ে বলে, ‘চা করছি। গিলতে হলে গেলো। নাহলে আর করতে পারবনা।’

আজ কীযে দয়া হয়েছিল, ডাকেনি। আন্নাকালী চা নিয়ে এল।তখন তার ছ্যাঁচাবেড়ার ঘরের দেয়াল ফুঁড়ে রোদ ঢুকে পড়েছে। সে আলো চটা ওঠা মেঝেয় পড়ে একটা আভা তৈরি করে ঘোর কালো আন্নাকালীর মুখে পড়েছে। লটারিতে প্রাইজ না উঠলে এ মেয়েকে পার করা শক্ত।

     আজ কুড়িটা। নির্মল সরকার, যে লোকটা পাইকারি রেটে টিকিট দেয়, সে বলে, কালো জগতের আলো। তা মুখে বলা যায়। তোমার ছেলেটাতো বেশ বড় হল। গঞ্জে দোকানে বিকেলটা বসে। চেহারাপত্তর ভালো। পেটাই যাকে বলে। মাজা গায়ের রঙ। বাহার করে দাড়ি রাখা। কোঁকড়া চুল। সাদা শার্ট, কলার তোলা। হাতা কনুইয়ের কাছ অব্দি গুটোনো। তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা বেশ শক্ত। এরকম জামাই যে পাবে, তার ভাগ্য লটারির টিকিটের চেয়ে দামি।

আন্নার মুখটাতো খুব মিষ্টি, পাড়ার বউ-ঝিরা বলে । শুধু চামড়াটা…

     এর মধ্যে নিবারণ মনে মনে কয়েকবার পাড়া আর বাড়ি করল। সেইতো রেল লাইনের ওপার। গুডস শেড ছাড়িয়ে একটা জংলি পথ। দুপাশে কালো আর খয়েরি বাকলের ভিড়। তাদের ঘন বাদামি-কালো ডালপালা, কিছু পাতা, ছায়া। ছোট চারাও অনেক।এরপর অনেকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে কবেকার একটা পুরোনো গাছ, ডালপালা মেলে ছড়িয়ে আছে। তার পাশে এক ডোবা। একটু ঢাল। তার ওপর তার রাজপ্রাসাদ। একটা হেলে পড়া ঘর। তার বউ গুল দিয়ে দাঁত মাজে। ডোবার পাড়ে বসে মুখ ধোয়, আর পিচিক পিচিক করে মুখের ভেতরের জল ছুঁড়ে দেয় এদিক ওদিক। আন্নাকালী ফিরল। তার পিঠে বইয়ের বোঝা। পড়ন্ত বেলায় আরও ঘোর কালো ওর মুখ। এরপর সন্ধে নামল। বাড়ির পেছনের বন্ধ ইটভাটা, খালপার, তার গা ঘেঁসে দক্ষিণে কারখানা। তার দেয়াল বেয়ে গাছ। জঙ্গল।ওখানে দীর্ঘশ্বাস হাওয়ায় মিশে আছে।লটারির টিকিটে প্রাইজ উঠলেও উঠতে পারে।বন্ধ কারখানা খোলার কোনো চান্স নেই। প্রত্যেক দিনকার এই রোজনামচার মধ্যে একঘেয়েমি থেকে বাঁচতে তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনে আন্নাকালীর ভবিষ্যতের কথা ভাবে। কোনো আশা সে ভাবনার ভেতর ধরা পড়েনা। এইসব কথার ভেতর কথা চালাচালি করতে করতে কখন আরও রাত নামে। বল্টু গান গাইতে গাইতে ডেকচি, কেটলি মাজে।

কাজ শেষ হলে বল্টু নিবারণের কাছে এসে দাঁড়ায়, বলে, ‘এবার গুছোও বস।‘

‘হুঁ।’

বল্টু বেশ আছে। ছাব্বিশ সাতাশ বছর বয়েস, বিয়ে করেনি। আচ্ছা, আন্নাকালীর সঙ্গে বল্টুর। না-না। সারাজীবন সেই একই কষ্ট।না! থাক।

বল্টু বলল, ‘চলি বস।’

‘আমিও যাব।’

‘তোমার দেরি হবে বস।’

‘বাড়ি গিয়ে কোন বাঘটা মারবি? বিয়ে থা করিসনি, মজায় আছিস।’

‘বিয়ে করতে বলছ?’

‘হুঁ।’

‘না বস। খাওয়াব কী? তাছাড়া ওরা তো দুটো ভাত পেয়ে খুশি থাকবেনা। কত কী মেয়েদের লাগে। সাজগোজের জিনিসগুলোর দাম জানো?’

‘হুঁ।’

‘আজ চলি,’ বলে, বল্টু চলে গেল।

স্টেশনটা বড্ড ফাঁকা। ঘোষক চলে গেছে। মেশিনের মেয়েটার গলাও বন্ধ। তখন একটা ডাউন ট্রেন আসে।

মুখটা যেন পোড়া। বয়েস নিবারণের মতই।ঘন সবুজ শাড়ি। তার কনুই অব্দি লাল ব্লাউজ। সিঁথিতে গাঢ় সিঁদুর। মাথার পেছনে বিশাল একটা জটা। পায়ে প্ল্যাস্টিকের চটি। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। সে এসে নিবারণের সামনে দাঁড়িয়ে।

সে বলল, ‘লটারি ব্যাচো?’

‘হুঁ। কেন, নেবে?’

‘না।’

‘অ।’

‘বিয়ে করেছ?’

‘হুঁ,’ বিরক্তি একমুখ নিয়ে নিবারণ জবাব দিল।

‘ছেলেপুলে কী?’

‘আপনাকে আমি চিনিনা।’

‘চিনতে কতক্ষ্ণণ লাগে?’ এই বলে সে অদ্ভুত এক হাসি হাসল।

পেছন থেকে ছাগলটা ব্যা করে ডাকতে জটাউলি বেশ শব্দ করে হেসে উঠল।

এ কীরে! কে? ভাবতে ভাবতে সে ফ্লেক্সটা খোলা শুরু করল।

‘গুটোচ্ছ?’

‘হুঁ।’

‘বললেনা ছেলেপুলে কটা?’

‘তুমি তোমারটা বলো। তারপর আমি বলব।’

‘সে নাহয় বলব। তবে তুমি বললে তোমার কাজে লাগবে।‘

‘মানে?’

‘আগে বলো।‘

‘তুমি পুলিশের লোক নয়তো।’

‘না।’

‘কী যেন জানতে চাইছিলে?’

‘তোমার ছেলেপুলে।’

‘ছেলে আবার পুলে। হুঁফ।‘

‘নেই?’

‘আছে। একটা। মেয়ে।’

‘বেশ। কেমন দেখতে?’

‘তুমি কি ঘটকালি করো?’

‘না।’

‘তবে, তোমাকে আমি না জানি না চিনি।রাত ও হয়েছে। তাছাড়া কার কী মনে আছে…’

‘এটাই বড় দুঃখের গো। দিনকাল এমন হয়েছে, গরিব মানুষও গরিব মানুষকে বিশ্বাস করেনা। গরিব মানুষরাতো এক ঠাঁই হলে পারে। তাদের মধ্যে আবার লাল নীল হলদে সবজে কত ভাগ। কত ঢং।’

‘অত ভনিতা না করে খোলাখুলি বলোতো, ব্যাপারটা কী?’

‘তোমার মেয়েকে দেখতে কেমন বলছনা। অসুবিধে আছে?’

‘অসুবিধে, কীসের অসুবিধে। ওর মুখ চোখ খুব সুন্দর। গায়ের রঙটা একটু ময়লা এই যা।’

‘ময়লা মানে কীরকম, কয়লার মতো?’

‘অতটা নয়।‘

‘বুঝেছি। বাপতো…’ বলতে বলতে সে তার ঝোলা ব্যাগের আটকে যাওয়া চেনটা টানাটানি করে খুলে ফেলল। একটা ভাঁজ করা কাগজ বার করল। বলল, ‘দ্যাখো।’

‘এতো মেমসাহেবের ছবি। দুধের মতো গায়ের রঙ। দাঁড়াও। এটা দেখাচ্ছ কেন? সোনালি চুল! কার ছবি এটা?’

‘তোমার মেয়েকে যদি এরকম দেখতে হয়ে যায়?’

‘য্যা!’

‘হবে গো। হবে।’

‘একদম এরকম! আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা, মাইরি বলছি,’ ফটোটা হাতে নিয়ে নিবারণ বকে যায়, ‘এরকম হলে রাজার বাড়ি থেকে লোক আসবে, চৌদোলায় করে নিয়ে যাবে। না না কী বলছি! রাজা কোথায় এখন। রাজা না রাজা না। বড়লোক বাড়ি। বলো বড়লোক বাড়ি। কত বড়। পাঁচিল। উঁচু পাঁচিল। তুমি সত্যি বলছ, সত্যি।’

‘তবে মেয়েকে তোমাদের ভুলে যেতে হবে।’

‘কেন?’

‘সে বাড়িতে তোমার আমার মত হাড়হাভাতের জায়গা হবেনা।’

‘মেয়েকে দেখতে পাবনা!’

‘তোমার পরিচয় কিছু আছে?’

‘আমি, আমি নিবারণ ঘোষাল। শালা আধার কার্ড, সেখানে ঘোষালের এইচটা মারেনি। কী হারামি বলো!’

‘থাক থাক ও পরিচয় নিয়ে কী করব। ছাড়ো। ফটোটা দাও, আমি চলি।’

‘কিছু বাগানোর ধান্ধায় এসেছিলে?’

‘তুমি মতলবের কথা বলো। নাহলে হাঁটা দি।’

নিবারণ রেগে গিয়ে বলল, ‘তাহলে নাচালে কেন?সব ফলস। শালা।’

তখন ঝমর ঝম ঝমর ঝম করে মালগাড়ি স্টেশন কাঁপিয়ে যাচ্ছে। রাতের কোনো আলো থাকে তাতেই সে ছায়া ও আলো ফেলে যাচ্ছে। নিবারণ সেই ফাঁকে মেয়েটাকে দেখছে। রেল স্টেশন অদ্ভুত একটা জায়গা। কত মানুয আসে। কত গুল মারে। দিনকে রাত করার মাস্টার। এও তাই ঢপের চপ।

জটাওলি মালগাড়ির ঝমঝমের মধ্যে বলে উঠল, ‘তুমি গরিব। আমিও গরিব। তোমাকে ঠকাবো না। মেয়েকে নিয়ে এসো। আজ রাতেই ওর চামড়াটা বদলে দেব।‘

‘টাকা কত লাগবে?’

‘যা লাগে লাগবে।‘

‘মেয়েটা আমার ঐ ছবির মেমসাহেবের মতো হয়ে যাবে?’

‘হ্যাঁ।’

‘তুমি যদি অনেক টাকা চাও। পারবনা। পারবনা দিতে।বিশ্বাস করো। তখন তুমি আবার ওকে কালো করে দেবে?’

‘না। তবে আমারও তো পেট আছে, বলো?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ সে তো বটেই। সেতো বটেই।‘

জটাওলি মোবাইল নম্বর দিয়ে বলে গেল রাতেই ফোন করতে।

একটা কাচ ঢাকা কালো গাড়ি মুম্বাই বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে চলেছে, মেরিন ড্রাইভ ধরে। আরব সাগরের কিনারা ছুঁয়ে। কয়েক মিনিট বাদে তা পৌঁছে গেল এক সাত তারা হোটেলে।

রুম নাম্বার ২০৬। সাগরের দিকে জানলা। পরদা সরিয়ে সে কাচের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে রইল পড়ন্ত বেলার সাগরের দিকে। সে সময় তার ফোন বেজে উঠল। সে সোনালি চুল কানের পাশ থেকে সরিয়ে ফোনটা ধরল।

সে বলল, ‘ভালো আছি।‘

তার পর সে অনেকক্ষণ কথা বলতে চাইল। আয়নায় একবার নিজেকে দেখল। তার সারা শরীর জুড়ে এক দ্যুতি। তার চোখের মণি নীল। সেখানে দুঃখ জড়ো হয়ে রয়েছে।

সে শুনল, ‘তোকে কতদিন দেখিনি। একবার আয়। বাড়িটা তোর মনের মতো করে করেছি।‘

এবার সে চুপ করে রইল। তার গাল বেয়ে চোখের জল। কান্না চেপে বলল, ‘যাব।’

তার পেছন থেকে কে যেন অসভ্য গলায় ধমকে উঠল, ‘কিস সে বাত হো রহী হ্যায়? শালি। রান্ডি। মাদারচোদ।‘

সে পেছন ফিরে ধেড়ে শুয়োরটাকে দেখল না। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × five =