চোরকাঁটার সোনাঝুরি

ত্রয়ণ চক্রবর্তী, কলকাতা 

 

এই জায়গাটায় এমন নামের পাহাড় কেন?  ‘চোরকাঁটা পাহাড়’ আবার পাহাড়ের নাম হয়? অপর্ণা প্রশ্ন করে ইন্দ্রনীলকে?

কি জানি, হয়তো চোরেরা এই পাহাড়ে পাথরের নিচে চোরাই মাল লুকিয়ে রাখত আর সামনে রেখে দিত কাঁটার ঝোপ। সেই থেকেই নাম। ইন্দ্রনীল উত্তর দেয়।

ওরা দুজনেই বসে আছে দুটো পাথরের ওপর।

পাহাড় বলতে যে বিরাট, বিপুল জিনিসটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুম করে, চোরকাঁটা ঠিক তেমন নয়। নিচের দিক থেকে খাঁড়াইয়ের বেশিরভাগটাতেই পাথর নেই শুকনো নোনা ধরা মাটি। মাঝে মাঝে বড় পাথর আর একেবারে ওপরে মস্ত কিছু পাথর। তবু সেগুলোকে ছোঁয়া যায়, চেনা যায়, মনে মনে চুরি করা যায়।

দৃশ্যপটের উল্টোদিকে একই মাটি, বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে। খানিক দুরে দুরে দুরে সোনাঝুরি। পাশাপাশি দুটি গাছ দুজনকে ধরতে না পেরে মাঝে মাঝে হাওয়া শূন্যতার মধ্যেও মাথার পাতাগুলো দিয়ে পরস্পরের পরস্পরকে স্পর্শ করে নিচ্ছে অকাতরে। বলতে চাইছে, চিন্তা নেই রে, আমি আছি।

এই জায়গার আসল আনন্দ নিঃশব্দতায়, নিঃস্তব্ধতায়।

অপর্ণা ইন্দ্রনীল চুপচাপ দুটি পাথরে বসে আছে। স্মার্টফোন বার করে বারবার ছবি তোলার ইচ্ছাও জন্মাচ্ছে না ওদের। প্রকৃতি যেন তার ফোটোকপি যন্ত্রে ওদের তুলে রাখছে। এখন ওরা ছবিওয়ালা নয়, নিজেরাই ছবি। শিকারী নয়, শিকার, প্রেমিক-প্রেমিকা নয়, ভালোবাসা।

অপর্ণা বসেছিল যে দিকে, সূর্য তার উল্টো দিকে। শীতের দুপুরের রোদ এসে পড়ছিল তার মাথায়, চোখে, মুখে। তেরছা ভাবে চুল ভেদ করে ঠোঁটে পড়ছিল রোদ্দুর। ইন্দ্র মাঝেসাজে তাকাচ্ছিল আড়চোখের চোরা দৃষ্টিতে। মনে মনে আসছিল, এই মুখের আলো দেখে ভোলা যায় যে কোনও কষ্ট। মুখে বলল,  তুমি সরে বসো, রোদটা সরাসরি মুখে পড়ছে।

উত্তরে অপর্ণা বলল, তোমায় ওতো দেখতে হবে না।

দুজনের চোখেই একটা সম্পাদনের ইঙ্গিত। মনে কোথাও কোনও অবিশ্বাস নেই কারুর প্রতি।

– এই সামনের পাহাড়টার কি নাম বলতো? উত্তরের আশা না করেই অপর্ণা বলল, ‘প্রলয়দা বলল নান্না পাহাড়’, দাড়াও ওপরের বড় টিলা থেকে একবার দেখি কেমন লাগে ওকে? ‘নান্না না বড়া’।

প্রমোদ গুনল ইন্দ্র, না, না, বলছি তো না।

ধপ, ধপ, ধপ করে সোজা নিচে নেমে গেল অপর্ণা। মাঝে বলতে বলতে গেল,  ধ্যাত, এই অভিবাবকগিরিদের সঙ্গে কেউ ঘুরতে আসে। প্রলয়দাই ওদের এই জায়গাটায় ঘুরতে এনেছেন।

ইন্দ্র ওখানেই বসে একটা সিগারেট ধরায়,  মনে মনে বলে, আমার বলার উদ্দেশ্যে তো ওকে আটকানো নয়, ভয়। যদি কোনও কিছু হয়। আমি কোথায় যাবো! আমি তো ওর চেয়েও অসহায়।

নীচে নেমে ওরা নান্না পাহাড়ের দিকে একবার গেল বটে কিন্তু কথা আর হল না। দুজন দুদিকে, প্রলয়দা বোঝেন, তাই কথা বাড়ালো না। আজই ওদের ঘোরার ছুটি, ঘরে ফেরার দিন। এনএইচ ইতিমধ্যে ধরা হয়েও গেছে। আবার দৌড়। সেই গতিময়, যেখানে প্রতি মুহুর্ত দৌড়াচ্ছে। জীবনের গায়ে আলতো হাত বুলিয়ে জীবনে এখানে কেউ জিজ্ঞেস করে না, জীবন কেমন আছো? এখানে জীবনকে নিয়ে সবাই ছুটতে চায়। কোথায়? কার পিছনে? কেউ জানে না।

গড়িয়াহাট মোড়ে গাড়ি থামলো,  ইন্দ্রনীল নেমে গেল। ভিতর-বাইরে চারটে চোখ করুণ। প্রলয়দার চোখ লাল লিগন্যালের সময়ের দিকে, ইন্দ্র গাড়ির সিটে ইশারা করে চোখ নামিয়ে চলে গেল, অপর্ণা দেখল দুটো সোনাঝুরি পাতাও চোরকাঁটা পাহাড় থেকে চলে এসেছে গাড়িতে করে, কলকাতার ব্যস্ততায়। পাতা দুটো চেপে ধরে শীতের শেষ বিকেলেও রোদচশমা পড়ে নিল অপর্ণা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

16 − 7 =