জীবনের পাঠশালা

শ্যামলী রায়, কলকাতা ##

ঘরের ভেতরে পা দিতেই ভাস্করের ফোন। “তুই আজ বাড়ি এলি আমি যেতে পারলাম না? আটকে গেলাম। কাল যাচ্ছি তোর কাছে।”

সুজাতা “হ্যাঁ অবশ্যই কাল দেখা হবে। এখন খুব ক্লান্ত রে। রাখি?” ফোন রেখে বসে সুজাতা। আবাসনে ঢোকার সময় আজ প্রচুর মানুষ তাকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন।   মেয়ে আজ টানা পনেরো দিন কোভিড পেশেন্ট অ্যাটেন্ড করে বাড়ি ফিরেছে।  চব্বিশ ঘণ্টা পি.পি.ই পরে নার্সিং করতে করতে কখন খাওয়া কখন ঘুম কিছু ঠিক ছিল না। কি নিদারুণ কষ্ট করে তারা কাজ করে চলেছে সে তারাই জানে। ফিরে এসে এই অভ্যর্থনাটা পেয়ে সে স্বভাবতই খুব খুশি। এদিকে রমার মনে ভীড় করে আসে সেদিনের কথা। বিয়ের পর মোটামুটি সে মানিয়ে চলতে পারত। তাপস একটু বেশি মাতৃভক্ত এছাড়া কোন অসুবিধে ছিল না। দুবছর না যেতে শাশুড়ি বাঁজাটাজা বলে অসন্তোষ জানাতে লাগলেন। নাতির মুখ দেখার জন্যে অধৈর্য হয়ে উঠলেন। অবশেষে রমার মাতৃত্বের সম্ভাবনা দেখা দিল। ভয় ছিল রমার যদি মেয়ে হয় তাহলে কি হবে। সেই মেয়ে হল তার সুজাতা। জন্মের পরই শাশুড়ির নির্দেশে মেয়ে সহ তাকে বাবার বাড়ি রেখে যায় তাপস। আর কোনদিন আসেনি। রমার বাবা এই আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে কোনও দিন মেয়েকে ঐ অপমানের মধ্যে ফিরে যেতে দেননি বরং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিভোর্স করিয়ে দিলেন। রমার কোন আপত্তি ছিল না। এই অন্যায় সেও মেনে নিতে পারে নি। সুজাতা দাদুর বাড়ি হেসে খেলে বড় হয়ে গেল। রমা একটা ছোটখাট স্কুলে কাজ করতে শুরু করল।  সুজাতা একটু বড় হবার পর সবই জেনেছে আর মায়ের সাথে একসাথে লড়াই চালিয়েছে। নার্সিং পড়ছে নিজের ইচ্ছেতে। দাদু দিদা গত হলেন। সুজাতার চাকরি পাকা হবার পর তারা উত্তরপাড়া দাদুর বাড়ি ছেড়ে সল্টলেকের এক আবাসনে চলে আসে তার কাজের জায়গায় যাবার সুবিধে হয় তাতে।

রমা নিজের কাজটা ছাড়েনি এখনও বরং উত্তর পাড়ার বাড়িতে কয়েকটি বাচ্চাকে আশ্রয় দিয়ে কিছু একটা করতে চায়। “জীবনের পাঠশালা”, তবে জীবনের পাঠশালা-র সব  ভাস্করই দেখে। স্কুলের চাকরির পাশাপাশি এই সব কাজ নিয়ে ছেলেটি রমা আর  সুজাতার পরম আশ্রয় হয়ে উঠেছে। সুজাতা আর ভাস্কর একসঙ্গে পড়াশোনা করেছে বন্ধুত্ব অনেক দিনের। এবার হয় তো সেটা ভালবাসায় পরিণত হয়েছে।

সন্ধে হতেই আবার ভাস্করের ফোন। 

—সু কেমন আছিস?

-ভাল। তুই কাল আসবি তো?

—হ্যাঁ রে অবশ্যই। তবে এদিকে একটা ঝামেলা হযেছে। যে ভদ্রমহিলাকে সেদিন তোর সাহায্য নিয়ে ভর্তি করেছিলাম তিনি তাঁর বাড়ি থাকতে চাইছেন না ওনার ভয় হচ্ছে বস্তির লোকজন করোনার কথা জানতে পারলে থাকতে দেবে না। আমি কাউন্সিলরকে ডেকে বস্তির মানুষের সঙ্গে কথা বার্তা বলেছি। সকলেই সাহায্যর আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু উনি চাইছেন কোন আশ্রম টাশ্রমে যেতে। আমাকে ভীষণ অনুরোধ করছেন। কি করা যায় বল তো? “

সুজাতা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে” আমরা ওনাকে পাঠশালায় রাখতে পারি তো! মাকে বলছিলাম ওই মহিলার কথা। ছেলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে শুনে মা ও খুব রিঅ্যাক্ট করছিল। তুই কালকেই ওনাকে নিয়ে আয়। আমি মাকে বলে রাখছি।” তখনকার মত সমস্যা মিটল। রমা সব শুনে রাজি হয়ে গেল। তাদের বাড়িটা দোতলা অনেকগুলো ঘর।  না হয় আরো একজন আশ্রয় পাবে। 

পরদিন শনিবার ভাস্কর এসে সব কথা জানায় রমাকে। সুজাতার  সঙ্গে গল্প হয়। সাধারণতঃ শনিবার রবিবার ওরা উত্তর পাড়ার বাড়িতেই থাকে।   রবিবার সবাই গেল “জীবনের পাঠশালায়”।

রবিবার ওখানে কিছু কাজ থাকে। সব হিসেব পত্র করা, কাজের লোকদের সঙ্গে কথা বলা,  সুবিধে অসুবিধে সব ঠিক করা ইত্যাদি। রবিবার ওরা পৌঁছতেই বাচ্চারা হৈচৈ করে এসে ঘিরে ধরে। জানে সেদিন ওদের জন্য অনেক গিফট চকোলেট এসব আসবে। কিছুক্ষণ পরে ভাস্কর ঐ মহিলাকে নিয়ে আসে রমার কাছে পরিচয় করবার জন্য। ছিমছাম সুশ্রী বয়স্ক মহিলা পরিস্কার শাড়ি পড়া, মাথায় অল্প ঘোমটা দেওয়া। ভদ্র সম্ভ্রান্ত বাড়ির মানুষ বলেই মনে হয়। ভদ্রমহিলা সামনে এসে দাঁড়াতে রমা চেয়ার থেকে ছিটকে ওঠে —

“একি! আপনি? আপনি কি করে এখানে এলেন?” সুজাতা বলতে যায়

“মা উনিই তো সেই…….”

ততক্ষণে ভদ্রমহিলাও হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠেন

“রমা তুমি? আমায় ক্ষমা করো মা ক্ষমা করো। আমি যে অন্যায় তোমার সঙ্গে করেছি ভগবান আমায় তার শাস্তি দিয়েছেন। আমার কোথাও যাবার জায়গা নেই।  তপু আমায় বৌ-এর কথায় বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। তুমি আমায় বাঁচাও।”

সবাই চুপ, শুধু সুজাতা ফিসফিসিয়ে “ঠাকুমা!” বলে ওনাকে ধরে বসায়। একটু ধাতস্থ হয়ে রমা কথা বলে –

” ক্ষমা করার আমি কে বলুন। বরং ভগবানের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করুন।  আপনার ছেলে আপনার কাছ থেকে যে শিক্ষা পেয়েছে আপনি তারই ফল ভোগ করছেন। আর কান্নাকাটি করবেন না। এখানে থাকুন আপনার কোনও কষ্ট বা অযত্ন হবে না। বরং বাচ্চারা এক জন ঠাকুমা পাবে। গল্প বলবেন ওদের। কি —পারবেন না? “তারপর খুব সহজ স্বরে ডাকে” ভাস্কর সু পপি বুলি ভুটকা যা ঠাকুমার ঘরটা ঠিকঠাক করে সাজিয়ে দে আর এবার থেকে ঠাকুমার কাছে রোজ গল্প শুনতে পাবি তোরা।

বাচ্চারা আর ভাস্কর সুজাতা চল ঠাকুমা বলে হৈ হৈ করে দোতলার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়, সুজাতা শুধু একবার পিছনে ফিরে মাকে দেখে —রমা তখন দুহাত মুখ ঢেকে মাথা একটু নামিয়ে টেবিলে কনুই ভর দিয়ে বসে।

One thought on “জীবনের পাঠশালা

  • December 20, 2020 at 10:35 pm
    Permalink

    খুব ভালো লাগলো ।মানুষকে তার কৃত কর্মের ফল এ জীবনেই পাতে হয় ।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nine − nine =