দেবেশ রায় ব্যাতিক্রমী গদ্যকার

আবদুস সালাম ##

    দেবেশ রায় ১৭ই ডিসেম্বর ১৯৩৬ ___১৪ই মে ২০২০

অবিভক্ত বাংলার পাবনা জেলার বাগমারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ক্ষীতিষ রায় মাতা অপর্ণা রায় ।১৯৪৩ সালে তারা চলে আসেন জলপাই গুড়ি। ছাত্র রাজনীতি আর জনদরদী  মানুষ বলেই তার পরিচিতি ।

এই মূল্যবান পুঁজি করে হাতিয়ার করে রাজ্য রাজনীতি তে তার  প্রবেশ। আজীবন থেকে গিয়েছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির হোলটাইমার। ১৯৬২  সালে ৬ই মে  কাকলী দেবীর সাথে  পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন ।

 রাজনীতির সূত্র ধরেই তার রাজবংশী ভাষার সাথে মানুষের সাথে সখ্যতা। পরবর্তী কালে যা তাঁকে এনে দিয়েছিল বিরলতম সম্মান। 

   ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯সাল পর্যন্ত পরিচয় নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। এর মাধ্যমে তার অচিরায়ত ভাবনা কে মেলে ধরেছেন।আর পাঠক সমাজ কে নতুন ভাবনার জালে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। কমিউনিষ্ট পার্টির সাথে যুক্ত হওয়ার সুবাদে  বিভিন্ন জনজাতি, জনপদে নির্মিত আন্দোলন, তাদের জীবন যাপনের কড়চা দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন।এই অভিজ্ঞতার আলোকে তার সাহিত্য ভাবনার বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ,যাপন চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। কলকাতার ট্রেড ইউনিয়ন এর সাথে যুক্ত হয়েছিলেন।  এই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ভাতা নিয়ে আন্দোলন আর মালিক শ্রমিক সম্পর্কের টানাপোড়েন তার কোমল হৃদয় কে নাড়া দিয়েছিল।তাঁর ফলস্বরূপ বিভিন্ন গল্প , প্রবন্ধ লিখেছেন হৃদয় মথিত উপলব্ধি নিয়ে।

তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় জলার্ক পত্রিকায়। এবং বেশ সাড়া পড়ে পাঠকের দরবারে। তিনি প্রচলিত ধারার বাইরে এসে  নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করতে শুরু করলেন তার রচিত গল্প উপন্যাস কে। এই সময় তিনি বেশ কিছু গল্প গ্রন্থ আমাদের উপহার দিয়েছেন। প্রথম উপন্যাস  (যযাতি), মানুষ খুন করে কেন১৯৭৬, মফস্বলী বৃত্তান্ত ১৯৮০, তিস্তা পারের  বৃত্তান্ত ১৯৮৮,    সময় অসময়ের বৃত্তান্ত ১৯৯৩ লগনগান্ধার ১৯৯৫ । অনুবাদ করেন রোমিও জুলিয়েট ,ট্রয়ের মেয়েরা, প্রবন্ধের বই  আঠারো শতকের বাংলা গদ্য ও উপনিবেশ শাসনের  সমাজ ও বাংলা সাংবাদিক গদ্য , বিপরীতের বাস্তব ও রবীন্দ্রনাথের গল্প, উপন্যাস নিয়ে উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজ, ব্যাক্তি পুরুষেরা, রবীন্দ্রনাথ ও তার আদি গদ্য। আজীবন তিনি  সেতু বন্ধন নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

      তাঁর গদ্য রীতি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান সম্পদ। তিনি ছিলেন বাংলা কথা সাহিত্যের বিষ্ময়। তিনি নিজস্ব ঘরানার সাহিত্য আমাদের উপহার দিয়েছেন। তিনি বাহিরবিশ্বের সমাজ ওব্যক্তি মানুষ কে আশ্চর্য  নৈপুণ্যে গভীর সংবেদনশীলতার তরঙ্গে তরঙ্গায়ীত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। চাবাগানের মানুষ ও তাদের  সুখ দুঃখের ইতিহাস, জীবন যাপনের অবহেলিত মানুষের ইতিহাস ভূগোলের লেপ্টে থাকা চিন্তা ও চিত্র তুলে ধরেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। তিনি বাংলা সাহিত্যের বিষ্ময়। সমাজ বিশ্বের সাথে ব্যাক্তি মানুষ কে  নৈপুন্য চাতুরীতে  উদ্বেলিত করতে থাকেন। সমগ্র জীবন জুড়ে দেখেছেন দেশ কাল ,প্রান্ত প্রান্তিকের দ্বন্দ্ব ,ভন্ড প্রতিরোধ। বাস্তব এবং ভাবনার যে চিরায়ত  দ্বন্দ্ব তাকে তিনি অনবদ্য নৈপুন্য চাতুরীতে উদ্বেলিত করেছেন।

      ইতিহাস পুরাণ এর সাথে বাস্তবতার আলোকে মানুষ কে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছেন বারবার। তাঁর সমগ্র রচনাবলী তে আমরা খুঁজে পায় সমাজ সংসার , অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ নিয়ে তুচ্ছাতিতুচ্ছ আলোচনা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তুকে ভবিষ্যতের  উপাদান হিসেবে পাঠকের দরবারে হাজির করেন এটাই তাঁর।   সাহিত্যিক আত্মার বিশেষত্ব।প্রতিকী ও সংকেতময়তা তার লেখায় আমরা খুঁজে পাই। সাধারণ মানুষ সবসময় ভীত ও সন্ত্রস্ত। নিরাপত্তা হীনতা  তাকিয়ে জড়িয়ে ধরে। নিজের ভাবনা অপরের গায়ে চাপাতে পারে না। মানুষ মরতে চায় না ও যেন সবসময় মারতে চায়। তাঁর আখ্যায়ীত চরিত্রে ঘটনাবলী প্রবাহিত হয় নৈবেক্তিক জলধারার মতো। তাঁর সাহিত্যের চরিত্রের ঘটনা,কথক ভাষ্য, অতীত, বর্তমান ভবিষ্যৎ, সংবাদ, রেডিও, সরকারি তৎপরতা, সরকারি নিস্কৃয়ীতা, চায়ের দোকানের আলোচনা,অরন্য বাস্তব অভিজ্ঞতা,হাসি কান্না, কৌতুক সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। তাঁর কলমের যাদুতে সব আখ্যান  শিল্প হয়ে যায়।

   তাঁর উপন্যাসে ঘটমান চরিত্রাবলীর প্রবাহ ভিন্ন ভাবধারায় আবর্তিত হতে থাকে। তিনি তাঁর উপন্যাসে প্রথমে  উপন্যাসিক হয়ে ঘটনা প্রবাহ সাজান পরে পাঠক হয়ে তার সমালোচনা করেন। পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেন ঘটনা প্রবাহের। যা অন্যান্য উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই না। বিরলতম ধারার প্রয়োগ তিনি করেছেন। এবং পাঠক মহলে যথেষ্ট সাড়া ফেলে দিয়েছেন। একদিকে তিনি চরিত্রের স্রষ্টা অন্য দিকে তার সচেতন সমালোচক। গতানুগতিক  উপন্যাসে  এমন আমরা সচরাচর দেখি না। আর দেবেশ রায় এর বিশেষত্ব এখানেই। পাঠক ও লেখকের মেলবন্ধন তৈরী করতে চেয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি একজন সচেতন ভাবুক। দেশীয় ভাবনার ঐতিহ্যকে সবসময় তুলে ধরতে চেয়েছেন। তিনি তাঁর লেখায় মিথকে ব্যবহার করেছেন নিপুণ ভাবে। তিনি তাঁর উপন্যাস গল্পের চরিত্র চিত্রনে পালাকীর্তন, মঙ্গল কাব্য , গ্রামীণ বচন তুলে ধরেছেন বারবার। তিনি সবসময় চেয়েছেন বিকল্প আদর্শ খুঁজতে। সাহিত্যের আঙিনায় বিকল্প আদর্শ খুঁজতে, চরিত্র নির্মাণে, এবং সুদীর্ঘ জীবন চর্চায় গুরুত্ব দিয়েছেন আত্মভাবনাকে আত্মসম্মানকে। এখানে তিনি কারো সঙ্গে আপোস করেননি ।

   তাঁর ব্যক্তিগত আত্মপোলব্ধিতে বারবার বলেছেন  “লেখকের মান যখন আপোষ করে বাজারী পণ্যের সাথে  তখন লেখক পরিকল্পনা হীন, অগভীর পৌনঃপুনিকতায় লেখকের স্বাধীনতা বারবার খর্ব হয়। তাঁর এই  বিকল্প আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে এক একটি লেখা কে পাঁচ সাত বছর ধরে ঝাড়ায় বাছাই করতে দ্বিধা করেন নি। তিনি কখনোই সস্তা চটুল প্রচার চাননি। তাঁর  বিকল্প আদর্শ  প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে  সচেতন ভাবে নতুন গদ্য রীতির আশ্রয় নিয়েছেন। স্বাধীনতা উত্তর ভারতে  বিশশতকের শেষের দশকগুলোতে দেশ দুনিয়ার পরিবর্তিত পরিস্থিতি, উত্তর উপনিবেশিক দুনিয়া, পুঁজি বিনিয়োগের  নিত্য নতুন  শ্রমজীবী মানুষ ঠকানোর নবনব কৌশল, শ্রমিক মালিকের সঙ্গে অম্ল সম্পর্কের নতুন নতুন নকশা, রাষ্ট্র ক্ষমতার  নিষ্পেষণে সাধারণ মানুষের জীবন্ত বাস্তবায়ন স্বনামধন্য সাহিত্যিক স্বত্ত্বাকে বারবার নাড়া দিয়েছে। আজীবন  কমিউনিস্ট পার্টির হোলটাইমারকে বাস্তব নিষ্পেষণে জর্জরিত সমাজ মনোগত দিকে বিধ্বস্ত করেছে ।

 সাহিত্যিক দেবেশ রায়ের বিশেষত্ব হলো আধুনিক উন্নয়নের সমস্ত প্রক্রিয়াকে প্রত্যাখ্যান করা। এই দিকটি তার সবচেয়ে দুর্বল দিক। তিনি ভেবেছিলেন উন্নয়ন পুরাতন প্রথাতেও সম্ভব। তবে এটি যে ধীরে ধীরে আসবে এটা তিনি কেন মাথায় আনার চেষ্টা করেননি কে জানে।

       দেবেশ রায় একদিকে উপন্যাসিক, গল্প কার, প্রাবন্ধিক, সমালোচক এবং প্রখর এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সি পি আই এর উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি যে কত  দাপুটে লোক ছিলেন একটি ঘটনা তা প্রমাণের পক্ষে যথেষ্ট। “মোরারজি দেশাই তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। উত্তর বঙ্গে বন্যা নিয়ে এক বৈঠকে তিনি ও আমন্ত্রিত। বৈঠক চলাকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা দেয় মতবিরোধ। দাপুটে নেতা তার বাস্তব অভিজ্ঞতা এই বৈঠকে তুলে ধরতে চাইছেন। অন্যদিকে  প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই তাকে বারবার থামাতে চেষ্টা করছেন।” সাট্ আপ ” বলে বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসেন।

২০০৬সালে প্রকাশিত ব্যক্তিগত ও গোপন ফ্যাসিবাদ একটি বইও তিনি লিখেছিলেন। মার্ক্সবাদ যে কোন পূর্ব নির্দিষ্টতায় বিশ্বাস করে না এই অবিশ্বাসই  হোগলের ডায়ালেকটিস থেকে মার্ক্সকে আলাদা করে ছিল।

ভূমিহীন মানুষের যাপন পরিপ্রেক্ষিতে তার রাজনৈতিক চিন্তাধারার সুস্পষ্ট ছাপ লক্ষ্য করা যায়। ১৯৯০সালে “তিস্তা পারের বৃত্তান্ত” এনে দেয়  বিরলতম সম্মান সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরষ্কার। এছাড়া আরও বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।ব্যাতিক্রমী সাহিত্য কর্মের জন্য  তিনি পাঠক হৃদয়ে চিরন্তন স্থান দখল করে নিয়েছেন।

ঋণ স্বীকার

_________

বাংলার মুখ,

 হিন্দুস্থান টাইমস,

বাংলা নিউজ দৈনিক ১৫ই মে ২০২০

গল্প সমগ্র এর ভূমিকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × four =