প্রাপ্তি

 চিত্রা দাশগুপ্ত  ##

 পনেরদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছে উজ্জ্বল। দুদিন পর ওর বিয়ে। 

মেয়েটিকে ও চাক্ষুষ দেখেনি,ছবি দেখেছে। ছবি দেখে আর মেয়েটির বিষয় সব শুনে ওর ভালোই লেগেছে। কলকাতা থেকে আসার সময় খুব সুন্দর একটা রুবির আংটি কিনে এনেছে ফুল শয্যার রাতে বৌকে দেবে বলে। 

দুই দিদি, ছোট বোন ছেলেপিলেদের নিয়ে এসেছে …বিয়েবাড়িতে চাঁদের হাট বসেছে। সারাদিন হাসাহাসি আনন্দের জোয়ার বইছে বাড়িতে। 

বিয়ের আগের দিন। রান্নাঘর থেকে থেকে উলু ধ্বনির শব্দ ভেসে আসছে দিদি বৌদিরা মিলে হলুদ কুটছে ….

হঠাৎ দরজার বেল বেজে উঠল, উজ্জ্বল এগিয়ে দরজা খুলে দিল। 

সামনে এক উদভ্রান্ত চেহারা প্রায় ওরই বয়সি একটি অপরিচিত ছেলে দাঁড়িয়ে। উজ্জ্বল কিছু বলার আগে আগন্তুক —— আপনি উজ্জ্বল ?

উজ্জ্বল অবাক চোখে তাকিয়ে —- হুম। 

আমাকে আপনি চিনবেন না, আমি শাশ্বত ——আপনার কাছে একটা বিশেষ দরকারে এসেছি —— মানে কিছু কথা ছিল যদি একটু বাইরে আসেন—-

দরজাটা ভেজিয়ে উজ্জ্বল আর শাশ্বতএগিয়ে গেল। একটু দূরে সরে শাশ্বত হঠাৎ করে উজ্জ্বলের হাত দুটো চেপে ধরে —- আপনি আমাদের বাঁচান, অনেক আশা নিয়ে আপনার কাছে ছুটে এসেছি —-

উজ্জ্বল —- একটু বিরক্ত হয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে রুক্ষ স্বরে বলে উঠল—

ব্যাপারটা কী বলুন তো আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা। আপনার উদ্দেশ্যটা কি? 

শাশ্বত—- আমাদের বাঁচান …. একমাত্র আপনি পারেন আমাদের মানে আমাকে আর আপনার হবু বউ দীপ্তিকে বাঁচাতে…. প্লিজ আপনি বিয়েটা ভেঙ্গে দিন ….উজ্জ্বল বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শাশ্বাতর মুখের দিকে, মুখ দিয়ে কথা সরছে না। 

শাশ্বত একটু থেমে ওর মনে জমে থাকা সব কথা উজাড় করে দিল …

দীপ্তি আর শাশ্বত দুজনে দুজনকে ছোট বেলা থেকে ভালবাসে কিন্তু ওরা জানতো ওদের ভালবাসাটা দু’পরিবারের কেউ মেনে নেবে না, তাই ওরা ভেবেছিল শাশ্বত চাকরি পেলে ওরা কামাক্ষ্যা মন্দিরে গিয়ে লুকিয়ে বিয়েটা করে নেবে। এদিকে দীপ্তির গ্র্যাজুয়েশন শেষ হলে ওর বাড়ি থেকে উঠে পড়ে সম্বন্ধ খুঁজতে আরম্ভ করে অথচ শাশ্বত তখনো চাকরি পায়নি। শেষে বাধ্য হয়ে দীপ্তি মাকে শাশ্বতর ব্যাপারটা জানায়।  আর তখনি শুরু হয় অশান্তি, ওদের জীবনে নেমে আসে হতাশার-অন্ধকার। দীপ্তির মা মেয়েকে মাথার দিব্যি দিয়ে বলে ও যদি এ বিয়ে করে তবে সে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবে….

মাকে কিছুতেই বোঝাতে পারেনি দীপ্তি তাই ও কাল রাতে এক বন্ধুর হাতে লুকিয়ে ওকে একটা চিঠি পাঠিয়েছে তাতে এমন কিছু লিখেছে যাতে শাশ্বত কিছু বিপদের ইঙ্গিত পেয়ে ঐ বন্ধুর থেকে উজ্জ্বলের ঠিকানা জোগাড় করে ছুটে এসেছে। 

শাশ্বত বহু কষ্টে শেষ কথাটা বললো “দীপ্তির কিছু হলে আমি ও বাঁচব না… “

*********************

পরদিন সকালের ফ্লাইটে উজ্জ্বল ফিরে গেল কলকাতা। বাড়িতে কী পরিস্থিতি হয়েছিল সে কথা আর নাই বললাম। অবশ্য বড়দাকে আড়ালে ডেকে সব কথা ও জানিয়েছিল ,সব কথাশুনে দাদা ওকে চলে যেতে বলেছিলেন। 

********************

সেই ঘটনার পর অনেক দিন উজ্জ্বল বাড়ি যায়নি। কলকাতায় একটি মেয়ের সাথে পরিচয় ও বাড়ির সবার উপস্থিতিতে বিয়ে করে অবশেষে দু বছর পর নতুন বৌকে নিয়ে উজ্জ্বল গেলো বাড়িতে। এক সন্ধেবেলায় মায়ের কথা মতো নতুন বৌকে নিয়ে কালিবাড়ি পুজো দিতে গেল উজ্জ্বল। 

হঠাৎ পিছন থেকে কে ডাকলো,“উজ্জ্বলদা”…

ফিরে দেখে একটি ফুটফুটে পুতুলের মতো মেয়ে কোলে নিয়ে একটি বৌ দাঁড়িয়ে আছে ,মুখটা কেমন চেনা চেনা লাগছে মনে করতে পারছেনা…,

পাশে এসে দাঁড়ালো…, কে ও ? শাশ্বত নাকি ?…শাশ্বতর সেই উদভ্রান্ত মুখটা আজ খুশিতে ঝলমল করছে। ওরা দুজনে এগিয়ে এলো, উজ্জ্বলকে শাশ্বত বুকে জড়িয়ে ধরলো। 

উজ্জ্বল ভাবছে যাক সেইদিন কোন অ‍পরাধ না করে  মুখ লুকিয়ে পালিয়ে গিয়ে ভুল করেনি ও, বরঞ্চ দুটো জীবন স্বার্থক হয়ে পূর্ণতা পেয়েছে,আজ তাদের কোলে এসেছে নতুন জীবন যা ভবিষ্যতে জীবনধারাকে অক্ষুন্ন রাখবে। এ যে বিরাট প্রাপ্তি! 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seventeen − 1 =