বাঙালির গান (পর্ব ৪)

পার্থসারথী সরকার ##

চৈতন্য জীবনী সাহিত্য:   

 শ্রীচৈতন্যের প্রথম জীবনীকাব্য রচিত হয় সংস্কৃত ভাষায়, মহাপ্রভুর জীবিত অবস্থাতেই।  নরহরি সরকার চৈতন্য বিষয়ক পদ লিখলেও তখনও শাস্ত্রাচারী দলে চৈতন্য ততখানি স্বীকৃত হননি। রঘুনাথ দাস ‘স্তবমালা’ রচনা করেছিলেন। রূপগোস্বামীর ‘স্তবমালা’র প্রথম তিনটি অষ্টকে চৈতন্য জীবনকথার কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। চৈতন্যজীবনী সমূহের মধ্যে মুরারি গুপ্তের আদিতম ও মূল গ্রন্থের নাম ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃতম্‌’ হলেও তা ‘মুরারি গুপ্তের কড়চা’ নামেই অধিক পরিচিত। যদিও কড়চার সংক্ষিপ্ত দিনলিপির বৈশিষ্ট্য এতে রক্ষিত হয় নি। অনুমেয় এই গ্রন্থের প্রথম তিনটি উপক্রম চৈতন্যজীবৎকালে এবং শেষ উপক্রমটি চৈতন্যতিরোধানের পরে রচিত হয়। চৈতন্যের অন্যতম পার্ষদ শিবানন্দ সেনের কনিষ্ঠ পুত্র পরমানন্দ সেন (দাস) বা কবিকর্ণপূর চৈতন্যচরিতামৃত মহাকাব্য ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন। এখানে বিশটি সর্গ এবং উনিশ শ’য়ের বেশী শ্লোক আছে। তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ চৈতন্যচন্দ্রোদয় নাটকম্‌। তাঁর  গৌরগণোদ্দেশদীপিকার মধ্যে চৈতন্য-অবতারের পাশাপাশি চৈতন্য পারিষদদের অবতারত্বও ব্যাখ্যা করা হয়েছে।  প্রবোধানন্দ সরস্বতীর ‘চৈতন্যচন্দ্রামৃত’ একটি স্তবগ্রন্থ হ’লেও এতে জীবনীসাহিত্যের উপাদান আছে।

চৈতন্যের বাংলা জীবনীকাব্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্য ভাগবত’—যা বাংলা জীবনী গ্রন্থ গুলির মধ্যে আদিতম বলে জানা ছিল কিন্তু সাম্প্রতিক কালে ড. কাননবিহারী গোস্বামী শ্রীচৈতন্য পার্ষদ ও তাঁর প্রত্যক্ষ লীলাদর্শী কবি, পূর্বপুরুষ বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীগৌরলীলামৃত’ কাব্যের পুঁথি আবিস্কার ও আলোচনা ক’রে প্রমাণ করেছেন যে, এটিই প্রথম বাংলায় রচিত চৈতন্যচরিত কাব্য। এই কাব্যের গো-দোহন-লীলা’র পটচিত্র বর্ণনায় আধুনিক ‘পটুয়া-লোকসংগীতে’র পূর্বরূপ আছে। বৃন্দাবন দাস সাবলীল গতিতে কাহিনী বর্ণনা করেছেন; তবে বর্ণনায় কিছু অলৌকিকতাও এসেছে।  বিমানবিহারী মজুমদার বৃন্দাবনদাসের জন্মকাল ১৪৪০ শক বা ১৫১৮ অব্দ স্থির করে তিনি যে বিখ্যাত খেতুরী উৎসবে (১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দ) উপস্থিত ছিলেন সে বিষয়ে মান্যতা দিয়েছেন।  এই গ্রন্থের রচনাকাল স্পষ্ট উল্লেখ না থাকায় মতান্তর আছে।  ড. সুকুমার সেনের মতানুযায়ী পনেরশো একচল্লিশ বিয়াল্লিশ  খ্রিস্টাব্দে চৈতন্যভাগবত রচিত হয়েছিল।  ড. বিমানবিহারী মজুমদারের মতে, এই কাব্যের রচনাকাল ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দ। গ্রন্থটি আদি খণ্ড ১৫ অধ্যায়, মধ্য খণ্ড ২৬ অধ্যায় এবং অন্ত্যখণ্ড ১০ অধ্যায়ে সম্পূর্ণ।  বৃন্দাবন দাস তাঁর রচনায় বিবৃতিমূলক পাঁচালী রীতি অনুসরণ করেছিলেন। সংগীতবিদ্যায় তিনি অভিজ্ঞ থাকার হেতু তাঁর বর্ণনাতে একটা স্বাভাবিক স্বাদু মাধুর্য  সঞ্চারিত হয়েছে। চৈতন্য অবতার দর্শনে বর্ণিত নৃত্যগীতের বর্ণনাটি গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীচৈতন্যের অভিনয়েও গীতিরীতির পরিচয় আছে।

       লোচনদাসের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ মূলত সাধারণ বিশ্বাসপ্রবণ ভক্ত বৈষ্ণবদের জন্য রচিত হয়েছিল।  এটি মূলত পাঁচালী প্রবন্ধ ও মঙ্গলকাব্যের ধারা অনুসারে গীত হ’ত।  লোচনদাস তাঁর গুরু নরহরি সরকারের কাছে গৌরনাগরীভাবের সাধন-ভজনের আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন এবং সেই অনুসরণে অনেক ধামালি পদ বা লৌকিক গীত রচনা করেছিলেন—যার প্রভাব তাঁর ‘চৈতন্যমঙ্গলে’ রয়েছে।  চৈতন্যমঙ্গলের পুঁথিতে সন তারিখ নির্ণয় করা না থাকলেও সতীশচন্দ্র রায়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে লোচনদাসের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ রচিত হয়।  এই গ্রন্থের ৪ খন্ড—সূত্র খন্ড, আদি খণ্ড খণ্ড,  মধ্য খণ্ড এবং শেষ খণ্ড। কাব্যটি মুখ্যত স্বল্পশিক্ষিত সমাজে গান গাইবার জন্য প্রচারিত হয়েছিল।  সেই কারণে এই কাব্যের সর্বত্রই রাগরাগিণীর উল্লেখ আছে।  যদিও সর্গ বিভাগ বা অধ্যায় বিভাগ নেই।

 জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গলে’র পরিচিতি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে পাওয়া যায়।  তাঁর গ্রন্থনুযায়ী তিনি বর্ধমানের কাছে আমাইপুরা গ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায় বংশে জন্মগ্রহণ করেন। কাব্যটি পাঁচালি-গীতধর্মী পিতা ছিলেন সুবুদ্ধি মিশ্র এবং মাতা ছিলেন রোদনী।  তাঁর কাব্যানুযায়ী নীলাচল থেকে ফেরার পথে শ্রীচৈতন্য সুবুদ্ধি মিশ্রের গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করেন।  ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এর মত অনুসারে, তিনি ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দের দিকে প্রায় সাতচল্লিশ বছর বয়সে ‘চৈতন্যমঙ্গল’ রচনা করেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর বাস ছিল বর্ধমান জেলার কাটোয়ার নিকট ঝামটপুর গ্রামে।  জগদ্বন্ধু ভদ্রর গৌরপদতরঙ্গিনী অনুযায়ী কৃষ্ণদাসের জন্ম ১৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে।  পিতা ভগীরথ এবং মাতা সুনন্দা।  ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থ কৃষ্ণদাস অসাধারণ মনীষা, দার্শনিকতা, সৃজনীশক্তি ও কবিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।  মননশীল তত্ত্বকথাকে কবিত্বের সঙ্গে পয়ার ত্রিপদীর বাঁধনে  বেঁধেছেন। বৃন্দাবনদাস বা কবিরাজ গোস্বামীর গীতলতা এখানে অনেকখানি  প্রশমিত হয়েছে, কারণ এটি মূলত গেয় না, পাঠ্য কাব্য তবে অনেক ত্রিপদীতে ‘যথারাগে গেয়ম্‌’ উল্লেখ আছে। 

       গোবিন্দদাসের কড়চা চৈতন্যজীবনীকাব্য একটি বিতর্কিত গ্রন্থ। আধুনিক শব্দের প্রয়োগ,  আধুনিক ভাষার প্রয়োগ,  উচ্ছলতা,  ঐতিহাসিকতার অভাব এই কাব্যে দৃষ্ট হয়। এটি ‘জালগ্রন্থ’ রূপে প্রতিপাদিত হয়েছে। চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গবিজয় বা ভুবনমঙ্গল একটি অসম্পূর্ণ পুঁথিতে পাওয়া যায়। কাব্যটি সম্ভবত ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি রচিত হয়।  বাংলার পাশাপাশি অসমীয়া গ্রন্থে চৈতন্যদেবের নানা প্রসঙ্গ আছে।  কৃষ্ণভারতীর ‘সন্তনির্ণয়’-র চৈতন্যের সঙ্গে এই গ্রন্থের প্রভূত মিল আছে।  চৈতন্য জীবনীগ্রন্থগুলি শুধুমাত্র মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে নয় ভারতীয় সংগীতের এক পরম সম্পদ তাতে সন্দেহ নেই।

বাংলা চৈতন্যজীবনীগ্রন্থগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য একটি গ্রন্থ হল বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবত। চৈতন্যভাগবতের মধ্যে বহু বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘আনদ্ধ-বাদ্যের’ মধ্যে রয়েছে দুন্দুভি, ডিণ্ডিম, মৃদঙ্গ, জয়ঢাক, বীরঢাক, পটহ, দগড়, ডমরু, কাড়া ইত্যাদি। শুষির শ্রেণির বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে সানাঞি, কাহাল, শঙ্খ, শিঙ্গা, মুহরী (মধুকরিকা) উল্লিখিত। ‘ঘন-বাদ্যযন্ত্রের’ মধ্যে রয়েছে করতাল, মন্দিরা এবং ঘন্টা। এছাড়াও মঙ্গল, বরগো এবং পঞ্চশব্দী বাদ্যযন্ত্রের শ্রেণি-নির্নয় করা সম্ভব হয়নি। জয়ানন্দ এবং লোচনদাসের গ্রন্থদ্বয়ও চৈতন্য চরিত সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ দুটি গ্রন্থ। এই গ্রন্থদুটির মধ্য বহু বাদ্যগ্রন্থের উল্লেখ আছে। ‘তত’-বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে পাই রবাব, স্বপ্তস্বরা, স্বরমণ্ডল, রুদ্রবীণা, কপিলাস, মধুস্রবা, যন্ত্র, খমক ইত্যাদি। আনদ্ধ বাদ্যযন্ত্রর মধ্যে উল্লিখিত মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ, ডম্ফ, মুরজ, ডিণ্ডিম, ভেরি ও আনক। ‘শুষির’ বাদ্যযন্ত্রগুলি হল মুহরি (মধুকারিকা), উপাঙ্গ এবং শিঙ্গা। ‘ঘন’ বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ঘন্টা, করতাল ও ঝাঁঝর ছিল উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও চন্দ্রতারা, ধুসরী এবং চন্দ্রহাস নামক বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়—যাদের শ্রেণি-নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।  

খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতককে ঐতিহাসিক ড. যদুনাথ সরকারের মূল্যবান মতানুযায়ী বাঙালির ইতিহাসে এক ‘সুবর্ণ যুগ’ (Golden Age)  হিসেবে চিহ্নিত করা যায়—আর তা সম্ভব হয়েছিল মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের  ফলেই।  চৈতন্যপ্রভাব বাঙালি তথা ভারতীয় মানস পাঁচশ বছরের বেশি সময় ধরে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে বহন করে নিয়ে চলেছে। শ্রীচৈতন্য ব্যক্তিগতভাবে পন্ডিত হলেও তাঁর নিজস্ব রচনা তিনটি ‘শিক্ষাষ্টক’, ‘জগন্নাথষ্টক’ এবং ‘শিবাষ্টক’ ছাড়া নিজের রচনা আর কিছু নেই।

শুশুনিয়ার শিলালিপি

খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দী  থেকে বঙ্গে বিষ্ণুর  উপাসনা প্রচলিত ছিল তাঁর প্রমাণ মেলে। বাঁকুড়া শুশুনিয়া পাহাড়ে উৎকীর্ণ শিলালিপিতে পুষ্করের রাজা সিংহবর্মা ও তার পুত্র চন্দ্রবর্মা যে চক্রস্বামী বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন তা জানতে পারা যায়। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র মধ্যে সাহিত্য আদর্শ ক্ষীণ হলেও তার সাংগীতিক আদর্শ  উত্তরসূরির মধ্যে বর্তেছে।

খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে তুর্কি আক্রমণের পরবর্তীতে বহুদিন অবদমিত থাকার পর বাঙালির স্বাতন্ত্র্যবোধ আবার উজ্জীবিত হ’তে শুরু করেছিল। শ্রীচৈতন্যদেব সেই উজ্জীবনে পথপ্রদর্শক নায়ক এবং মশালচি দুইই। বঙ্গের সঙ্গীত এবং সাহিত্যের পরবর্তী গতিপথ শ্রীচৈতন্যদ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল। শ্রীচৈতন্য ‘গীতগোবিন্দম্’ কাব্যকে দক্ষিণ ভারতে নিয়ে যান। কেরলে ‘অষ্টপদী-আট্টম’ গানসমৃদ্ধ রাধাকৃষ্ণের  নৃত্যনাট্যের প্রসার ঘটে এবং তা দ্রুত প্রসারিত হয় সমগ্র কেরলে। এতে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে  মর্দল এবং বাঁশি ব্যবহৃত হত। পরবর্তীকালে রাজানুগ্রহ কৃষ্ণগীতির নাট্যরূপ জন্ম দেয় ‘কৃষ্ণনাট্যম’, ‘রামনাট্যম’ ইত্যাদি। এই ধারার অনুকরণ করে সপ্তদশ শতকের শেষার্ধে দক্ষণ ভারতে মুখোশ নির্ভর কথাকলি নৃত্যশৈলী গড়ে ওঠে। সন্ন্যাসপূর্ব জীবনে শ্রীচৈতন্য রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক নাটক সংগঠন করেন তাঁর মেসো চন্দ্রশেখর  আচার্যের আঙিনায় এবং সে নাটকে রুক্মিণীর ও মহাদেবীর ভূমিকায় তিনি স্বয়ং অভিনয় করেন। পুরীতে রায়-রামানন্দ তাঁর ‘জগন্নাথবল্লভ’ নাটকে জগন্নাথ মন্দিরের দেবদাসীদের নৃত্য-গীত-বাদ্য অভিনয়াদিতে প্রশিক্ষণ দেন। তাঁর নির্দেশেই পুরীধামে তাঁর সংস্কৃতে রচিত ‘জগন্নাথ বল্লভ’ নাটক মঞ্চস্থ হয়। ভক্তি সাধনায় অধিকারী-ভেদ বিষয়ে শ্রীচৈতন্য অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তৎপ্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন ছিল গভীর সাধনার বস্তু। রায় রামানন্দ পরবর্তী বৈষ্ণবরা নারীনৃত্যকে মর্যাদা দেননি এবং নিজেরাই সখীভাবে নৃত্য করতেন। ষোড়শ শতকে বালমদের ‘গোটিপুও’ নৃত্য সূচনার একটি কারণ হিসেবে এই বিষয়টিকে গণ্য করা হয়। এই ‘মাহারী’ বা দেবদাসী নৃত্য এবং ‘গুটিপুও’ নৃত্য বর্তমান নবনির্মিত ওড়িশি নৃত্যের জনক হিসেবে মানা হয়। ওড়িয়ায় লিখিত অচ্যুতানন্দের ‘শূন্যসংহিতা’য় পঞ্চখার সঙ্গে শ্রীচৈতন্য নৃত্য বর্ণনার কথা পাওয়া যায়। এই পাঁচজন পার্ষদ ছিলেন বলরাম, জগন্নাথ, অচ্যুত, যশোবন্ত এবং অনন্ত।  শ্রীচৈতন্যই  বঙ্গের মর্দলকে ওড়িশায় নিয়ে যান। শ্রীখোল বাজানোর এই পদ্ধতি পুরীতে ‘গৌড়ী পদ্ধতি’ হিসেবে পরিচিত। দক্ষিণ ভারতের সাংগীতিক ইতিহাসে ষোড়শ শতকে যেমন সংগীতকারদের উপর শ্রীব্যাস রায়ের প্রভাব ছিল তেমনি প্রভাব ছিল শ্রীচৈতন্যদেবেরও।  নীলকান্ত শাস্ত্রীর মতানুসারে কন্নড় সাহিত্যে মাধবাচার্য ব্যাসরায়ের সঙ্গে শ্রীচৈতন্যের প্রভাবও দেখতে পাওয়া যায়। দক্ষিণ ভারতের প্রসিদ্ধ নৃত্যরূপ ‘ভারতনাট্যম’-এর উপর ‘ভগবৎ মেলা’ নাটকের প্রভাব আছে। খ্রিস্টী পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে নির্মিত ‘কুচিপুড়ি’ নৃত্যও তার অন্যথা নয়। দক্ষিণ ভারতের পাশাপাশি অসম রাজ্য এবং মণিপুরেও শ্রীচৈতন্যপ্রভাব অবিসংবাদিত। মণিপুর রাজ ভাগ্যচন্দ্র (১৭৬৩-১৭৯৮) গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন নরোত্তম দত্তের প্রভাবে। গৌড়ীয় বৈষ্ণবাচার্যদের হাতেই সেখানে চৈতন্যসংস্কৃতির  বীজ রোপিত হয়, যার ফলে মণিপুরের প্রচলিত রাসনৃত্য এবং অন্যান্য  কিছু নৃত্যশৈলী নবভাবে সজ্জিত হয়ে ওঠে। রাস নৃত্য হয়ে যায় ‘নটসংকীর্তন’।  গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের বাইরে নানা সমাজ থেকে আসা সাধারণ সাধক সাধিকারাও চৈতন্য সংস্কৃতিতে লাভ করেছিলেন পরম প্রশান্তি। সম্রাট আকবর, মীরাবাঈ, কবীর-রা শ্রীচৈতন্যদেবকে হৃদয়ে ধারণ করে গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ রচনা করেন। ‘গ্রন্থসাহিব’-এর শেষে নানক নিত্যানন্দ প্রভুকে নিজের গুরু হিসেবে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

10 + one =