বাঙালির গান (পর্ব ৫)

পার্থসারথি সরকার ##

নাটগীতি ও যাত্রাগান:

বাঙালির মধ্যযুগীয় সংগীত ধারার মধ্যে ছিল কবিগান, কীর্তন, ঝুমুর, বাউলগান, মালসীগান ইত্যাদি—যা ছিল মূলত গীতাত্মক এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোন না কোন ধর্মকৃত্যের অঙ্গ। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে কালের পরিবর্তনে বাঙালি-সমাজেরও স্বাভাবিকভাবে রূপান্তরসাধন শুরু হয়—যদিও তার অংশীদার ছিল কলকাতার নব্য ধনী বাবু-সম্প্রদায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় তৃতীয় দশক থেকেই ইংরাজী শিক্ষার সঙ্গে পাশ্চাত্য দর্শন, সমাজচিন্তা, বিজ্ঞান, ইতিহাসবোধের মতো বিষয়গুলিও  বাঙালি মনে একটি ব্যাপক ও স্থায়ী প্রভাব ফেলে—যার মধ্যে দিয়ে পরবর্তীকালের সাহিত্য ও শিল্পবোধ নব-কলেবর লাভ করে এবং পুরানো ধ্যান-ধারণার বিসর্জনের পালা শুরু হয়। এই গ্রহণ-বর্জনের কালে গ্রামীন সমাজের অনেকখানি পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গৃহীত হয় নতুনভাবে। গ্রামীন সমাজে কোন মতে অস্তিত্ব রক্ষা করে থাকা ‘রামায়ণ-গান’, ‘মনসার-ভাসান’, ‘চণ্ডীর গান’, ‘চৈতন্যলীলাগান’, ‘পাঁচালি গানের’ও ক্রমরূপান্তর সাধিত হল গ্রামে ইংরাজী শিক্ষার বিস্তারের মধ্যে দিয়ে। তথাপি এ সবের মধ্যেও মধ্যযুগ থেকে একটি গীত শাখা এখনো পর্যন্ত অব্যহত আছে, যার মধ্যে দিয়ে বাঙালি তার গানের আনন্দ-উপভোগ একইভাবে করে চলেছে—সেই শাখাটি হল ‘নাটগীতি’ ও ‘যাত্রাগানের’ ধারা।

          ‘নাটক’ শব্দটির উৎপত্তি সম্বন্ধে বলতে গিয়ে কেউ কেউ বলেন’ সংস্কৃত ‘নৃত্‌’ ধাতু থেকে প্রাকৃতে ‘নট’ শব্দের উৎপত্তি হয়। এর থেকে ধরা যায় যে সংস্কৃতে প্রথমে নৃত্যগীতি যা থেকে পরবর্তীতে ‘নাটক’-এর আবির্ভাব। এ বিষয়ে A. A. Macdonell সাহেবের ‘A History of Sanskrit Literature’ পুস্তকানুসারে বলা যায় যে, নৃত্যগীতিতেই ভারতীয় নাটকের বীজ সুপ্তভাবে অন্তর্লীন ছিল। ভারতীয় নৃত্যগীতির নানা আঙ্গিক, মুদ্রা, মুখভঙ্গিমা ইত্যাদি থেকেই পরবর্তী নাটক পরিপূর্ণ রূপলাভ করেছে। যদিও A. B. Keith-তাঁর ‘The Sanskrit Drama’-র মধ্যে এই মতকে সম্পূর্ণভাবে মানেননি, সেখানে তিনি মহাকাব্যের মধ্যেই নাটকের বীজ লুকিয়ে ছিল বলে দেখিয়েছেন। R. Pischel (পিশেল) ‘Die Heimat der Puppenspites’ গ্রন্থের মধ্যে নাটকের উৎপত্তি হিসাবে পুতুলনাচকে (Puppetry) চিহ্নিত করেছেন। নট, নাট্য, নাটক শব্দগুলির সঙ্গে ‘নৃত্‌’ ধাতুর যোগ ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে কেউ কেউ খারিজ করলেও  গেলেও, প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে নৃত্যের সঙ্গে নাটকের ঘনিষ্ট যোগাযোগ লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন গুহাবাসী মানুষ শিকারশেষে অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে যে নৃত্যগীতির অনুষ্ঠান করতো সেখানে অবশ্যই কিছু নাট্যলক্ষণ প্রকাশিত হ’ত—যদিও বৈদিক সাহিত্যে নৃত্যের উল্লেখ থাকলেও নাটকের সঙ্গে তার কোন যোগ নেই। সংস্কৃত নাটকের সাদৃশ্যে নৃত্যগীতি থেকে উল্লেখ সমালোচকরা করলেও তা ভারতীয় নাট্যক্ষেত্রে সম্পূর্ণ খাটে না। ঋগ্বেদে একাধিক সংলাপধর্মী আখ্যান দেখতে পাওয়া যায়—যম-যমীর আখ্যান।

          পুরুরবা উর্বশী সংলাপের মতো সংলাপধর্মী আখ্যান থাকলেও ঋগ্বেদের যুগে কোনরকম প্রত্যক্ষ অভিনয়ের প্রচলন ছিল না—যদিও Keith মনে করেন যজ্ঞানুষ্ঠানে পুরোহিতেরা দেবতা-দানবের অভিনয় করতেন, যা যজ্ঞেরই অঙ্গ ছিল। তাঁর মতানুযায়ী এই প্রচ্ছন্ন নাট্যাভিনয় দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল, একটি বিশুদ্ধ যজ্ঞকার্যে ব্যবহৃত হত, অন্য শ্রেণিটি সাধারণ জনগণের মধ্যে বঙ্গদেশের যাত্রার মতো প্রচলিত ছিল, যার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল আনন্দ বিতরণ করা। ক্রমে বৈদিক ক্রিয়াকলাপ পরবর্তী সমাজে অনেকটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে এই যাজ্ঞীয় নাট্যপ্রকরণ একেবারে লুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু লোকাভিনয়ের ধারাটি বঙ্গদেশের এবং অন্যান্য প্রদেশের যাত্রাগানে অনুরূপ অনুষ্ঠানরূপে স্থায়িত্ব লাভ করে।

          বৈদিক যুগের পরবর্তী ক্ষেত্রে নিয়মানুগ মঞ্চাভিনয় যে ক্রমে ক্রমে শিষ্টসমাজে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছিল তার উদাহরণ পতঞ্জলিকৃত পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’ ‘মহাভাষ্যে’র মধ্যে পাওয়া যায়। পূর্বোক্ত নাটক নিছক আনন্দদানের জায়গা থেকে ক্রমে শিল্প পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীর পূর্বেই। আচার্য ভরতের সময়কাল থেকে আরম্ভ ক’রে দশম শতাব্দী পর্যন্ত এই হাজার বৎসরের সংস্কৃত নাট্যসাহিত্য ভরতের নাট্যসূত্রের দ্বারা পরিচালিত হয়ে জটিল শিল্পরূপ পেয়েছিল। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই শিল্প-প্রকরণটি রাজ্যাভিষেক, রাজকুমারের জন্ম, সিংহাসনারোহণ, বিবাহ, দেবপূজা, শোভাযাত্রা সর্বত্রই অভিনীত হ’তে থাকে। এই অভিজাত নাট্য প্রকরণটি সম্ভবত সাধারণ মানুষের আস্বাদনের বাইরে ছিল, তা অনুমেয়। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতক থেকেই সংস্কৃত নাটকের আঙ্গিকগত বিশুদ্ধতা ক্ষুণ্ণ হতে শুরু করে। সুভটের ‘দূতাঙ্গদ’র একটি দৃষ্টান্ত। সম্ভবত চালুক্যরাজ ত্রিভুবন পালের রাজত্বকালে এর সৃষ্টি। শ্লোকাধিক্য, গদ্য সংলাপের স্বল্পতা এবং ঘটনা আখ্যান বর্ণনার রীতিতে উপস্থাপন—যা নাটকের সামগ্রিকতাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। অন্যদিকে ভবভূতির ‘মহানাটকে’ও এই একই বিষয়কে দেখতে পাওয়া যায়। সংস্কৃত নাটকের এই অধঃপতনের খুব বড়ো একটা কারণ ছিল দ্বাদশ শতাব্দীতে দেশীয় ভাষায় সাহিত্যকর্মের শুরু হওয়া। পূর্বে অপভ্রংশের প্রভাবে সংস্কৃত ভাষায় অনেকখানি শিথিলতা প্রবেশ করেছিল, পরবর্তীতে নব্যভারতীয় আর্য ভাষাকে (NIA) অবলম্বন করে সাহিত্যকর্মের বিস্তার ঘটলে সংস্কৃতের প্রসার অনেকখানি সংকুচিত হয়ে পড়ে; আবার মনোরঞ্জনের জন্য সংস্কৃত নাটক দেশীয় নাটকের রীতিকে খানিকটা মেনে নিতে বাধ্য হয়। লোকনাট্য সংস্কৃত নাটকের পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল—যা এই সময় সংস্কৃত নাটকে প্রভাব বিস্তার করে তাকে প্রায় অবলুপ্ত ক’রে দেয়। পাশাপাশি ইসলামী শাসকদের অভ্যুদয় এবং সংস্কৃত সাহিত্যের পৃষ্টপোষকতার অভাবও এই ক্রম-অবলুপ্তিতে সহায়তা করল। তবে, নাট্যশিল্প বাঁধা রঙ্গশালা (প্রসেনিয়াম) থেকে অপসৃত হ’লেও জনমানস থেকে তার অবলুপ্তি একেবারে সম্ভব তো হ’লই না, বরং তা বাড়তে থাকল, আর যার ফলে নৃত্যগীতিবহুল নাটক লোকসমাজে ক্রমাগত জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করল—যা সে যুগে নাট্যগীত নামে প্রচলিত থাকলেও উনিশ শতক থেকে বঙ্গে পরিচিতি লাভ করেছে গীতাভিনয় বা যাত্রাগান হিসাবে।

          A. B. Keith-তাঁর ‘The Sanskrit Drama’ গ্রন্থে বৈদিক সংহিতায় ‘সুপর্ণাধায়’ নামক নাট্যধর্মী রচনা আলোচনা করতে গিয়ে অভিমত দিয়েছেন যে, বৈদিকযুগেও আদিমরীতির নাট্যরীতি প্রচলন ছিল। Macdonell এই আদিম নাট্যরীতির সঙ্গে পরবর্তী বাংলা যাত্রার তুলনা টেনেছেন। Von Schroeder-ও গীতগোবিন্দের আলোচনা প্রসঙ্গে বাংলা যাত্রার সঙ্গে পরবর্তীকালের নাটকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক লক্ষ্য করেছেন। সংস্কৃত নাটকের অবক্ষয়ের যুগে যে ধর্মীয় যাত্রাভিনয় ক্রমে জনপ্রিয়তা অর্জন ক’রে তার বিষয় ছিল পৌরাণিক এবং রচনারীতিতে কিয়দংশে ছিল নাটকের প্রভাব। এখানে মূল আকর্ষণীয় বিষয় ছিল সুরেলা আবৃত্তি ও তৎসহ সংগীত। ভবভূতির ‘মালতীমাধব’ নাটক অনুসারে বলা যায়, কালপ্রিয়নাথের শোভাযাত্রা এবং বাদ্যভাণ্ডসহ বিগ্রহকে মন্দির থেকে বাইরে ও পুনরায় মন্দিরে প্রবিষ্ট করানো ‘যাত্রা’ নামে পরিচিত ছিল, সম্ভবত সেই শোভাযাত্রা উপলক্ষে দেবদেবীর লীলাজ্ঞাপক লোকাভিনয় ‘যাত্রা’ নামে পরিচিত হয়। এর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে গ্রীক দেবতা Dionysus—এর শীতকালীন ও বসন্তকালীন রথযাত্রায় ট্রাজেডি ও কমেডি নাটকের অনুষ্ঠান।

চর্যাপদ:

‘চর্যাপদে’র দুস্থলে নাটক বা নাটকের অভিনয়ের প্রসঙ্গ আছে। কাহ্নপাদ রচিত চর্যার ১০নং পদটিতে পাওয়া যায়—‘তোহোরে অন্তরে ছাড়ি নড়পেটা’। এখানে কাহ্ন মোক্ষপ্রদায়িণী নৈরাত্মাবধূতিকাকে উল্লেখ করে বলেছেন যে ‘ডোম্বী’র জন্যই তিনি সংসাররূপ নটপেটিকা পরিত্যাগ করেছেন। অনুমেয় সে যুগে লোকনাট্য অভিনয়ের দল গ্রামে গ্রামে অভিনয় করে বেড়াতো, এবং তাঁদের সঙ্গে থাকা পেটিকায় (make up box) থাকত সাজগোজের সরঞ্জাম—যা পরিধান করে তাঁরা পয়নাটিকায় (Street Drama) প্রয়োজন মতো পাত্রপাত্রীদের রূপসজ্জা পরিগ্রহণ করতেন। বর্তমানে গ্রামীন লেটো দলও অনুরূপ কাজ করে। চর্যার ১৭ সংখ্যক পদেও অনুরূপ বর্ণনার সন্ধান পাওয়া যায়। রচয়িতা বীণাপাদ লেখেন—‘নাচন্তি বাজিল গাঅন্তী দেঈ।/ বুদ্ধ নাটক বিসমা হোই।।’ অর্থাৎ বজ্রাচার্য নাচছেন, দেবী অবধূতিকা গাইছেন, যাতে সম্পূর্ণ বিপরীত রীতিতে বুদ্ধনাটক অভিনীত হচ্ছে। ‘বিপরীত-রীতি’, কারণ সাধারণত মেয়েরা নাচে এবং পুরুষেরা গান গায়। এখানে তার বিপরীত বা উল্টোটা হচ্ছে। এই নাটকে সংলাপ নেই, নৃত্যগীতই একমাত্র উপাদান। পদটি সহজিয়া বজ্রযান সম্প্রদায়ের মধ্যে যে লোকনাট্যের প্রচার ছিল, সে কথাকেই প্রমাণিত করে।    

গীতগোবিন্দ:

সেনরাজা লক্ষ্মণ সেনের অন্যতম সভাকবি গোবর্ধন আচার্যর ‘আর্যাসপ্তশতী’ গ্রন্থের মধ্যে সেনযুগে সংস্কৃত সাহিত্যচর্চার বিশেষ হদিস পাওয়া যায়। ‘আর্যাসপ্তশতী’র ১৭৪ সংখ্যক শ্লোকে অভিনয়ের কথা আছে। অন্য একটি শ্লোকে আছে—

‘ব্রীড়াপ্রসরঃ প্রথমং তদনু চ রসভাবপুষ্টচেষ্টয়ম্‌।

যবনী বিনির্গমাদনু নটীব দয়িতা মনো হরতি।।’

এখানে যবনিকা উত্তোলণে নায়িকার রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ, সেখানে এসে তার আড়ষ্টতা ভেঙে স্বাভাবিক অভিনয় ছন্দে ফেরা ইত্যাদি অভিনয়-রীতির নাটকের যথাযথ সাক্ষ্য দেয়। ‘আর্যাসপ্তশতী’ ছাড়া আবার যে সাহিত্যকর্মটি এ ব্যপারে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে আছে তা হল জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্য। ‘গীতগোবিন্দ’ দ্বাদশ সর্গে সমাপ্ত আখ্যানকাব্য বিশেষ। একে খণ্ডকাব্য বা পাশ্চাত্য মতানুযায়ী দীর্ঘ আখ্যানকাব্য হিসাবে আখ্যায়িত করে যেতে পারে। বহিরঙ্গ লক্ষণ বিচারে ‘গীতগোবিন্দ’কে কাব্য হিসাবে চিহ্নিত করা হলেও এই কাব্য পুরীর মন্দিরে এবং তাঞ্জোরের দেবমন্দিরে একদা দেবদাসীদের দ্বারা নৃত্যগীতি হিসাবেই অভিনীত হ’ত। তাঞ্জোরের ‘সরস্বতী মহল’-কর্তৃক প্রকাশিত কে. বাসুদেব শাস্ত্রী-সম্পাদিত এই পুস্তকে মুদ্রা সম্বলিত নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ‘গীতগোবিন্দ’র গঠনপ্রকৃতি বিচার এবং জাতিগঠনের দিক দিয়ে বিচার করে William Jones বলেছেন ‘Pastoral Drama’—যা যাত্রার পূর্বরূপ। লেভির মতে ‘Opera’, এবং শ্রোয়ডারের মতে এটি একটি মার্জিত ধরণের যাত্রা (refined Yatra) । Keith-ও ‘গীতগোবিন্দ’ ও যাত্রাগান উভয়ের মধ্যেই লোকনাট্যের কিছু চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন।

          ‘গীতগোবিন্দে’র মধ্যে চব্বিশটি পদ রাধা, কৃষ্ণ ও সখীর মধ্যে—তথাপি এ সংলাপ নয় বরং অনেকখানি সংগীতধর্মী পদাবলী। ‘গীতগোবিন্দে’র পূর্বে সমাজে যে নৃত্যগীতিময় কৃষ্ণযাত্রা প্রচলিত ছিল, এ কাব্য তারই মার্জিত রূপ। ড. সুকুমার সেন একে ‘নাট্যগীতি’ বা ‘নটগীত’ বা ‘গীতনাট’-এর সঙ্গে সম্পর্কিত করেছেন। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ তাঁর ‘পদাবলী কীর্তনের ইতিহাস’-এর মধ্যে অবশ্য ‘গীতগোবিন্দ’কে নৃত্যনাট্য বা যাত্রাগানের পূর্বরূপ হিসাবে মানতে বেশ খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত। তাঁর মতানুযায়ী, ‘গীতগোবিন্দ’ পাদগান যদি নাটগীতি বা যাত্রার পূর্বসুরী হ’ত তাহ’লে তার মধ্যে অভিজাত ক্লাসিক্যাল পর্যায়ের রাগ-তালের সার্থকতা থাকত না। আসলে ‘গীতগোবিন্দ’ প্রবন্ধগান, যার মধ্যে রাগতালের সূক্ষাতিসূক্ষ্ম প্রকরণ ও উল্লেখ থাকলেও নৃত্যেরও উল্লেখ আছে। যেমন, রাধার কাছে সখীর উক্তিতে—‘বিহরতি হরিরিহ সরস বসন্তে,/ নৃত্যতি যুবতী জনেন সমং সখী,/ বিরহী জনস্য দুরক্তে।।’ সম্ভবত সংগীত পরিবেশনায় বৈচিত্র্যের জন্য এর আগমন। আসলে ‘গীতগোবিন্দ’ মূলত কাব্য যা যাত্রাগানের চেয়ে পাঁচালির অনেকখানি কাছাকাছি তবে এর নাটগীতাত্মক (সংস্কৃত ত্রি-চরিত্রাত্মক ‘বীথী’ নাটকের) আবেদনের জন্যই বাংলা যাত্রাপালার বিকাশে এর খানিকটা প্রভাব আছে ব’লে মনে করা যেতে পারে।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও নাটগীত:

বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ (যমুনাখণ্ডে) পাওয়া যায়—

‘ষোল শত গোপী গেলা যমুনার ঘাটে।

তা দেখিআঁ কাহ্নাঞি পাতিল ‘নাটে’।।

খনে করতাল খনে বাজাএ মৃদঙ্গ।

তা দেখি রাধিকার সখিগণে রঙ্গ।।’

এর অর্থ যমুনার ঘাটে ষোল শত গোপীকে যেতে দেখে কৃষ্ণ ‘নাট্যকলার অভিনয় আরম্ভ করিয়া দিল’। সঙ্গে করতাল, মৃদঙ্গাদির মতো ঘন ও আনদ্ধ বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার আছে। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের’ কাহিনি পুরাণ থেকে অংশত গৃহীত হলেও তা লোককল্পনায় লালিত হয়েছিল। এখানে রাধা, কৃষ্ণ ও বড়াই মূলত এই তিন চরিত্রের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে কাহিনি অগ্রসর হয়েছে বলে এর মধ্যে কিঞ্চিৎ নাট্য উপাদান রক্ষিত হয়েছে। কাব্যটির গঠন বিশ্লেষণে দেখা যায় তা তেরো খণ্ডে বিভক্ত,। পূর্বখণ্ডের সঙ্গে পরবর্তী খণ্ডের মধ্যে যোগসূত্র আছে, যেখানে নেই সেখানে কবি স্ব উক্তির মধ্যে দিয়ে কিংবা সংস্কৃত গ্রন্থন শ্লোকের মাধ্যমে তা পূরণ করেছেন। এতে প্রত্যেক গীতের শীর্ষে রাগতাল ইত্যাদি রক্ষিত হয়েছে।

          ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র যুগে (চতুর্দশ-পঞ্চদশ খ্রিস্টীয় শতকে) এবং পরবর্তীতে ঝুমুরের উল্লেখ আছে, দু-তিন দলের কেউ রাধার পক্ষ, কেউ কৃষ্ণপক্ষ নিয়ে সংলাপধর্মী চটুল গানই হল ঝুমুর—তাই অনেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকে ঝুমুর গান হিসাবে বা ঝাড়খণ্ডী কীর্তন বলে চিহ্নিত করতে চান। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ গীতাত্মক হ’লেও এ-কাব্যে সংলাপরীতি পুরোপুরি বজায় ছিল। কৃত্তিবাস ওঝা উল্লিখিত ‘মঙ্গল নাটগীতি’র উদাহরণ সম্ভবত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। তবে, এখানে কিঞ্চিৎ নৃত্যগীতাত্মক লোকনাট্যের পূর্বরূপ ফুটে উঠেছিল। মধ্যযুগে বহুপূর্ব থেকে চলে আসা পাঁচালি ও ঝুমুর ধরণের লোকাভিনয়ের মিশ্র ধারাই পরবর্তী যাত্রাগানকে প্রভাবিত করেছিল।

          মধ্যযুগের অনেকস্থলেই ‘নাটগীতির’ উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। রামাই পণ্ডিতের ‘শূণ্যপুরাণে’র মধ্যে বহুস্থলে ঐ ‘নাটগীতির’ উল্লেখ পাওয়া যায়—“নাটগীতি করে গতি/ এ চারি চৌপর রাতি/ তামর অঙ্গুরী লইএ করে’ কিংবা ‘কেহ বেচে কেহ কিনে/ গীত নাট কেহ সুনে/ কেহ দূরে করএ পসার।”

চৈতন্যদেব ও যাত্রাভিনয়:

বৃন্দাবন্দাসের ‘শ্রীচৈতন্যভাগবত’-এর মধ্য খণ্ডের অষ্টাদশ পরিচ্ছেদে শ্রীচৈতন্যের ব্রজলীলা-অভিনয়ের কথা পাওয়া যায়; সেখানে গৌরাঙ্গদেব বেশসজ্জার উপাদান বলে দেন। গৌরাঙ্গের মেসো চন্দ্রশেখর আচার্যের বাড়ির উঠানে অভিনয় স্থান নির্দিষ্ট হয়। সামিয়ানা খাটানো হয়েছিল এবং এই অভিনয়ে গৌরাঙ্গ স্বয়ং লক্ষ্মীর ও মহাদেবীর ভূমিকায় নৃত্য পরিবেশন করেন। এটি আসরী অভিনয়, অর্থাৎ যাত্রাভিনয়। ঐ যাত্রাভিনয় বঙ্গদেশে প্রথম যাত্রার পুঁথিগত প্রমাণ। পালা, সাজসজ্জা, আলোক প্রক্ষেপ এবং যাত্রাভিনয়ে বৃন্দানবদাসের এই বিবরণ সে-যুগের একটি মূল্যবান দলিল। ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় উক্ত পালাটি বিশ্লেষণ ক’রে কয়েকটি সিধান্তে এসেছেন—প্রথমত, এটি যাত্রাভিনয়, দ্বিতীয়ত এতে ব্যবহৃত সংলাপ গদ্যসংলাপ—যা কুশীলবরা তাৎক্ষণিক বানিয়ে বানিয়ে বলতেন; যা পরবর্তীকালে যাত্রাগানে ব্যবহৃত হ’ত এবং তৃতীয়ত, নৃত্যই ছিল এই যাত্রাপালার প্রধান অঙ্গ।

          উপযুক্ত আলোচনায় ‘গীতগোবিন্দ’, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কিংবা ‘চৈতন্যভগবতে’র মধ্যে নাটগীতির সংক্ষিপ্ত উল্লেখ পাওয়া গেলেও বঙ্গদেশে গীতিনাট্যের কোন পালাবদ্ধ রূপ পুঁথির মধ্যে পাওয়া যায় না। যদিও সেই সময় মিথিলা, নেপাল ও অসমে একাধিক পালাগানের পুঁথি পাওয়া গেছে—যা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় ঐ সব অঞ্চলে তা অনুষ্ঠিত হত। এ-প্রসঙ্গে অসমে শঙ্করদেবের ‘রুক্মিণীহরণ’ অঙ্কিয়াগীত স্মরণীয়। এর পরবর্তীতে বঙ্গে অষ্টাদশ শতাব্দীতে আবার নাটগীতি রচনা এবং অভিনয়ের সংবাদ পাওয়া যায়—আর সে কারণেই বাংলায় নাটগীত এবং যাত্রাগানের যথার্থ মঞ্চাভিনয়ের চিত্রারম্ভ হিসাবে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগকেই মান্যতা দিতে হয়।

          খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বে যাত্রাগান, বিশেষত কৃষ্ণযাত্রার গঠনে পালাকীর্তনের প্রভাব ছিল, কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর যাত্রাগানে কৃষ্ণযাত্রার উপকরণ ছিল সামান্যই। যাত্রার অধিকারী কথকতার ঢঙে কাহিনি বিবৃত করতেন। যাত্রা শুরুর প্রথমে কীর্তনের ঢঙে ‘গৌরচন্দ্রিকা-গান’ হ’ত এবং এরপর ঝুমুরের দল গান ধরত। অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে যাত্রাগানে খোল, করতাল, বেহালা এমনকিবিদেশি বাদ্যযন্ত্র ক্ল্যরিওনেটের ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়।

          ১৭০০ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ পত্রিকার পাতায় রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের প্রবন্ধ অনুসারে বলা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীতে বঙ্গে যাত্রার যে ক্ষয়িষ্ণু দশা চলেছিল, সেখান থেকে যাত্রাগানকে নবরূপে সজ্জিত ক’রে তাকে যথাযথ মূল্য দেন দ্বিজরাম অধিকারী এবং শ্রীদাম, সুবল, পরমানন্দ অধিকারী প্রমুখ যাত্রাওয়ালারা। তাঁরা যাত্রার যথার্থ শ্রীবৃদ্ধি ঘটান। অষ্টাদশ শতাব্দীর সমাপ্তি এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ক্রমে ক্রমে কবিগানের প্রভাব হ্রাস হতে শুরু করল এবং যাত্রাগানের জনপ্রিয়তা দেখা দিতে লাগল। শিশুরাম অধিকারী বীরভূম জেলার কেন্দুবিল্ব গ্রামে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের (কণ্ঠমশাই) মতে তিনিই কালীয়দমন যাত্রার প্রবর্তক। পরমানন্দ অধিকারী সম্ভবত বীরভূমে জন্মলাভ করেন। দূতী চরিত্রে তিনি পারঙ্গম ছিলেন। তিনি গানের চেয়ে সংলাপ বা ঘটকালি বেশী ব্যবহার করতেন। এই ঘটকালি অনেকটা পয়ার ঢংয়ে পাঁচালি আবৃত্তির মতো। পরবর্তীতে ঊনবিংশ শতাব্দীর যাত্রাওয়ালাদের টানাসুরে গদ্যালাপ পরমানন্দ রীতির মার্জিত রূপ।

          যমজ ভ্রাতা শ্রীদাম-সুবল ‘কালীয়দমন যাত্রায়’ বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা অনুসারে, ১৮২০ সালের অক্টোবর মাসে ৭০-৭২ বৎসর বয়সে শ্রীদামের মৃত্যু ঘটে। ‘কালীয়দমন-যাত্রাকালে’ তাঁরা জলাশয়ের উপরে কৃত্রিম পরিবেশ তৈরী ক’রে অভিনয় করতেন। এঁদের পর থেকে ‘কালীয়দমন যাত্রা’ ‘কৃষ্ণযাত্রা’ নামে পরিগণিত হতে থাকে। ‘কৃষ্ণযাত্রা’য় বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন প্রেমচাঁদ গোস্বামী। তিনি কৃষ্ণযাত্রার সুর বিলম্বিত ক’রে পয়ার ধরণের বাক্যবিন্যাস এবং পয়ার শেষে ‘তুক্কো’ রীতি পরিহার ক’রে চৌপদী আবৃত্তি করতেন। বৈষ্ণবপদের ব্রজবুলি সাধারণ শ্রোতার সামনে প্রায়োগিক দক্ষতায় তাদের হৃদয় জয় করেছিলেন। প্রেমচাঁদের শিষ্য বদন পর্যন্ত ছিল পুরাতন ধারার যাত্রার কাল। বদনের অধিকারী মৃত্যুর  চল্লিশ বেয়াল্লিশ বছরের মধ্যে (১৮৪৬ অব্দ অনুযায়ী) এই যাত্রার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটে।

          বঙ্গসংস্কৃতির ইতিহাসে উনিশ শতক একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। ঊনবিংশ শতকে শুধুমাত্র দর্শক শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের জন্য তৈরি ‘যাত্রাভিনয়’ আধুনিকতার প্লাবনে বিষয়বস্তুতে, কলারূপে ও আদর্শে অনেকখানি পরিবর্তন সাধন করল। এ যুগের অসাধারণ নাট্যব্যক্তিত্ব ছিলেন গোবিন্দ অধিকারী। পালার রচনাকার, প্রযোজক, অভিনেতা, গীতিকার—এ সবই যখন এক ব্যক্তিতে মিলিত হত, তিনি হতেন ‘অধিকারী’। দুর্গাদাস লাহিড়ী মহাশয়ের ‘বাঙালীর গান’ অনুসারে গোবিন্দ অধিকারীর জন্ম হুগলীর খানাকুল কৃষ্ণনগরের নিকট জাঙ্গীপাড়ায় বৈষ্ণববংশে ১৭৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে।

          স্বভাবকবি গোবিন্দ অধিকারী বদন অধিকারীর দলে প্রবেশ ক’রে সখীর ভূমিকায় অভিনয় করতে শুরু করেন এবং পরে দল তৈরী ক’রে যুগধর্মকে মান্যতা দিয়ে পূর্বতন আদর্শকে পরিত্যাগ করে কৃষ্ণযাত্রাকে নতুনভাবে ও রূপে সাজালেন। পূর্বের ‘কালীয়দমনে’ গানের ভাগ ছিল বেশি, সঙ্গে পয়ার ও চতুষ্পদীর সুরেলা আবৃত্তি। গোবিন্দ অধিকারী ‘ঘটকালি প্রথা’ সম্পূর্ণ বর্জন করে অভিনয়কলাকে গুরুত্ব দেন, ফলে যাত্রাগান গানের সঙ্গে অভিনয়কলা হয়ে উঠল। যথাযথ সংলাপ প্রয়োগের পাশাপাশি তিনি তাঁর যাত্রায় সংযোগ করলেন কীর্তনাঙ্গ গান—যা ইতর ভদ্র সবাইকেই আকৃষ্ট করল। তাঁর শুকসারীর দ্বন্দ্ব বা চূড়ানূপুরের দ্বন্দ্ব পরবর্তীতে যাত্রায় অপ্রচলিত হয়ে পড়লেও সাধারণের কণ্ঠে বহুদিন প্রচলিত ছিল। গানে তাঁর সুকণ্ঠ এবং সুদক্ষ সুরপ্রয়োগ ছিল এই জনপ্রিয়তার কারণ। এর সমাদরের উল্লেখ আছে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে। শিল্প ও সাহিত্যসৃষ্টির দিক থেকে গোবিন্দ অধিকারীর পালাগান উচ্চতর কোন দৃষ্টান্ত না হ’লেও অভিনয় শিল্পমূর্তিতে তিনি দর্শকের মনে ছিলেন সজীব—যা এ যুগে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করা সহজ নয়।

          গোবিন্দ অধিকারীর পরে বাংলা যাত্রাগানের ক্ষেত্রে যে নামটি আসে তা হল কৃষ্ণকমল গোস্বামীর (১৮১০-১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দ)। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের অত্যন্ত জনপ্রিয় এই যাত্রাকার সাধারণ যাত্রাগানের থেকে উচ্চ ভাবকল্পনা ও সূক্ষ্ম ভক্তিরস তুলে ধরতে খানিকটা সমর্থ হয়েছিলেন, যদিও তাঁর রীতি পদ্ধতি ছিল পুরাতনপন্থী। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের পার্শ্বচর সদাশিব কবিরাজের বংশে তাঁর জন্ম হয়। জন্মস্থান নদীয়া জেলার ভাজনঘাট। বাল্যকালে পিতার কাছে সংস্কৃত শিক্ষা এবং সংগীতে হাতেখড়ি, নবদ্বীপের টোলে সংস্কৃত অধ্যয়নকালে ‘নিমাইসন্ন্যাস’ পালা রচনা ক’রে খ্যাতিলাভ করেন। কলকাতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক পদের প্রস্তাবে অসম্মত হয়ে স্বাধীনভাবে জীবনযাপনে তিনি উৎসুক হন। তাঁর রচিত পালাগানগুলির মধ্যে ‘স্বপ্নবিলাস’, ‘দিব্যোন্মাদ বা রাই উন্মাদিনী’, ‘বিচিত্রবিলাস’, ‘কালীয়দমন’, ‘নিমাই সন্ন্যাস’, ‘ভরতমিলন’, ‘গন্ধর্বমিলন’, ‘শ্রীরাধার মানভঙ্গ’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাঁর জীবৎকালেই কলকাতায় আধুনিকতার বন্যা চলেছে, ইতালীয় অপেরার আদলে চলেছে গীতিনাট্য, সাহিত্যে এসেছেন বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর উপন্যাসের পসরা সাজিয়ে; তথাপি তাঁর যাত্রাগানের সরলতা, স্বতোৎসারিত ভক্তিরস, বৈষ্ণবতত্ত্বের সহজ সরল ব্যাখ্যায় শিক্ষিত সমাজও ছিলেন তাঁর গানের প্রতি অনুরক্ত। কৃষ্ণকমলের রচনায় গানেরই প্রাধান্য। দিব্যোন্মাদ বা ‘রাই উন্মাদিনী’ পালার প্রায় সব গানই মনোহরশাহী ঢঙে গাওয়া কীর্তন। নিজে সুদক্ষ গায়ক। সুরেলা কথকথা তাঁকে এইভাবে গানপ্রয়োগের প্রেরণা দিয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। কৃষ্ণকমলের গানের ভাষা ছাপার অক্ষরে অনেকক্ষেত্রে প্রীতিকর নয়, রবীন্দ্রনাথ এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিলেন, তথাপি এই গানের আসল রস গায়নরীতিতে। পুরানো যাত্রা রীতিকে নতুনভাবে যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা-স্থাপনে কৃষ্ণকমলের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

          কৃষ্ণযাত্রার শেষপর্বের প্রধান যাত্রাকার হিসাবে বিখ্যাত ছিলেন নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় বা কণ্ঠমশাই। বর্ধমান জেলার দুর্গাপুর রেল স্টেশনের তেরো মাইল উত্তরে ধরণীগ্রামে  ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বামাচরণ মুখোপাধ্যায়, মাতা সরস্বতী দেবী। ‘কণ্ঠ’ বা ‘কণ্ঠমহাশয়’ নামে পরিচিত নীলকণ্ঠ বাল্যকাল থেকেই সুকণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। তিনি নিজেও দূতীর ভূমিকায় অভিনয় ক’রে সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর যাত্রার দল শহর কলকাতা এবং কলকাতার বাইরে বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, নদীয়া, মেদিনীপুর এবং বাংলার বাইরেও অভিনয় করেও তাঁর যাত্রাগানের সুখ্যাতি ব্যপ্ত ছিল। নবদ্বীপের গুণীসমাজ-কর্তৃক তিনি ‘গীতরত্ন’ উপাধি লাভ করেছিলেন। রামকৃষ্ণকথামৃত আনুসারে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর গান শুনে ভাবাবিষ্ট হতেন। শ্রীপতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের তথ্যানুযায়ী রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান শুনে খুশি হন ও তাঁর পৌষ-উৎসবে তাঁকে আমন্ত্রণ করেন। ১৩০০ বঙ্গাব্দ থেকে তাঁর কৃষ্ণযাত্রা সুনাম পেতে থাকে। তাঁর দলে ৫০-৬০ জন লোক মিলে ছয় সাত ঘন্টার তাঁর পালাগুলি অভিনয় করত। তাঁর পালায় কখনও নিজের গান, কখনও গুরুর গান থাকত। তাঁর স্বরচিত যাত্রাপালার সংখ্যা সাত—‘চণ্ডালিনী উদ্ধার’, ‘প্রভাস যজ্ঞ’, ‘কংসবধ’, ‘যযাতির যজ্ঞ’, ‘মান’, ‘মাথুর’ ও ‘কলঙ্কভঞ্জন’। ‘ব্রজলীলা’ পালা তিনি শেষ করতে পারেননি। নীলকণ্ঠের গানে বহু স্থলে বৈরাগ্যের সুর ফুটে উঠলেও তাঁর গান আসলে ভক্তিভাবোদ্যোতক।

          যাত্রাগান যে কলকাতা শহরের অন্যতম প্রিয় বিষয় ছিল, হুতোমের নক্‌শা-রচনায় তার একটি যথাযথ ছবি পাওয়া যায়—“ যাত্রার অধিকারীর বয়স ৭৬ বৎসর, বাব্‌রি চুল, উল্‌কী ও কানে মাকড়ি! অধিকারী দূতী সেজে গুটি বারো বুড়ো বুড়ো ছেলে সখী সাজিয়ে আসোরে নাব্লেন। প্রথমে কৃষ্ণ খোলের সঙ্গে নাচ্‌লেন, তার পর ব্যাসদেব ও মণি গোঁসাই গান করে গ্যালেন। সকেষ্ট সখী ও দূতী প্রণপণে ভোর পর্য্যন্ত “কাল জল খাবোনা!” “কাল মেঘ দেখবোনা!!” (সামিয়ানা খাটাইয়ে দিমু) “কাল কাপড় পরবো না” ইত্যাদি কথা বার্ত্তায় ও “নবীন বিদেশিনীর” গানে লোকের মনোরঞ্জন কল্লেন। থাল, গাড়ু, ঘড়া, ছেঁড়া কাপড়, পুরাণ বনাত্‌ ও সালের গাদী হয়ে গ্যালো। টাকা, আদুলী, সিকি ও পয়সা পর্যন্ত প্যালা পেলেন। মধ্যে মধ্যে “বাবা দে আমার বিয়ে” ও “আমার নাম সুন্দুরে জেলে, ধরি মাছ্‌ বাউতি জালে” প্রভৃতি রকমওয়ারি সংএরও অভাব ছিল না। ব্যালা আট্টার সময় যাত্রা ভাংলো” 

          ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই নাগরিক বাঙালি ক্রমে পাশ্চাত্যের শাসনের ফলে বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন ও সমাজসচেতন হয়ে উঠল। তাই আনন্দভোগের উপাদান ও তার বহিঃপ্রকাশকেই নতুন যুগের মানুষ মেনে নিয়ে শিল্প উপভোগ শুরু করল, এবং তার ফল হল কবিগান, আখড়াই-হাফ আখড়াই যা পৌরাণিক উপাদানকে গ্রহণ করলেও বাস্তব আনন্দকে সামনে রেখেই তৈরি হয়ে চলল। ভক্তি ও আবেগ-মিশ্রিত ‘কৃষ্ণযাত্রার’ স্থলে এলো নতুন ধরণের যাত্রা—ঊনবিংশ শতকে এই যাত্রাকেই সখের যাত্রা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। পূর্বের গীতিনির্ভরতাকে ত্যাগ করে সখের যাত্রা হয়ে উঠল পুরোপুরি Profane—এর উদ্দেশ্য হ’ল শুধুমাত্র দশকি-শ্রোতেকে আনন্দ বিতরণ। মফঃস্বলেও এমনটি শুরু হ’ল। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত গ্রাম ও মফঃস্বলে এই যাত্রা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সমাচার দর্পণে ১৮২২ এর ১৮, ২২ ও ২৬ জানুয়ারি) এই ধরণের যাত্রাভিনয়কে ‘নূতন যাত্রা’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে চরিত্র উপযোগী সাজসজ্জাকে বলা হয়েছে ‘সং সাজা’। রামচাঁদ মুখোপাধ্যায় ‘নন্দবিদায়’ পালার অভিনয় করান। যাত্রায় আখড়াই গান ও  নিধুবাবুর টপ্পার ধারা অনুসৃত হয়, পাশাপাশি কীর্তনও ঐশ্বর্য নিয়ে হাজির হয়।

          ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে নাট্যমঞ্চের পাশাপাশি কলকাতা ও মফঃস্বলের অসংখ্য যাত্রার দল গড়ে উঠতে থাকে। এঁদের মধ্যে পীতাম্বর দাস, বলাই ঠাকুর, দুর্লভ দাস, শ্রীনাথ ও গিরিশচন্দ্র চক্রবর্তী, মাধবদাস, রাইচরণ বেরা, গোবিন্দ পাঠক, অদ্বৈত পাল, মতিলাল চক্রবর্তী, যাদব বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামাচরণ গাঙ্গুলী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। মধ্য কলকাতার হাড়কাটা গলির দুর্গা ঘড়িয়াল যাত্রাগানে দোহারে বয়স্কদের বদলে বালকদেরকে নিয়োগ করেন। যশোরের রসিকলাল চক্রবর্তী ‘বালকসঙ্গীত’ নামে বালকযাত্রার দল তৈরী করেন। এঁরা যাত্রা নিয়ে নানা চিন্তাভাবনা ও তার পরিবর্তন সাধন করেন। যাত্রা-লেখক হিসাবে নড়াইলের অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ, বিষ্ণুপুরের শ্রীবাস দাস, বরিশালের গোবিন্দ ধুপিরা উল্লেখযোগ্য।

          চন্দননগর-চুঁচুড়ার ‘মদন মাস্টার’ নামে পরিচিত মদনমোহন চট্টোপাধ্যায় শখের যাত্রাগান গড়েও পরে তা পেশাদার দলে পরিবর্তিত হয়। এই মদন মাস্টারের হাতেই যাত্রায় প্রথম ‘জুড়িগানে’র প্রচার হয়। তিনিই অভিনেতাদের তাৎক্ষণিক সংলাপ প্রয়োগ থেকে বিরত করেন। এছাড়াও পূর্বোক্ত যাত্রাদল কর্তৃক পেলা চাওয়ার প্রথা বন্ধ করে দেন। মদন মাস্টার রচিত ‘পরজ-বাহার’ রাগের গান—‘গয়াগঙ্গা প্রভাসাদি কাশী-কাঞ্চী কে বা চায়’ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বিশেষ প্রিয় ছিল। মদন মাস্টারের মৃত্যুর পর পুত্র ‘নবীন মাস্টার’ যাত্রার দায়িত্ব নেন ও তাঁর অকাল প্রয়াণে হাল ধরেন স্ত্রী কৈলাসবাসিনী এবং যাত্রাদলের নাম হয় ‘বৌ মাস্টারের দল’। নবদ্বীপের ‘বউ-কুণ্ডুর দল’-এই দলের অনুরূপে গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে ‘রাধারাণী যাত্রাসম্প্রদায়’ এই রীতির দলের প্রতিনিধিত্ব করেন।

বিদ্যাসুন্দর যাত্রা:

খ্রিস্টীয় উনিশ শতকের শেষে পৌরাণিক কাহিনিভিত্তিক যাত্রাগানের প্রচলন থাকলেও বৈশ্য কলকাতায় আমোদপ্রেমীদের সন্তুষ্টির জন্য ক্রমে লৌকিক কাহিনিভিত্তিক যাত্রাগানের ধারাটি  জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করল। সেখানে ভবানীপুরের দলের ‘নল-দময়ন্তী’ পালার পাশাপাশি ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরকে সামনে রেখে তার সঙ্গে উদগ্র আদিরসের মিশ্রণ ঘটিয়ে এক নতুন চটুল নৃত্যগীতাত্মক যাত্রাসমগ্র কলকাতা ও গ্রামগঞ্জকে একেবারে মাতিয়ে তুলল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে উনিশ শতকের পাঁচ দশকে এর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৮২১ এর সমাচার দর্পণে এই যাত্রার সম্বন্ধে বর্ণনা আছে। সম্ভবত বরাহনগরের ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায় সর্বপ্রথম বিদ্যাসুন্দর যাত্রার দল গড়ে তোলেন। ক্রমে এই যাত্রাদলের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এই যাত্রায় নতুনত্বের সূচনা করেন ভবানীপুরের বেলতলার দল। বেহালা বাদক প্যারীমোহনের এই যাত্রার দল যাত্রার সাজ পোষাক, রীতিপদ্ধতি ও গানবাজনার সংস্কার সাধন করেন। লঘুসুরের চটুল রীতিতে গানগুলি জনপ্রিয় হয়েছিল। নবীনচন্দ্র বসুর নিজ বাড়িতে রঙ্গমঞ্চে অভিনীত বিদ্যাসুন্দর অনেকখানি থিয়েটারি ঢঙয়ে হয়েছিল, তা ১৮৩৫ এর ‘Hindoo Pioneer’ অনুসারে জানতে পারা যায়। এছাড়াও স্বরূপ দত্ত, ধনেখালির বাগ্‌দির যাত্রাও উল্লেখযোগ্য।

          বিদ্যাসুন্দরের যাত্রায় গোপাল উড়ে এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য নাম। উড়িষ্যার যাজপুরের কায়স্থ বংশে ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম হয়। পিতা মুকুন্দদাস। ১৮-১৯ বছরে কলকাতায় রাধামোহন সরকার তাঁর বিদ্যাসুন্দর যাত্রাদলে গোপালকে ভর্তি করে নেন। দুবছরের মহড়ার পরে শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের বাড়িতে যাত্রার আয়োজন হয়। গোপাল এখানে বিদ্যাসুন্দরের মালিনীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। এরপর গোপাল নিজে যাত্রাদল খুললেন এবং তার আনুকূল্যে রাধামোহনের পালা আরও হালকা রূপলাভ করল। গীতিরচনার লঘুত্বে বিদ্যাসুন্দর পালার গান-রচয়িতা শ্যামলাল মুখোপাধ্যায়, ভৈরব হালদাররা দায়ী। গোপাল হালকা রাগের প্রয়োগ করেন ও ভাবোদ্দীপক লঘুচালেরর মেয়েলী নৃত্য, আদিরসাত্মক অঙ্গভঙ্গীর প্রচলন করেন। গোপালের হালকা চালের টপ্পা ‘গোপাল উড়ের টপ্পা’ নামে প্রচলিত। তিনি এই স্ত্রীর হালকা চাল ও চটুলতা নিয়ে এসে খেমটা নাটের সঙ্গী করলেন। পালার ভিস্তি, কালুয়া ও মেথরানীর মজাদার গান উপভোগ্য ছিল। বঙ্গদর্শনে যদিও এই যাত্রাপালার তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। হুতোমের বর্ণনাতেও বিদ্যাসুন্দর যাত্রার একটি হাস্যোদ্দীপক বর্ণনা আছে—“একবার সহরের শামবাজার অঞ্চলের এক বনিদী বড় মানুষের বাড়িতে বিদ্যাসুন্দর যাত্রা হচ্ছিলো, বাড়ির মেজো বাবু পাঁচো ইয়ার নিয়ে যাত্রা শুন্‌তে বসেচেন; সাম্‌নে মালিনী ও বিদ্যে “মদন আগুন জ্বলচে দ্বিগুণ কল্লে কি গুণ ঐ বিদেশী” গান করে মুটো মুটো প্যালা পাচ্চে—বছর ষোল বয়সের দুটো (ষ্টড্‌ ব্রেড) ছোকরা সখী সেজে ঘুরে ঘুরে খেম্‌টা নাচ্চে। মজ্‌লিসে রূপোর গ্ল্যাসে ব্র্যাণ্ডি চল্‌চে—বাড়ীর টিক্‌টিকী ও শালগ্রাম ঠাকুর পর্য্যন্ত নেশায় চুরচুরে ও ভোঁ! ক্রমে মিলনের মন্ত্রণা, বিদ্যার গর্ভ, রাণীর তিরস্কার, চোর ধরা ও মালিনীর যন্ত্রণার পালা এসে পড়্‌লো; কোটাল মালিনীকে বেঁধে মাত্তে আরম্ভ কল্লে—মালিনী বাবুদের “দোহাই” দিয়ে কেঁদে বাড়ী সরগরম করে তুল্লে—বাবুর চম্‌কা ভেঙ্গে গ্যালো; দেখ্‌লেন কোটাল মালিনীকে মাচ্চে, মালিনী বাবুর দোহাই দিচ্চে অথচ পার পাচ্চে না। এতে বাবু বড় রাগত হলেন “কোন্‌ বেটার সাধ্যি আমার কাছ থেকে মালিনীকে নিয়ে যায়” এই বলে সাম্‌নের রূপোর গেলাসটি কোটালের রগ ত্যেগে ছুঁড়ে মাল্লেন” । কলকাতার শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কাছে এই যাত্রাগানের অপযশ থাকলেও উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেও এই যাত্রাগান কলকাতা ও মফঃস্বলে প্রচলিত ছিল। এই সব যাত্রাগানের পরিবেশকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মতিলাল রায় ও ব্রজমোহন রায়।

          সমগ্র খ্রিস্টীয় উনিশ ও বিশ শতকের বঙ্গ-সংস্কৃতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, সংগীতের অনেক শাখার উৎপত্তি ও অবলুপ্তি সাধিত হলেও একমাত্র যাত্রাগান চৈতন্যপূর্ব কাল থেকে এখনও তার অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে। এর একমাত্র কারণ যুগের সঙ্গে সঙ্গে তার খাপ খাইয়ে নেবার প্রবণতা। বর্তমান দিনেও যাত্রাপালা রচিত হয়ে চলেছে। আজকের সাধারণ শিক্ষিত সমাজ এর প্রতি কিছু অমনোযোগী হয়ে পড়লেও তা আজও বেঁচে আছে। আধুনিক যাত্রাপালাকার হিসেবে ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ (বড়ো ফণী) ও ব্রজেন্দ্রনাথ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। উত্তর কলকাতায় ‘ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ মঞ্চ’ নামে স্থায়ী যাত্রামঞ্চ স্থাপিত হয়েছে। যাত্রাগানের সঙ্গে বাঙালি জাতির ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আতি বাঙালি জাতি ও বাংলা সংগীতের ইতিহাস বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে যাত্রার ভূমিকা অনেকখানি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seventeen − nine =