ভাগ্যকে মানতেই হয়

  নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী, পর্ণশ্রী, কলকাতা  

##

                    (১)

         পাঁচ ব্যাটারীর টর্চের আলোতে পুলিশ ইন্সপেক্টর বাইরের গেট, ঘরের বাইরে কোলাপ্সীবেল গেট ও সর্বশেষে ঘরে ঢোকার দরজার তালা একের পর এক ভাঙ্গার পরে চারজন পুলিশ কর্মীকে নিয়ে দোতলার বিশাল ড্রয়িংরুমের ভিতর এসে দাঁড়ালেন।  অন্ধকার ঘরের লাইটের সুইচ পেতে তাদের বিশেষ বেগ পেতে হলো না কারন পাঁচ ব্যাটারীর দু’দুটি টর্চ তাদের সাথে ছিলো। সন্ধ্যা তখন প্রায় হয় হয়। পাড়ার জনৈক ব্যক্তির ফোনে তাদের এখানে আসা।  জনৈক ব্যক্তি পুলিসকে জানান,  বাংলোসম বিশাল দোতলা বাড়ি থেকে  কয়েকদিন ধরেই পচা দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে! ঘরের ভিতর ঢুকেই প্রত্যেকেই নাকে রুমাল চাপা দেন। অগ্রহায়ণের শীতের সন্ধ্যা; বেশ জাঁকিয়ে ঠান্ডাও পড়েছে।  সকাল থেকেই কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়েছে প্রকৃতি। এই ঠান্ডার মাঝেও ওই বাড়ির বাইরে পুরুষ ও মহিলা গিজগিজ করছে।  সকলের ভিতরই একটি চাপা ফিসফিসানি!  এখানে তো পারমান্যান্টলি কেউ থাকেনা; মাঝে মাঝে রাতের দিকে লাইট জ্বলতে দেখা যায়!  কিণ্তু সেভাবে কাউকে কোনদিনও দেখা যায়নি ।  চারিদিকে উঁচু প্রাচীরে ঘেরা ।  সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে ফুলের বাগান।  মাঝে মাঝে এক বৃদ্ধকে ওই বাড়িতে দেখা যায় বটে কিণ্তু সে নিজেকে ওই ফুল বাগানের মালি বলেই পরিচয় দেয়। বাড়ির বাইরেও বিশাল পুলিশ বাহিনী দাঁড়িয়ে; যাতে করে কোন পাড়ার লোক ভিতরে ঢুকতে সাহস না পায়।

ইন্সপেক্টর উত্তম মজুমদার ও তার সহকর্মীরা ঘরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে বিভৎস দৃশ্য দেখে কয়েক সেকেন্ড কেউই কথা বলতে পারেননি। সারাঘর রক্তে ভেসে গেছে যদিও সেই রক্ত এখন শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। মধ্য বয়স্ক দুই ভদ্রলোক -একজন সোফার কাছে আর একজন বাথরুমের দরজার কাছে পড়ে আছেন। দুজনকেই ছুরিকাঘাত করে মারা হয়েছে। ঘরের মধ্যে ইতস্তত মদের বোতল,  গ্লাস, নানান ধরনের খাবার দাবার ছড়ানো ছিটানো। বোঝাই যাচ্ছে মৃত দুই ব্যক্তির সাথে আরও এক বা একাধিক লোক ছিলো। যে বা যারা বচসার জেরে এদের দু’জনকে খুন করে সকলের অলক্ষ্যে এই বাড়ি থেকে ধীর স্থির ভাবেই বেরিয়ে গেছে।  সমস্ত ঘর সার্চ করে সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়ে না কারও। বডি দুটিকে ময়না তদন্তের জন্য পাঠিয়ে বাড়িটা সিল করে ইন্সপেক্টর তার দলবল নিয়ে থানার উদ্দেশে রওনা দেন।

                      (২)

                ছোটবেলা থেকেই চন্দন পড়াশুনায় খুব ভালো। প্রতি বছরই সে প্রথম হয়ে উপরের ক্লাসে ওঠে। স্কুলের শিক্ষকেরা প্রত্যেকেই চন্দন সম্পর্কে উচ্চ ধারনা পোষণ করেন ও তার উজ্জ্বল ভবিষৎ চোখের সম্মুখে দেখতে পান। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সে 90% নম্বর নিয়ে পাশ করে বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়। কিণ্তু উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে সে রেলের চাকরীর পরীক্ষা দিয়ে রেলে চাকরী পেলেও তার বাবা তাকে ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হতে বলেন।  বাধ্য চন্দন বাবার ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেয়। ফলে তার জীবনে স্বেচ্ছায় লক্ষ্মী এসে ধরা দিলেও ভাগ্যের পরিহাসে তাকে তা খোয়াতে হোলো। তিন ভাই বোনের বড় চন্দন।  বড় ছেলের উজ্জ্বল ভবিষৎ বাবাও কল্পনা করেছিলেন। ছোট ছেলে ও মেজ মেয়েটি পড়াশুনায় ছিলো মোটামুটি। হুগলির প্রত্যন্ত গ্রামে সামান্য যা কিছু জমিজমা ছিলো তিনি সকলের অজান্তেই ছোট ছেলের নামে উইল করে রাখেন।  তার ধারনা অনুযায়ী চন্দন পাশ করে বেরিয়েই চাকরী পাবে আর তখন সে গ্রামে থাকবেও না, নিজেরটা নিজে চালিয়ে নিতে পারবে।  তাই অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছোট ছেলেকেই তিনি তার সম্পত্তির পুরোটা লিখে দেন। যেহেতু সরকারী খরচে চন্দন  পড়াশুনা করতো তাই তাকে নিয়ে তার বাবার কোন চিন্তা ছিলো না। টুকটাক হাত খরচ সে টিউশনি করেই জোগাড় করতো।  চন্দনের ইঞ্জিনিয়ারিং এ যখন তৃতীয়বর্ষ তখন তার বোন চারুলতার বেশ অবস্থাপন্ন ঘরেই বিবাহ হয়ে যায়।  চন্দনের স্কুল শিক্ষক বাবা মেয়ের বিয়ের ঠিক এক বছরের মধ্যেই মারা যান। চন্দন ভালভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং এ পাশ করে চাকরীর জন্য হন্যে হয়ে ইন্টারভিউ দিয়ে যেতে লাগলো।  কিণ্তু কোথায় চাকরী ? চাকরীর চাবি তো সব নেতাদের হাতে! সরকারী থেকে বেসরকারী! গ্রামের ছেলে চন্দনের তো কিছু ভালো সর্টিফিকেট ছাড়া আর কিছুই নেই। তাই চাকরীও তার মেলে না। সাথে আলোচনা করে ঠিক করে ভায়ের মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেই গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে তারা কলকাতায় ছোটখাটো একটা ভাড়া বাড়িতে এসে উঠবে। ভাইকে কলকাতার কলেজেই ভর্তি করবে; নিত্য সে প্রাইভেট কোম্পানীগুলিতে চাকরীর চেষ্টা করার সাথে সাথে কিছু টিউশনি করতেও পারবে। মাকে দিয়ে বাড়ির দলিল বের করিয়ে উইল দেখে সে হতভম্ব! বাবা তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছেন!  কিণ্তু কেন?  কি তার অপরাধ ছিলো ? বাবা কেন এটা করলেন ?

ভয়ানক অভিমান থেকে চন্দন পরদিন সকালেই মা, ভাইকে কিচ্ছুটি না জানিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে।  সে কলকাতা শহরে নানান জায়গায় চাকরীর চেষ্টা করতে লাগে। বলা বাহুল্য তার এই মনের ইচ্ছা পূরণ হয়না। একদিন রাতের আঁধারে স্টেশনে নিজের অজান্তেই একটি খুনের সাক্ষী হয়ে যায়।  খুনীদের  সেটা নজর এড়ায় না।  চন্দনকেও তারা মেরে ফেলতে যায়। চন্দনের কাকুতি মিনতিতে দয়া পরবশ হয়ে তারা চন্দনের চোখ বেঁধে তাদের বসের কাছে নিয়ে যায়। চন্দনের কাছে তাদের পারিবারিক ঘটনা জেনে ও তার কোন পিছুটান নেই শুনে তিনি বস তাদের দলে ওকে ভিড়িয়ে নেন;  নাহলে খুনের ঘটনার সাক্ষী থাকার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড!

চন্দন আস্তে আস্তে হয়ে উঠে কুখ্যাত ডাকাত শমশের খান ।

  (৩)

          ক’দিন আগেই বেলেঘাটার জনবহুল এলাকায় ব্যাঙ্ক ডাকাতির সূত্র ধরে প্রশাসন জানতে পারেন সেদিনের বিলাসবহুল ওই বাড়ির দুই ব্যক্তির খুনের সাথে ব্যাঙ্ক ডাকাতির সংযোগ রয়েছে। ব্যাঙ্কের গোপন সি.সি.ভি. টিভির মাধ্যমে সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে যে দুই ব্যক্তি খুন হয়েছেন তারা ওই ব্যাঙ্ক ডাকাতির তিন মূল মাথার দুই মাথা। মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা থাকলেও দুঁদে পুলিশ অফিসারদের মৃত দুই  ব্যক্তির মুখের সাথে তাদের মিল খুঁজে পেতে একটুও অসুবিধা হয়না ! সাথে আর যে তিন চারজন ছিলো তাদের খুঁজতে খুঁজতেই প্রসাশনের কালঘাম ছুটে যায়.

(৪)

          কর্তব্যনিষ্ঠ পুলিশ অফিসার তার সমস্ত রকম সোর্স কাজে লাগিয়ে জানতে পারেন ওই ব্যাঙ্ক ডাকাতির সাথে কুখ্যাত সমাজ বিরোধী শমসের খানের যোগাযোগের কথা।  সেদিন ব্যাঙ্ক ডাকাতির পর ভাগ বাটোয়ারা হচ্ছিল প্রাসাদোপম ওই বাংলো বাড়িতে, যার মালিক আমেরিকায় থাকেন; বাড়িটি দেখভালের জন্য ওই মৃত এক ব্যক্তির নিকট  বাড়ির চাবি ন্যস্ত থাকে। সমস্ত খবরাখবর নিয়ে বিশেষ সোর্সের মাধ্যমে খবর পেয়ে এস্প্লানেডের নামকরা বার থেকে শমসের খানকে গ্রেপ্তার করতে যেয়ে হতভম্ব হয়ে যান! এ কাকে দেখছেন তিনি ? শমসের খান নামে পরিচিত কুখ্যাত সমাজ বিরোধী, খুন, রাহাজানি, ব্যাঙ্ক ডাকাতি, প্রশাসনের সন্ত্রাস, ধনীব্যক্তির রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার মূল ব্যক্তি -একদা মেধাবী ছাত্র, সকলের প্রিয়, ইঞ্জিনিয়রিং এ ফাস্ট ক্লাস পাওয়া তার দাদা চন্দন মজুমদার? সামান্য অভিমান থেকে দাদার আজ এই চরম পরিনতি? কিণ্তু কেন?  কি কারনে দাদা এই অন্ধকার পথ বেছে নিল?  তবে কি বেকারত্বের জ্বালা? কিণ্তু কিছুই জিজ্ঞাসা করতে সে পারলো না! পুলিশকে অ্যারেস্ট করার অর্ডার দিয়ে দাদার চোখ ভর্তি জলের দিক থেকে তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলেন যাতে তার নিজের চোখের জল তার অতি প্রিয় দাদার চোখে ধরা পড়ে না যায়। তিনি ভালোভাবেই জানেন শমসের খান বা তার দাদার কি চরম শাস্তি হতে পারে। দু’জনের মনেই নানান প্রশ্ন!  কিণ্তু জিজ্ঞাসা করার অধিকার আজ আর কারও নেই কারন একজন আইনের রক্ষক আর একজন আইনের ভক্ষক !

 

গাড়ি ছুটলো থানার উদ্দেশে।

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × five =