রাজপুত্র


        মণিকুন্তলা ভট্টাচার্য
        মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস


        জ্যাকেটের পকেটে হাত ভরিয়ে সে রাস্তাটা পার হল।বাইকে বসে অনেক সময় পার করার মতো ওপারে অপেক্ষা করছে নিয়র।দ্রুত পায়ে রাস্তা পার হল। নিয়রের পেছনে উঠে বসল। মুনলাইটের সামনে বাইকটা রেখে নিয়র বলল-‘যা এটা নিয়ে আয়।‘
        ‘না,আজ লাগবে না।‘
        ‘তাহলে?’
        ‘বাড়ি চল।‘
গেটের সামনে তার মা অপেক্ষা করছিল। আগের রাতে ঘুমোতে না পারা, এক গ্লাসও জল খেতে না পেরে উদ্বিগ্ন একজন মানুষকে যেরকম দেখায়, তার চেয়েও অনেক বেশি ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে।
        সে চোখ নিচে নামিয়ে বাইক থেকে নেমে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। নিয়র চলে গেল। সে বাড়ির দিকে এগোল,  পা এগোতে চায় না, চোখ তুলতে পারছে না।ঐ যে মাত্র দুহাত দূরে তার মা অপেক্ষা করছে, স্কুলের পরীক্ষায় সাদা খাতা জমা দিয়ে
এসেছে, কখন ও কোনো পরীক্ষায় দ্বিতীয় না হওয়া ছেলে সে, তার ওপরে মায়ের বিরাট আস্থা, এই যে সে সাদা খাতা জমা দিয়ে এসেছে, লেখার সময় সমস্ত উত্তর মনে থাকলেও বিশৃঙ্খ্লা লেগেছিল, অর্থহীন যেন মনে হচ্ছিল। এই যে সে প্রথমবারের জন্য ভাঙের সিগারেট খেয়ে বাড়ি ফিরছে।এই যে সে শ্বশুর বাড়ি থেকে অপমানিত হয়ে ফিরছে।এই যে সে বাবার সমাধির কাছে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে কাক ভিজে
বাড়ি ফিরছে। মায়ের রক্ত পরীক্ষার কাগজ পকেটে নিয়ে ফিরছে। চিকিৎসক বারবার একই কথা বলছেন – যে কয়দিন আছে বাড়িতেই থাকুন,লাস্ট স্টেজ।
        ‘এসেছিস?’
        সে মাথা তুলল। মা গেটটা খুলে দিলেন। বারান্দায় কাজ করা মহিলাটি দ্রুত ভেতরে চলে এলেন। সে বারান্দায় বসল। জুতোমোজা খুলল। জ্যাকেট খুলল। শার্ট-গেঞ্জি খুলল।
        মা অপেক্ষা করছিল। চোখদুটি ছেলের শরীরে ঘুরে বেড়াল। সারাটা রাত পুলিশ কি তাকে এমনিই বসিয়ে রেখেছে? নিশ্চয় মারধর করেছে। জ্বলন্ত সিগারেট নিশ্চয় পুড়েছে।
        মা অধৈর্য কণ্ঠে বলল-‘ওরা কী কী করেছে?‘
        ‘কিছুই করেনি।দুটো প্রশ্ন করে বসিয়ে রেখেছিল।‘
        ‘লক-আপে?’
        হ্যাঁ। সে মাথা নাড়ল। সে হাতের ঘড়ি খুলে রেখেছে। কোমরের বেল্ট খুলতে শুরু করেছে। মা বলল-‘কী করছিস?’
        ‘নোঙরা লাগছে।’
        ‘এখানে কেন খুলছিস? বাথরুমে যা।’
        ‘এগুলো সব নোঙরা হয়েছে।’
        ‘তবু।’
        ‘শ্মশান থেকে এসেছি বলেই ধরে নে।’
        মা শিউরে উঠল। দুদিন পরে সে এভাবেই শ্মশান থেকে আসবে। কিন্তু কাকে বলবে সে-একটু আগুন দাও, হাত-পা সেঁকে নিই। ‘কে তাকে উঠোনে স্নান করার জল এগিয়ে দেবে?
        তার চোখ দুটো সরোবর হয়ে উঠল। বুকের মধ্যে পাখি ফেলে যাওয়া শূন্য খাঁচা। সে ভেতরে ঢুকে গেল।মহিলাটিকে নির্দেশ দিল—‘ছেলেটা উঠোনে স্নান করবে, কাপড় গুছিয়ে দাও।’
        সে গিয়ে বিছানায় পড়ল। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারে না। কণ্ঠনালীর কর্কট। গলায় ফুটো। ওতে একটা পাইপ লাগানো আছে। কথাবার্তা ছেলে বুঝতে পারে। কাজের ভদ্রমহিলা আধা বোঝে, আধা বোঝে না।
        পা দুটো বিছানা থেকে ঝুলে থাকা অবস্থায় তিনি তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন। বুকের মধ্যে শূন্য খাঁচা। ছেলে একদিন একটি মেয়ের হাত ধরে নিয়ে এসেছিল। দুজন একসঙ্গে রুরকীর আই.আই.টি তে পড়াশোনা করেছিল। একমাস আগে বাবাকে হারিয়েছে, মাকে একটা নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছে।
        সে নাগপুরের মেয়ে ছিল। তাঁদের ইচ্ছামতো মা নিজের সমস্ত ইচ্ছা ছেড়ে বিয়েটা পেতে দিয়েছিল। ছেলেটাকে সুখী করতে হবে। বুকের ভেতরটা পাখির কূজনে পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। দুজনেরই দিল্লিতে চাকরি। কিন্তু সে বারবার চলে আসে। মেয়েটি ভাবে,নিঃসঙ্গ মায়ের কথা তার মনে পড়ছে।মা ও ভাবে।সবাই ভাবে।কিন্তু সে বিছানায় পড়ে থাকে। বলব কী বলব না উচ্চারণ করে-
        ‘আমার ভালো লাগে না।জব করতে পারব না।’
        মা পাখা মেলে ছেলেকে ঘিরে রাখে। সমস্ত তিরস্কার থেকে তাকে বাঁচাতে চায়। হাতের কানের সমস্ত কিছু রুমালে বেঁধে তার হাতে দিয়ে বলে –‘ব্যাঙ্ক থেকে লোন নে। ব্যবসা কর।’
 সে মায়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মায়ের অবয়ব আবছা হয়ে আসে…সঙ্গে্র দুটো এখনও এই শহরেই আছে, এখনও বিশাল আড্ডা চলছে। সে ওখানে গিয়ে সামিল হয়।
        পাখিটা উড়ে আসে উড়ে উড়ে চলে যায়, ফেলে যায় এক টুকরো কাগজ।কাঁপা কাঁপা হাতে মা কুড়িয়ে নেয়। তিনি বুঝতে পারেন। সমস্তই বুঝেন। তিনি তো স্ত্রী, বিছানার সঙ্গী।তার মা তো নয় যে সমস্ত কিছু সহ্য করবে।
        হাতে বেত নিয়ে তিনি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন।বাড়িতে বেতের কোনো ব্যবহার ছিল না। বাবা স্টেট ব্যাঙ্কের চাকুরিজীবী ছিলেন। অমায়িক স্বভাবের মানুষ ছিলেন। ছেলেকে শাসন করার যা প্রয়োজন মা করতেন, কর্কশ স্বরে ডাকলেই শান্ত হয়ে যেত। অত্যন্ত মেধাবী ছেলে। হাতে সবসময় বি থাকত।
        সেই ছেলে ডিপ্রেশনের শিকার হল।মানুষটার ঘুম ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।জীবন যেন একটা কাঁচের একোরিয়াম। পাকা মেঝেতে পড়ে যায় আর সমস্ত কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। সোনালি-রূপোলি মাছগুলি ধড়ফড় করে ছটফটাতে থাকে।
        তিনি ধড়ফড় করে উঠেন। উঠে বসেন। না না প্রবল ইচ্ছা নিষ্ফল হয়ে যায়। মানুষ যতই প্রবল ইচ্ছাশক্তির কথা বলুক না কেন, সন্তানের সামনে সমস্ত কিছুই অর্থহীন। সন্তানের সামনে পরাক্রমের সমস্ত অস্ত্র সমর্পণ।
        তিনি বিছানা থেকেই শুনতে পাচ্ছেন, ছেলে হুড়মুড় করে শরীরে জল ঢালছেন। আইনগত প্রক্রিয়ায় বিবাহ-বিচ্ছেদ হওয়ার আগে তাঁর স্বামী তার কাছে দৌড়ে এসেছিল, বোধহয় তার পায়েও পড়েছিল, এভাবেই সকালের ট্রেনে এসে উঠোনে গা ধুয়েছিল, নোঙরা হয়ে ছিল বলে। পরে চা-রুটি চিবোতে চিবোতে তাকে বলেছিল—‘সে শুধু পড়াশানাই করেছে, অনেক কিছুই শিখেনি।’
        ‘কেন,কী হয়েছে?’
        ‘আমাকে লাথি বসিয়ে দিল। মানুষ কীভাবে মানুষকে লাথি মারতে পারে? মুখের কথাই যথেষ্ট নয় কি? বল।’
        মায়ের বুকে যেন লাথি। সামলাতে না পেরে তিনি চিৎকার করে উঠেছিলেন। যে সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য ওঝা, ঝাঁড়ফুক, তাবিজ-মাদুলি, পূজা-পার্বণ সমস্ত কিছু করেছিল, মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত কিছু ঠেলে ঠুলে তিনি বলে উঠলেন—
        ‘ওকে ছেড়ে দে।’
        ‘কী?’
        সে মায়ের কথা শুনতে পায়নি। জিহ্বার ভেতরে জলের মতো শব্দগুলি ঘুরছিল। কিন্তু যা বোঝার বুঝে গিয়েছিলাম।একটা শূন্য কাগজে মা জলের আঙ্গুলে যেন প্রাচীন কিছু কথা পুনরায় বলে যাচ্ছিল—সব মায়েই রাজপুত্রের মত ছেলেকে লালন পালন করে, ছেলে রাজার মতো পরাক্রমী হয়ে উঠুক তাই চায়। মা চান রাজচক্রবর্তী রাজাকে সবাই আদর-সম্মান করুক।’
        কিন্তু সে একদিন আদালত থেকে ফিরে আসার পরে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন—‘সে যেরকমই হোক না কেন, মানুষ হিসেবে তারও একটা স্বপ্ন আছে। ফ্রি করে দিলি, এখন সে এগিয়ে নিয়ে যাক,স্বপ্ন পুরো করুক।’
        সে মনে মনে ছিল।বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল তার প্রশ্ন—‘আর আমার স্বপ্ন?’
        মা ছেলের দিকে তাকাতে পারছিল না। পড়াশোনা করে ভালো চাকরি করাটা যে তার
স্বপ্ন ছিল না, ভালোভাবেই তা বোঝা গিয়েছিল। কিন্ত কী হতে পারে তার স্বপ্ন? নেশা, বন্ধুর আড্ডা, এসব তো স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন থেকে পালানোর রাস্তা।
        কী তোর স্বপ্ন?
        না না তাকে জিজ্ঞেস করা যাবে না। সে এখন বিবাহ-বিচ্ছেদের পরবর্তী ডিপ্রেশনে। নিয়মিত ওষুধ খাওয়া। যোগাসন শিখছে।
        সে ভালো হয়ে যাবে। ক্রোধকে দমন করতে পারছে। মন খারাপ করে বসে থাকে না।বাইরে বেশি ঘোরাফেরা করে না। ঘরে বসে থাকে না। সে ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকতে চায়। এটাও ধীরে ধীরে কমে আসবে।তিন যাবার আগে সুস্থ হয়ে উঠবে। সুস্থ মানুষ হয়ে,সৎ নাগরিক হয়ে সে এই সমাজে বাস করবে। পুনরায় সে কাজে যাবে, পুনরায় এই ফিরে আসবে তার দুচোখে
জীবন-জ্যোৎস্না। কোনো একদিন পুনরায় সে নতুন নারীর হাত ধরবে ।
        সে বিশ্রান্তিতে মরতে চায়। বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়তে থাকা ছেলেটির মুখ বিছানা থেকে দেখা যায় না। তবুও কাগজটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
        সে উঠে আসে।
        ‘মা, একটা কথা ভাবছি । মাটিটা বেকার পড়ে রয়েছে ।’
        ‘ওদিকে নজর দিস না। মোটেই নজর দিস না। অন্যের মাটি।’
        ‘কিন্তু আমাদেরই তো ছিল।’
        ‘এখন আমাদের নয়। কেন বুঝিস না?’
        ‘সেটা বুঝেছি। কিন্তু মাটি বিক্রি করার কত বছর হল? পুরো পাঁচ বছর। আমার বিয়ের সময় তুই বিক্রি করেছিলি। সেই যে ওয়াল দিয়েছিলি, আজ পর্যন্ত খবর নেই।’
        ‘দত্ত মারা গেল। কে আসবে? মিসেসের চাকরি দিল্লিতে। ছেলে মেয়েও নেই। কী করবি মাটি দিয়ে?’
        ‘আমিই দেখাশোনা করব ভাবছি। জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য কাল লেবার লাগাব।’
        ‘না,না একদম করবি না।’
‘কিছুই করব না মা। তর্জার বেড়া দিয়ে দুটো রুম ভাড়া দিয়ে দেব। কত খরচ আমাদের।‘
‘তুই কাজে জয়েন করছিস না কেন? এল আই সি এজেন্ট।‘ সে হাঃহাঃ করে হাসতে
লাগল। মা কিন্তু দমে গেলেন না। বালিশ থেকে মাথা তুললেন না। পাইপ লাগানো গলায়
ফিসফিস করে বলে উঠলেন –
‘ট্র্যাভেল এজেন্সি   এয়ার ট্র্যেভেল করা মানুষের।‘
সে চলে গিয়েছিল। মায়ের কথা সে কানে নেয় না। মা বিছানায় পড়ে থাকল। খোলা
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। একদিন দুদিন করে কয়েকদিন।তার কথা কানে আসে না।মা বলে ডাকে ঠিকই, কিন্তু তাঁর নতুন অপচিন্তার কথা বলতে চায় না। বাদই দিয়েছে মনে হয়। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। দুচোখের পাতায় দুফোঁটা শিশিরের মতো অশ্রুকণা তবু লেগে থাকে। এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না,এত নম্র মেধাবী ছেলেটার আজ অকর্মণ্যের মতো জীবন।
মৃদু হুলুস্থুল।বাগানের জঙ্গল পরিষ্কার করিয়েছে, ঐ যে কিছু তর্জার বেড়া আনিয়েছে, শ্রমিকদের কথা-বার্তা শোনা যাচ্ছে। শব্দ ছিটকে আসছে।
শরীরটা সামান্য নাড়াচাড়া করতে পেরে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। ঐ যে প্রয়াত
দত্ত কিনে নেওয়া তাঁদেরই জমিতে ঘর মাথা তুলেছে।ছেলেকে ঘিরে
ধ্রলেন-যেখানের জিনিস সেখানে ফিরিয়ে দিয়ে আয়। ঘর-বাড়ি গুলি উঠিয়ে
ফেল। অন্যের জমিতে কী কাণ্ড!
‘ডোন্ট ওরি।‘
পাখিটা তার জীবনে এক বছর ও থাকেনি। তার আগে পর্যন্ত মাঝে মধ্যে বাড়ির রুমগুলিতে মাঝে মধ্যে একটা শিস বাজত। ঠিক ধূপের ধোঁয়ার মতো। ভালোলাগা। পবিত্রতায় উপচে পড়া। সুখে ভরা।
সেই শিসধ্বনি পুনরায় শোনা গেল। তিনি বিছানায় বসে রইলেন। ছেলেটি সম্পূর্ণ সুস্থ। শিস দিচ্ছে। তিনি শান্তি পেয়েছেন কি? সুখী কি? জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেই দেখা যায় মাথা তুলে উঠা অন্যায়ের ঘর?
একমাস গেল, দুইমাস গেল,বছর শেষ হতে চলল। তাকে চিকিৎসালয়ে ভর্তি করা হয়েছিল। কয়েকদিনের শুশ্রূষায় কিছূটা সুস্থ হলেন। কাউকে বলতে হয় না। তিনি নিজেই জানেন, যে কোনো মুহূর্তে তাকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। ছেলে ‘টিউটোরিয়েল হোম’ খুলেছে, তাঁর জীবন এগিয়ে যাবে।
তাঁকে ঘরে ফিরিয়ে আনে। বিছানায় পড়ে থাকেন। ছেলে নিজে সেবা-শুশ্রূষা করে। তিনি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ছেলে বুদ্ধ হয়ে বনে গমন করার সময় রাজমাতার কী যন্ত্রণা হয়েছিল, তিনি উপলদ্ধি করেন। চোখের জল বাধা মানে না। কী এই পৃথিবী  কী এই মানব জীবন কী এই জরা, ব্যাধি মৃত্যু?
কে দেবে উত্তর, এখানে তো কেউ নেই। শূন্য হয়ে পড়ে আছে বুকের মাঝের খাঁচা।
ছেলেটাকে বলতে চায়— ‘যাকে ভালো লাগে, নিয়া আয় সবসময় এক সঙ্গে থাকবি, আমার আশীর্বাদ  ।‘
হঠাৎ হুলুস্থুল। পূর্বের মতো নয়। অথচ পূর্বের জায়গাতেই হয়েছে। দিল্লি থেকে শ্রীমতী দত্ত এসেছেন। সঙ্গে্ পুলিশ। হাতে মাটির কাগজ।
তিনি বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন কিন্তু পুলিশ ছেলেটিকে ঘিরে ধরায় ভেতরে চলে গেলেন। এই ছেলের হাতে হাতকড়ি দেখতে পারবেন না।
প্রায় দুই তিন ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত কিছু শান্ত হয়ে গেল। তর্জাবেড়ার ভাড়াঘরে বসবাস করা কাজের মহিলা, রিক্সাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা সবাই কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে চলে গেল। শ্রীমতী দত্তের নির্দেশে ঘরগুলি উপড়ে ফেলার কাজ শুরু হল আর শেষও হল।
কিন্তু কী হল, মহিলার মনে দয়া জাগল নাকি, বেড়া আর টিনগুলি এই ঘরের সীমানায় ফেলে রাখলেন আর তাকে না দেখেই চলে গেলেন।
ছেলে সারা রাত হাজতে রইল।মা রইলেন উজাগরী শয্যায়।এই ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয়। ছেলের বিবাহ-বিচ্ছেদের রাতটাও এই রকম ছিল। সারারাত সে কোন বন্ধুর বাড়িতে বসেছিল, সকালে এসে উঠোনেই স্নান করেছিল। বলেছিল-নিউ জার্নি স্টার্ট হবে এখন মা। পরিষ্কার হয়ে নিলাম।‘
‘বাথরুমে যা।‘
‘মনে কর শ্মশান থেকে এসেছি। একটা সম্পর্কের মৃত্যু হল।‘
এই সেদিন বলেছিল সে। আজ আবার বলেছে। ঐ যে স্নান করছে, বিছানা থেকেই তিনি শুনতে পাচ্ছেন। গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে কিছুক্ষণ পরে মায়ের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। পর্দার ওপার থেকেই বলল —
‘আর কোনো ঝামেলা নেই মা। কোর্টে হাজির হলেই নাকি কেস উইথড্র করে নেবে। তোর জন্যই করবে। এখন আর চিন্তা করিস না। তুই ভালো ভাবে থাক। আমি টিউশুনিতে যাচ্ছি। কাল ক্ষতি হয়েছে। সেটার ডে ক্ষতি হলে সান ডে তে বেশি কষ্ট হয়। লাঞ্চ করব।‘
এক সময়ে সে বেরিয়ে গেল।
ভালো খারাপ মানুষ অনেক কাজই করে, তার থেকে শিক্ষা নেয় কি?
বেঁচে আছে না নেই নিজেই বুঝতে না পারা মা ভাবল কেবল এই ছেলে চিরকাল
রাজপুত্র হয়ে থাকুক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

12 − five =