সম্পাদকীয় (বড়দিন ২০১৮)

 বছর সাতেক আগের কথা। সপ্তমীর রাত। অফিস থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরছি। দমদমের বাড়িতে নয়, পুজো উপলক্ষে বাড়ির সকলে তখন গোবরডাঙ্গায়। আমিও তাই গোবরডাঙ্গাতেই ফিরব। শিয়ালদহে পৌঁছে দেখি দত্তপুকুর লোকাল ছাড়ছে। ফাঁকা ট্রেন দেখে উঠেই পড়লাম, যতটুকু এগিয়ে থাকা যায়। বামনগাছিতে নেমে বসে আছি পরের বনগাঁ লোকাল ধরবার জন্য। পাশেই গোলমালের আওয়াজ পেয়ে চোখ তুলে দেখি প্ল্যাটফর্মের এক ছোট্ট দোকানের বিক্রেতার সঙ্গে এক যুবকের গন্ডগোল। দিন রাত খুন জখম, গন্ডগোল, মারামারি দেখে ক্লান্ত থাকি তাই তেমন আমল দিলাম না। কিন্তু খানিক পরেই বোধ হল বিষয়টা ঠিক ক্রেতা বিক্রেতার গোলমাল নয়। একটু এগোতেই সেই বিক্রেতা আমায় বলল –“দেখুন তো সেই তখন থেকে প্ল্যাটফর্মে থুতু ফেলে যাচ্ছে আমি বারন করতে চোটপাট দেখাচ্ছে।” আমিও দেখলাম বেশ কিছুটা এলাকা জুড়ে তার থুতুর আলপনা। বললাম যে “এখানে থুতু ফেলা বেআইনি এবং অশোভন। তুমি নিদেন পক্ষে রেল লাইনের দিকে যাও”। এবার সে আমার দিকে তেড়ে এল, বেশ করেছি, আপনার জায়গা? বলতে বলতেই ট্রেন ঢুকছে স্টেশনে। ট্রেনে উঠতে যাব, হঠাৎ হোচট খেলাম, পা বাড়িয়ে দিয়েছে ওই ছেলেটি। কোনও রকমে উঠে গেলাম, দেখলাম আমার সঙ্গে সেও উঠল ট্রেনে। উঠেই আমাকে হুমকি “এই লাইনে যাতায়াত করেন? কার সাথে পাঙ্গা নিচ্ছেন? দেখে নেব। নামিয়ে নিয়ে যাব ট্রেন থেকে।” একটু থমকালাম। তারপরে চিৎকার করে সকলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলাম।“সকলে শুনছেন, এই ছেলেটি প্ল্যাটফর্মে থুতু ফেলে নোংরা করছিল, আমি বা অন্যরা বাধা দিতে এখন আমাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে নিয়ে মারতে চাইছে। কি করা উচিৎ?” কিছু তো কাজ হলই, অন্যরা তাকাল, ছেলেটি একটু মিইয়ে গেল। ফোন করলাম আমার চ্যানেলের স্থানীয় সাংবাদিককে। জিআরপি-কে বলে রাখতে বললাম, যাতে হাবড়ায় নামলে ছেলেটিকে একটু শিক্ষা দেওয়া যায়। তার দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত স্বরে বললাম “তোমার ব্যবস্থা করে ফেলেছি, কে কাকে কোথায় নামায় সেটা আমিই তোমায় দেখিয়ে দিচ্ছি।” এবারে সে ছেলে বুঝতে পেরেছে যে আমাকে যতটা নিরীহ বলে মনে করেছিল আমি ততটা নই। ধীরে ধীরে সরতে সরতে ক্রমশ আড়ালে চলে গেল সে। হাবড়ায় ট্রেন ঢুকতেই ওসি জিআরপি দেখা করে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাকে আর পাওয়া যায়নি।

গল্পটা একটু বড় হয়ে গেল বটে, কিন্তু আবশ্যিক ছিল। কারন রাস্তায় বেরলে এখন থুতু ফেলাটা সিংহ ভাগ মানুষের অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে কোথায় কখন থুতু ফেলছেন তার তোয়াক্কা করেন না। প্রতিবাদ করতে গেলেই প্রায় উপরের ঘটনার পুনরাবৃত্তি। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি এই মানুষগুলি বাড়িতে যখন থাকেন, তখন মিনিটে মিনিটে থুতু ফেলেন কোথায়? দমদম জংশন স্টেশনে নৈহাটি বা বনগাঁ লোকাল থেকে নেমেই যে লোকটি থুতু ফেলল এক দলা সেই লোকটিই মেট্রোতে ঢুকে গিলে ফেলল পরের থুতুটিকে। পরিবেশ তাকে পালটে দেয়, মেট্রোয় নজরদারিও বেশি, থুতু ফেললেই জরিমানা। সে জরিমানার আইন বা নিয়ম তো সর্বত্র। ভারতীয় রেলের আইনেও থুতু ফেলা দণ্ডনীয় অপরাধ। প্ল্যাটফর্মে, স্টেশন চত্বরে বা ট্রেনের ভিতরে থুতু ফেললে জরিমানার পরিমাণ ৫০০ টাকা। এমনকি, ছ’মাস জেলও হতে পারে। রাস্তাতে বা অন্যান্য জায়গাতে এসব দেখার লোক নেই।
অনেক দেশেই যত্রতত্র থুথু ফেললে শাস্তির বিধান রয়েছে। দুবাইয়ের রাস্তায় সিগারেটের অবশিষ্টাংশ বা থুথু ফেলার জরিমানা ১১ হাজার টাকা। থুথু বা চলন্ত গাড়ি থেকে কোনও আবর্জনা ফেললেই ৩০০০ টাকা জরিমানা গুনতে হবে বলে আইন পাশ করেছে সৌদি আরব। ক্যালিফোর্নিয়ায় ২০০০ ডলার জরিমানা এবং ছমাসের জেল, অস্ট্রেলিয়ায় ৫০০ ডলার পর্যন্ত প্রকাশ্যে থুতু ফেললে জরিমানা করা হয়। এমন আইন প্রায় সব কটি দেশেই কম বেশি রয়েছে।
ভারতেও গঙ্গায় বর্জ্য বা থুথু ফেললে তিন বছর কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানার আইন রয়েছে। ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযানে’র অংশ হিসেবে গত কয়েক বছর ধরেই কোয়ালিটি কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া দেশটির ৪৩৪টি শহরে সমীক্ষা চালায়। পরিচ্ছন্নতার বিচারে এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর ইন্দোর। ইন্দোর পুর এলাকায় থুতু ফেললে আর্থিক জরিমানা তো হবেই, ছবি ছাপা হবে পত্রিকায়। এমনকি রেডিওতে তাদের নামও ঘোষণা করা হবে। মুম্বাইয়ের রাস্তায় থুথু বা পানের পিক ফেললে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা পাশাপাশি ১ থেকে ৫ দিন পর্যন্ত সরকারি দফতর হাসপাতাল ও রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কারের নিয়ম করা হয়েছে। শহর পরিস্কার রাখার জন্য সম্প্রতি অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে পুনে পুরকর্তৃপক্ষ। কেউ যদি শহরে থুতু ফেলেন তাহলে তাকে জরিমানা তো দিতেই হবে সঙ্গে তা ওই ব্যক্তিকেই পরিষ্কার করতে হবে। ইতিমধ্যে প্রায় দেড়শো জনের বেশি মানুষকে জরিমানা দেওয়ার পাশাপাশি নিজের থুতু পরিস্কারও করতে হয়েছে। কলকাতা পুলিশ অ্যাক্টে থুতু ফেলা নিয়ে কোনও আইন না থাকলেও ‘ন্যুইস্যান্স অ্যাক্ট’ রয়েছে, যার মধ্যে থুতু ফেলার কথাও উল্লেখ রয়েছে। ওই ধারায় ধরা পড়লে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ২০০ টাকা জরিমানা দিতে হয়। তবে সাম্প্রতিক কালে থুতু ফেলার জন্য কোনও জরিমানা ধার্য করার কথা শোনা যায়নি।
এমন আইন ঘোষণায় পিছিয়ে নেই বাংলাও। দক্ষিনেশ্বর স্কাই ওয়াকে থুতু ফেললে তাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে পাশাপাশি পরিষ্কার করে দিতে হবে বলে হুঁশিয়ারি মুখ্যমন্ত্রীর। কিন্তু ঘোষণা থাকলেও দেখার লোক কই? তাই তো যত্রতত্র থুতু ফেলেও লজ্জা পাওয়ার বদলে পালটা হুমকি দেয় মানুষজন। হাওড়া ব্রিজ বিপন্ন গুটখার থুতুতে। আমাদের কি সামান্য পরিচ্ছন্ন বোধ নেই? নিজের বাড়িটুকুই পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব? বাইরে বেরলেই একগাল থুতু নিতে গোটা রাস্তা বা সর্বত্র আলপনা দিতে দিতে যেতে হবে? ছোটদের কিভাবে বোঝাবো? যখন সে প্রশ্ন করবে প্রাপ্ত বয়স্কদের এমন আচরণ দেখে। আপনি কি তাও একটু বারণ করবেন, পাশের লোকটিকে যেখানে সেখানে থুতু ফেলতে দেখলে? আমি তো করি, হুমকিও পাই। তবুও…

ভাল থাকবেন সকলে। আপনাদেরকেও একটু দায়িত্ব দেব, আশপাশটা একটু পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে অন্যদেরকে বোঝানোর জন্য। কাজটা সহজ নয়, কিন্তু কাউকে না কাউকে তো এগোতেই হবে। আমরা কেন নয়? এবারে প্রযুক্তিগত কিছু পরিমার্জনের কারনে পত্রিকা বেরতে সামান্য দেরি হল। আমরা দুঃখিত সে কারনে। আগামী সংখ্যা ঠিক সময়ে বেরবে ফেব্রুয়ারির প্রথমদিকেই। আজ তবে এটুকুই, আবার কথা হবে আগামী সংখ্যায়।

পলাশ মুখোপাধ্যায়

সম্পাদক

অবেক্ষণ

 


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 × three =