সে প্রথম প্রেম আমার….

তনুপ্রিয়া চক্রবর্তী, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা ##

কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় প্রথম দেখি তাকে; সর্বদাই উন্নত শির আর গাম্ভীর্যের আড়ালে প্রশ্রয়ের হাতছানি।  পোশাকটা কেমন অদ্ভুত যেন,দূর থেকে শুভ্র আকাশি-নীল আর কাছ থেকে একেবারে ঘন সবুজ।  হরিদ্বার থেকে বাসে করে মুসৌরি যাওয়ার পথে নিজের দুটি মাত্র চোখকে অপর্যাপ্ত লাগছিল তার সৌন্দর্যের স্বাদ নেওয়ার জন্য। যখন তার বুকের ওপরে সংকীর্ণ পথ-রেখা ধরে চলেছি তখন ঠিক পাশের খাদটি যেন রহস্যময় ইঙ্গিতে ডাকে আবার অনেক দূরে তারই প্রতিরূপেরা যখন বুক চিতিয়ে দাঁঁড়িয়ে থাকে অনন্ত সৌন্দর্যের গরিমা নিয়ে তখন নিজের একমাত্র সম্বল পুচকে ফোনের ক‍্যামেরাকে বিশ্রাম দিয়ে খুব ব‍্যাকুল হয়ে চেয়েছিলাম মনেই গজিয়ে উঠুক হাজারটা চোখ যাতে ঐ অসীম সৌন্দর্যের অন্তত খানিকটা নিজের কাছে সসীম থাকে। এমনি করেই ঘটে আমার প্রথম প্রেম, পাহাড়-প্রেম।

আবার দীর্ঘ চার বছর বিরহের পর ২০১৭ সালে পাহাড়ের সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনা উঁকি দিতে লাগল। আমার ও প্রিয় বান্ধবীর পরিবার মিলিয়ে মোট আটজন পাহাড়ের কাছে যাব ঠিক করলাম। ৭ই অক্টোবর যাত্রা স্থির হল; শিয়ালদহ থেকে পদাতিক এক্সপ্রেসে নিউ জলপাইগুড়ি অবধি যাব। টিকিট কেটে ফেললাম। ১৩ই অক্টোবর দার্জিলিং মেলে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে শিয়ালদহ ফেরা;শারদীয়া ছুটির লক্ষীপুজো আর কালী পুজোর মাঝখানে যে সাতদিন সেটাই আমরা বেছে নিয়েছিলাম। টিকিট তো কাটলাম এবার চিন্তা শুরু হল এন.জে.পি থেকে কোথায় গিয়ে সাক্ষাৎ করব পাহাড়ের সাথে,কীভাবে গাড়ি পাব আর কোথায় থাকব। পুজোর ছুটিতে সমস্ত ভ্রমণের জায়গাগুলোর বুকিং শুরু হয়ে গেছে; নিজেরা পৌঁছনোর পর সবকিছু জোগাড় করতে পারব কিনা সেই ভরসাও পাচ্ছিলাম না। কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সিতে খোঁজ নিয়ে টাকার অংক শুনে পিছিয়ে গেলাম আর তারা যে জনপ্রিয় জায়গাগুলো বলছিলেন প‍্যাকেজ হিসাবে সেখানে আমাদের নির্জন প্রকৃতি ভ্রমণ সম্ভব হত না। এমতাবস্থায় জনৈক এক কাকু খোঁজ দিলেন মহামায়া খান নামক ভদ্রমহিলার যিনি নিজে অদৃশ্য থেকে অসাধারণ ট‍্যুর পরিচালনা করেন পূর্ব-সিকিমের কিছু প্রত‍্যন্ত অঞ্চলে, অরুনাচল প্রদেশে ও ভূটানে। ওনার সাথে যোগাযোগ করে আমরা সিকিমে যাওয়াই স্থির করলাম। তিনি আমাদের ৫ দিনের ভ্রমণ পরিকল্পনা দিয়ে দিলেন। দেখলাম ৫টা রাত আমরা ৫ জায়গায় কাটাতে চলেছি আর থাকা-খাওয়া-গাড়ি বন্দোবস্তের দায়িত্ব উনি নিলেন। উপরি পাওনা হিসাবে যা পেলাম তা হল একেবারে নিজেদের মতো করে ঘোরার স্বাধীনতা, কারন আমাদের সাথে কোনো ট্রাভেল এজেন্ট থাকবে না। এইবার আসি জায়গার কথায়। উনি যে ৫টি জায়গার নাম আমাদের জানিয়েছিলেন সেই নামগুলি আমরা কেউই কোনোদিন শুনিনি, তাই নামগুলো সঠিকভাবে মনে রাখতে কয়েকটি দিন কসরৎ করতে হল। একে পাহাড়-প্রেমের দ্বিতীয় পর্বের সূচনা হতে চলেছে তার সাথে জুড়ে গেছে একেবারে অজানা-অচেনা জায়গায় তার সাথে নতুন করে আলাপের উত্তেজনা। যত দিন এগিয়ে আসতে লাগল মনকে চুপ করিয়ে রাখাই দায় হয়ে গেল; এবার কেমন রূপ তার দেখব সেই কল্পনা, সাথে এতগুলো প্রিয় মানুষ নিয়ে বেরাতে যাওয়ার উন্মাদনা আর একটু আশংকা ও ছিল অদৃশ্য মহামায়া দিদি সব ব‍্যবস্থা ঠিকঠাক করবেন কিনা; এইরকম সব অনুভূতি মিলিয়ে মন একবারে অস্থির হয়ে উঠল।

আরিতারের পথে
সুন্দরী তিস্তা

আনন্দ ও উত্তেজনার হৃদকম্প নিয়ে ৮ই অক্টোবর সকাল সাড়ে নটা নাগাদ আমরা নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের বাইরে এসে হাসি-খুশি এক নেপালি ধাঁচের দেখতে ভদ্রলোকের সাক্ষাৎ পেলাম; তিনি মহামায়া দিদির পাঠানো দূত শরণজী, যার শ‍রণে আমাদের আগামী ৫টি দিন কাটতে চলেছে। চটপট লাগেজ গুছিয়ে আমরা উঠে পড়লাম গাড়িতে। শুরু হল যাত্রা সেদিনের গন্তব্য আরিতারের উদ্দেশ্যে। এক রাতের ট্রেন জার্নির ক্লান্তি ভুলে চোখটাকে আলতো করে মেলে রাখলাম জানলায় আর সে স্পর্শ করে চলল চারপাশের নয়নাভিরাম দৃশ‍্যগুলিকে। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই, একবার শুধু ঝুলি নিয়ে পাহাড়ের সামনে দাঁড়ানোর অপেক্ষা তারপরে সব ছাপিয়ে উপচে পড়ে তার দান। পথে তিস্তা নদীর সাথে আলাপ সারতে সারতেই এগিয়ে চললাম আমরা; আমার বান্ধবী তো রাস্তার ওপর বসে থাকা হনুমানের কচি ছানাদের দেখে আবদার জুড়েছে একটা অন্তত বাড়ি নিয়ে যাবে। দুপুরের পরে আস্তে আস্তে আবহাওয়ায় হিমেল স্পর্শ পেতে শুরু করলাম।

আরিতারের গনেশ মন্দির

 বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ শরণজী আরিতারের এক গনেশ মন্দিরের সামনে গাড়ি থামালেন। বাইরে তখন টিপ-টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। সবাই মিলে নেমে পড়লাম পাহাড়ি রাস্তার ঢাল বেয়ে সেই মন্দির দর্শনে। পাহাড়ের ঢালেই বেশ খানিকটা বিস্তৃত জায়গা জুড়ে তৈরি হয়েছে এই মন্দির। আবার মন্দির চত্বরের সমতল জায়গা থেকে নীচের দিকে সিঁড়ি বানিয়ে তৈরি হয়েছে ছোট্ট একটি পার্ক। মন্দির টা ভীষণই পরিচ্ছন্ন; পূজা দেওয়ার বাড়াবাড়ি রকমের কোনো আড়ম্বর দেখলাম না। সবচেয়ে অপূর্ব লাগল একটি বেশ বড়ো মাপের আর্কিটেকচার যাতে সমুদ্র মন্থনের দৃশ্য অপরূপ ভাবে দেখানো হয়েছে।

আরিতারের হোম স্টে

 প্রায় আধ ঘন্টার মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম হোম স্টে তে। খুব সুন্দর ছোট্ট খাট্টো একটা বাড়ির তিনটে ঘর আমরা দখল করলাম আর অনতিদূরে আর একটি ছোট্ট বাড়িতে ছিলেন হোম স্টের মালিক, এক গৃহবধূ। আমরা পৌঁঁছতেই তিনি আর তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি মিলে এত আন্তরিক হাসি নিয়ে আমাদের স্বাগত জানালেন যে মনে হল ওনাদের বাড়িতে অতিথি হয়েই এসেছি আমরা। পেটে তখন চলছে খিদের হামলা। স্নান করে ফ্রেশ হয়ে আমরা স্কোয়াশের তরকারি আর ডিমের ঝোল দিয়ে ভাত খেলাম;তার সাথে খেলাম এক অনবদ্য স্বাদ ও গন্ধের আচার যার নাম মাকিনা যেটা ঐ বাড়ির কর্ত্রী স্বহস্তে বানিয়ে ছিলেন। পরের দিন সকালের প্রাতরাশ অবধি যতবার ওখানে আমরা খাবার খেয়েছি ততবারই ঐ আচার আমাদের তৃপ্তি দিয়েছে।

বুট লেকের জঙ্গল

 আমরা খাবার খেয়ে উঠতেই দেখি সন্ধে নেমে গেছে। গায়ে গরম জামা চাপিয়ে টর্চ নিয়ে আমরা সদলবলে বেরিয়ে পড়লাম পায়ে হাঁটা দূরত্বের বুট লেকে একটা চক্কর দিতে। লেকটার আকৃতি বুটের মতো, তাই ঐরূপ নাম। লেক ভ্রমণ সেরে এসে প্রথম উত্তেজনাদায়ক সারপ্রাইজ আমরা পেলাম জোঁকের কাছ থেকে যিনি ঐ লেক থেকেই আমার কাকিমা ও দাদার পায়ে আতিথেয়তা গ্ৰহন করেছিলেন। অগত্যা ঐ নিয়ে সন্ধ্যার পর্ব কাটিয়ে মাংস-রুটি সহযোগে রাতের ভোজন সেরে আমরা কম্বলের তলায় আশ্রয় নিলাম। সকালে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে উঠে রেডি হয়ে আমি, বান্ধবী ও দাদা বেরিয়ে পড়লাম আরিতারের পথে। হালকা কুয়াশার চাদর ভেদ করে আমরা এগোলাম সেই বুট লেকের দিকে। সন্ধ্যার রুপ দেখেছি, সকালে কেমন সাজে সেই লেক দেখতে হবে না! গিয়ে দেখি কতগুলো রাজ হাঁস সাড়ম্বরে সেখানে রাজত্ব ফলাচ্ছে। তাদের অতি উচ্চ কলরবে চারপাশের নিস্তব্ধতা চুরমার হয়ে যাচ্ছে। লেকের চারপাশ দিয়েই রয়েছে এক জঙ্গলময় উচ্চভূমি,একদিকে আবার সিঁড়ির ধাপ কাটা। তিনজনে তিনটে লাঠি জোগাড় করে উঠতে লাগলাম শিশির ভেজা সেই ধাপ বেয়ে; প্রথমে দাদা, মাঝখানে বান্ধবী আর পিছনে আমি। খানিকটা ওঠার পর একটু দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিচ্ছিলাম আমরা, গল্পের অবসরে দেখছিলাম চারপাশ। হঠাৎ পায়ে একটা অস্বস্তি টের পেতেই তাকিয়ে দেখি ফেলুদার বলা থিওরি অব‍্যর্থ ভাবে মিলে গেছে। তিন নম্বরে থাকার সুবাদে জোঁকেরা আমাকেই প্রথম আক্রমণ করেছে। বাকি দুজন যেই না ব‍্যস্ত হয়েছে আমার জুতোর জোঁক ছাড়াতে অমনি তাদের পা কেও কব্জা করেছে তেনারা। খুব বেশি লাফালাফি ও আমরা করতে পারছি না,পথ খুবই পিচ্ছিল, পড়ে গেলে আর রক্ষে থাকবে না। এমতাবস্থায় তাড়াতাড়ি নীচে নেমে জোঁক ছাড়ানোয় ব‍্যস্ত হলাম; আমার বান্ধবী টের পাচ্ছে তার জুতো-মোজার মধ্যে রক্ত খেয়ে জোঁকেরা মোটা হয়ে ফুলে উঠছে। সেই অস্বস্তি নিয়ে আমরা হোম স্টে তে ফিরে আসলাম।

বুট লেক

জোঁকেরা একটু রক্তই যা খেল,আমাদের ভালোলাগা আর উন্মাদনা এতে বরং বেড়েই গেল। সকালের ঝলমলে রোদে হোম স্টের সামনের লন টা দেখে আমরা তো আহ্লাদে আটজন ষোলখানা হয়ে গেলাম। হলুদ রঙা পাতা বাহারি গাছের মধ্যে দাঁড়িয়ে অনেক ছবি তুললাম আর চোখ ভরে দেখতে লাগলাম দূরের নীল পাহাড়। দশটা নাগাদ প্রাতরাশ সেরে লাগেজ নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল নতুন গন্তব্য আগামলোকের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার পথে আমরা একটি ছোট মনাস্ট্রি আর পাহাড়ের উচ্চ ধাপে অবস্থিত এক শিব মন্দির দেখলাম। মন্দিরটা সুন্দর তো ছিলই কিন্তু মন্দিরের চাতাল থেকে চারপাশের পর্বতরাজি দেখে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিলাম। এখানে দাঁড়িয়ে উঁচু থেকে আমরা বুট আকৃতি লেকটা দেখে আরও মজা পেলাম। সত্যি বলতে কি হরিদ্বারে পাহাড়ের রূপ আমার মনে যে ভালোবাসার দীপ জ্বেলেছিল তার শিখাটি যেন পূর্ণ দীপ্তির দৃঢ়তা পেল সিকিমে এসে।

আগামলোক

 আরিতার ছেড়ে আমরা যতই এগোতে লাগলাম ঝকঝকে সকালটা কুয়াশার জলবিন্দুতে মিশে গাড়ির কাচের জানলায় লেপ্টে গেল। আমরা ছোটবেলায় নভেম্বরের মাঝামাঝি যে শীতটা পেতাম (গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর দাপটে যা এখন অবলুপ্ত) সেই রকম শীত ছিল আরিতারে আর দুপুর ১ টা নাগাদ আগামলোকে প্রবেশ করে আমরা ডিসেম্বরের শীত টের পেলাম। এই জায়গাটার নাম মেঘলোক হলে বড্ড মানাত। পাহাড়ের কোলে একটা হোটেলে ছিল আমাদের আস্তানা আর সেটা পুরো মেঘ রাজ‍্যের মধ্যে। ঘরের সামনে লম্বা ব‍্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আমরা সকলে আনন্দে পাগল হয়ে গেলাম মেঘ-রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলা দেখে। ব‍্যালকনির সামনেই পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে বড়দা সুলভ গাম্ভীর্য নিয়ে আর মেঘ-রোদ্দুর যেন ছোট ভাই-বোনের মতো লুটোপুটি খাচ্ছে তার গায়ে। নীচে তাকিয়ে দেখি একটি নদী বয়ে চলেছে; এতটা উপর থেকে যাকে দেখে সরু দড়ি স্থির হয়ে পড়ে আছে বলে মনে হচ্ছে। দুপুরে ডাল ও মাছের ঝোল সহযোগে ভাত খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে ও আশেপাশের লোকদের সাথে আলাপ করতে।

আগামলোক

 হোটেলের পাশেই একটা ছোট্ট চালা বাড়িতে দুজন মহিলা ছিলেন। তাদের উঠোনে আমরা ঢুকে পড়লাম অনেক রকম সবজি ও ফলে আকৃষ্ট হয়ে। ওনারা আমাদের কয়েকটি পাহাড়ি টমেটো দিলেন আর আখ দিলেন। উঠোন যেখানে শেষ সেখানেই খাদের শুরু। পাহাড়ের দিকে ফিরে উঠোনের প্রান্তে পা ঝুলিয়ে বসে আমরা আখ খেতে শুরু করলাম। চিরকালের অলস আমি দাঁত দিয়ে আখ ছাড়িয়ে খেতে গিয়ে কী যে নাস্তানাবুদ হলাম তা আর বলার নয়। সারাটা বিকেল ঘোরাঘুরি করে সন্ধে বেলায় ব‍্যালকনিতে চলল চা এর আড্ডা। রাতে মেঘের কোলে নিশ্চিন্ত ঘুমে ঢলে পড়লাম। পরদিন সকালে খুব জলদি রেডি হলাম সকলে কারণ এবারের গন্তব্য জুলুক বেশ দূরে। শেষবারের মতো ব‍্যালকনি থেকে আর একবার উপভোগ করে নিলাম মেঘেদের নৃত্য-নাট‍্য। আগামলোক থেকে আমরা মেঘলা ওয়েদারই পাচ্ছিলাম।

জুলুক গ্রাম

 জুলুক যাওয়ার পথেও আবহাওয়া বিশেষ পরিবর্তন হল না। জুলুকে প্রবেশ করতেই শীতের কড়া স্পর্শ টের পেলাম। চারপাশের দৃশ‍্যপট দেখলাম বেশ পাল্টে গেছে। চারদিকে শুস্কতা বেশি আর তৃন জাতীয় উদ্ভিদ দেখলাম লাল হয়ে গেছে। বরফ পড়ার ফলে অমন হয় শুনলাম। দুপুরে হোম স্টেতে পৌঁছে শুনলাম ঐ অঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ আসেনি তখনও। কাঠের উনানেই তারা আমাদের গরম জলের ব‍্যবস্থা করলেন। জ‍্যাকেট, গ্লাভস, পায়ে ডবল মোজা সব চাপিয়ে ফেললাম আমরা। দুপুরে ডিম ও সবজি দিয়ে ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পাহাড়ি রাস্তার এক বাঁকে বসে পড়লাম আমি আর বান্ধবী, দাদা স্কেচবুকে আঁকল আমাদের ছবি। পাহাড়ের কোলে আমাদের সেই ছবি এক অনাবিল আনন্দঘন মুহুর্তের সাক্ষী। পায়ে পায়ে গল্প করতে করতে বান্ধবী, আমি ও দাদা পাহাড়ি পথ দিয়ে ক্রমশ উপরে উঠতে উঠতে খেয়ালই করিনি যে কতটা উপরে চলে এসেছি। নীচের যে গ্ৰামে আমাদের হোম স্টে সেখানে তখন হেঁটে নামতে গেলে সন্ধে হয়ে যাবে আর খুব জল তেষ্টা ও পেয়েছিল। এমতাবস্থায় বুদ্ধিমান দাদা উপরের পাহাড়ি পথ দিয়ে একটা আর্মির ট্রাক আসতে দেখে ঠিক করে ফেলল যে আমরা ঐ ট্রাকে লিফট চাইব। আমি আর আমার বান্ধবী তো এক কথায় রাজী হয়ে গেলাম; তখন তো আর বুঝিনি যে দাদার মতো লম্বা পা নেই, ট্রাকে উঠব কীভাবে!ট্রাক যখন সামনে এসে থামল তখন আসল সমস্যা বুঝলাম। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। ট্রাকের পিছনের খোলা দিকে অনেক মহিলা শ্রমিক দাঁড়িয়ে রয়েছে যারা রাস্তা সারাই এর কাজ করে আর তখন ট্রাকে করে গ্ৰামে ফিরছে। আমাদের হাঁচড়ে-পিঁচড়ে ট্রাকে ওঠা দেখে তারা খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলো। আমাকে তো সবাই চ‍্যাঙদোলা করেই ট্রাকে তুলল প্রায়। তারপর শুরু হল আসল মজা। জীবনে আর কখনো এমন দিন আসেনি যখন আমরা চরম ভয় পেয়েও বোকার মতো খিলখিল করে হেসেছি। ট্রাক যেই চলতে শুরু করলো পিছনের ঐ খোলা অংশে আমাদের গড়িয়ে পড়ার উপক্রম হল। সব দিদিরা মিলে হাসতে হাসতে আমাদের আগলে ধরে রাখল যাতে পড়ে না যাই আর গোল-গোল পাহাড়ি পথে ট্রাক যতবার বাঁক নেয় ততবারই আমরা ভাবি এই বুঝি পড়লাম খাদে। এইভাবে ডানদিক-বাঁ দিক হেলাহেলি করতে করতে আর হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা করে আমরা নীচে একটা আর্মি ক‍্যাম্পে নেমে গেলাম; সেখান থেকে জল খেয়ে আরও খানিকটা ওপরে উঠে আমরা হোম স্টে তে ফিরলাম। সন্ধে থেকে রাত পর্যন্ত মোমবাতির আলোয় খাওয়া-দাওয়া,গান,গল্প সেরে ঘুমানোর আগে আমরা রাতের রহস্য ঘেরা পাহাড় দেখলাম। হোম স্টের জানলা খুলতেই দেখা দিল সে;তখন তার গায়ে মিশকালো এক স‍্যুট যার ওপর নক্ষত্রের মতো কিছু হীরে ঝিকমিক করছে।

সিল্ক রূট
বাবা মন্দিরে ঢোকার রাস্তা

 খুব সকালে উঠে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলাম বাবা-মন্দিরের উদ্দেশ‍্যে। যেতে যেতে শুনলাম তাঁর কিংবদন্তি জীবনী। থামভি ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আমরা সেই বিখ্যাত সিল্ক রুট কে দড়ির আলপনার মতো পড়ে থাকতে দেখলাম পাহাড়ের গায়ে। আরও মজা লাগল এটা ভেবে যে আমরা একটু আগে ঐ পথ দিয়েই এসেছি। বাবা-মন্দির দর্শন করে পকেট ভর্তি কিশমিশ প্রসাদ নিয়ে আমরা চললাম কুপুপের এলিফ্যান্ট লেক দেখতে।

এলিফ্যান্ট লেক

 লেকটার আকৃতি হাতির মুখ সহ শুঁড়ের মতো বলে অমন নাম। এই অঞ্চলে আমরা সবচেয়ে বেশি ঠাণ্ডা পেলাম, অক্সিজেনের অভাবও টের পাওয়া যাচ্ছিল। চারপাশের দৃশ্যে রুক্ষতা থাকলেও তার সৌন্দর্যে কোনও কমতি নেই। আমরা কয়েকটি চমড়ি গাই ও দেখলাম আর দেখলাম ছোট্ট একটা গ্ৰাম নাথাং ভ‍্যালি। এরপর জুলুকের হোম স্টেতে ফিরে আমরা অপূর্ব সুস্বাদু রুটি আর মোমো খেলাম। আমার কথা তো ছেড়েই দিলাম আমার মা পর্যন্ত তাঁর জীবনে এমন নরম অথচ পুরু রুটি কখনো খাননি। এরপর আমাদের যাত্রা শুরু হল রোলেপের উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল।

নাথাং ভ্যালি

রোলেপে গিয়ে আমাদের ভ্রমণটা ক্লাইম্যাক্স ছুঁলো। গাড়ি যেখানে আমাদের নামালো সেখান থেকে জঙ্গলের সরু ধাপ কাটা পথ ধরে পৌঁছাতে হবে হোম স্টেতে আর সেই পথ এমনই যে ট্রলি গুলো মাথায় করে নিয়ে যেতে হয়। হোম স্টের একজন লোক এসে হাজির হলেন, তিনি ট্রলি পিছু পঞ্চাশ টাকা করে নিয়ে তাদের পার করলেন। আমরা যখন হোম স্টের সামনে পৌঁছলাম তখন আমাদের আত্মহারা অবস্থা। এ কি জায়গায় এসেছি! চারিদিকে পাহাড় আর তার পায়ের কাছে ছোট্ট একটা গোলাপি রঙের হোম স্টে, তার বারান্দা থেকে কুড়ি ফুট দূরত্বের মধ্যেই সশব্দে বয়ে চলেছে ফেনিল পাহাড়ি নদী; নদীর পাড়ে রয়েছে বড়ো বড়ো বোল্ডার, পাথর আর লম্বা লম্বা ঘাসের জঙ্গল। সত্যি বলছি রোমাঞ্চিত হওয়ার অনুভূতিটা ঠিক কেমন তা আমি এখানে এসেই প্রথম অনুভব করি। কোনো মতে স্নান, খাওয়া সেরে আমরা হামলে পড়লাম নদীর সৌন্দর্য চেটেপুটে নিতে। কাকু (বান্ধবীর বাবা) সবচেয়ে উঁচু বোল্ডারে উঠে প্রনায়াম করা শুরু করে দিলেন। মা, কাকিমারা নীচু টিলাতেই বসলেন। আমি খানিক হামাগুড়ি দিয়ে, খানিকটা বান্ধবী আর দাদার টানাটানির ফলে উঠতে পারলাম একটা উঁচু বোল্ডারে। ঐ পর্বতরাজি বেষ্টিত স্থানে এক উঁচু টিলায় বসে সামনে বয়ে চলা বেগমান নদীর দিকে তাকিয়ে থাকা,সে যে অন্তরে কীরূপ আলোড়ন তুলে আবার প্রশান্তিতে ভরিয়ে দেয় তা বর্ণনার ভাষা সত্যিই নেই আমার কাছে।

রোলেপের হোম স্টে
রোলেপের নদী

আঁধার নামতেই আমরা ফিরে এলাম হোম স্টের বারান্দার পাশে একখন্ড জমিতে। সেখানে গোল করে চেয়ার নিয়ে বসলাম। দাদার তত্ত্বাবধানে চলতে লাগল শিক কাবাব বানানো। অল্প মশলাতেই সকলের মন জয় করে নিল সেই কাবাব। আমাদের আনন্দে সামিল হল হোম স্টের মালিক ও তার ছেলে-মেয়েরা। রোলেপের শীত উপভোগ্য ছিল আর কম্বলের তলায় শুয়ে পাহাড়ি নদীর জলোচ্ছ্বাসের শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমানো আমার জীবনের অন‍্যতম সেরা অভিজ্ঞতা হয়ে রয়ে গেল। রাত ফুরোতেই ভোরবেলা ছ’টার সময় বান্ধবী, আমি আর দাদা মিলে হোম স্টের পাশ দিয়ে পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম। খানিকটা গিয়ে একটা ঝুলন্ত ব্রিজ পেলাম যার তলা দিয়ে বয়ে চলেছে সেই পাহাড়ি নদী; এখানে বোল্ডার কম থাকায় স্রোত আরও বেশি।

হঠাৎ পিছনে কথা বার্তার আওয়াজ পেতেই দেখি আমাদের টিমের বড়রাও বেরিয়ে পড়েছেন পাহাড়ি অভিযানে। আরও খানিকটা ওপরে উঠতেই আমাদের দেখা হল বছর বারোর একটি ছেলের সাথে যার নাম সন্দেস। সে আমাদের পথ দেখিয়ে উপরের গ্ৰামে নিয়ে গেল। মনে হল যেন আমরা ওদের সবার অতিথি। ওখানকার গ্ৰাম মানে হল দুটো-তিনটে বাড়ির অবস্থান আর বাড়ির পুরুষদের কোনো চাকরি করতে যাওয়ার বিষয় নেই, তাদের সবারই পাহাড়ের আরও উপরে এলাচের ক্ষেত আছে, সকাল হলেই গাম্বুট পরে (জোঁকের জন্য) সেখানে কাজ করতে চলে যায়। একবাড়ি তে ঢুকে আমরা এক দাদুর সাথে গল্প করলাম যার বয়স আশি কিন্তু পাহাড়ের জল হাওয়ায় তার শরীর এত সুস্থ রেখেছে যে দেখলে অত বয়স বোঝাই যায় না। তাদের বাড়ির দাওয়াতে অনেক ভুট্টা ঝোলানো দেখলাম, তারা ওগুলোকে মকাই বলে। ঘুরতে ঘুরতে খেয়ালই করিনি কখন রোদ চড়েছে। আমাদের অবস্থা দেখে সন্দেস নিয়ে গেল আরেক বাড়িতে। মনে হল যেন পুতুলের বাড়ি। ছোট্ট ছোট্ট কাঠের বেড়া দেওয়া বারান্দা,সাজানো ঘর আর পরিচ্ছন্ন একফালি উঠোন দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। এক মা কোলের বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন। আমাদের দেখে বসতে দিলেন আর কাকড়ি খেতে দিলেন। ওটা লাউ আর শশার মাঝামাঝি দেখতে একটা ফল,খেতে শশার মতোই। ওখান থেকে গল্প করে বিশ্রাম নিয়ে আমরা নীচে ফিরলাম,সন্দেস আমাদের সাথেই রয়ে গেল। আমরা যখন এই ওঠা-নামায় হিমসিম খাচ্ছি তখন পাশ দিয়ে তীরের বেগে নেমে গেল এক স্কুলের ছাত্র;কাঁধে যার ব‍্যাগ নেই, বুকের কাছে আঁকড়ে ধরেছিল বই-খাতা। যাওয়ার সময় উপস্থিত হলে এই জায়গাটা ছেড়ে যেতে সকলেরই যেন মন কেমন করছিল।

তারপর সক্বলকে বিদায় জানিয়ে শুরু হল আমাদের নতুন যাত্রা ইচ্ছেগাঁও এর পথে। এই গ্ৰাম দার্জিলিংয়ের অন্তর্ভুক্ত কিন্তু সিকিমের কাছে। যাওয়ার পথে শরণজী একটা বাগান বাড়িতে দাঁড়ালেন যেখানে নেমে আমরা অনেক সিঙ্কোনা গাছ দেখলাম আর বাগানের প্রান্তে দাঁড়িয়ে নীচে তিস্তা নদীকে সিলভার বেল্ট রূপে দেখলাম। বিকেলের দিকে পৌঁছলাম ইচ্ছেগাঁও। গিয়ে দেখলাম একটা পাহাড়ের ধাপে ধাপে জমি তৈরি করে একটা-দুটো বাড়ি তৈরি হয়েছে যেগুলো ছবির মতো সুন্দর আর গোছানো। এই কয়টি বাড়ি মিলেই ইচ্ছেগাঁও তৈরি হয়েছে। এই পাহাড়ের মাথায় একটা হোম স্টে যার সার্থক নাম রাখা হয়েছে প‍্যারাডাইস সেইখানে পদব্রজে তল্পিতল্পা সহ পৌঁছাতে হবে শুনে আমাদের সকলেরই মুখ করুণ রসে ডুবে গেল। আমাদের গ্ৰুপের বয়োজেষ্ঠ‍্যরা হাঁটুর ব‍্যাথা নিয়েই চলতে শুরু করলেন। একটু একটু করে ওপরে উঠতেই আমাদের মুখে কিন্তু আনন্দরস সঞ্চারিত হতে লাগল। প্রতিটা বাড়ির উঠানে অজস্র ফুল গাছ আর কোথাও এতটুকু ময়লা নেই। যতই উপরে উঠছি পাহাড়ে ঘেরা প্রকৃতির শোভা ততই মনোরম হয়ে উঠছে। ধীরে ধীরে ক্লান্তি, হাঁটু ব‍্যাথা সব ভুলে আমরা প‍্যারাডাইস এ পৌঁছলাম।

ফ্রেশ হয়ে ঘুরে দেখলাম চারপাশ, ভাব হয়ে গেল মিশুকে গ্ৰামবাসীদের সঙ্গে। এখানেও শীত ছিল তবে কষ্টদায়ক নয়। পরদিন সকালে হাতে খুবই অল্প সময় ছিল যেহেতু ঐদিনই আমাদের ফেরার ট্রেন ধরতে হবে। তাই সকাল সকাল বেরিয়ে আমরা কষাড় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ে উঠলাম মনাস্ট্রির সন্ধানে, কিন্তু এতটাই দূরে ছিল সেটা যে মাঝপথে সাপের ফোঁসফোঁসানি শুনে আমরা ফিরে আসতে বাধ্য হলাম। বিশ্রাম নিতে ঢুকে এক রিটায়ার্ড কাকুর বাড়িতে লবঙ্গ-গোলমরিচ মেশানো চা খেয়ে আমরা চাঙ্গা হয়ে গেলাম। তার বাড়ি থেকে আমরা পাহাড়ি লঙ্কার চারাও এনেছিলাম, পুঁতে ফল লাভও হয়েছে। অবশেষে ব‍্যাগপত্র গুছিয়ে বাড়ি ফেরার যাত্রাপথে নামলাম। মনের কোনে কুলকুল শব্দে বইতে লাগল পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে দেখা অজস্র ঝর্ণার স্মৃতি। পাহাড়কে আর বিদায় কি জানাব!সে তো সর্বদাই আমার অন্তরের খুব কাছটিতেই থাকে, শুধু মাঝে মাঝে আরও কাছে পৌঁছনোর ব‍্যাকুলতায় ছুটে যাই তার কাছে। কী এক পূর্ণতার আনন্দে ভাসিয়ে দিতে পারে সে। তাইতো বলি “এ জীবনে যতটুকু চেয়েছি,মন বলে তারও বেশি পেয়েছি।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

16 − four =