হালদার পাড়ার হিরো

অঙ্কন মুখোপাধ্যায় 

 

চিঙ্কুকে চেনো তোমরা? চেনো না? চিঙ্কু হল আমার দূরসম্পর্কের পিসতুতো কাকিমার মেজ ছেলে । সম্পর্কে আমার দাদা। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার চেয়ে মাত্র চার মাস তিন দিনের বড় সে। ব্যাটা একনম্বরের বিচ্চু। যতরকম কুটবুদ্ধি ওর মাথায়।পিসেমশাই এর লাঠি দিয়ে কখনো মিছি মিছি মাছ ধরার ছিপ বানায়,তো কখনো ঠাকুমার পান খাওয়ার মশলার কৌটে ধূল ভরে রেখে দেয়। এর জন্য পিসেমোশায়ের কাছে নাকমোলা আর কানমোলা যে কতোবার খেয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।তোবু ব্যাটার শিক্ষে হয় না।লেজ ধরে পিসির পোষা বিড়ালটাকে একবার না টানলে চিঙ্কুর পেটের ভাত হজম হয় না। আর ও গুল মারতে ওস্তাদ। চিঙ্কুর মতো গুল মারতে আমি কাউকে এখনো দেখিনি। আমাদের মতো বাচ্চা-কাচ্ছাদের কাছে ওর যত বীরত্বের কাহিনি শোনাতে যে ও কী ভালোবাসে সে তোমরা আর কি করে জানবে। ব্যাটা বলে কি না পিসির বাড়িতে যে কথাবলা কাকাতুয়াটা আছে সেটাকে নাকি চিঙ্কু নিজে ধরেছিল ওদের ছাদে মাথা থেকে। আমার একদম বিশ্বাস হয় না ওর কথা। সেবার পুজোতে পিসির বাড়ির ছাদে আমাদের মানে ছোটদের হিসাব চলছিল পুজোতে কার কটা জমা হয়েছে,কার কটা জুতো। চিঙ্কু কোথা থেকে এসে হাজির হলো। ওর হাতে কী সুন্দর একটা কালো রঙের হাতঘড়ি! তাতে আবার কতো রকমের কেরামতি। পিক পিক ঘন্টা বেজে জানান দেয় একঘন্টা পার হলো। আবার তারিখ দেখা যায়। সবচেয়ে আমার ভালো লেগেছিল ঘড়িতে একটা ছোট্ট কাঁটা ঘুরে ঘুরে দেখিয়ে দিচ্ছিল কোন দিকটা উত্তর আর কোনটা দক্ষিণ। যে দিকেই ঘোরানো হোক ঠিক খুঁজে খুঁজে দিক বার করে নিচ্ছে। আমাদের কারো অমন একখানা ঘড়ি ছিল না। তাই সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম। চিঙ্কু হেসে বলল – কি,কেমন ? দেখলে হবে।এটা যারতার জিনিস নয় বাবা।এ স্বয়ং হালদার পাড়ার হিরোর ঘড়ি।

আমরা প্রশ্ন করলাম – হালদার পাড়ার হিরো? সেটা আবার কে?

আমাদের যেন এক ফু-এ উড়িয়ে দিয়ে বলল,-কে মানে! তোদের সামনে এই জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে আছি, আর বলছিস কে! ও তোদের তো আমার এই হিরো হয়ে ওঠার গল্প বলাই হয় নি। মুখে একটা গম্ভীর ভাব এনে বলল- তোরা যদি সেই ভয়ানক কাহিনী শুনতে চাস তো বলব।

আমরা শুনতে না চাইলেও চিঙ্কু তার গল্প না বলে থামবে না তা বুঝতে পারলাম। কারন ওর মূল লক্ষ্যই থাকে সবসময় গুলগাপ্পি গল্প বলে নিজেকে ধর্মের ষাঁড় প্রমাণ করা। আমাদের সবার মাঝখানে এসে গ্যাঁট হয়ে বসে ওর ধর্মের ষাঁড় হওয়ার গল্প শুরু করল।

গত তিন মাস আগে আমাদের এই হালদার পাড়ায় ভীষণ চুরির উপদ্রব দেখা যায়। সে নানা রকমের চুরি।আজ এর বাড়িতে সাইকেল চুরি হয় তো কাল ওর বাড়িতে মেয়েদের সোনার গয়না। একদিন মাস্টারমশাই দ্বারিকবাবুর বাড়ি থেকে পাওয়া গেল না মাস্টারমশাই এর সোনার কলম।এমনকি পাড়ার মোড়ে বিশুদার চাএর দোকানের দরজাটাই একদিন গেল হাওয়া হয়ে। বোস বাড়ির বড় গিন্নী ,মানে পাপাই-এর বড়মা রাতে উঠে একদিন দেখলো তার ঘরের সিন্দুক থেকে কি কে যেন বার করছে। সে তো চেঁচিয়েমেচিয়ে পাড়া শুদ্ধু জাগিয়ে তুলল। গোটা হালদার পাড়ার লোকে ভরে গেল বোস বাড়ি। কিন্তু চোর ধরা গেল না।কোন ফাঁকে চোরবাবাজি সবাই কে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে। পাড়ার সবার মুখে মুখে তখন একটাই গল্প,-চোর। পাড়ার ছেলেরা পালা করে রাত পাহারা দেবে ঠিক হলো। কিন্তু চোর আর চুরি কোনোটাকেই আটকানো গেল না কিছুতেই। আমার ন’কাকার একদিন পালা পড়লো। সে দিন রাতে ন’কাক পঞ্চাশটা ডনবৈঠক মেরে, ডাম্বেল কসরত করে বন্ধুদের নিয়ে বেরোলো চোর ধরতে। সঙ্গে নিল দাদুর দু’নলা বন্দুকটা।। ন’কাকা বলল,- অচল তো কি। এমনি একটা বন্দুক সাথে থাকলে চোর বাপ বাপ করে লেজ তুলে দৌড় দেবে। পরদিন সকাল গড়িয়ে দুপুরে কাঁচুমাচু মুখ করে বাড়ি ফিরল ন’কাকা।  দাদু খুব চেঁচামেচি করল ন’কাকাকে। হতভাগা, ঢাল নেই তলোয়ার নেই সবকটা পালোয়ান হয়েছে। তুমুল অশান্তি বাড়িতে।হবে নাই বা কেন দাদুর বাবার আমলের বন্দুকটাই চুরি করেছে চোরে। ন’কাকার দোষ বলতে পাহারা দিতে গিয়ে শেষ রাতে শুধু একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল।

আমি চিঙ্কুকে থামিয়ে বললাম – তার সঙ্গে তোর হালদার পাড়ার হিরো হয়ে ওঠার সম্পর্ক কিরে চিঙ্কু? 

আরে সেই কথাতেই তো আসছি। শোন না পুরোটা।

 তুই আবার গুল মারছিস না তো?

 ভ্রু দুটোকে বেঁকিয়ে একটা হেডমাস্টার হেডমাস্টার ভাব করে চিঙ্কু বলল,-  তোদের সবকিছুতেই সন্দেহ। নিজেরা তো কোন কাজ করবিনা আর আমি করলেই সেটা হয়ে যায় গুল। কথার মাঝে বেশি বকবক করিস না তো। চুপ করে শুনে যা শুধু।

আমি চুপ করতে চিঙ্কু শুরু করল। আমাদের ছোটোদের মধ্যে তো দারুন একটা রহস্যময় ব্যপার হয়ে উঠেছে এই চোরের ব্যপারটা।পড়াশোনায় মন নেই।সব সময় গোয়েন্দা গল্পের ডিটেকটিভদের মতো ক্লু খুঁজে চলেছি। আমাদের ক্রিকেট খেলাতেও তেমন আগ্ৰহ নেই।দু এক রাউন্ড খেলার পরই শুরু হয়ে যাচ্ছে চোরের গল্প। এমনি গল্প চলছে একদিন হঠাৎ দেখি রাস্তা দিয়ে নীলুর বাবা আর পল্টুর কাকা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চলেছে। তার পিছু পিছু আমার ন’কাকা।হেঁকে বললাম,- ন’কাকা এমন দৌড়ে দৌড়ে চললে কোথায়?কাকা যেতে যেতেই বলল,- কোথায় আবার,কাল রাতে ব্যাটা চোর ধরা পড়েছে। বাঁধা রয়েছে স্কুলমাঠে।

আমরাও এক ছুটে স্কুলমাঠে। অনেক লোকের ভিড়। গোটা হালদার পাড়া ঝেঁটিয়ে এসেছে।ভির ঠেলে কোনো রকমে পৌছালাম চোরের সামনে। একটা নয় একেবারে জোড়া চোর। দুটো থামে দুজন বাঁধা রয়েছে। উত্তম মধ্যম খাওয়ার চিহ্ন তাদের সারা গায়ে। এদের মধ্যে একজনকে কেমন আমার চেনা চেনা মনে হলো। কোথায় দেখেছি ঠিক মনে করতে পারলাম না। কিছুক্ষণ থেকে যা বুঝলাম তার সারমর্ম হলো আমাদের পাড়ায় পুলিশ অফিসার অমিতাভ হাওলাদারের বাড়ি। ওনার বাড়িতেই বেচারী চোরেরা চুরি করতে গিয়ে কাল ধরা পরেছে।আমিতাত বাবু নিজে চোর ধরেছেন হাতেনাতে।থানায় খবর  পাঠিয়েছেন অমিতাভবাবু।

আমি চিঙ্কুকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,- তা এতে তোর ভূমিকা কী? তুই না ধরলি চোর না করলি কিছু?

তুই না বড্ড বেশি কথা বলিস। আরে শোনই না শেষ পর্যন্ত। পিকচার আভি বাকি হে মেরা দোস্ত। থানা থেকে গাড়ি এলো চোরদের নিয়ে যেতে। দড়ি দিয়ে বেঁধে জিপে তোলার আগে একজন চোর হঠাৎ আমাদের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,- সব এই বিচ্চু ছেলেগুলোর জন্য। ওরা শয়তানি করে ভুল ঠিকানা না বললে আজি আমরা পগারপার। আমি এবার বুঝতে পারছি কেন চোরটাকে চেনা চেনা লাগছিল। আমার বন্ধুরা তো থ।পাড়া শুদ্ধু লোকের চোখ আমাদের দিকে। আমি কিন্তু ভয় পাবার পাত্র নই। তখন পাপাই ভয়ে ভয়ে আগের দিনের ঘটনাটা সবার কাছে বলে দিল।পাপাইয়ের বড়মার মটরমালা সোনার হার চুরি যাওয়ার পরের দিন। আমরা খেলার মাঠে সে নিয়ে আলোচনা করছি এমন সময় একটা উদ্ভট পোশাক পরা লোক এসে আমাদের জিজ্ঞাসা করল,- আচ্ছা ছেলেরা , এটাতো হালদার পাড়া? আমি বললাম ,-হ্যাঁ । কি চায় ? লোকটা বলল ,- এখানে অনিরুদ্ধ হালদারের বাড়ি কোনটা? আমি বললাম ,- ওই তো গলির মোড়ে ডান দিকের দোতলা বাড়িটা,ওটাই। আমি ওদের অনিরুদ্ধদাদুর বাড়ি না দেখিয়ে অমিতাভবাবুর দেখিয়েছিলাম। অমিতাভবাবুর বাড়ির ঠিক উল্টো দিকের বাড়িতে থাকেন আশি বছরের অনিরুদ্ধ হালদার।এ পাড়ার সব চেয়ে বয়স্ক মানুষ। ছেলে থাকে বিদেশে। উনি একা মানুষ। ওনার বাড়িতে চোর শেষ চুরিটা করে ভেগে যেত।সব শুনে অমিতাভবাবু তো বেজায় খুশি হলেন। বললেন,- ভাগ্যিস তুমি বুদ্ধি করে আমার বাড়ি দেখিয়ে ছিলে। না হলে অনিরুদ্ধবাবুর বাড়িতে চুরি করে ব্যাটারা চম্পট দিত। ওদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ।ধরা যাচ্ছিল না কিছুতেই।এমন কাজের জন্য তোমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে পুরস্কৃত করা হবে। গোটা পাড়ার সামনে উনি বললেন,- চিঙ্কু হলো এই হালদার পাড়ার আসল হিরো। তারপর তো বিশাল সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান। আমার গলায় মালা পরিয়ে দিলেন মাস্টারমশাই দ্বারিকবাবু। দুপুরে খাসির মাংসটা যা হয়েছিল না তোদের আর কি বলব রে। এখন মুখে লেগে আছে।আমাকে কেউ ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে আমি ভুল বাড়িতে পাঠিয়ে দি।এ আমার বহুদিনের বদঅভ্যাস। বদঅভ্যাসটা যে এমন উপকারে আসবে তা ভাবিনি। চিঙ্কু দাঁত বের করে হাসতে লাগলো।

চিঙ্কুর এসব কথা আমার মোটেও বিশ্বাস হয় না। যতসব গুল। 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × three =