হোগেনাকাল

জয়িতা সরকার, বেঙ্গালুরু ##

তিস্তা, করলা, লিস, ঘিস – এর রাজ্যে বড় হয়ে ওঠা আমার। নদী, পাহাড়, চা বাগান এর মাঝে নিজের শৈশব থেকে কৈশোর কেটেছে। প্রকৃতির প্রতি যে টান তা হয়ত উত্তরবঙ্গবাসী হওয়াতে মজ্জাগত। তবে নদী, পাহাড় দেখে মন ভরে থাকলেও ঝরনা দেখার সাধ আমার ছোটবেলা থেকেই। দার্জিলিং পাহাড়ের ঝরনা দেখলেও শৈশবে মনে দাগ কেটে যাওয়া ঝর্ণা ছিল ‘ দিল হে  ছোটা সা, ছোটি শি আশা’, অর্থাৎ রোজা সিনেমার দৃশ্যপটগুলি। তখন শুধু জানতাম দক্ষিণ ভারতে কোনো একটা জায়গা।  শিশু মনের সেই সাধ নিয়েই কৈশোর থেকে যৌবনে পা রেখে, প্রকৃতির অমোঘ টানে, বিবাহসূত্রে আমি এখন দ্রাবিড়ভূমের বাঙ্গালি । 

বাঙ্গালি মানেই ভ্রমণপ্রিয়, আমিই বা পিছিয়ে থাকব কেন? তাই সিলিকন ভ্যালি অফ ইন্ডিয়াতে এসেই খোঁজ শুরু করি আমার সেই শৈশবের রুপোলি পর্দায় দেখা ঝরনার। বইয়ের পাতায় দক্ষিণের যে ঝরনার নাম উঠে আসে তা হলো শিবসমুদ্রম, যোগ ফলস। কিন্তু আমার দেখা ঝরনা এই দুটির কোনটিই নয়। জানতে পারলাম আমার মন ভোলানো খরস্রোতা রয়েছে মাত্র 130কিমি দূরে। তামিলনাড়ুর ধর্মনগর জেলায়। আমার ছুঁয়ে না দেখা ভালোবাসার ঝরনার নাম ‘হোগেনাকাল’। 

আর কী, খোঁজ যখন পেয়েছি, যেতে আর দেরি কেন? চললাম রুপোলি পর্দায় দেখা দৃশ্যকে বাস্তবে ছুঁয়ে দেখতে। অগস্ট মাস। খুব গরম। সকাল সকাল রওনা হলাম  হোগেনাকাল এর উদ্দেশ্যে। পৌঁছে দেখলাম খুব ভিড়। টিকিটের লম্বা লাইন। টিকিট কেটে লাইফ জ্যাকেট পরে চেপে বসলাম ঝুরি নৌকাতে। এখানে যা  কোরাকেল নামে পরিচিত। সে এক অন্য অভিজ্ঞতা, নতুন ধরনের নৌকা চড়ার আলাদাই মজা। কিছুটা যেতেই নেমে পড়তে হলো। হেঁটে পৌঁছলাম আমার জলের দেশে। চাক্ষুষ করলাম সেই ঝরনাকে। মনে পড়ছিল ছোটবেলায় প্রথম সাদা কালো টিভিতে দেখা রোজা সিনেমার কথা। 

কাবেরী এর এক অসামান্য রুপ, একরাশ জলরাশি নিয়ে আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে কাবেরী। পাথরের ওপর যখন ছলাৎ ছলাৎ করে জলরাশি এসে পড়ছে, চারিদিক তখন ধোঁয়াময়। ভেসে গেলাম প্রকৃতির সেই মোহময়ী রুপে। নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়েছিল সেদিন বিরাট প্রকৃতির কাছে। কিন্তু সেদিন ফিরতে হয়েছিল তাড়াতড়ি। এত রূপময়ী, মায়াবি, যার জন্য অপেক্ষা দীর্ঘ 20 বছরের, তাকে কী এক ঘন্টা দেখে মন ভরানো যায়? 

তবে ভালোবাসার টানে আমি আবার পৌঁছে যাই স্মোকি রক এর দেশে। এবার জানুয়ারি মাস। উচ্ছল কাবেরী এখন অনেকটা নিস্তরঙ্গ। এবার তাই অন্য মজা। কোরাকেল-এ চেপে কাবেরীকে ছুঁয়ে দেখা। একদিকে সাদা পাথর, অন্যদিকে কালো পাথর। সবই কার্বনাইট শিলা। দুদিকে উঁচু পাথরের টিলা, তার মাঝে কাবেরী এর জলে ঝুড়ি নৌকাতে চেপে দেড় ঘন্টা ঘুরে বেড়ালাম। সঙ্গে ছিল মাছ ভাজা আর চিপস। এবার আমার আশাপূরণ। যা ছিল সেলুলয়েডে তা এখন আমার ভ্রমণের ঝুলিতে। আমার ছোটি সি আশা পূর্ণ। এতোটাই ভালবাসা,  তাই হয়ত তৃতীয় বার যাওয়ার সুযোগও হয়েছিল। তবুও বারবার দেখার ইচ্ছে রইল। 

বেঙালুরু এলে অবশ্যই একদিনের ঘোরার তালিকায় রাখুন এই জলপ্রপাতকে। নিরাশ করবে না একদম। বর্ষা হোক বা শীত সব সময় সমান অনন্য রূপে এই জলরাশি। 

কোরাকেল এর ভাড়া – বর্ষায় – ৩৫০ ( ৪ জন )

                  বাকি সময় –৭৫০  ( জন )

2 thoughts on “হোগেনাকাল

  • July 5, 2020 at 3:47 pm
    Permalink

    অসাধারণ, এমন অভিজ্ঞতা ভাগ করার জন্য ধন্যবাদ।

    Reply
  • July 31, 2020 at 7:24 am
    Permalink

    যাওয়াটার বিস্তারিত থাকলে ভালো হত। ওখানে থাকা যায় কিনা। এসবও জানার থাকে। তবে ইচ্ছেটা থাকে।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twenty − thirteen =