আরাকুর আকর্ষণে

পলাশ মুখোপাধ্যায়

শীতের শুরুতেও যেন সবুজের সুনামি। অপুর্ব নৈসর্গিক পাহাড়ী কন্যা যেন সবুজের মেখলা পরে সেজে বসে আছে নীরবে নিভৃতে। অনাবিল সৌন্দর্যে ভরপুর আরাকু উপত্যকা রেল এবং সড়ক দুই পথেই বিশাখাপত্তনমের সঙ্গে যুক্ত। কলকাতা থেকে যে কোন ট্রেনে বিশাখাপত্তনম। তার পর সেখান থেকে কোট্টাভালাসা হয়ে কিরন্ডুল প্যাসেঞ্জারে আরাকু। বিশাখাপত্তনম থেকে আরাকু যাবার এই একটাই ট্রেন। সড়ক পথটিতে আরাকু ভ্রমনের সৌন্দর্য্য অবশ্যই উপভোগ্য, কিন্তু আমি বলব আরাকু যদি যেতে চান তবে ট্রেনে যাওয়াই উচিত। এমন নয়নাভিরাম ট্রেন যাত্রা ভারতবর্ষে আর আছে কিনা সন্দেহ।

ওড়িশা এবং মধ্যপ্রদেশের সীমান্ত ঘেষে আরাকু উপত্যকা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২,৯৮৯ ফুট উচুতে। পাহাড় ঘেরা এই উপত্যকার মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় গালিকোন্ডা, যার উচ্চতা পাঁচ হাজার ফুট। আরাকু যাওয়ার জন্য হাওড়া থেকে করমণ্ডল এক্সপ্রেস সব চেয়ে ভালো ট্রেন, ভোর বেলা বিশাখাপত্তনমে নামিয়ে দেয় করমণ্ডল। বিশাখাপত্তনম থেকে কিরন্ডুল এক্সপ্রেস ছাড়ে সকাল ৬.৫০-এ, রেলপথে দুরত্ব ১৩১ কিমি। এই ট্রেনটি কিন্তু সময় মতই ছাড়ে। যেহেতু লোকাল ট্রেন, তাই প্রতিটা ষ্টেশনেই থামে আর সেই সুযোগে হকাররা ট্রেনে ওঠেন নানা রকম খাবার নিয়ে। আদিবাসী রমনীদের কাছে মিলবে কলা, পেয়ারা, সিদ্ধ বাদাম, ছোট ছোট সিঙ্গারা প্রভৃতি নানা ধরনের খাবার। চা বা কফি খেতে খেতে এবার চোখ রাখুন জানালার ওপাশে। ট্রেন সমতল থেকে একটু একটু করে উপরের দিকে উঠছে। পার হয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা নাম না জানা স্টেশন। কোট্টাভালাসা থেকে ট্রেন মেইন লাইন ছেড়ে ডান দিকে ঘুরে গেল।

শিভালিঙ্গপুরম ষ্টেশন থেকে শুরু হলো পাহাড় এবং উপত্যকার সারি। একটার পর একটা সুড়ঙ্গ পেরিয়ে ক্রমশ উপরের দিকে উঠছে ট্রেন। অন্ধকার সেই গুহায় ট্রেন ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই কচিকাঁচার চিৎকার। কেউ কেউ বাজাচ্ছে বাঁশি। এভাবে আরাকু পর্যন্ত প্রায় ৫৮ টি সুড়ঙ্গ পেরিয়ে যায় ট্রেনটি। সেই বিশাল ট্রেন সাপের মত একে বেঁকে উঠে যাচ্ছে পাহাড়ের গা বেয়ে। চারিদিকের অপুর্ব সেই দৃশ্য থেকে চোখ ফেরানো মুশকিল। যাত্রাপথে পড়বে ছোট বড় বেশ কয়েকটি জলপ্রপাত এবং পাহাড়ি নদী, চিমডিপাল্লি ষ্টেশনের বাদিকে রয়েছে তেমনই একটি জলপ্রপাত, কিন্ত বর্ষাকাল ছাড়া তার রূপ তেমন খোলে না। আরাকুর অন্যতম আকর্ষন বোরা কেভস এ যাওয়ার জন্য ষ্টেশন বোরাগুহালু পার হয়ে যাবে ট্রেন। যারা আগে বোরা গুহা দেখে তারপর আরাকু যেতে চান তারা এখানে নেমে যেতে পারেন। শিমলিগুড়া ষ্টেশনের মেইন বিলডিং এ টাঙ্গানো বোর্ডে লেখা আছে এটা হলো ভারতীয় রেলওয়ের ব্রডগেজ লাইনের সর্বোচ্চ স্টেশন, অর্থাৎ শিমলিগুড়া ভারতের সর্বোচ্চ ব্রডগেজ লাইন ষ্টেশন।

শিমলিগুড়ার পরেই আরাকু। প্রায় ৩৬ স্কোয়ার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত আরাকু উপত্যকা। শীতকালে যখন হলুদ শর্ষে ফুলে গোটা উপত্যকা ছেয়ে থাকে তখন নয় রকম উপজাতীদের আবাসভুমি আরাকু হয়ে উঠে দেবভূমি। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ ট্রেন থেকে নামতেই ঘিরে ধরবে লোকাল ট্যাক্সি বা ছোট গাড়ির চালকেরা। তবে আপনার হোটেল থেকে গাড়ি বলা থাকলে নিশ্চিন্ত। আরাকুর সৌন্দর্য চেটেপুটে নিতে গেলে অন্তত দুটো দিন আপনাকে এখানে কাটাতেই হবে। থাকার জন্য কোন চিন্তা নেই, রয়েছে বিভিন্ন বাজেটের নানা হোটেল-রিসোর্ট। এখানে এসেও বুক করতে পারেন, তবে হ্যাপা নেওয়ার ঝামেলা এড়াতে আগে থেকে বুক করে রাখাই ভাল।

দুপুরে খাওয়া সেরে সামান্য বিশ্রামের পর বেড়ানো শুরু হলো উপজাতীয় এক মিউজিয়াম দিয়ে। লালের ওপর সাদা কাজ, মাথার দিকে চূড়া করা স্থানীয় আদিবাসীদের ঘরের আদলে তৈরি ছোটখাটো একটা গোলাকার ভবন। দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে আদিবাসীদের হাতে তৈরি বাঁশ-বেতের কিছু উপকরণ, শিকার করার তীর-ধনুক ইত্যাদি। ছোট খাটো উপস্থাপনা, দর্শনীয় সামগ্রীও অপ্রতুল। অন্যান্য জায়গায় দেখা কোন মিউজিয়ামের সঙ্গে একে মেলাতে গেলে ভুল করবেন। আরাকুর আদিবাসী মিউজিয়ামের ভিতরে ছবি তোলা নিষেধ। মিউজিয়াম চত্বরে খানিকক্ষণ বেড়াতে পারেন, রয়েছে হস্তশিল্পের নানা সামগ্রী কেনাকাটার ব্যবস্থাও।

মিউজিয়াম থেকে এবার চাপ্পুরাই। পাহাড়ি নদী আপন খেয়ালে ছোটোখাটো জলপ্রপাত তৈরি করে এগিয়ে চলেছে। পাহাড় ঘেরা নির্জন এই স্থানটির সৌন্দর্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। অত্যুৎসাহী হলে নদীর জলে স্নানও করতে পারেন। অনেকেই দেখলাম নেমে পড়েছেন। উপজাতি মহিলারা আগুনে পুড়িয়ে বা সেদ্ধ ভুট্টা বিক্রি করছেন। বেশ সুন্দর তার স্বাদ, আমাদের দলের সকলেই দেখলাম বেশ তারিয়ে তারিয়ে ভুট্টা খেল।

পরদিন সকাল সকাল উঠে পাহাড়ী পথে ছুটিয়ে দিন গাড়ি। খুব সুন্দর ছায়া ঘেরা পিছ ঢালা মসৃণ পথ। এক দিকে উচু পাহাড় তো অন্য দিকে প্রশস্ত উপত্যকা। এরপর গালিকোন্ডা শ্যুটিং স্পট। কিছুক্ষন পর এক জায়গায় গাড়ী থামিয়ে চালক উপত্যকার বাঁ দিকে আঙ্গুল দিয়ে নির্দেশ করলো। ঐ যে দূরে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে ওটা হলো শ্যুটিং স্পট। কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতেই জানাল, দূর থেকেই নাকি ওটা দেখতে হয়। হতভম্ব হয়ে গেলাম পর্যটনের নমুনা দেখে। সুদুরে ছায়া ছায়া শ্যুটিং স্পট, নিঃশব্দে নীরবে আবার দু একটা ছবি তুলে ফের গাড়িতে উঠে বসলাম। খানিক দূরে ভিউ পয়েন্ট। পাহাড়ের কিনারায় সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো ভিউ পয়েন্ট থেকে উপত্যকার স্বর্গীয় সৌন্দর্য বেশ উপভোগ্য। তবে একেবারে পথের উপরে হওয়ায় নির্জনতার স্বাভাবিকতা থেকে বঞ্চিত হবেন। কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে ফের গাড়িতে।

এবারের গন্তব্য কফি বাগান। স্থানীয় আদিবাসী মানুষজনের হাতে তৈরী ভারতের প্রথম ভেষজ কফি আরাকু এমারেল্ড সারা বিশ্বব্যাপী বিক্রী হয়ে থাকে। হাজার হাজার মানুষ এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। পাহাড়ের গা বেয়ে একরের পর একর বিস্তৃত কফি বাগান। কফির পাশাপাশি গোলমরিচ এবং দারুচিনির চাষও হয় এখানে। রাস্তার পাশে স্থানীয় মানুষজন এসব বিক্রী করেন। কফিবাগানের পাশ দিয়ে চলে যাবেন আর কফি নেবেন না তা কি হয়। মান তেমন উন্নত না হলেও খানিকটা কফি নিতেই পারেন এখান থেকে। দরাদরি করে কিনতে পারেন দারুচিনি এবং গোলমরিচও।

কিছুটা গেলেই অনন্তগিরি। রয়েছে একটি মাঝারি আকারের জলপ্রপাত। মাঝারি হলেও তার রূপ কিছু কম নয়। অনন্তগিরিতে কিছু সময় কাটিয়ে আমরা রওনা হলাম আরাকুর প্রধান আকর্ষন বিখ্যাত বোরা গুহা দেখতে। পথে দেখা মিলল ছোট বড় নানা আকারের বিভিন্ন বানরের সঙ্গে। অবশেষে হাজির হোলাম বোরা কেভসে। গাড়ি চালক আমাদের নামিয়ে দিল যতক্ষন খুশী দেখার জন্য। ১৮০৭ সালে ব্রিটিশ ভূতত্ত্ববিদ উইলিয়াম কিং ১৫০ মিলিয়ন বছরের পুরনো এ গুহা আবিষ্কার করেন। টিকিট কেটে ঢুকতে হবে অনন্তগিরি পাহাড়ের মাঝে লুকিয়ে থাকা ভারতের বৃহত্তম গুহা বোরা কেভস-এ। ছোট পাহাড়ি নদী গোস্থানির পাশ ঘেঁষে বয়ে যাচ্ছে। এরই জলে থাকা বিভিন্ন খনিজদ্রব্য চুইয়ে গুহার ভেতরে প্রবেশ করে সৃষ্টি করেছে চুনাপাথরের বিভিন্ন আকারের স্তম্ভ।ওপর থেকে ঝুলে থাকা স্তম্ভগুলোকে ইংরাজিতে বলে স্ট্যালেক্টাইট। আর মাটিতে পড়ে খাড়া হয়ে আছে তাকে বলে স্ট্যালেগমাইট। স্তম্ভগুলো নান্দনিক সৌন্দর্যের সৃষ্টি ছাড়াও যেন রচনা করেছে বিভিন্ন আকৃতির মূর্তি। যার মাঝে বেশ কিছু দেব-দেবীর সাদৃশ্য খুঁজে পেয়ে পূজা-অর্চনাও করছে স্থানীয়রা। গুহার ওপর দিয়ে চলে যাওয়া রেলপথটিও চিহ্নিত করা আছে।

২৬২ দশমিক ৫ ফুট গভীর এ গুহা ভারতের সবচেয়ে গভীরতম বটে। অসংখ্য সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছি আমরা সেই গুহা গর্ভে। ২০০ মিটার দীর্ঘ হলেও গুহাটি দেখতে ৩৫০ মিটার পথ হাঁটতে হয়। ভেতরে কিছু জায়গায় নানারকম বাতি ব্যবহারে সৃষ্ট আলোকছটা চোখে লেগে থাকার মতো। সেই অনিন্দ্য সুন্দর গুহার রূপ দেখে যে পথে নেমেছিলাম, সেই পথেই আবার বের হয়ে এলাম সূর্যালোকে।

বোরা গুহা যাওয়ার পথেই গুহার সামান্য আগে পড়ে একটি মোড়। সেই মোড় থেকে বাঁ দিকে গেলে মিলবে কাতিকি জলপ্রপাত। কাতিকি যেতে গেলে বেশ হ্যাপা পোহাতে হবে আপনাকে। যে গাড়িতে আপনি এতক্ষণ ঘুরছেন সেই গাড়ি কাতিকি যাবে না। কাতিকি যাওয়ার জন্য অন্য গাড়ি ভাড়া করতে হবে এই মোড় থেকেই। ভাড়াও কম নয় প্রায় হাজার টাকার কাছাকাছি, তবে দরাদরি করতে পারলে গাড়ি ভাড়া অনেকটাই কমান সম্ভব। অত্যন্ত খারাপ একটি রাস্তায় প্রায় ছয় থেকে সাত কিলোমিটার যাওয়ার পরে রেল লাইনের আগে গাড়ি আপনাকে নামিয়ে দেবে। ততক্ষণে অবশ্য আপনার শরীরের কলকব্জা সব ঢিলে হয়ে গিয়েছে। রেল লাইন পার করে এবার হাঁটা পথ। প্রায় দেড়-দু কিলোমিটার হাঁটার পর এবার পাহাড়ে ওঠার পালা। খুব বেশী নয়, শ খানেক ফুট উঠতে পারলে দেখা মিলবে কাতিকি জলপ্রপাতের। তবে হ্যা, কাতিকির কাছে পৌঁছে মনে হয় এই পরিশ্রম সার্থক। নির্জন সবুজ পাহাড়ের মাঝে ঘন অরন্যে ঘেরা পরিবেশে কাতিকি জলপ্রপাতের সৌন্দর্য এক কথায় অসাধারণ। যাতায়াতের রাস্তাটিও কিন্তু বেশ সুন্দর। মোট কথা শরীর এবং পকেট দুটোই যদি অনুমতি দেয় তবে বোরা গুহা গেলে কাতিকি ফলস অবশ্যই যাবেন।

এবার হোটেলে ফেরার পালা। সন্ধে নাগাদ আমরা গেলাম একটু আরাকু বাজারে বেড়াতে। ছোট একটা হাট বসেছে। এখান থেকে কেনার তেমন কিছু নেই, তবে গ্রামের হাটে ঘুরতে খারাপ লাগবে না। স্থানীয় ছোটখাটো দোকানের ইডলি বা দোসা খেয়ে দেখতে পারেন, বেশ ভালো স্বাদ। ও হ্যা, আর একটা জিনিস আরাকু গেলে নিশ্চই খাবেন, ব্যাম্বু চিকেন। কাঁচা বাঁশের মধ্যে তেল ছাড়া বিভিন্ন মশলা মাখানো দেশী মুরগির মাংস পুরে ভাল করে পোড়ান হয়। ব্যাম্বু চিকেনের স্বাদ কিন্তু মুখে লেগে থাকবে বহুদিন।

পর দিন সকাল সকাল পদ্মপুরম গার্ডেন ঘুরে নিন। ট্রেনে ফিরতে হলে সেই বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। গাড়িতে বা বাসেও ফিরতে পারেন বিশাখাপত্তনম। তাই সকালের দিকে পদ্মপুরম দেখে নিলে সুবিধা হবে। আমাদের শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের মত না হলেও পদ্মপুরমও বেশ বড়। চেনা অচেনা অসংখ্য গাছপালা রয়েছে এই উদ্যানে। রয়েছে থাকার জন্য গাছের উপরে বাড়িও।

এবার আরাকু ছেড়ে ফেরার পালা। আমরা অবশ্য গাড়িতেই ফিরেছি বিশাখাপত্তনম। সেই অভিজ্ঞতাও বেশ সুন্দর। দেখতে দেখতে পাহাড় ছেড়ে এবার সমতলে, প্রথম গন্তব্য সীমাচলম। সে গল্প? নিশ্চই হবে, তবে আর এক দিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fourteen − 11 =