সম্পাদকীয়, মে ২০২১

দেশের সাম্প্রতিক কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলায় কি পদক্ষেপ করছে কেন্দ্র?  আদালতের এই প্রশ্নের উত্তরে সলিসিটার জেনারেলের উত্তর “আমরা গর্বিত যে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী নিজে অক্সিজেনের বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন।“ এবারে আপনি ভাবুন দেশে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অক্সিজেনের অভাবে চারিদিকে হাহাকার,  মারা যাচ্ছেন ফি দিন কয়েক হাজার মানুষ, সেখানে আমাদের প্রধান মন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে নিজে ভাবছেন শুনে আপনি কতটা গর্বিত হতে পারেন।  প্রধান মন্ত্রীর কথা শুনে মনে পড়ে গেল আর এক প্রধান মন্ত্রীর কথা। তিনি থাইল্যান্ডের প্রধান মন্ত্রী, সম্প্রতি মাস্ক না পরায় জরিমানা গুনতে হয়েছে তাকে। টিকা সংক্রান্ত একটি বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী প্রয়ুথ চান-ও-চা’কে মাস্ক না পরেই দেখা গিয়েছিল। আর সেই অপরাধের কারণেই ৬ হাজার বাহত অর্থাৎ, ভারতীয় মূল্যে ১৪ হাজার ৭২০ টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে তাঁকে। প্রসঙ্গত, রাজধানী ব্যাংকক-সহ ৪৮টি প্রদেশে সকলের জন্য মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে থাইল্যান্ডে।

এবারে ভাবুন, আমাদের প্রধান মন্ত্রীর কথা। না তিনি অবশ্য মাস্ক পরেছেন বা পরেন বটে, কিন্তু এই চরম করোনাকালে তার বিভিন্ন নির্বাচনী সভায় হাজার হাজার মানুষ যে মাস্ক পরে আসেননি সে ব্যাপারে তিনি ছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। একবারও তাকে বলতে শোনা যায়নি মাস্ক পরবার কথা। বরং সভায় ভীড় দেখে তিনি পুলকিত হয়েছেন, বার বার তাকে বলতে শোনা গেছে এমন ভিড় তিনি কখনও দেখেননি, তিনি অভিভূত। ভাবুন তাহলে কোথায় বেচারা থাইল্যান্ডের প্রধান মন্ত্রী, কোথায় আমাদের। প্রধান মন্ত্রী তো ছেড়েই দিন, আমাদের দেশে পঞ্চায়েত প্রধানও যদি মাস্ক ছাড়া চলেন তাকে জরিমানা করবার সাহস কি কেউ দেখাতে পারবে? কি মনে হয় আপনার। সত্য সেলুকাস বিচিত্র এই দেশ।

টিকা দেওয়া নিয়ে এখন তো চরম বিভ্রান্তি। একটু মনে করিয়ে দিই, মাস তিনেক আগে বিহার নির্বাচনে ইস্তেহারে বিজেপি জানিয়েছিল জিতে এলে তারা সকলকে বিনামূল্যে টিকা দেবে। এখন তো টিকার বিভিন্ন জায়গাতে বিভিন্ন দাম শুনছি। তা বিহারের সকলে কি বিনা পয়সায় টিকা পাবেন? সেটা পেলে অন্যরা কেন পাবেন না। সর্ব ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলিতে চোখ রাখলেই দেখা যাবে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে করোনার প্রকোপকে চেপে দেওয়ার প্রবনতা দেখা যাচ্ছে। গুজরাট, উত্তর প্রদেশ, প্রভৃতি এলাকায় করোনা আক্রান্তের সঠিক সংখ্যাকে চেপে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। যে অভিযোগটা এখানকার বিজেপি নেতারা মমতা সরকারের বিরুদ্ধে করে আসছেন সেটাই তারা তাদের শাসিত রাজ্যে করে দেখাচ্ছেন। ডবল ইঞ্জিন সরকার এত দিন ছিল যে সব রাজ্যে সেখানে চিকিৎসা পরিকাঠামোর এই হাল কেন? অক্সিজেনের হাহাকার সামলাতে বরং অন্য রাজ্যকে সাহায্য পাঠাচ্ছে ওড়িশা, কেরলের মত অবিজেপি শাসিত রাজ্য। মোদি, শাহের পরে আর এক ভগবান যোগীর রাজ্যে তো অক্সিজেন প্রয়োজন বলে ফেসবুক পোস্ট দিলেও পুলিশ এসে পেটাচ্ছে। ডবল ইঞ্জিনের এ কি দশা ? 

দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি সত্যিই মায়া হয়। একে তো তিনি এমন একটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যেখানে রাজ্য সরকারের ভূমিকাটাই রান্নায় তেজপাতার মত। রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বটুকুও তাদের হাতে নেই। এমন অবস্থায় যখন তাদের চাহিদা মত অক্সিজেন অন্য বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি আটকে দেয়, কেন্দ্র প্রয়োজনের থেকে কম অক্সিজেন পাঠানোর জন্য অক্সিজেন প্রস্তুতকারী সংস্থাকে চোখ রাঙায় তখন অসহায় মুখ্যমন্ত্রীর  কান্না ছাড়া আর কি করবার থাকে!

একটু ভাবুন এমন প্রধান মন্ত্রী কি আপনি আমি আগে পেয়েছি যিনি দশবছরে একবারও সাংবাদিক সম্মেলন করেননি। তিনি কিন্তু পূর্বতন মনমোহন সিং এর মত স্বল্পবাক নন। বরং বেশিই কথা বলেন। সেই মানুষটি কোনও সাংবাদিক সম্মেলনে কেন থাকেন না। একবার ছিলেন মনে আছে, কিন্তু কোনও কথা বলেননি, মিনিট কুড়ি চুপ করে বসে থেকে উঠে যান, সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন অমিত শাহ। আসলে আমাদের প্রধান মন্ত্রী ভগবান। তিনি শুধুই স্তুতি পছন্দ করেন। সাংবাদিক সম্মেলন মানেই নানা ধরনের সাংবাদিকদের নানা ধরনের প্রশ্ন, যা তার অনুকূলে মোটেই হবে বলে মনে হয়না। তাই ওসব ঝামেলায় না গিয়ে রেডিও টিভিতে শুধু ভাষণ দেন, মন কি বাত বলেন। সেখানে শুধুই তার কথা, তার ভাবনা। থাকবে না কোনও উটকো, অপ্রিয় প্রশ্ন। 

এরই মাঝে জরুরী পরিষেবা হিসেবে সেন্ট্রাল ভিস্তার কাজ চলছে দিল্লীতে। প্রায় কুড়ি হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প যাতে লকডাউনেও থেমে না যায় তাই নেওয়া হয়েছে সব রকম ব্যবস্থা। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প বলে কথা। তাঁর পাশাপাশি এটি শেষ হলে গর্বিত হবেন আপনিও। অবশ্য যদি বেঁচে থাকেন তবেই। কি রোম সম্রাট নিরোর কথা একটু মনে পড়ছে? ভাবুন ভাবুন, ভাবা প্র্যাক্টিস করুন, আপনি কি ভাবে কতটা গর্বিত হবেন।

সকলে সাবধানে থাকবেন। এ পোড়া দেশে কবে প্রতিষেধক পাবেন, বা আদৌ পাবেন কিনা তা বড়ই অনিশ্চিত। তাই নিজের সাবধানতা নিজেকেই নিতে হবে। বেঁচে থাকলে পরের সংখ্যায় আবার কথা হবে।

পলাশ মুখোপাধ্যায়

প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × 4 =

preload imagepreload image