অবগাহন

অনিমা দত্ত

মূল অসমিয়া গল্প থেকে বাংলা অনুবাদ – বাসুদেব দাস

    যার কথা আমি বলতে চলেছি, তিনি দুই কুড়ির ও বেশি বয়সের একজন বিদেশি ভদ্রমহিলা। নাম র’জা মার্গারেট ফিল্ড। পাঁচ ফুট শারীরিক উচ্চতা,সুগঠিত দেহ,নিস্তেজ নীল চোখ এবং এখানে সেখানে সময়ের রূপোলি রেখা জ্বলজ্বল করা মাথার ছোট ছোট মৌ্মাছি বর্ণের চুল সহ সুন্দরী মানুষটা। ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক লাগানো ছাড়া কখনও কোনো প্রসাধন না করা, সুতির কাপড় ছাড়া অন্য কোনো দামি পোশাক না পরা,কখন ও কোনো ক্লাবে গিয়ে উত্তেজক পানীয় পান করে না। সরল জীবন যাপন করা এই বিদূষী মহিলার সঙ্গে যেদিন পরিচয় হয়েছে সেদিন থেকে আমাকে আকর্ষণ করেছিল। তাঁর স্বামী নাগা পাহাড়ের ভাটি অঞ্চলের একটি বড় চা বাগানের ম্যানেজার ছিলেন। শহরে অনুষ্ঠিত একটি প্রদর্শনীতে মিসেস ফিন্ডের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে প্রগাঢ় আত্মীয়তা গড়ে উঠে।

তাঁর নিমন্ত্রণে একদিন আমি তাঁদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। শহর থেকে অনেকটা দূরে, জঙ্গলে ঘেরা অঞ্চলে যে এরকম একটা সুন্দর-মধুর পরিবেশ থাকতে পারে, তা আমার কল্পনারও অতীত ছিল। তাঁদের বাড়িটা অসমে প্রথম চা চাষ শুরু হওয়া সময়ের। নতুন নতুন ঘর, বারান্দা, গাড়ি পোর্টিকো, এয়ার কণ্ডিশনড শোবার ঘর এইসব কিছু অবশ্য প্রাসাদোপম পুরোনো বাড়িটাতে আধুনিক আভিজাত্য দান করেছে। বাড়ির পেছনের ঢালু অঞ্চলে স্নিগ্ধ সবুজ বিশাল লন, তার আশে পাশে এখানে সেখানে সোনারু ফুলগুলির হলদে পাপড়ি সবুজ লনে সোনার মণি ছড়িয়ে রেখেছে। ফার, সিলভার ওক, কৃ্ষ্ণচূড়া এবং অনেক নাম না জানা গাছের নিচে নিচে এক একটি ফুলের বেড।সেই মনোরম সৌ্ন্দর্য আমার দৃষ্টিকে স্নিগ্ধ করে তুলছিল। সঙ্গে সঙ্গে কানও আরাম পেয়েছিল যখন বারান্দার একটা খাঁচা  থেকে একটা ময়না পাখি সুন্দর স্বরে ডেকে উঠেছিল –‘সখি কি-রি-ষ্ণ।’ মিসেস ফিল্ডে্র ডায়েনা এবং থেরেসা নামের কুকুর দুটো লেজ নাড়াতে নাড়াতে বারান্দার সিঁড়িতে বসেছিল এবং পোষা বিড়ালটা তুলোর মতো কোমল দুটো বাচ্চা নিয়ে সবুজ ঘাসে খেলছিল। আমি বসলাম।মিসেস ফিল্ডের সঙ্গে নানা ধরনের কথা বললাম, চা এবং স্যাণ্ডুইচ খেলাম।

‘আপনার বাড়িটা বড় সুন্দর। এত সুন্দর বাগান এর আগে কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।’-আমি বললাম।

‘আমাদের বাড়ি নয় গীতা। কোম্পানি আমাদের থাকতে দিয়েছে।তবে একটা কথা সত্য যে বাগানের খুব যত্ন করি বলেই এই রূপ অক্ষুণ্ণ রয়েছে।’

‘আপনাদের আসল বাড়ি বিলাতের কোথায় মিসেস ফিল্ড?’

‘কবি ওয়র্ডসওয়র্থের বাড়ি যেখানে ছিল, সেখানেই।’

‘তারমানে ড্যাফোডিল ফুলের রাজত্বে।’এত সুন্দর জায়গা থেকে এসে আপনাদের এখানে ভালো লাগে?’

‘না লাগার কারণ নেই। দেখতে জানলে আসলে পৃথিবীর সমস্ত জায়গাই সুন্দর। একজায়গায় যা আছে, তা অন্য জায়গায় নেই।প্রতিটি জায়গারই কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সব জায়গাতেই নতুনত্ব রয়েছে। এখানে ড্যাফোডিল নাই। কিন্তু ঐ যে সোনারু ফুল? তোমরা সোনারু বল না?এই মণি মুক্তোর মতো গাছগুলি কোথায় পাব? মিসেস ফিল্ড হালকা গলাটা হেলিয়ে দূরের গাছগুলির দিকে তাকায়।

‘তাছাড়া তোমাদের শঙ্করদেব, মাধব দেব, মাধব কন্দলীকে আমাদের দেশে তো পাব না।’

‘আপনি অসমের এই মহাপুরুষ আর কবিদের জানেন?’

আমি খুব অবাক হলাম। মিসেস ফিল্ড কিছু না বলে হাসলেন।আমাকে তিনি ড্রয়িং রূমে নিয়ে গেলেন। পাশের বুক সেলফে জ্বলজ্বল করছে মাধব কন্দলীর রামায়ণ, শঙ্করদেবের দশম আর মাধবদেবের নামঘোষা।আমি অবাক বিশ্ময়ে তাকালাম।ময়না পাখিটা আবার শিস দিয়ে ডাকল-‘সখি কৃ্ষ্ণ’।

‘ময়নাটাকে এই ডাক কে শিখিয়েছে মিসেস ফিল্ড?’

‘মাসখানেক আগে একটা হাট থেকে এটা কিনেছিলাম। সেদিন থেকেই এভাবে ডাকছে। সম্ভবত আগের মালিক শিখিয়েছে। কৃ্ষ্ণ নামটি বড় মধুর।তোমাদের কৃ্ষ্ণ নামটির আসল অর্থ আনন্দ এবং শান্তির একটি অনুভূতি,নয় কি? ইজ দেট ইয়োর লর্ড কৃ্ষ্ণ-এ সেন্স অফ জয় এণ্ড ওয়েল বিইং? আমি তো সেভাবেই ভাবি।’মিসেস ফিল্ডের প্রশান্ত মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়া স্নিগ্ধ হাসিটার দিকে তাকিয়ে আমি বলি, ‘কৃ্ষ্ণ মানে সুন্দর এবং আনন্দময়।’ হঠাৎ আমাকে আরও বেশি অবাক করে মিসেস ফিল্ড নামঘোষার একটি পদ গেয়ে শোনালেন-‘কৃ্ষ্ণ হেন শব্দ ইটো পৃথিবী বাছক ভৈ্ল,ণ আনন্দত প্রবর্তয়’-সাত সাগর তেরো নদীর ওপারের একজন বিদেশি মহিলার মুখে অর্ধস্ফুট সেই ঘোষার পদ শুনে আমি অবাক হলাম। অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের প্রতি এই প্রীতি দেখে সাহিত্যের ইতিহাসের পাতা জ্বলজ্বল করতে থাকা অরুণোদয় যুগের মিসেস ব্রনসন এবং মিসেস ব্রাউন ইত্যাদি বিদৃষী মহিলার কথা মনে পড়ে গেল। ইনি অবশ্য কিছুটা ব্যতিক্রম।ইনি আমাদের ধর্মকেও ভালোবাসেন,শুধু ভাষা নয়।

‘আপনি আমাদের ধর্ম বিষয়ে অনেক কিছু জানেন।’

আমি সমস্ত ধর্ম সম্পর্কেই অল্প কিছু জানি।সাহিত্য হিসেবে আমি সমস্ত ধর্মগ্রন্থই পড়েছি।কোরাণ পড়েছি,বাইবেল পড়েছি, ত্রিপিটক পড়েছি, দশম নামঘোষাও পড়েছি। ধর্মকে আমি জানি,তবু আমার প্রবৃত্তি নেই। রজা ফিল্ড হাসলেন। যূথিকা ফুলের মতো সাদা ছোট দাঁতগুলি বের করে হাসলেন।

মিসেস ফিল্ড এবার আমাকে নিজের সম্পর্কে বললেন।তাঁর মেয়েটি প্যারিসের আর্ট স্কুলের ছাত্রী।ছেলে বিজ্ঞানের গবেষণায় ব্যস্ত এবং তিনি নিজে অসমের লোক সাহিত্যের ওপর অধ্যয়ন করছেন।বিলেতের ছেলেমেয়েদের জন্য তিনি অসমের লোককথা নিয়ে গল্প লিখেন। লোককথা শেখার জন্য তিনি গ্রামে গঞ্জে বেড়াতে যান। অসমিয়া ভাষা ভালোভাবে বুঝতে পারা এই বিদেশিনী মহিলাকে গ্রামের মানুষ ঘিরে ধরেন।কারও বাড়ির নিখুঁত ভাবে নিকোনো বারান্দার মোড়ায় বসে তিনি লোককথা শুনেন।বাড়ির প্রধান কোনো বুড়ো সহজ সরলভাবে তাঁর কাছে পিয়লি,দুখিরাম,টোটোনের লোককথা তাঁর কাছে বলে যায়।মাঝে মধ্যে দেওয়ালের টিকটিকি টিক টিক করে উঠার সঙ্গে সঙ্গে সত্যি সত্যি বলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। আবার আরম্ভ করে। বেড়ার ফোঁকর দিয়ে এসে উঠোনে পড়া বিকেলের কোমল রোদের আলোতে রজা ফিল্ড লোককথার খাতায় লোককথা গুলি লিখে নেন। ধোঁয়া বেরোতে থাকা একবাটি চা এবং দুটো পিঠে নিয়ে তাকে অ্যাপায়িত করা গৃহিনীকে ধন্যবাদ দিয়ে মিসেস ফিল্ড ফিরে যান।জঙ্গলের পথে একা পাঠশালায় যেতে ভয় করা পাঁচ বছরের পিয়লিকে সাহায্য করা কৃ্ষ্ণ গোঁসাইর গল্প শুনে আনন্দ পাওয়া মিসেস ফিল্ড কথা-বার্তার মধ্যে সেদিনই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল,’ইজ দ্যাট ইয়োর লর্ড কৃ্ষ্ণ,অ্যা সেন্স অফ জয়-অ্যা গোল্ডেন ফিলিং অফ কনটেন্ট?’

মিসেস ফিল্ডের ড্রয়িং রুমের পাতলা নীল রঙের দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা পাগড়ি বাঁধা একজনের একটা ছবি আমার চোখে পড়ল।‘এটা কার ছবি?’-জিজ্ঞেস করলাম।

‘আমাদের বাংলোর বুড়ো চৌকিদার রামলালের।আমি পেন্সিল দিয়ে এঁকেছি।আমার মেয়ের কাছ থেকে আমি আর্ট বিষয়ে সামান্য শিক্ষা লাভ করেছিলাম।মেয়ে এই বছরেই কোর্স কমপ্লিট করে সেফিল্ডের একটা স্কুলের কাজে যোগ দেবে।’

এবার আমার আরও বেশি অবাক হওয়ার পালা।মোজাইক করা মেঝেতে এই সুন্দর ড্রইং রুমের দেওয়ালে কারও ছবি নেই।আছে কিনা বাংলোর বুড়ো চৌকিদারের ছবি।মিসেস ফিল্ড এক অপূর্ব ব্যক্তিত্বের অধিকারিনী।            

    এরপরের দিনগুলি যেতে থাকল। মিসেস ফিল্ডের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা আগের মতোই রইল।তিনি লিখতে শুরু করা অসমের লোককথার বইটি ইতিমধ্যে শেষ হয়েছিল।তারপরে কার্তিক মাসের একটা জ্যোৎস্নাস্নিগ্ধ সন্ধ্যেবেলা মিসেস ফিল্ড আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে বললেন,তোমাকে যদি আমাদের সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যেতে বলা হয় যাবে কি?মা-বাবারা যেতে দেবে কি?’

‘আপনাকে আমাদের বাড়ির সবাই খুব ভালো করে জানে। তাই অনুমতি পেতে কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু কোথায় যাবেন?’

‘মাজুলি। কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথি তোমরা রাস পূর্ণিমা হিসেবে মান তাই তো? আমি শুনেছি রাস পূর্ণিমার রাতে মাজুলির কিছু সত্রে কৃ্ষ্ণলীলা সম্বন্ধীয় অত্যন্ত সুন্দর নৃ্ত্যের আয়োজন করা হয়।আমি দেখতে যাব বলে ভেবেছি।আমার যাবার আগ্রহের কথা জানালাম।আমার সঙ্গে আমার বোন প্রীতাও যাবে বলে ঠিক হল।

মাজুলি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘রিভার-আইল্যাণ্ড’বলে আমি বইপত্রে পড়েছি।তাছাড়া আরও শুনেছি মাজুলিতে নানা বর্ণের পাখি আছে।সেইসব দেখতে খুব ভালো লাগবে। মোটরবোটে ব্রহ্মপুত্র পার হতেও খুব ভালো লাগবে বলে মনে হয়।

এরপরে আমরা একদিন কুয়াশায় ভরা সুন্দর সকালে মাজুলির এক বিশেষ সত্রে যাবার জন্য নিমাতিঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।ভোরবেলাটা বেশ সুন্দর ছিল।দূরে আবছাভাবে মাজুলি দেখা যাচ্ছে।ওপারে সারি সারি নীল পর্বতমালার বুক থেকে খসে পড়া সাদা মেঘের আঁচল,লুইতের ছোট ছোট ঢেউগুলিতে কুয়াশা ভেদ করে বের হওয়া সকালের রোদের ঝলমলানি এবং তীরের এখানে ওখানে নাচতে থাকা বিরিণার ঝোপে একটা নয়নাভিরাম সকালবেলা।‘গীতা সোঁ প্লেজেন্ট!-মিসেস ফিল্ড উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন।নীল রঙের কাপাসের কাপড়টার ওপরে গলা থেকে ঝুলে থাকা মুক্তার মালাটা রোদের কিরণে জ্বলজ্বল করছিল।বাইনোকুলারটা নিয়ে তিনি দূরের দিকে তাকালেন।‘ও লাভলি রিভার আইল্যাণ্ড।ইট ইজ সোয়ার্ম এণ্ড গ্রীণ এণ্ড ইনভাইটিং।আই অলওয়েজ লাইক ওয়াটার্স।’একঝাঁক মাছরাঙা পাখি দল বেঁধে চিৎকার করে গেল।মিসেস ফিল্ড পাখির ঝাঁকটা দেখে আনন্দে হেসে উঠলেন। নদীর তীরে বসে আমরা সঙ্গে নিয়ে আসা চা-জলখাবার খেলাম।তারপর একটা সময়ে আমরা মোটর বোটে উঠে মাজুলির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। মাজুলিতে পৌছানর একটু আগে দেখলাম,জলের ঘাটে নল খাগড়ার নিচে ঢুকে থাকা ছোট ছোট কাছিম মোটর বোট সৃষ্টি করা জলের ঢেউয়ে চমকে উঠে লাফ মেরে টুপ টুপ করে জলে লাফিয়ে পড়ছে।সেই দৃশ্য দেখেও মিসেস ফিল্ড খুব মজা পেলেন।

মাজুলির একটি বিশেষ সত্রের বাইরের একটি ডাক বাংলোয় আমরা তিন রাত বসবাস করলাম।অসমের প্রাচীন সংস্কৃতির নিদর্শন যেন সেই সত্রে দুদিন মহাসমারোহের সঙ্গে ‘মহারাস’অনুষ্ঠিত হয়েছিল।অসমের বৈষ্ণব ধর্মের বিষয়ে গভীর জ্ঞান থাকা মিসেস ফিল্ড সেই মনোরোম নৃ্ত্যানুষ্ঠান দেখে অভিভূত হলেন। আমাকে বললেন, ‘ নৃত্যশিল্পে ভারতবর্ষ ধনী দেশ বলে আমি জানি।কিন্তু অসমের এই দুর্গম নির্জন গ্রামগুলিতেও যে এই ধরনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন রমনীয় নৃ্ত্যের চর্চা থাকতে পারে তা আমাদের স্বপ্নেরও অগোচর ছিল।’

        আসার দিন বিকেলে আমরা ডাক বাংলোর বাইরের বারান্দায় বসে ছিলাম। কৃষ্ণ প্রতিপদ তিথির চাঁদটা আকাশে রপালী আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল। দূরের বাঁশ বনের মধ্যে ঢুকে গিয়ে ধীরে ধীরে না দেখা হয়ে যাওয়া সংকীর্ণ সাদা রাজপথটা জ্যোৎসার আলোতে ঝলসে উঠেছিল।বাতাসে শরৎকালের  শিউলি ফুলের জানা-অজানা মৃদু গন্ধ ভেসে আসছিল। মিসেস ফিল্ড আগের দিন দেখে আসা নৃ্ত্য অনুষ্ঠানটি বিষয়ে আমাকে দুই একটি কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। তারপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাদের ধর্মের প্রতি আপনার এই ধরনের অনুরাগ কীভাবে সম্ভব হল মিসেস ফিল্ড?’

          তিনি হাসলেন।

          ‘ধর্মের প্রতি আমার কোনো অনুরাগ নেই। আমি কেবল সাহিত্য এবং সংস্কৃতির অনুরাগী।’ তার সোজাসুজি উত্তরে আমি থমকে গেলাম। ভাবলাম,তিনি হয়তো আমার কথায় খারাপ পেয়েছেন।তাই কথার সুরটা ঘোরাতে চাইলাম।

        ‘মাজুলী আপনার কেমন লেগেছে?’

        ‘ভালো।আজ সকালে নদীর তীরে বেড়াতে গিয়ে বন্য পাখিদের দেখেছিলাম,বড় ভালো লেগেছিল। আর কাছিমগুলি।ওদের ও খুব ভালো লেগেছিল।গ্রামের ছেলেমেয়েরা অত্যন্ত আদরের।কী সরল ওদের মুখগুলি। এই বিশাল নদীর ওপারে যে একটা জগত আছে,ওরা তাঁর খবরই রাখে না। ওদের স্বাস্থ্য ও নিঁখুত।’

        কিছুক্ষণ আমারা চুপ করে রইলাম। আমার বোন প্রীতা জিজ্ঞেস করল, ‘ আজ কী বার দিদি?’

          ‘রবিবার।’ হঠাৎ মিসেস ফিল্ডকে আমি জিজ্ঞেস করে ফেললাম,‘আজ আপনাদের বোধহয় দূটো সার্ভিস ছিল। আপনার যাওয়া হল না।’

          নিজের ধর্মের প্রতি তাঁর কতটা নিষ্ঠা, তা জানার জন্যই আমি জিজ্ঞেস করলাম।

          ‘আমার কোনো সার্ভিসে যাবার অভ্যাস নেই গীতা। আমাদের পরিবারের কেউ গির্জায় যায় না।তুমি হয়তো শুনলে বিশ্বাস করবে আমরা খ্রিস্টিয়ান নই।’ মিসেস ফিল্ড বললেন।

          আমরা সত্যিই অবাক হলাম। এই সুন্দরী মহিলাটি কী এক জটিল রহস্য।

          ‘একটা সময়ে অবশ্য আমরা খ্রিস্টিয়ানই ছিলাম। কিন্তু জীবনের ওপরে গভীর অভিজ্ঞতা হওয়ার পরে আমার ধর্মের প্রতি আর কোনো আগ্রহই রইল না। এখন আভিধানিক অর্থে বলতে গেলে আমি এথেইস্ট। আমার ছেলেমেয়ে দুটিও আমার চিন্তাধারায় বিশ্বাসী।

          আমি অবাক হয়ে মিসেস ফিল্ডের দিকে তাকিয়ে রইলাম।তাঁর প্রতি হঠাৎ আমার মনে এক ধরনের বিদ্বেষভাবের সৃষ্টি হল। কী যেন এক ধরনের বিজাতীয় সঙ্কোচ উপস্থিত হল। এই কমনীয় মুখের নারীটি ধর্ম পরায়ণ তো নয়ই, নাস্তিক। আমার সামনে নামঘোষার পদ গেয়ে শুনিয়েছিল। আর এখন বলছে সেই অনূরক্তি নাকি কেবল সাহিত্যের প্রতি। ধর্মের প্রতি নয়। ধর্মের প্রতি কোনো ধরনের দুর্বলতাকে তিনি প্রশ্রয় দেন না। অথচ আমরা এই ধরনের কথা ভাবতেই পারি না। ভাবি না। সেভাবে ভাবাও পাপ। কথাটা কেন জানি মেলাতে পারছিলাম না। আমি নির্বাক হয়ে বসে রইলাম। এরকম মনে হল,আমার সামনে যেন মিসেস ফিল্ড নামের কোনো নারী বসে নেই। চারপাশে ধোঁয়াশা কুয়াশা। তারমধ্যে একজন বিদূষী বিদেশি মহিলার বুদ্ধিদীপ্ত মুখের ছবিটা ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। হঠাৎ আমার চেতনা ফিরে এল। মিসেস ফিল্ডের কোমল মুখটা জ্যোৎস্নায় জ্বলজ্বল করছিল। নভেম্বর মাসের রাতের কুয়াশাগুলি বারান্দাটা ঢেকে ধরেছিল। রজা ফিল্ড বললেন, ‘গীতা ঠাণ্ডা পড়েছে। চল ভেতরে যাই। প্রীতার বোধকরি ঘুম পেয়েছে। কাল সকালেই আমরা কমলাবারী ঘাটে পার হতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাওয়া ভালো হবে।’

একমাস পরের কথা। একদিন মিসেস ফিল্ডের বাংলোয় গিয়েছিলাম।তখন সূর্য ডোবার সময় হয়েছিল। বাংলার পেছনে সুবিস্তৃত লনের একপাশে থাকা উইপিং উইলো গাছের নিচে বসে মিসেস ফিল্ড একটা বই পড়ছিলেন। আমাকে দেখে হেসে অভিবাদন জানালেন।বসতে বললেন তিনি যে বইটি পড়ছেন সেটি অসমের লোককথার বই। বিলেতের একটি প্রতিষ্ঠান ছেপে বের করেছে। আগেরদিন কয়েকটি বইয়ের একটি পার্সেল এসেছে। একটি আমার জন্যও এসেছে।

‘আমি একটু আগে স্কুল থেকে এসেছি।’

‘স্কুল থেকে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘আমি বাগানের শ্রমিকদের ছেলেদের সপ্তাহে দুদিন ইংরেজি শেখাই। ছোট ছোট ছেলেদের শেখানোর একটি আনন্দ আছে। ওরাও আমাকে চায়। কখনও যেতে না পারলে বাড়িতে এসে হাজির হয়।’

মিসেস ফিল্ডের উদারতার পরিচয় পেয়ে আমি অভিভূত হলাম। মহিলার কী অপরিসীম প্রাণশক্তি। গবেষণা করে, বই লিখে,গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে লোককথা মানুষের মুখ থেকে তুলে  নেন,ছবি আঁকেন, বাড়ির সমস্ত কাজকর্ম করেন,কোনোরকম অবহেলা করেন না। তারপরে আবার দুঃখী শ্রমিকদের ছেলেদের পড়ান।

আমি অন্য কোনো কথা বললাম। চা খেলাম। এবং তার পরে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য তৈরি হলাম। ঠিক তখনই একটা ঘটনা ঘটল। একটা ক্ষীণ এবং দুর্বল চেহারার চার বছরের ছেলে দৌড়ে এসে আমাদের কাছে পৌছাল। মিসেস ফিল্ড তাকে দেখে গালে হাত বুলিয়ে আদর করে কাছে টেনে নিলেন এবং আমাকে বললেন-‘ও আমাদের  ড্রাইভার মোহনের ছেলে। এর স্বাস্থ্য শৈশব থেকেই ভালো নয়। আমিই দেখাশোনা করি। কিন্তু ওর স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি দেখতে পাচ্ছি না।’ ছেলেটি সরল চোখদুটি বড় বড় করে মেলে দিয়ে মিসেস ফিল্ডের দিকে তাকাল। তিনি কিছুক্ষণের জন্য থামলেন। তারপর বললেন,‘গীতা তুমি তো গল্প লিখ। মোহন ড্রাইভারের জীবনটা নিয়ে একটা গল্প লিখতে পার। বেচারা বড় দুর্ভাগা।বাগানের একজন খ্রিস্টিয়ান মেয়েকে সে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিল। ওদের জাত না মেলার জন্য বিয়ের পথে অনেক বাধা দেখা দিল। অবশেষে সত্যিকারের প্রেমের জয় হল। কিন্তু সন্তানের জন্মের পরে স্ত্রীর মৃত্যু হল। যত্নের অভাবে বাচ্চাটার স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়ে গেল। কেউ তাকে গ্রহণ করতে চায় না। মোহনের মা-বাবা নিল না। কারণ নাতি হলেও তার শরীরে খ্রিস্টিয়ানের রক্ত মিশে আছে।’ মিসেস ফিল্ড কিছুক্ষণের জন্য থেমে আবার বললেন, ‘কিন্তু আমি তো বাচ্চাটাকে মরে যেতে দিতে পারি না। টাকা পয়সা খরচ করে তার চিকিৎসা করালাম। সে স্বাস্থ্য ফিরে পেল। কিন্তু জ্যোতি নেই। এই পৃথিবীতে সে যেন একটা অনাহূত অতিথি।’

তাঁর চোখদুটি জলে ভরে এল।

কিছু সময় মৌন থেকে পুনরায় বললেন,-‘এসব দেখে শুনে অস্কার ওয়াইল্ডের একটা কথা আমার মনে পড়ে-‘উই হেভ জাস্ট এনাফ রিলিজিয়ন টু মেক আস হেইট,বাট নট এনাফ টু মেক আস লাভ ওয়ান এনাদার।’ –এই সমস্ত কথা বলে তোমাকে ইনফ্লুয়েন্স করতে চাইছি বলে যেন ভুলেও কখনও ভেব না।যদি আমি কোনো অপ্রিয় কথা বলে থাকি তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।’

আমি নির্বাক হয়ে রইলাম। উত্তর হিসেবে আমার মুখ থেকে একটা কথাও বের হল না।আমার মনে তখন অন্য কোনো চিন্তা ভাবনার জায়গা ছিল না। সন্ধ্যের পাতলা অন্ধকারে আমি কেবল উপলদ্ধি করলাম এক সনাতন পবিত্র মাতৃমূর্তির ছবি-পৃথিবীর সমস্ত ধর্মের অতীত, করুণা এবং মমতায় সিক্ত মধুময়ী সেই মাতৃরূপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × three =