আন্তর্জাতিক সংগ্রহশালা দিবসের প্রেক্ষাপটে কিছু কথাঃ

অরুন কুমার, শিলিগুড়ি   ##

সংগ্রহশালা বা জাদুঘর সম্পর্কে আগ্রহ বা কৌতুহল আজও আমরা দেখতে পাই নূতন প্রজন্মের মধ্যে।  ১৮ মে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস। ১৯৭৭ সাল থেকেই দিনটি পালন করে আসছে ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব মিউজিয়াম। বিশ্বের বিভিন্ন পেশাজীবীদের যেমন সংগঠন রয়েছে, তেমনি জাদুঘর তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্তদের নিয়ে তৈরি এই সংগঠন। পৃথিবীর সব জাদুঘরের ব্যবস্থাপনা ও সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণ নিয়েই কাজ করে থাকে সংগঠনটি।

জাদুঘর দিবস উপলক্ষে এই লেখায় বিশ্বের সব দেশের মতো আমাদের দেশের জাদুঘরের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হবে, এসব জাদুঘর যেন একেকটি ইতিহাসের বই; এর একেকটি নিদর্শন যেন ইতিহাসের কোনো বইয়ের একেকটি পাতা। তাই বিশিষ্ট মার্কিন সাহিত্যিক  ন্যানেট এল. অ্যাভারির মতে, এই জাদুঘর হল এমন একটি জায়গা, যেখানে গেলে মনে হয় কিছুই যেন হারিয়ে যায়নি। তুরস্কের নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ওরহান পামুকের অভিমত হল, সত্যিকারের জাদুঘর এমন একটি জায়গা যেখানে সময়কে যেন বদলে ফেলা হয়েছে স্থানের আদলে। জাদুঘর নিয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিদের এসব উক্তির অবতারণা এমনি এমনি নয়। এর একটা ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক সেতু বন্ধনের ক্ষেত্রেও গুরুত্ত্ব রয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব মিউজিয়ামের লক্ষ্য, বিশ্বব্যাপী জাদুঘরগুলোর সংরক্ষণ করা, যেন যে কোনো সময়ের মানুষ তাদের অতীতের বা তাদের পূর্বপ্রজন্মের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, দর্শন, জ্ঞান সবকিছু জানতে পারে। কারণ, এসব জাদুঘরই অতীত আর ভবিষ্যতের মধ্যে সংযোগ তৈরি করে থাকে। জাদুঘর দিবসে তাই জাদুঘর নিয়েই জনসচেতনতা তৈরি করতে চায় জাদুঘর সম্পর্কিত পেশাগুলোর পেশাজীবীদের সংগঠন।

এরকমই এক অভিনব এক যাদুঘর বা সংগ্রহশালার কথা আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি পাঠকদের সামনে ।

হিমালয়ের পাদদেশের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন জনজাতির বসবাস, রয়েছে নানা সংস্কৃতির মাঝে ঐক্যের সুর। একদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়, চা বাগান, বনবস্তি বাসী আর অপরদিকে তাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র।আর এই হিমালয়ের পাদদেশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই বিভিন্ন জনজাতির বেশভুসা, পোশাক, মুখোশ, কৃষি কাজ, সঙ্গীতের কাজে ব্যবহার হয় এমন যন্ত্রপাতির প্রতি আজও আকর্ষণ লক্ষ্য করা করা যায় যা লুপ্ত হতে বসেছে। এগুলিকে এক নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে সেগুলিকে নুতন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার লক্ষ্যে উত্তরবঙ্গে এই প্রথম বেসরকারি উদ্যোগে আরম্ভ হতে চলেছে এক অভিনব সংগ্রহশালা যার নাম “হিমালয়ান ওয়ার্ল্ড মিউজিয়ম”। শিলিগুড়ির কাছে বাগডোগরা জাতীয় সড়ক লাগোয়া সবুজ ছায়ায় ঘেরা এই “হিমালয়ান ওয়ার্ল্ড মিউজিয়ম”। এর প্রধান ডঃ ওম প্রকাশ ভারতী জানিয়েছেন, এই অভিনব সংগ্রহশালায় ১৫০০ টির বেশি আরটিফেক্টস বা শিল্পকলা বস্তু সামগ্রী রয়েছে। এগুলি পশ্চিম হিমালয়ের জম্মু –কাশ্মীর, লাদাক, হিমাচল, উত্তরাঞ্চল থেকে সিক্কিম, দার্জিলিং, অসম, অরুণাচল ছাড়াও প্রতিবেশী চীন, তিব্বত, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার থেকে আনা আরটিফেক্টস বা শিল্পকলা সামগ্রীও এখানে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬৫ বেশী মুখোশ, ২৫০- কৃষি কাজ, সঙ্গীত যন্ত্র সামগ্রী, দুর্লভ পাণ্ডুলিপি ছাড়াও ৫৫০-র বেশী নানান শিল্পকলা বস্তু সামগ্রী রয়েছে  আগামি দিনে এগুলির সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ডঃ ভারতী জানিয়েছেন। ১৮ ই মে আন্তর্জাতিক সংগ্রহশালা দিবস উপলক্ষ্যে এই “হিমালয়ান ওয়ার্ল্ড মিউজিয়ম” এর আনুষ্ঠানিক ভাবে পথ চলা শুরু হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন ।

এই মিউজিউমের উদ্দেশ্য কেবল চিরাচরিত ঐতিহ্যকে রক্ষা  করাই নয়, এই সংগ্রহশালা গনমাধ্যমেরও ভূমিকা পালন করবে।  নূতন প্রজন্মকে এই বিষয়ে বলা, জানতে সাহায্য করাও এই উত্তরবঙ্গের বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা সংগ্রহশালা “হিমালয়ান ওয়ার্ল্ড মিউজিয়ম” উদ্দেশ্য। আগামি দিনে দেশ ও বিদেশের পর্যটকদের কাছেও এই বেসরকারি সংগ্রহশালা অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দু হয়ে উঠতে পারে।

 এতো গেল একটা দিক। অপরদিকে আমরা যদি মহানগরীতে ভারতীয় সংগ্রহশালা কি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে ঢোকার জন্য অনেক সময় লম্বা লাইন দেখি মনে হবে আজও আগ্রহ আর উৎসাহ রয়েছে সংগ্রহশালা বা মিউজিয়ামের প্রতি। আমরা জানি কলকাতা সহ রাজ্যে সরকারী বেসরকারি সব মিলিয়ে সংগ্রহশালার সংখ্যা একশোরও বেশি।  এর  অধিকাংশের খোঁজ কলকাতার মানুষই রাখেন না, বাইরের লোকের তো প্রশ্নই নেই। অধিকাংশেরই কোনও প্রচার নেই, দর্শক সংখ্যাও নগণ্য।  কোথাও রক্ষণাবেক্ষণের অবস্থাও খুব খারাপ।

যারা এই  সংগ্রহশালাগুলির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন তাদের বর্তমান আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভাল না। এমন কেন হচ্ছে? বহু-প্রত্যাশিত “মিউজিয়ম ডিরেক্টরি” আজও আলোর মুখ দেখল না।  অথচ সংগ্রহশালা বা জাদুঘর সম্পর্কে আগ্রহ বা  কৌতুহল আজও আমরা দেখতে পাই নূতন প্রজন্মের মধ্যে। এই সমস্ত বিষয়গুলি আজও প্রাসঙ্গিক, তাই আন্তর্জাতিক সংগ্রহশালা দিবসে আজকের প্রেক্ষাপটে এগুলি দেশ, সমাজ ও দেশের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ত্বভার যাদের ওপর ন্যস্ত তাদেরকে এবিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা গ্রহণ করতে হবে। তবেই আন্তর্জাতিক সংগ্রহশালা দিবস পালন সার্থক হবে।

One thought on “আন্তর্জাতিক সংগ্রহশালা দিবসের প্রেক্ষাপটে কিছু কথাঃ

  • May 18, 2019 at 5:44 pm
    Permalink

    খুব প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ লেখা। ভাল লাগল। পরবর্তীতে আরও এমন লেখার অপেক্ষায় থাকলাম। ধন্যবাদ লেখককে, ধন্যবাদ অবেক্ষণ পত্রিকাকেও।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nineteen + six =