উড়াল বাঁধ

রাজর্ষি বর্ধন, আগরপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা ##

সে যে ভারি সুখের সময় !

একপাশে বিরাট পাঁচিল পাহাড়, তারই ওপর তুলির পোঁছ মারা পাহাড়ি সড়ক, যে অষ্টাবক্রের মতো এগিয়ে গেছে। নাকি গুল্মলতার মতো গোটা পাহাড়টাকে ঘিরে ধরেছে !

কিংবা মেঘের বালিশে শুয়ে থাকা পাহাড়ের চুড়া যখন সদ্য জাগ্রত মহাপুরুষের মতো বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়, তখন কি দেখে মনে হয় না, এযাবৎকালে ঘটে যাওয়া অনেক কিছুরই সাক্ষী এই হিমালয় ! তবু কেমন শান্ত, ধীর, অটল !

কার্শিয়াং এ  তৃনাকে নিয়ে প্রথম এলাম। আর এই প্রথম মুক্তির স্বাদ অনুভব করলাম ! শৃঙ্খল বন্ধন থেকে মুক্তি ! সমাজ পারিবারিক দায়ভার এসবের ভ্রূকুটি থেকে কতো দূরে এই নির্জন পাহাড়ি পরিবেশে ! এখানে কারো কিছু বলার নেই, কেউ আঙ্গুল তোলবার নেই- পরিপূর্ণ জীবনের আস্বাদ নিতে কোন বাঁধা নেই, তা হোক না হাতে গোনা কয়েকটা দিনের !

আসলে আমিই তৃণাকে মুক্তির স্বাদ  দিতে চেয়েছিলাম ! বের করে আনতে চেয়েছিলাম সংসার নামক অন্ধকার কুয়ো থেকে ! ওর ব্যবসায়ী স্বামীর অত্যাচার থেকে ! কারণ আমি জানি, মনীষার সঙ্গে ডিভোর্সের পর আমি সম্পূর্ণ মুক্ত হলেও ওকে থেকে যেতে হবে ওর স্বামীর গুহায়, যে কিনা তার অসীম লালসা চরিৎারথের জন্য তৃণাকে ব্যবহার করে যাবে, আর তৃণার ওপর দিয়ে বয়ে যাবে ঝড় ! তাতে ওর জীবনী শক্তি নষ্ট হবে, আর ওর ফুলের মত নরম মন ঝড়ে তছনছ হবে ! যেটা আমি দাঁড়িয়ে থেকে দেখে যেতে পারি না!

আসলে আমার আর তৃণার কারোরই দাম্পত্য জীবন ওস্তাদ শিল্পীর সুর-তালের মতো নিখুত ভাবে হয়নি, ছন্দপতন ছিল প্রথম দিন থেকেই ! আমি যেমন আমার কর্পোরেট দুনিয়ায় কর্মরত উচ্চাভিলাষী স্ত্রীর মন মতো হতে পারিনি, তৃণাকেও তেমন ওর বিজনেসম্যান স্বামী নিজের মতো গড়ে নিতে পারেনি!  আমরা দুজনেই একই স্কুলের শিক্ষক ছিলাম। আমি জীবন বিজ্ঞান পড়াতাম, তৃনা বাংলা ! বলা যেতে পারে, নিজেদের অসুখি দাম্পত্যই আমাদের কাছে টেনেছিল ! নিজেদের সমস্যার কথা একে অপরকে জানাতে গিয়ে কখন যে হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করেছিলাম একে ওপরের প্রতি !

  স্কুলের এক্সকারসনে যাচ্ছি, এই বলে তৃণাকে নিয়ে এই নির্জন শৈলশহরে এসেছি ! আমি ইচ্ছে করেই বর্ষাকালে আশার প্ল্যান করেছিল। বর্ষাকালে কারসিয়াঙ্গের রূপ, বিশেষ করে মেঘের ঘোমটা দেওয়া পাহাড় আর গাছে-গাছে বৃষ্টির ফোটার টুপটাপ পিয়ানোর সুর, এসব চাক্ষুস করতে !

দূরে পাহাড়ে একটা নদী বয়ে চলেছে ষোড়শী তরুণীর মতো ! উচ্ছ্বাস রয়েছে, কিন্তু প্রকাশ নেই ! গিয়ে দেখলাম, নদীর দুধারে বড় বড় বল্ডার ফেলা। প্রায় দুমানুষ উঁচু সেসব বোল্ডার ! নদীর গতিকে রোধ করার জন্যই এমন ব্যবস্থা ! চঞ্চলমতি যুবতী নদী যেন বেশি বয়ে না যায়, তাই তার পায়ে শিকল বাঁধা ! মনটা খারাপ হয়ে গেলো দেখে !

একজন স্থানীয় পথচারীকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি ব্যপার, নদীর চারপাশে বাঁধ কি বর্ষার জল ধরে রাখার জন্য !

সে মাথা নেড়ে বলল, “ না বাবু! প্রতি বর্ষায় এ নদীর খুব বাড়বাড়ন্ত দেখা যায় ! পাশের গ্রাম- টামে ঢুকে পড়ে, পুরো ভাসিয়ে দেয় ! তাই নদী যাতে অন্য পথে না বইতে পারে, নিজের পথেই থাকে, সেই জন্য সরকার থেকে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে !”

আমি আর তৃণা পরস্পরের দিকে তাকালাম। নিজেদের চোখের ভাষা বুঝতে পারলাম ! বুঝলাম, আমরাও এই নদীরই মতো, যতই ভেসে বেরিয়ে ছুটে অন্যত্র যেতে চাই না কেন, সেই আবার ফিরে আসতে হয়, নিজের খাতে বইতে হয় ! নইলে যে পরিবার, সম্পর্ক, সামাজিক অবস্থান- সব ভেসে যায় !

পাহাড় জুড়ে তখন সন্ধ্যা নামার আয়োজন চলতে থাকে ! আমরা হোটেলের দিকে পা বাড়াই !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one × 4 =