একটি গোয়েন্দা গল্প

জয়ন চট্টোপাধ্যায় ##

প্রত্যেক মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে ফেলুদা, ব্যোমকেশ এবং কিরিটি পুষ্ট বাঙালিদের মধ্যে ছোট থেকেই একটা গোয়েন্দা মন বর্তমান, আর অহেতুক সন্দেহ এবং অবিশ্বাস মানুষের এই গোয়েন্দা স্বত্বাটিকে আরও প্ররোচিত করে। বর্তমান সমাজ এবং মানুষের বদলে যাওয়া হাবভাব জন্ম দেয় অবিশ্বাস এবং সন্দেহ। আমাদের গল্পটি এরকম কিছু অবিশ্বাস এবং সন্দেহর উপর প্রতিষ্ঠিত। একটা ছোট শহরের ছোট মেসবাড়ি কে কেন্দ্র করে গল্পটি। রায়পুর ছোট শহর হলেও জংশন স্টেশন থাকায় শহরটি বেশ জমজমাট। সরকারি স্কুল, কলেজ, লাইব্রেরি সবই আছে। থিয়েটার হল আছে, নাটকরে দল আছে, পার্টি-পলিটিক্স আছে, ফি বছর মেলা, যাত্রা এবং সারকাসের হিড়িক আছে, এছাড়াও  বেশ কয়েকটি সরকারি দফতরের ব্রাঞ্চ অফিসও আছে রায়পুরে এবং সেইসব দফতরের কর্মীবৃন্দের থাকার জন্য আছে বেশ কয়েকটি মেসবাড়ি। এমনই এক মেস বাড়ি কে নিয়ে আমাদের গল্প।রথতলা মেস এই এলাকার সব থেকে প্রাচীন মেস গুলোর মধ্যে অন্যতম। ছোটো ছোটো এক একটি ঘরে এক একজন বোর্ডার, সাফসুতরো পরিবেশ, মেসের পিছনে খানিকটা জঙ্গল মতো আর তারপরেই একটা বিশাল দীঘি, নির্জন পরিবেশ বলে খুবই চাহিদা ছিল এই মেসটির আর তাছাড়াও বর্তমান মালিক অমর বাবুর মতো সদা হাস্যময় লোক খুবই কম দেখা যায়। অকৃতদার এই মানুষটির নারীজাতির উপর বিশেষ রাগ বা অভিমান আছে। সঠিক কারন টা জানা যায়নি তবে কানাঘুষো শোনা যায় অমর বাবুর বিয়ের দুদিন আগে নাকি তার হবু স্ত্রী তার প্রেমিকের সাথে পালিয়েছিলেন। তারপর থেকেই মহিলা দেখলেই তিনি খেপে যেতেন। এতটায় বিদ্বেষ যে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরদিনেই মেসের বহুদিনের পুরাতন রান্নার লোক মমতাদেবী কে তারিয়ে দেন এবং মেসের বাইরে ‘মহিলা প্রবেশ নিষিদ্ধ’ এর বোর্ড টানিয়ে দেন। তারপর থেকে মেসের সদস্যদের বউ, বোন, মা এমনকি বাচ্চা মেয়েদেরও দরজার বাইরে থেকে কথা বলে ফিরে যেতে হয়। এই ব্যবস্থায় অনেকে ক্ষুব্ধ হয়। অনেকে মেস ছেড়ে দেয়। বাকিরা অল্প ভাড়ার জন্যই হোক বা অমর বাবুর মতো মিষ্টি মালিকের জন্যই হোক বা নতুন ওড়িয়া ঠাকুরের দুর্দান্ত রান্নার জন্যই হোক, কেউ ছেড়ে গেলো না। আর তাছাড়াও পুরুষদের মেসে মহিলা থাকাটাও শোভনীয় নয়। কিন্তু তবুও নমাসে ছমাসে অনেকের পরিবারই আসত মাঝে মাঝে, তাদের জন্য আলাদা গেস্ট রুমের ব্যবস্থাও ছিলো, কিন্তু ঐ নিয়মের পর সেই গেস্টরুমে খান তিনেক চৌকি ফেলে মেস সম্প্রসারন করলেন অনুকুল বাবু। অতঃপর এই ব্যবস্থায় চলে আসছে ১০ বছর ধরে। পুরোনো মেম্বাররা এই নিয়মের সাথে মানিয়ে নিয়েছিলেন নিজেদেরকে আর নতুন মেম্বাররা এটাই এখানকার দস্তুর বলে কিছুটা কষ্ট করেই দিনযাপন করছিলেন। ছুটিতে গিয়ে পরিবারের দেখা সাক্ষাত ভিন্ন আর উপায় ছিলো না। পুরোনো মেম্বাররা দীর্ঘদিন ধরে পরিবারের থেকে দূরে থাকায় তাদের অসুবিধা হয় না আর। নতুন মেম্বারদের মধ্যে অবশ্য অধিকাংশ কলেজ পড়ুয়া ছাত্র, আশেপাশের গ্রামে থাকে, পড়াশোনার সুবিধার জন্য এখানে মেসে থাকে। তাই তাদের এই অদ্ভুত নিয়মের মধ্যে থাকতে অসুবিধা হয়না। যত পরিবারের শাসনের বাইরে থাকা যায় তত তাদের ভালো। ভালো লাগাতে পারল না কেবল একজন, বিশ্ব মজুমদার। স্থানীয় ব্যাঙ্কের একজন ক্লার্ক। সদ্য বিয়ে করেছে, এই সময় ভেবেছিল নিজের কাছে বউ কে এনে কয়েকদিন রাখবে, কিন্তু বিধি বাম, অমরবাবু থাকতে সেটা সম্ভব না। এক ছুটির দুপুরে বসে মেসতুতো বন্ধু সমীরের সাথে গল্প হচ্ছিল এই নিয়েই।

‘যায় বলিস সমীর, বুড়োর জীবন শুকনো কাঠের মতো বলে কি আমরাও ব্রহ্মচর্য পালন করব?’

‘আরে অমর জেঠুর ট্র্যাজেডিটা একবার বোঝ’।

‘ধুর শালা, ঐ মহিলাকে পেলে খুন করব আমি’।

‘ইচ্ছাটা যে আমার মনেও আছেরে বন্ধু’।

‘ধুর এইভাবে বিবাগি হয়ে থাকতে ভালোলাগছে না, বিয়ে করার তো কোনো মানেই রইল না’।

‘আমি বলি কি? তুই এখানে বাড়ি ভাড়া নিয়ে নে’।

‘ সেই উপায় নাইরে, ওখানের বাস একেবারে উঠিয়ে নিলে সম্পত্তির ভাগ নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে, এমনিতেই বাবা আমার এখানে চাকরি করাটা পচ্ছন্দ করেন না, বাবা চান তার ছেলেরা একসাথে থাকুক কিন্তু আমার চাকরি বাধ সাধলো এবার বউকেও যদি নিয়ে চলে আসি সমস্যা হয়ে যাবে, বাবা আমাকে হয়তো ত্যজপুত্র করবেন, খুউউব সমস্যা রে’।

‘মানে ব্যাপারটা হোলো বাড়িতে বাবা আর এখানে জেঠু তোর প্রণয়ের পথের কাঁটা’।

এই সময় বাইরে চিৎকার চেঁচামিচি শোনা গেলো, অমর বাবুর গলা, ‘ সব্বোনাশ করেছে, এসব কি? বাইরের বোর্ডের লেখাটা কি পড়েনি? ওরে কে আছিস আমাকে ধর, বুকটা কেমন ধরফর করছে’। সমীর আর বিশ্ব বাইরে বেরোল, সামনেই স্বপন বাবু ছিলেন তাকে জিজ্ঞেস করতে জানা গেল মেসের নতুন ছোকরা চাকর বিট্টু, দুপুরের উদবৃত্ত খাবারগুলো ফেলে না দিয়ে এক বুড়ি ভিখারিনি কে ডেকে এনে খাওয়াচ্ছিল, সেটা দেখেই অমর বাবু খেপে যান। বেচারা ছেলেটি লেখাপড়া জানে না, বেফালতু হেনস্থা হতে হোল তাকে।তবে অমর বাবুর মন ভালো এই ‘গুরুতর’ অপরাধের জন্য ছেলেটির অজ্ঞানতাকেই দায়ী করলেন এবং বর্ণপরিচয় প্রথমভাগ এনে সেদিন থেকেই ছেলেটির সাক্ষরতার কাজে ব্রতী হলেন। অতঃপর দিন কাটতে লাগলো। বিশ্ব বেচারা আর বউ কে আনার ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করলনা আর। কে জানে হয়তো তাকেও আবার বর্ণপরিচয় প্রথমভাগ থেকে আরম্ভ করতে হবে পড়াশোনা। বউকে ছেড়ে থাকাটা বিরহের কিন্তু পড়াশোনা আবার প্রথম থেকে শুরু করা আরও বেদনাদায়ক। তাই ক্যালেন্ডারের পাতা বদলাতে লাগল। এর মধ্যে বিশ্বর বাবা মারা গেলেন এবং সেই কারনে মাসখানেক পর যখন বাবার কাজ শেষ কাজ সেরে মেসে ফিরল তখন দেখল কলঘরের পাশের দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে থাকা ঘরটিতে নতুন বোর্ডার এসেছে, বিট্টু ‘গোপাল বড় সুবোধ বালক’ থেকে ‘কুমোড় পাড়ার গরুর গাড়ি’ তে পৌছে গেছে। বিট্টুর এই কমসময়ে এতোটা উন্নতিতে অমর বাবু বেজায় খুশি। সব ঠিকঠাক চলছিলো, কিন্তু বিশ্ব ফিরে আসার দুদিন পর থেকে শুরু হল এক কাণ্ড। মাঝরাতে মেসবাড়ির অনেকেই শুনলো মহিলা কন্ঠস্বর। প্রথম প্রথম সবাই মনের ভুল হিসাবেই ধরে নিয়েছিল তাই কেউ কারোর সাথে কোনো আলোচনা করেনি। কিন্তু ব্যাপারটা জটিল হল যখন একদিন বিকালে মেসের আদিবাসিন্দা শান্তিলাল বাবু মেসের বারান্দাতে আবিষ্কার করলেন একটি কানের দুল। ভুত দেখার মতো চমকে উঠলেন উনি। খবরটা শীঘ্রই ছড়িয়ে পরল, মেসের সবাই অকুস্থলে গেল। অমরবাবু রাগে ফেটে পড়লেন, ‘এসব কি? কার কাজ এটা? বেইমান সবাই, কে মেয়ে নিয়ে এসেছে? পুলিশ ডাকবো, কে করেছে এটা, ও মাগো কি সর্বনাশ হলো আমা্র, উফ জল দে কেউ, দিনে দুপুরে  এসব কি?’ সবাই ধন্দে পড়ে গেল এটা নিয়ে, বড়রা সবাই দোষ দিচ্ছে ছাত্রদের, ‘ যুগের হাওয়া বুঝলেন না অমর বাবু? এই সব ওই ছেলেপুলেগুলোর কাজ, উঠতি বয়স তো তাই ফুর্তির লোভ সামলাতে পারেনি’। কলেজের ছেলেগুলো প্রতিবাদ করে উঠল, ‘হ্যাঁ তাই তো, যত দোষ নন্দ ঘোষ। আমাদের পরীক্ষার চাপে চোখে সর্ষে ফুল দেখছি এখন না কি আমরা মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করব, হুহ ওসব আপনাদেরই কাজ’।

-‘কি বললে হে ছোকরা? লজ্জা করে না? দেখুন অমরবাবু দেখছেন দোষ করে গলা উঁচু করে কথা বলছে কেমন?’

ছেলেরা উত্তর দিতেই যাচ্ছিল তাদের থামিয়ে মেসের আরেক বাসিন্দা সাহেব বলল, ‘মামাবাবু আপনাকে বলা হয়নি, গত কয়েকদিন ধরে আমি মাঝরাতে খুব হাল্কা মেয়ের গলা শুনতে পেয়েছি’। পাশ থেকে সমীর বলে উঠল, ‘হ্যাঁ জেঠু আমিও গলার আওয়াজ পেয়েছি’। এবং প্রায় সাথে সাথে প্রত্যেকে স্বীকার করল যে তারা মহিলা কণ্ঠস্বর শুনেছে। অমরবাবু গম্ভীর হয়ে গেলেন, ‘সবাই নিজের নিজের কাজে যান, আমি দেখছি’। সবাই যে যার রুমে ফিরে গেল শুধু বিশ্ব যেতে গিয়েও ফিরে এসে বলল, ‘আচ্ছা জেঠু, এটা ঐ নতুন ছেলেটার কাজ না তো? ও আসার পর থেকেই কিন্তু এইসব ঘটছে’। অমরবাবু বললেন, ‘তুমি জয়কে দেখোনি বাবা, ও খুবই ভদ্রছেলে, আর তাছাড়াও জয় তো আজকে ১০ টার গাড়িতে বাড়ি গিয়েছে’। ‘হুম বুঝলাম, জেঠু আপনি এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি টেনশন করবেন না, হতেই পারে আপনার পোষা কুকুর ভুলু মুখে করে এনেছে, আপনি প্রেশার বাড়াবেন না এসব নিয়ে ভেবে, আমি এলাম’। কিন্তু ভাববেনা বললেই তো ভাবা বন্ধ হয়না, প্রত্যেকের মনের মধ্যে সুপ্ত থাকা গোয়েন্দাটা জেগে উঠল, সবাই সবাইকে সন্দেহ করতে শুরু করল। ব্যাপারটা চরমে পৌছাল দুদিন পরে, প্রত্যেক শুক্রবার মেসের হল ঘরে আড্ডায় বসে সবাই মিলে,ছাত্রের দল এই আড্ডায় যোগ দিত না। এই শুক্রবারে আড্ডায় আবির্ভাব হল বিখ্যাত সব গোয়েন্দাদের, চলতে থাকলো দোষারোপের রিলে রেস, প্রথমে শুরু করেন তপনবাবু, ‘দেখুন আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি এই কাজ ওই সব কলেজে পড়া ছোঁড়াগুলোর’। পাশ থেকে ফোড়ন কাটেন মধুসুদনবাবু, ‘যা বলেছেন, আরে মশায় আজকালকার ছেলেপুলে গুলো সব উচ্ছন্নে গেছে’। ‘দেখুন প্রমান হাতে না আসা পর্যন্ত এভাবে কাউকে দোষারোপ করতে পারেন না, আমার মনে হয়না ওরা এসব করবে, আর তাছাড়াও ওরা সব ভদ্র ঘরের ছেলে, ওদের মা বাবার সাথে আমি পারসোনালি কথা বলে তবে থাকতে দিয়েছি আর ওদের মা বাবা দের দেখে আমার মনে হয়না যে ছেলেদের কুশিক্ষা দেবে’, অমরবাবু বললেন। বিশ্ব বলল, ‘দেখুন জেঠু ঐ যে জয় নামের ছেলেটি ওকে আমার সুবিধার মনে হয়না, না হলে এতোদিন যে এসেছে একদিনও ওকে আমি কারোর সাথে কথা বলতে দেখিনি এবং ওর ঘরের দরজা সব সময় বন্ধ রাখে, নিশ্চয় কিছু গন্ডগোল আছে’। ‘এই তো বিশ্বভায়া একটা কাজের কথা বলেছে, আরে ঐ ছেলেটির মনে পাপ আছে তাই কারোর সাথে মেশেনা’, সৌরভবাবু সায় দিলেন। সাহেব বলল, ‘ আরে ছেলেটি মনে হয় তোতলা তাই কথা বলেনা সেরকম ভাবে, বা হয়তো বোবা’। ‘ না জয় বোবা তোতলা কিছুই নয়, আর কিছু কিছু মানুষ প্রাইভেসি পচ্ছন্দ করে তাই হয়তো কারোর সাথে মেশেনা’, অমরবাবু বললেন। ‘জেঠু একদম ঠিক কথা বলেছেন’, সমীর এইবার মুখ খুলল, ‘ বিশ্ব সরি ভাই আমার মনে হয় এসব তোর কাজ, তুই তোর বউকে কয়েকদিনের জন্য মেসে এনে রাখতে চেয়েছিলিস না?’। বিশ্ব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ মানে বলতে কি চাইছিস আমি একদিন সারাদিনের জন্য বউ কে মেসে এনে রেখেছিলাম?’। সমীর বলল, ‘ হতেও পারে, তোর ঘরটা সদর দরজার পাশেই এটা ভুলে যাস না’। ‘ভাই আমার মনে হয় তোকে বাজার থেকে দু’টাকার হুঁশ এনে খেতে হবে, আমি মোটেও এসব করিনি, হ্যাঁ এটা সত্যি যে আমি বউ কে কয়েকদিনের জন্য এখানে আনতে চেয়েছিলাম, বাবার ভয়েই হোক বা মেসের নিয়মের কারনেই হোক আমি আনতে পারিনি, আর বাবা যখন আজ নেই আর আমাদের সম্পত্তিরও ভাগ হয়ে গেছে তাই আর গ্রামে পড়ে না থেকে আমি এখানেই পাকাপাকি ভাবে থাকতে চাই, তাই ভাড়া বাড়ির খোঁজও শুরু করে দিয়েছি’, বিশ্ব নিজের কথা শেষ করল। ঘরের পরিবেশ একটু থমথমে হয়ে গেলো। বিট্টু অনেকক্ষণ ধরে এদের কথাবার্তা শুনছিলো এইবার সুযোগ বুঝে বলল, ‘ আমি কিন্তু একদিন জয়দার ঘর থেকে মেয়ের গলার আওয়াজ শুনেছিলাম’। ঘরের মধ্যে যেন বোম পড়ল, সবাই অবাক হয়ে গেলো। অমরবাবু বললেন, ‘তুই এতোদিন বলিসনি কেন কিছু?’ বিট্টু বলল, ‘ আমি বুঝতে পারিনি আসলে দাদু আর আমি সেভাবে পাত্তা দিয়নি আজ হঠাত তোমাদের কথাতে মনে পড়ল’। এতক্ষণ ধরে চুপচাপ বসে থাকা শান্তিলাল বাবু এবার লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘আমি আগেই বুঝেছিলাম এসব ঐ ছোকরার কাজ,’। অমরবাবু খানিক আঘাতগ্রস্ত স্বরে বললেন, ‘জয়? ছি ছি ছেলেটাকে দেখে চুপচাপ ভদ্র সভ্য মনে হয়েছিল, বলেছিল নাকি থিয়েটার করে, আমিও ভাবলাম কালচার নিয়ে আছে মানে ভদ্রই হবে, ছি ছি’। মধুসুদনবাবু বললেন, ‘ তাহলে এখন করনীয় কি? এভাবে তো আর ভদ্র সমাজে থাকা যায়না? আজই দূর করুন ঐ ছোরা কে’। বিশ্ব বলল, ‘ না কাকু এভাবে হবে না, হাতেনাতে ধরে বিদায় করতে হবে, যাতে গোটা শহরের লোক জানে এমন ব্যবস্থা করতে হবে না হলে আবার কোনো মেস বাড়িতে উঠবে আর সেখানেও এই একই কাণ্ড ঘটাবে’। সমীর বলল, ‘ঠিক কথা, শোন বিট্টু তুই এবার থেকে একটু চোখ কান খোলা রাখবি যখনই কিছু বেগরবাই দেখবি সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জানাবি’।

পরদিন শনিবার। বিশ্ব আর সমীর দুজনেই অফিস যায়নি। বিশ্বর ঘরে বসে নিজেদের ভুল বোঝাবুঝিটা মিটিয়ে নিচ্ছিল, এমন সময় অমরবাবু হাঁপাতে হাঁপাতে আসেন, ‘এই যে বাবারা চলো তো একবার, জয় এর ঘর থেকে মেয়ের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে’। বিশ্ব বলল, ‘বলেন কি? এলো কোনদিক দিয়ে? সদর দিয়ে ঢুকলে তো দেখতে পেতুম’। সমীর বলল, ‘নিশ্চয় খিড়কি দিয়ে ঢুকেছে, আরে খিড়কির দরজার পাশেই তো জয় এর রুম, জেঠু চলুন দেরি করা ঠিক হবে না’। ওরা তিনজনে মিলে জয় এর রুমের সামনে এলো, দরজায় কান পাতলো, স্পষ্ট শুনলো মেয়ের গলার আওয়াজ, বিশ্ব কড়া নাড়ল কয়েকবার, ঘরের ভিতর থেকে আওয়াজ এল, ‘কে? যায়’। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুললো। ‘ এ কি অমরবাবু, আসুন আসুন, আপনারাও আসুন’। ওরা ঘরে ঢুকলো, কিন্তু আশ্চর্য কোথাও কোনো মেয়ে নেই, তিনজনেই ঘরটা চকিতে দেখে নিলো, অবাক হল ওরা, তারপর নিজেদের হতভম্ব ভাব লুকিয়ে বিশ্ব বলল, ‘তুমি নতুন এসেছো কোনোদিন আলাপ হয়নি তাই আলাপ করতে এলুম’, জয় বলল, ‘ তা বেশ করেছেন। আসলে আমিও সুজোগ পায়না আপনাদের আড্ডায় যাওয়ার, অনেক কাজ তো’। সমীর একটা আলমারির দিকে তাকিয়েছিলো এবার সে বলল, ‘ বাহ আলমারিটা তো চমৎকার, গোদরেজের বুঝি?’ জয় বলল, ‘ হ্যাঁ, নতুন মেসে আসার আগে কিনেছিলাম’। ‘আরে আমাকেও কিনতে হবে এরকম একটা আলমারি, খুব দরকার বুঝলে তো, তা কোথা থেকে কিনলে?’ সমীর বলল। জয় জবাব দিলো, ‘ এটা তো আশীর্বাদ স্টিলস থেকে কেনা’। সমীর বলল ‘ একবার দেখতে পারি? মানে স্পেস কতোটা, কটা সেলফ আছে, অসুবিধা না থাকলে দেখাবে একবার?’ জয় হেসে বলল, ‘ আরে দাদা এতে অসুবিধার কি আছে?’ বলে আলমারি টা খুললো। কিন্তু সমীর যেটা সন্দেহ করেছিলো যে মেয়েটা আলমারির ভিতরে থাকতে পারে সেটা হল না, আলমারি তে জামা কাপড় আর কয়েকটা বই ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। খানিকটা নিরাশ হয়েই বলল, ‘ বাহ, খাসা আলমারি, আমিও কিনব, একদিন তোমার সাথে গিয়েই কিনে নেব, কি বল?’ হঠাৎ ধপ করে পড়ার আওয়াজ হল, ওরা দেখে খাটের পাশে অমরবাবু পড়ে গেছেন। জয় ছুটে গিয়ে বলল, ‘ একি জেঠু, কি হল আপনার?’ অমরবাবু একটু কাতর স্বরে জবাব দিলো, ‘ কিছু না বাবা এই মাথাটা একটু ঘুরে গেছিলো’ বিশ্ব আর সমীর গিয়ে অমরবাবু কে ওঠালো, বিশ্ব বলল, ‘ আসি ভাই জেঠু কে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে’। জয় জিজ্ঞেস করল, ‘ আমি যাবো কি?’ বিশ্ব জবাব দিলো, ‘ না না তোমাকে যেতে হবে না আমরা দুজনেই সামলে নেব’। ওরা দুজনে জয়ের ঘর থেকে বেড়িয়ে বিশ্বর ঘরে এলো অমরবাবু বললেন, ‘ ছাড়ো আমায় আমি ঠিক আছি, মাথা ঘোরার অভিনয় করছিলাম, কিন্তু খাটের নিচেও যে কেউ নায়’। সমীর বলল, ‘ হুম। আপনার লাগে নি তো?’ অমরবাবু বিরস মুখে জবাব দিলো, ‘ না তেমন লাগে নাই, একি ভোজবাজি না কি? স্পষ্ট মেয়ের গলার আওয়াজ শুনলাম, গিয়ে দেখি কেউ নায়, ছেলেটা তান্ত্রিক না তো? ভুত নামায় না তো?’ বিশ্ব জবাব দিলো, ‘ না জেঠু ভুত না, ভুতে লিপস্টিক ব্যবহার করেনা’, তারপর সমীরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ আমি ওর ঘরে লিপস্টিক দেখেছি ওর আয়নার সামনে, গণ্ডগোলের ব্যাপার’। সমীর বলল, ‘মস্ত গণ্ডগোল রে ভাই, এবার কি করা যায়?’ বিশ্ব বলল, ‘সেটাই ভাবতে হবে, জেঠু আপনি বরং ঘরে যান, আর আজকে সবাই ফিরলে সবার সাথে হল ঘরে এটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে, আপনি সবাই কে জানিয়ে দেবেন প্লিস’। ‘ হ্যাঁ বাবা জানাবো, দেখো একটু তোমরা, এভাবে মেসের বদনাম রটে যাবে, উফফ আর টেনশন নিতে পারছি না’, বলে অমরবাবু চলে গেলেন।

সেদিন সন্ধেবেলায় হল ঘরে দুপুরের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছিলো সবাই, শুধু জয়, সমীর আর বিশ্ব ছিলো না, বাকি সবাই উপস্থিত ছিলো। এমন সময় ‘ইউরেকা ইউরেকা’ বলতে বলতে সমীর আর বিশ্ব প্রবেশ করল। বিশ্ব বলল, ‘ আচ্ছা জেঠু উপরে রুম ফাঁকা থাকতেও আপনি জয় কে নিচের রুম দিয়েছিলেন কেন?’ অমরবাবু বললেন, ‘ আমি তো অকে উপরেই থাকতে বলেছিলুম, ও তো নিজে থেকেয় নিচের রুম টা নিতে চেয়েছিল’। বিশ্ব বলল, ‘দেখলি সমীর বলেছিলাম না জয় হেব্বি ঝানু মাল, শুনুন সবাই আপনারা দুপুরের কাণ্ড সবাই শুনেছেন নিশ্চয়, জয়ের ঘর থেকে মেয়ের গলা শোনা যাচ্ছে অথচ ঘরে ঢুকে কোন মেয়ের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সমস্যায় পড়ে গেছিলাম খুবই তারপর সমীরের মাথায় একটা আইডিয়া আসে, আর তাই আমরা খিড়কি দিয়ে জয়ের ঘরের পিছনে যায় এবং গিয়ে দেখি জয়ের ঘরের জানলার লোহার শিকের একটা ভাঙা, এবং ওই পথেই মেয়েটি যাতায়াত করে’। সমীর বলল, ‘ আমার মনে হয় ও আগে থেকে খোঁজ খবর নিয়েই এসেছিলো, যাইহোক এবার একদিন হাতেনাতে ধরতে হবে ছেলেটাকে তাহলেই ষোলোকলা পূর্ণ হবে’। সমীর এর কথা শেষ হতে না হতেই বিট্টু ঘরে ঢুকলো, ‘ দাদু আবার মেয়ের গলা জয়দার রুম থেকে’। কালবিলম্ব না করে সবাই হুড়মুড় করে জয়ের ঘরের সামনে এলো, সমীর আর বিশ্ব দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকতেই হতবাক হয়ে গেল, বাকিদের সাথে অমরবাবু ঘরে ঢুকতেই বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল, ‘ হা ভগবান, এসব কি?’ সবাই দেখল জয় ঘরের মাঝখানে  অর্ধনারীশ্বর মূর্তিতে দাঁড়িয়ে, মানে একদিকে ছেলেদের সাজ আর অন্যদিকে মেয়েদের সাজ, হাতে একতাড়া কাগজ, জয়ও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ মানেটা কি? আপনারা?’ বিস্ময় কাটিয়ে বিশ্ব জিজ্ঞেস করল, ‘ তুমি এভাবে দাঁড়িয়ে?’ একটু লজ্জা পেয়ে জয় বলল, ‘ আসলে কাল আমাদের থিয়েটার আছে ‘অর্ধনারীশ্বর’, আমি লিড ক্যারেক্টার তাই আর কি আজ রিহার্সাল থেকে ফিরে ড্রেস সমেত আরেকবার রিহার্সাল করছিলাম, আমি ভেবেছিলাম আপনাদের কেউ দেখাবো আজ, কিন্তু আপনারা এভাবে?’ সমীর প্রকাণ্ড একটা হাসি হেসে গোটা ব্যাপারটা জয় কে বলে, জয়ও হেসে বলে, ‘ওহ তাই আমি আরেকটা কানের দুল খুঁজে পাচ্ছিলাম না,আর এই মেয়ের গলা করার গুনটাও ছোটো থেকেই আছে আমার,আমি তো হরবোলা, আরে তাই তো এই নাটক টা তুলেছি, আপনারা এতো হাঙ্গামা করলেন, অথচ একবার যদি আমাকে বলতেন আমি নিজেই আপনাদের সব বলে দিতাম, যাইহোক এখন দেখুন তো কেমন হয়েছে আমার পার্ট টা’। এই বলে জয় নিজের পার্টটা অভিনয় করতে লাগল আর মেসের সবাই একটা বড় দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়ে মহা উৎসাহে এবং বিস্মিত হয়ে হরবোলা জয় এর অভিনয় দেখতে লাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × three =