কান্নার শব্দ

 দীপন জুবায়ের, ধানমণ্ডি, ঢাকা

 ## 

— চা দিমু খালুজান ?
আফজাল সাহেবের একটু তন্দ্রার মত এসেছিল। ময়নার মায়ের কথায় ইজি চেয়ারে ধড়মড় করে উঠে বসলেন। হাতে আজকের খবরের কাগজ। কাগজ দেখতে দেখতে কখন যে ঘুম ঘুম ভাব এসে গেল !  কই, আগে তো কখনও এমন হয়নি ! এটা কি বয়সের লক্ষণ ? এই অসময়ে তন্দ্রার জন্যে তিনি মনে মনে একটু লজ্জিত হলেন। হাতের কাগজ খাটের উপর রেখে বললেন, দিতে পারিস এক কাপ।দুই চামুচ চিনি দিস ত।
কি কন আপনে , খালুজান ? ময়নার মা আতকে ওঠে, ডাক্তার না আপনেরে চিনি খাইতে নিষেধ দিছে ?
আজকাল আর কিছুই মনে থাকে না। প্রয়োজনীয় সব কথা ভুলে যান। মাথার ভেতর সর্বক্ষণ আজেবাজে চিন্তার আনাগোনা।এঠাও কি বয়সের জন্যে? হবে হয়ত। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, আচ্ছা এক চামুস দিস, দিনে একবার চায়ে চিনি খেলে কিছু হয় না। ময়নার মা নিজের মনে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
এই তো গত পরশু সন্ধ্যায় ডাক্তার এসেছিল বাড়িতে। নানান রকম পরীক্ষা কওে গম্ভীর গলায় বলল,
ডায়াবেটিসের অবস্থা ভালো না। হার্টের রিপোর্টও নরমাল না। এখন থেকে খুব সাবধানে চলতে হবে।মিষ্টি জাতীয় সব কিছুই আপনার জন্য বিষ। চায়ের সাথে একফোটা চিনিও খাওয়া যাবে না। খুব নিয়মের ভেতর থাকবেন, যখন-তখন বড় বিপদ হতে পারে।
এই ৬১ বছর বয়সে এসে আফজাল সাহেবের এখন মনে হয়, জীবনটা আর নিজের ইচ্ছেধীন নেই। পদে পদে বাধা-নিষেধ। কতক্ষন ভালো লাগে এসব ? কোন মানে হয় এভাবে বেঁচে থাকার ? মনে  নে নিজের ইপর ভীষন বিরক্ত হলেন তিনি।একটা  বুকচাপা অভিমান যেন বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে চোখ ফেটে।
হায়রে জীবন ! কত আশা ছিল জীবনের এই শেষ দিনগুলো সবার সাথে কাটিয়ে দেবেন পরম আনন্দে। মানুষ ভাবে কি আর হয় কি ! চাকরি থেকে রিটায়ার করার মাত্র দু-মাসের মাথায় উর্মির মা মারা গেল। উর্মি আফজাল সাহেবের একমাত্র সন্তান। একমাত্র মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছিলেন নিজের পছন্দের ছেলের সাথে। আশা ছিল সারাক্ষণ মেয়ের কাছাকাছি থাকা যাবে। কিন্তু বিধিবাম, বিয়ের দেড় বছরের মাথায় ডিবি লটারি পেয়ে মেয়ে-জামাই চলে গেল আমেরিকা। একমাত্র সন্তান তবু কাছে ধরে রাখতে পারলেন না। বৃদ্ধ বাবার কাছে থাকার জন্যে আমেরিকা যাবার সুযোগ হাতছাড়া করবে কোন বোকা ? আবেগ দিযে কি আর জীবন চলে ?
মনের অজান্তে একটা দীর্ঘ:শ্বাস বেরিয়ে এলো  বুক চিরে। আজ যদি উর্মির মা বেঁচে থাকতো তাহলে কি এত নি:সঙ্গ লাগত ? উর্মি ভালো আছে স্বপ্নের দেশে, খুব ভালো।
উনি ধীর পায়ে বাথরুমে ঢুকে পানির ঝাপটা দিলেন চোখে-মুখে, অনেক সময় নিয়ে। ঘরে এসে দেখলেন টেবিলের উপর গরম চায়ের মগ। ময়নার মা রেখে গেছে। ওনাকে দেখাশুনার মানুষ বলতে ওই ময়নার মাই আছে সর্বক্ষণ, কাছাকাছি।
উর্মি যখন অনেক ছোট, তখন একবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লো তার মা। ছোট্ট বাচ্চাকে দেখাশুনা করা, সংসারের সব কাজ যখন প্রায় বন্ধ হবার অবস্থা তখন একরকম বাধ্য হয়েই গ্রাম থেকে ময়নার মাকে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। তখন সংসাওে একজন বাড়তি মানুষ পোষা অনেক কষ্টকর ব্যাপার, নতুন চাকরি, বেতন কম। কোনরকম টানাটানির মধ্যে মাস চালিয়ে নিতে হয়। কিন্তু উর্মির মা বাসায় কাজের লোক রাখা একেবারেই পছন্দ করত না। তার একটাই কথা আমার সংসারে একজন বাইরের লোক এসে সব কিছু ঘাটাঘাটি করবে এটা আমার ভালো লাগে না। কিন্তু তখন তার জীবন মরন সমস্যা। কাজের লোক না রাখা ছাড়া উপায় কি ? ওই ভীষন অসুস্থতার ভেতরও ময়নার মাকে দেখে রেগে গেলো উর্মির মা। থমথমে গলায় তাকে বলল, আমি যেদিন একটু সুস্থ হব তুমি সেদিনই বিদায় হবে। আর সব কাজ করার আগে আমার কাছ থেকে আগে শুনে নেবে।
ছেলেমানুষি আর কাকে বলে ! নিয়তি বোধহয় সেদিন মুচকি হেসেছিলো তার কথা শুনে। সেই যে অসুস্থ হয়ে পড়লো  আর কখনও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেনি সে। ফলে যা হবার তাই হলো, ময়নার মা স্থায়ী হয়ে গেল এই সংসারে। তাকে ছাড়া আর একটা দিনও চলে না এমন অবস্থা।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে এসব কথা মনে পড়ছে আফজাল সাহেবের। চায়ে সামান্য চিনি দেওয়া হযেছে। তার মানে তার কথা এখনও পুরোপুরি অগ্রাহ্য হয়ে যায়নি। চা খেতে খেতে আবার অতীতে ডুব দিলেন তিনি। অতীত মানে প্রায় তিরিশ বছর আগের ঘটনা এসব। কিন্তু মনে হয় এই সেদিনকার ঘটনা যেন সব। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভাসবে পরিষ্কার। শুধু চোখ বুজলেই হলো, ফিরে যান তিরিশ বছর আগে। ওই স্মৃতিগুলো বারবার মনে করতে ভালো লাগে, কখনও পুরানো হয় না যেন । একটা ভালো গান বারবার শোনার মত।
সময় কাটতে চায় না আজকাল। দিন দিন ঘুম কমে আসছে।প্রতি ভোরে তিনি ব্যালকনিতে বসে থাকেন একা। কিছু সময় তাকিয়ে থাকেন রাস্তার দিকে, কিছু সময় চোখ বুজে থাকেন। এখন দিনগুলোই যেন বেশী ভালো লাগে। রাতগুলো একটুও ভালো লাগে না, বড় দুর্বিষহ লাগে। প্রতিটি রাত যেন ভীষণ ভারি পাথরের মত চেপে বসে তার কাঁধে, কিছুতেই রাত কাটতে চায় না। রাত এলেই বারবার শুধু মনে হয় এ রাত কাটবে তো ? আর একটা ভোর দেখতে পাব তো ?
এক এক দিন হঠাৎ শীলা এসে হাজির হয় একগাদা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে। শীলা আফজাল সাহেবের ছোট বোন। রক্তের সম্পর্ক বলতে ওই শীলাই আছে একটু কাছাকাছি। ও আসে ঝড়ের মত, অন্তত আফজাল সাহেবের তাই মনে হয়। এসেই শুরু করে খবরদারি আর নানান উপদেশ। এটা কর , ওটা করা যাবে না, ওটা খাওয়া যাবে না। একা কোথাও যাওয়া যাবে না মনের ভুলেও। আফজাল সাহেবের ভীষন মেজাজ খারাপ হয়……আরে তোরা তো সব বলেই বিদায় নিস। একবারও কি ভাবিস কিভাবে কাটে আমার একেকটা দিন-রাত ? কি ভীষন নি:সঙ্গ একাকি ? মনে মনে আজকাল সবার উপর অভিমান হয় ভীষনরকম। উর্মির সাথে কথা হয় প্রায় প্রতিদিন। ফোন ধরেই সেই গৎবাধা কথাবার্তা , এই-সেই উপদেশ। আর ভালো লাগে না এসব। কিছুই ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে মনে হয় বাড়ি-ঘর ছেড়ে একদিকে হাঁটা দিলে হয়। এখন তো জীবনে পিছুটান বলতে আর কিছু নেই। কিন্তু এই বাড়ি ছেড়ে একটা রাতও কোথাও কাটাতে পারবেন না, ভালো করেই জানেন তিনি। জীবনের সব মধুর স্মৃতিগুলো তো এই বাড়ির আঙিনায় ঘুরপাক খায় সারাক্ষন। স্মৃতিরও পিছুটান হয় ? হয় বোধহয়। ওনার জীবনে তো সেটাই হয়েছে।
খালুজান দুফুরে খাইবেন কি ? জলদি বলেন , বাজার যামু। ময়নার মার কথায় চমক ভাঙলো ওনার। হঠাৎ মনে হলো…. আচ্ছা আজ তো আমিই যেতে পারি বাজারে। কতদিন ধরে এই চার দেওয়ালের ভেতর তার জীবন কাটছে। বড্ড একঘেয়েমি লাগে, কতদিন বাইরে যাওয়া হয় না। যদিও এখন শরীরটা একেবারেই ভালো লাগছে না। রাতের পর রাত ঘুম না হলে যা হয়। বাইরে গেলে হয়তো একটু ভালো লাগবে। দু-চারটা পরিচিত মানুষের সাথে তো দেখা হবে। ভাবতে ভাবতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালেন তিনি। আলনা থেকে একটা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী গলায় ঢুকিয়ে বললেন, আজ আমি যাব বাজারে, কি কি আনতে হবে বল।
ও আল্লা, আপনে কি পাগল হইছেন খালুজান ? এই শরীলে আপনে যাবেন বাজারে ? আফায় জানতে পারলে আমারে আস্ত রাখবে?
চট করে মেজাজটা খিচড়ে গেল আফজাল সাহেবের। চোখ গরম করে বললেন , তোর আপার তো ঘুম হয় না রাত-দিন আমার কথা চিন্তা করে। যত্তসব আলগা দরদ। তুই বাজারের ব্যাগ এনে দে। আজ আমিই যাব বাজারে, কেউ কিছু জানতে পারলেও যায় আসে না। দুরে বসে যত্তসব আলগা দরদ…।
ময়নার মা একটু ঘাবড়ে গেল। এতগুলো বছর সে কাটিয়ে দিল এই সংসারে। কই কখনও তো এমন করে রাগতে দেখেনি মানুষটাকে! সে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে থাকলো আফজাল সাহেবের মুখের দিকে।
আফার সাথে আফনের ঝগড়া হয়নি তো খালুজান ? ভয়ার্ত গলায় জিগ্যেস করল ময়নার মা।
আফজাল সাহেব আগুন চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললেন , দাড়িয়ে আছিস কেন ভ্যাবলার মত ? ব্যাগ আনতে বললাম না ? যা… ব্যাগ আন।
ময়নার মা আরও ঘাবড়ে গেল। এক দৌড়ে ব্যাগ এনে আফজাল সাহেবের হাতে ধরিয়ে দিল। ব্যাগ হাতে নিয়েই ঘর থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন তিনি। পেছন থেকে একটানা সে দিকে তাকিয়ে থাকল ময়নার মা। তার মনের ভেতর তোলপাড় চলছে…..আহারে, মানুষটার মনে কত কষ্ট। সবই আছে তবু যেন কিছু নাই। আপন মানুষ গুলোই যদি পাশে না থাকলো , তাহলে কি হবে এই সব ঘর-বাড়ি, টাকা-পয়সা দিয়ে ? বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘ:শ্বাস বেরিয়ে আসে ময়নার মার। তার নিজের জীবনের দু-চারটে স্মৃতি উকি দেয় মনের ভেতর। এই মানুষটা যদি এতগুলো বছর তাকে আগলে না রাখত তাহলে যে কি হত তার এতদিন ! কিন্তু নিজেকে নিয়ে আর ভাবতে পারেনা সে, এই মুহুর্তে। তার বারবার মনে হচ্ছে মানুষটা ভালো নেই, একটুও ভালো নেই। তার কি এখন মানুষটার পেছন পেছন যাওয়া উচিত গোপনে ? এই অসুস্থ শরীরে যদি কিছু একটা হয়ে যায় মানুষটার ? কদিন ধরে দিন-রাত মন খারাপ করে বসে থাকে মানুষটা , কারও সাথে কথা বলতে চায় না। এই শরীরে মেজাজ খারাপ করে বেরিয়ে গেল একা। যদি……আর ভাবতে পারে না ময়নার মা। মাথার ভেতর চক্কও দিয়ে ওঠে।
কোনরকমে ঘরের দরজায় তালা দিয়ে সে ছুট দেয় বাজারের দিকে। মনের ভেতর শুধু বাজে চিন্তা আসছে। ওকে বাজারে দেখলে যদি আরও বেশী রেগে যান খালুজান ? এক বাজার মানুষের সামনে যদি ওকে দুর দুর করে ? করলে করবে…তবুও যেতে হবে ওকে।
ময়নার মা বাজারের সীমানায় এসে পৌছে। ওদের এলাকার এই বাজারটা খুব বেশী বড় না। একপাশে দাড়িয়ে দেখলে সবটুকু দেখা যায়। কিন্তু মানুষটা গেল কোথায় ? কোথাও দেখা যাচ্ছে না তাকে। তন্ন তন্ন করে খুজে দেখে সে। নাহ, কোথাও নেই। রাগ করে অন্য কোথাও যায়নি তো ? মনের মধ্যে নানান চিন্তা আসছে , সেই সাথে একটা ভীষন ভয়। অসুস্থ মানুষ তো…….
হঠাৎ ওর মুদির দোকানের বাদশা মিয়ার কথা মনে  পড়ে। ওর কাছে শুনলেই তো হয়। একছুটে ও দোকানের সামনে গিয়ে দাড়ায়। কিন্তু বাদশা মিয়া কই ? দোকানে শুধু মালিক বসে আছে একা। এ সময় তো বাদশার বাইরে থাকার কথা না। পায়ে পায়ে মালিকের সামনে যেয়ে দাড়ায় ময়নার মা। মাথার কাপড়টা ঠিকঠাক করে খুব সঙ্কোচে জিগ্যেস করে , আমার খালুজানরে দ্যাখছেন ?
লোকটা একমনে খবরের কাগজ পড়ছিল। ময়নার মার মুখের দিকে তাকিয়েই তড়াক করে উঠে দাড়াল চেয়ার থেকে।
একি ! তুমি এখানে কেন ? হাসপাতালে যাও নি ?
এয়নার মার বুকের ভেতর ধড়াস করে উঠলো। নি:শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, হাসপাতালের কথা শুনে বুকের ভেতর ভীষন একটা ভয় কামড়ে ধরেছে তার।
ক্যান কি হইছে আমার খালুজানের ? কান্নাজড়ানো গলায় জিগ্যেস করে ময়নার মা।
লোকটার কথা শুনে জানা গেল…. একটু আগে আফজাল সাহব অচেতন হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষন চেষ্টা করেও ওনার চেতনা ফেরেনি। এরপর ওনাকে দ্রুত রিকশা করে হাসপাতাল নেওয়া হয়েছে। চেতনহীন শরীরটা পাজাকোলা করে নিয়ে বাদশা মিয়া, সাথে আর একজন আছে। লোকটা আরও কি কি যেন বলল। কিন্তু এখন আর কোন কথাই কানে ঢুকছে না ময়নার মার। পা-দুটো ভীষণ ভার মনে হচ্ছে, মাথা ঘুরাচ্ছে, সারা শরীর ঘামে জবজবে তার মনে হচ্ছে এখনই হয়ত মাথা ঘুরে পড়ে যাবে এখানে।  তবু কিসের জোরে যেন হাসপাতালের পথ ধরে ছুটতে শুরু করে সে। মাথার কাপড় খসে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, তবু কোন দিকে খেয়াল নেই তার। ঠিক কতক্ষনে সে হাসপাতাল পৌছলো বলা যাবে না । কিন্তু ও যখন হাসপাতালে গিয়ে পৌছলো ঠিক তখন আফজাল সাহেব হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বাড়ি দিকে ফিরছেন। বাড়ি থেকে তিনি বেরিয়েছিলেন একা , দু-পায়ে হেটে। আর এখন বাড়ি ফিরছেন চারজন মানুষের কাধে শুয়ে , আট পায়ে।
দুর থেকে আফজাল সাহেবের প্রানহীন দেহটা দেখে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো ময়নার মা। তার সাথে কেঁদে উঠলো আরও অনেকে। কিন্তু যার জন্যে এ কান্না-কাটি তার কানে আর কখনও পৌছুবে না কারও কান্নার শব্দ , এমন কি সেই সুদুর আমেরিকায় থাকা তার একমাত্র মেয়ে উর্মিও  না।

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × 3 =