কেশব-বাঁশরী উপাখ্যান
চিত্রা দাশগুপ্ত, ক্যালিফোর্নিয়া #
হঠাৎ করে লকডাউন ঘোষণা হল, যানবাহন সব বন্ধ। প্রথমে ওরা ভেবেছিল কি আর করা যাবে এ’কটা দিন ঘরে বসে কাটিয়ে দেবে, কিন্তু বিধি বাম! হল না ঘরে বসা, উপর তলা থেকে আদেশ পেল পরিযায়ী শ্রমিকদের সবাইকে নিজের রাজ্যে ফিরে যেতে হবে। তা ছাড়া যেখানে কোন মতে মাথা গুঁজে দিন কাটায় সে ঘন বসতী অঞ্চলে ও আজ কোভিড উনিশ মহামারী আকার ধারণ করছে, বড্ড বিপদ জনক পরিস্থিতি সেখানেও। বড় বিপাকে পড়লো অসহায় মানুষগুলো।
যার যা কিছু সহায় সম্বল, সঞ্চয় গুছিয়ে মাথায়, কাঁধে, পিঠে নিয়ে, কারো কারো সাথে বৌ, বাচ্চা, সবাই বেরিয়ে পড়লো ওরা, দলে দলে অচেনা পথে অজানা ভবিষ্যতের উদ্দেশে। ডাক যোগাযোগের ঠিকানা সবার আলাদা কিন্তু সবার গন্তব্য একটাই, নিজ গৃহ, আপন জনের ছায়ার নিরাপদ আশ্রয়! ওরা কেউ জানে না কবে কখন পৌঁছবে, আদৌ পৌঁছবে কিনা! ওরা এগিয়ে চলেছে কখনো রেল লাইন ধরে কখনো হাই রোড ধরে আবার কখনো খানা খন্দ পেরিয়ে শর্টকাট পথে।
মাথার উপর খোলা আকাশ, কখনো সূর্য়ের প্রখর তাপে ঝলসে যাচ্ছে শরীর, রাস্তার পিচ গলে পা যাচ্ছে আটকে। আবার কখনো বৃষ্টিতে ভিজে চলেছে জল কাদা ভরা পিছল পথ বেয়ে। একটু অসাবধান হলে পড়ে মাথা, হাড়, পাঁজর ভাঙ্গার ভয়, মালপত্র সামলাবে না হাঁটবে —-ক্লান্ত শরীর, পা দুটো আর পারছে না শরীরটাকে টেনতে। এরা নানা ভাষাভাষি নানা দেশবাসী, এদের পেশা আলাদা। এদের মধ্যে আছে অল্প শিক্ষিত, আছে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, শিল্পী, কারিগর। যার যার কর্ম ক্ষেত্রে পারদর্শী দক্ষ কর্মী এরা। সবথেকে বড় পরিচয় এরা মানুষ কিন্তু সমাজ সেটা যেন বেমালুম ভুলে গেছে আজ ওদের একটাই পরিচয় ওরা পরিযায়ী শ্রমিক।
পরিয়ায়ীদের কি বাঁচার অধিকার নেই ?
ঐ দূরে হাইরোডের ধারে দেখে যাচ্ছে ধাবা । পেটের মধ্যে আগুন জ্বলছে, পা চালিয়ে এগিয়ে যায় কেশব, যদি কিছু খাবার পাওয়া যায় ! দেখতে দেখতে ছোট ধাবাটায় উবছে পড়ছে ভিড়। যে যেখানে পারে বসে পড়ল। কাড়াকাড়ি করে সবাই খাবার কিনছে। কত লোক এখনো এসে পৌঁছাতে পারলো না। টানা দুদিন ধরে চলেছে সবাই, সঙ্গে যা খাবার দাবার ছিল তা দিয়ে কোন মতে কাটিয়েছে প্রায় দুটো দিন। এর মধ্যে দু এক জন করে অনেকে অসুস্থ হয়ে থেমে গেছে মাঝপথে, তাদের পরিনতির খবর কেউ রাখেনি। সবাই নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটে চলেছে সামনে।
একটা স্টিলের থালায় দুটো রুটি একটু তরকারি আর কিছুটা আচার নিয়ে কেশব পেছন দিকে একটা টেবিলে একটা জায়গা খালি দেখে গিয়ে বসে পড়ে।
আগে থেকে ক’জন বসে খাচ্ছিলো, কারও মুখে কথা নেই —-
সবাই মন দিয়ে খাচ্ছে, কেউ জানে না আবার কখন কপালে খাবার জুটবে।
মুখে খাবারটা নিয়ে খেতে শুরু করার সাথে সাথে কি যে হলো খাবারটা
গলায় আটকে খুব জোরে বিষম খেলো কেশব। দমকা কাশি, ছটফট করে উঠলো কেশব, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে — খাওয়া বন্ধ করে সবাই তাকিয়ে আছে কেশবের দিকে।
উল্ট দিকে বসেছিলো বাঁশরী নিজের জলের বোতলটা এগিয়ে দিয়ে উৎকন্ঠিত সুরে বললো “জল খান”। বাঙলায় বলে সাথে সাথে নিজেকে শুধরে নিলো, বুঝবে কিনা কে জানে ?
বললো পানি পি লিজিয়ে, তারপর উঠে কেশবের পেছনে দাঁডিয়ে ওর পিঠে থপ্ থপ্ করে থাবরাতে লাগলো বাঁশরী। কেশব নিজেকে সামলে অতি কষ্টে কিছুটা জল খেল। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠলো কেশব। যে যার খাওয়ায় মন দিলো ।মুখে কিছু না বললে ও কেশবের দুচোখ বাঁশরীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো। রুমাল দিয়ে নাকের চোখের জল মুছে একটা বোকা বোকা হাসি হাসল। মাথা নেড়ে জানাল ও ঠিক আছে। বাঁশরী একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে নিজের জায়গায় ফিরে খাওয়া শুরু করল।
খাওয়া শেষ করে এক বোতল জল ভরে মুখে মাস্ক, মাথায় ওড়না বেঁধে মাল পত্র নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো বাঁশরী। “শুনছেন” পেছন থেকে কে ডাকলো, বাঁশরী ফিরে দেখে কেশব দু হাতে দু গ্লাস চা নিয়ে দাঁড়িয়ে ওকে ডাকছে। বাঁশরী একটু ইতস্তত করায় কেশব এগিয়ে এসে একটা চায়ের গ্লাস ওকে এগিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে——“আর একটু হলে মরে যেতাম, ভাগ্যিস আপনি ছিলেন” —- ।
বাঁশরী হেসে—-“চা খাইয়ে জীবনের দাম দিচ্ছেন?”
“না না -তা না – মানে – ঐ আর কি” তোতলাতে লাগলো কেশব ।
—-“বুঝেছি, আর কিছু বলতে হবে না। থ্যাঙ্কু”। হাত বাড়িয়ে চায়ের গ্লাসটা নিয়ে এগিয়ে গেলো বাঁশরী। বিস্মিত চোখে চেয়ে দেখল কেশব। এর আগে বাঁশরীর মত কেউ বোধহয় ওকে থ্যাঙ্কু বলে নি।
ওর ঐ মুখোশ আর ওড়না দিয়ে ঢাকা পুরো মুখখানা একবার খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল কেশবের।
পথ চলতে চলতে কেটে গেলো কটা দিন। অক্লান্ত হেঁটে চলেছে পরিযায়ী শ্রমিক দল। পথ আর শেষ হয় না। কষ্টের শেষ নেই, ঝিমিয়ে পড়া মন ও ক্ষত বিক্ষত পা নিয়ে এগিয়ে চলেছে ওরা, থামলে চলবে না।
সারা দিন হেঁটে রাতের আঁধার নামলে পথের ধারে যে যেখানে পারছে কুকুর কুণ্ডুলি হয়ে শুয়ে পড়ছে। অবসাদে ক্লান্তিতে কারো বা চোখ বুজে আসছে কেউ বা আশে পাশের সহ যাত্রীর সাথে আলাপ পরিচয় করে জানতে চাইছে কে কোথায় যাবে, মনের সুখ দুঃখের কথা ভাগ করে নিচ্ছে।
দূর থেকে শোনা যাচ্ছে কে যেন নিস্তব্ধ রাতের নিরবতা ভঙ্গ করে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে!
সে কান্না স্বজন হারাবার কান্না হতে পারে, হতে পারে অসহনীয় শারীরিক যন্ত্রনার জন্য। বাতাস বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই কান্নার প্রতিধ্বনী এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। সবাই শুনছে কিন্তু বড় অসহায় ওরা, কিছু করার সাধ্য কারো নেই। একটা ছোট্ট বাচ্চার কান্না শোনা যাচ্ছে, আহা অবলা শিশু না জানি কত কষ্ট হচ্ছে ওর।
ঝাঁক ঝাঁক জোনাকি উড়ছে চারিদিকে। বাঁশরীর চোখে ঘুম নেই, চুপচাপ শুয়ে জোনাকির আলো দেখছে। ওর মনে ও আজ আশা নিরাশা হাজার জোনাকি হয়ে জ্বলছে নিবছে। ও ভাবছে ও যদি ফিরতে না পারে তবে ওর মায়ের কি হবে? ও যখন খুব ছোট বাবাকে হারিয়েছে। কত কষ্ট করে মা ওকে মানুষ করেছে। ও ছাড়া মায়ের আর কেউ নেই। পড়া শোনায় ভালোই ছিলো, স্বপ্ন দেখতে ডাক্তার হবে কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়নি তবে নারসিং ট্রেনিং পাশ করেছে। মুম্বাই তে এসেছিল এক দূর সম্পর্কের মাসির সাথে। একটা এজেন্সিতে নাম লিখিয়ে বড়লোক বাড়িতে অসুস্থ মহিলাদের দেখাশুনা করত। ধারাভিতে আরো ক’টি মেয়ের সাথে একটা খোলিতে (ঘরে) ভাড়া থাকতো। মাস গেলে ভালোই রোজগার করতো। ভেবেছিলো পূজোয় গিয়ে মাকে নিয়ে আসবে, মাসি বলেছিলো মাকে একটা দুটো রান্নার কাজে ঢুকিয়ে দেবে—- হঠাৎ করে সব কেমন ওলোট পালোট হয়ে গেলো—-
সারাটা দিন কেশব ব্যাকুল চোখে খুঁজেছে নিশাকে সেই যে চা হাতে নিয়ে চলে গেল তারপর ভীড়ের মাঝে কোথায় যে হারিয়ে গেলো আর দেখতে পেলো না। অবশ্য মেয়েদের মুখের দিকে বারবার দেখতে একটু ভয়ও পায়, কে কি বলবে। শহরতলির ছেলে কেশব, একটু লাজুক প্রকৃতির। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বাবার দোকানে বসে বাবার কাছে কাজ শিখেছে, ওরা স্বর্ণকার। হাতের কাজটা বেশ ভালো, ভালো কারিগর হিসাবে অল্প সময়ে খুব সুখ্যাতি অর্জন করছে কেশব। হঠাৎ করে একটা কাজের সুযোগ পেয়ে ও মুম্বাই চলে আসে বছর তিনেক আগে। নিজের কাজ, রান্না খাওয়া আর একটু সিনেমা দেখার নেশা এই ওর দুনিয়া। খোলা আকাশের নিচে শুয়ে রাতের তারা ভরা আকাশটাকে যেন এক বিশাল জড়োয়ার চাঁদোয়ার মত মনে হচ্ছিল ওর।
প্রকৃতির নিয়মে রাতের আঁধার পেরিয়ে সূ্র্য়দয়ের সাথে সাথে আবার শুরু হলো পথ চলা। ক্লান্ত বিষন্ন পায়ে এগিয়ে চলেছে সবাই যেন একদল মন্ত্রপূত শব। কারো মুখে কথা নেই। হঠাৎ করে কেশবের কানে এলো কে যেন পিছন থেকে ডাকছে “এই যে শুনছেন”।
থমকে দাঁড়িয়ে গেল কেশব, দেখল মুখে মাথায় ওড়না বাঁধা একটি মেয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। একটু অপ্রস্তুত, একটু ইতস্তত করে—— ” আমাকে বলছেন?”
মেয়েটি বুঝতে পারছে না, কেশব কি ওকে চিনতে পারছে না, না চিনতে চায় না? যাই হোক হাতে সময় বেশি নেই, চটপট ওর হাতের বোতলটাতে জল আছে কি না জানতে চাইল। কেশব জলের বোতলটা এগিয়ে দিতেই প্রায় ছিনিয়ে নিল বোতলটা এবং ছুটে চলে গেল। কেশব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেই দিকে, তারপর না জানি কি আকর্ষণে এগিয়ে গেল সেই দিকে। গাছের নিচে একটা ছোট জটলা, কয়েক জন ভীড় করে দাঁড়িয়ে দেখছিল কিছু। কেশবও গিয়ে উঁকি দিল, দেখল একটি মহিলা ধূলায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে আর ওর চোখে মুখে জল ছিটা দিয়ে ওকে ডাকাডাকি করছে সেই মুখে ওড়না বাঁধা ঘোমটা ঢাকা মেয়েটা।
দু এক মিনিট পর মহিলাটি চোখ খুলল, ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করল, পারল না। মুখে ওড়না বাঁধা মেয়েটা কেশবের জলের বোতলের বাকি জলের মধ্যে নিজের ব্যাগের থেকে খুঁজে একটা ছোট প্যাকেট বার করে কিছু পাউডার ঢেলে মিশিয়ে মহিলাটিকে বলছে “পানি পি লিজিয়ে, ভাবিজি পানি পি লিজিয়ে”।
চমকে উঠল কেশব, আরে এইত সেই আওয়াজ….এই তো সে, ও যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, যার ক্ষণিকের সেই স্পর্শটুকু আজও ওর পিঠে লাগে আছে! হঠাৎ করে ওর বুকের ভেতর যেন সমুদ্রের বিশাল ঢেউ আছড়ে পরলো,কেশব বসে পড়ল মাটিতে।
ব্যাগ খুঁজে আরো দুটো টেবলেট বার করে বাঁশরী ভাবির মুখে দিল ।ওষুধ খেয়ে জলের বোতল রেখে ভাবি বাঁশরীর একটা হাত ধরে কিছু বলতে চেষ্টা করছিল। মুখের কাছে কান নিয়ে কথাটা শুনল বাঁশরী তারপর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক হ্যায় ভাবি, ডর মাত …”
খালি বোতলটা কেশবের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বাঁশরী বলল “আপনি জলটা না দিলে যে কি হত! যাক গ্গে,জল দান খুব বড় দান আপনার অনেক পুণ্যি হবে। এই ভাবি হিট্ স্ট্রোক মানে শর্দি গর্মি হয়ে জ্বর গায়ে নিয়ে হাঁটছিল ….”
কেশব ——বুঝলাম, তা উনি আপনার কে হন? আপনি কি ডাক্তার ?”
বাঁশরী— “পথে চলতে পরিচয়,ক’দিন ধরে একসাথে পথ চলছি, আরে না মশাই আমি ডাক্তার না। তবে রুগীদের সেবা করি তো, তাই একটু আধটু ওষুধ বিষুধ সাথে রাখি আর চিনি বা না চিনি কারোর অসুবিধা দেখলে নিজেকে আটকাতে পারিনা। একটু শ্লেষ মিশ্রিত কন্ঠে বাঁশরী বলল, “তবে রোগ সেরে গেলে রুগীরা অবশ্য আমাকে আর চিনতে পারে না।”
লজ্জিত হয়ে আমতা আমতা করে কেশব বলে “ডাক্তার যদি এমন মুখোশ ধারি পর্দানশিন হয় তবে রুগীর কি দোষ ?”
সে দিন ভাবির অনুরোধে বাঁশরী কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে বলে মনস্থ করে কেশবকে বলেছিল এগিয়ে যেতে। কিন্তু কেশব পারে নি চলে যাতে। ঐ পথের ধারে গাছের ছায়ায় বসে কথায় কথায় ওরা অনেক এগিয়ে গেল। কোথায় যেন অত কষ্টের মধ্যেও একটা আনন্দের সুর বাজছিল ওদের মনে। মনে হচ্ছিল ওরা যেন হারিয়ে যাওয়া আপন জন খুঁজে পেয়েছে। অনেক দিন পর কত কথা বলল ওরা, হাসলো, কাঁদল, নিজেদের ফোন নম্বর দেওয়া নেওয়া করল, আর আবিষ্কার করল ওরা একই দিকে যাবে, বলতে গেলে পাশাপাশি পাড়ায় থাকে ওরা। কোন যাদু বলে ওরা দুজনে যেন হঠাৎ করে নব উদ্যমে টগবগ করে উঠল। শুরু হল আবার পথ চলা। পাশাপাশি চলেছে ওরা ঘরে ফেরার টানে।
****************এক মাস পর ***********
সেদিন ছিলো রথ যাত্রা কিন্তু করোনার ভয়ে এবার সব বন্ধ, না বেরবে রথ না বসবে মেলা। তাই সবার মন খারাপ, এই দিনটার জন্য সকলে সারা বছর ধরে অপেক্ষা করে থাকে। যাও বা এবার ঘটনা চক্রে বাড়ি এসেছে কিন্তু সব মাঠে মারা গেল। বাড়ি ফিরেও ঘরে বন্দি, তার ওপর প্রথম কিছুদিন তো পথ চলার কষ্টে, অনিয়মে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বাঁশরী, মায়ের সেবা যত্নে আর পরমায়ুর জোরে বেঁচে গেছে। ওদিকে কেশবের ও এক অবস্থা। ফোনে দুজনের কথাটথা হয়। পথের পরিচয়টা বেশ গাড় বন্ধুত্বে পরিনত হয়েছে। কেশব বলেছে একদিন আসবে।
বিকালে মায়ের সাথে বসে চা বিস্কুট খাচ্ছিল বাঁশরী। পাশের বাড়ির বাচ্চু বাইরে থেকে ডাকছে, “বুড়িদি ও বুড়িদি দেখ তোমাকে কে খুঁজছে।”
বাঁশরী চায়ের কাপটা রেখে ওড়নাটা বুকের ওপর ছড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, দেখল কেশব সাইকেল নিয়ে বাচ্চুর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। বাঁশরী প্রস্তুত ছিল না, অবাক কন্ঠে বলে উঠল, “আপনি ?”
কেশব— “না মানে,বাঁশরী …আমি কেশব, বাঁশরীর সাথে দেখা করতে চাই। বাঁশরী কি বাড়িতে নেই ?
বাঁশরী কেশবের আচারণে মুহুর্তর জন্য একটু অবাক হল কিন্তু সাথে সাথে বুঝল যে কেশব ওকে চিনতে পারেনি। কেশবের চোখে মুখে অস্তগামী সূর্যের আলোটা পরছে আর বাঁশরী আছে উল্টো দিকে। হাত দিয়ে চোখটা আড়াল করার চেষ্টা করছে কেশব। ঘাবড়ে গিয়ে কেশবের এমন অপ্রস্তুত লাজুক, লাজুক চেহারা ও আগেও দেখেছে। বাঁশরীর খুব হাসি আসছিল কিন্তু না হেসে ওকে দাঁড়াতে বলে ভিতরে চলে গেল।
মাথায় মুখে আর একটা ওড়না বেঁধে বাঁশরী বাইরে বেরুতেই কেশব আশ্বস্ত হয়ে বলে ওঠল, “এইত্তো,কোথায় ছিলেন ? আমি তো ঘাবড়ে গেছিলাম যে ভুল জাগায় এসে পড়লাম নাকি! আবার কেউ ধরে মারধোর না দেয়।”
নিজের কৌতুকে কেশব নিজেই হেসে উঠল।
বাঁশরী —- খবর দিয়ে এলে ওয়েলকাম বলার জন্য ধরাচূড়া পরে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতাম, তা বিনা খবরে এলে একটু ….
কেশব—— “আসলে রথের মেলা না বসলেও হঠাৎ মনে হল এখানে আছি, যাই দূর থেকে না হয় মন্দিরে ঠাকুর প্রণাম করে আসি কিন্তু ঢুকতে দিল না। তখন মনে হলো এতটা কাছে এসেছি যখন না হয় আপনার সাথে দেখা করে যাই, তাই খবর না দিয়ে চলে এসেছি। অসুবিধা করলাম, তাহলে ….”
বাঁশরী—- “খুব হয়েছে, গরমের মধ্যে এতটা পথ সাইকেল চালিয়ে এলেন ভিতরে চলুন, আমার মায়ের সাথে আলাপ করে চা খেয়ে তারপর যাবেন। উফ্! আজ বড্ড গরম” বলে টেনে নিজের মাথা মুখ বাঁধা ওড়নাটা খুলে ফেললো বাঁশরী । চুলটা বাঁধা হয়নি তখন, এক পিঠ হাল্কা ঢেউ খেলান চুল। মুখের পাশে কিছুটা চুল মুখটাকে আড়াল করে ওকে রহস্যময়ী করে তুলেছে।
সাইকেলটা তালা দিয়ে হাতলে ঝুলিয়ে রাখা প্যাকেটটা হাতে নিয়ে মুখ তুলে কেশব সামনে বাঁশরীকে ঐ ভাবে দেখে হা করে তাকিয়ে রইল, যেন দম নিতে ও ভুলে গেছে, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না কেশব….ঐ পর্দানশিন যাকে ও চেনে বাঁশরী বলে একি সেই মেয়ে ? কেশব কখনো বাঁশরীকে মাথায় ঘোমটা আর মুখে মাস্ক ছাড়া তেমন ভাবে দেখেনি। ঐ যখন বিষম লেগেছিল তখন এক ঝলক, তা সে সময় কি আর মুখ দেখার মত অবস্থা ছিল ওর। সুস্থ হবার পর ও লজ্জায় সংকোচে সোজা সুজি তাকাতে পারেনি বাঁশরীর দিকে আর তারপর তো সর্বক্ষণ ঐ পর্দানশিনকেই দেখছে।
বাঁশরী ভুরু কুঁচকে —- “আবার কি হল ? অমন হা করে তাকিয়ে কি দেখছেন? মুখে মাছি ঢুকে যাবে তো”!
কথায় আছে বোকা, ভীরুরা প্রেমে পড়লে খুব চালাক চতুর হয়ে যায় আর সাহসী, চালাকরা হয়ে যায় ভীতু !
কেশব সেটা প্রমান করে দিল। গলাটা ঝেড়ে নিয়ে — না তেমন কিছু হয় নি এখনও তবে ভাবছিলাম—- কথাটা শেষ করতে দিল না বাঁশরী
বললো— কি ভাবছিলেন শুনি !
—— ভাবছিলাম জগন্নাথ ত দর্শন হল না কিন্তু সামনে জল জ্যান্ত সুভদ্রাআআ হরণ করলে কেমন হয়, না মানে পৃথিরাজ সংযুক্তাকে হরণ করে ঘোড়ায় নিয়ে পালিয়েছিলো আমার সাইকেলই আমার পক্ষীরাজ!
কোন উত্তরের আশা না করে কেশব প্যাকেটটা বাঁশরীকে দিয়ে বলল এগুলো আমাদের বাড়ির গাছের চাঁপা ফুল, নিলে খুব খুশি হব। চাঁপা ফুলের সুগন্ধর সাথে কেশবের শরীরের একটা হাল্কা ঝাঁঝাল বুনো গন্ধ অনুভব করল বাঁশরী। হঠাৎ মৃদু বাতাসে দোলা লাগা ফুলের মত কেঁপে উঠল ও।
ভেতর থেকে মায়ের আওয়াজ, কে এল রে বুড়ি ?
বারান্দায় মোড়া পেতে বসে চা পাঁপড় ভাজা, মুড়ি সহযোগে গল্প করতে করতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। এমনিতেই মুঠো ফোনের দৌলতে ওদের বন্ধুত্বটা বেশ গাড় হয়ে উঠেছিল আজ যেন সেটা আরো গভীরতা পেল। দুজনেই আরো সহজ ও অন্তরঙ্গ বোধ করছিল। এবার বিদায় নেবার পালা ।বাঁশরীর মা কেশবকে আবার আসার আমন্ত্রণ দিয়ে ভেতরে চলে গেল। কেশব সাইকেলের তালা খুলতে খুলতে আশপাশে কেউ নেই দেখে, যেন হাওয়াকে শুনিয়ে বললো,—-অভয় পেলে একটা কথা বলি।
—-কে বারন করেছে।
—-এই আপনি আজ্ঞে আর ভাল লাগছে না।
—- যা ভাল লাগে, মন চায় সেটা বললেই হয়! তাআআ, আবার কবে দেখা হবে?
সময় নষ্ট না করে কেশব চটপট জবাব দিল —-যেদিন তুমি বলবে! তবে পর্দানশীন, তোমার চিবুকের ঐ তিলটা আমায় পাগল করে দেবে। তুমি ওটা ঢেকেই রাখ না হলে আমি যদি কিছু দোষ করে ফেলি রাগ কোর না!
—— সুভদ্রা হরণ করার কথা যে ভাবতে পারে সে এটুকু সাহস দখাতে এত ভয় পায় ? খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বাঁশরী
বাঁশরীর হাসি যেন অগ্নি তে ঘি, সোনায় সোহাগা হয়ে কেশবের বুকে ধক়্ধক়্ কর জ্বলে উঠল।
বা হাতে বাঁশরীর কোমরটা জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিল বাঁশরীকে, ডানহাত সাইকেল ধরা, নিজে বাঁশরীর মুখের কাছে ঝুঁকে আলতো করে নিজের ঠোঁট জোড়া ছোঁয়াল বাঁশরীর চিবুকে! আবেশে চোখ বুজল বাঁশরী।
শ্ঙ্খর আওয়াজে দুজনে ছিটকে দূরে সরে গেল। মা বোধহয় গোপালের সন্ধ্যার ভোগ নিবেদন করছে। কেশব সাইকেলটা টেনে বাইরে বার করে রওনা দেবে, এমন সময় পেছন থেকে বাঁশরী —- আবার কবে আসবে বললে না তো?
কেশব —— উল্টো রথেএএএ।
যতক্ষণ দেখা যায় দাঁড়িয়ে রইল বাঁশরী ধীরে ধীরে কেশব অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
বেড়ার আগলটা টেনে বাঁশরী ভেতরে চলে গেল। ঘরে ঢুকতেই টের পেল সুন্দর গন্ধে ঘরটা ভরে গেছে। দেখল মা গোপালের কাছে ঐ চাঁপা ফুলগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে। নমস্কার করে একটা চাঁপা তুলে ও খোঁপায় গুঁজে নিল। চাঁপার সুগন্ধ আর কেশবের শরীরের ঐ ঝাঁঝাল বুনো গন্ধ মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে ওকে আবেশে বিভোর করে দিল। আয়নার সামনে দাঁডিয়ে চিবুকের তিলটা দেখে আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে হেসে সরে গেল —— মা যদি দেখে কি ভাববে —- ফোনটা হাতে তুলে নিল, আবার রেখে দিল। নিজেকে শাসনের সুরে মনে মনে বলল বাঁশরী কি ছেলেমানুষী হচ্ছে এটা?
উল্টো রথের দিন কেশব মাকে, বাবার স্কুটারে পিছনে বসিয়ে নিয়ে এসেছিল বাঁশরীর বাড়ি। পথ ওদের আগেই “বন্ধন হীন গ্রন্থী”তে বেঁধেছিল, কেশবের মা এসে ওদের “সাত পাঁক” বন্ধনে বেঁধে সামাজিক ও নৈতিক স্বীকৃতির ব্যবস্থাটা পাকাপাকি করে গেলেন। বিষাক্ত বিশ-বিশ শেষ হলে আসছে ফাল্গুনে চার হাত এক করার সিদ্ধান্ত নিল দু মা মিলে। বিষম খাওয়া দিয়ে শুরু হয়েছিল এক গল্প, এবার নেমন্তন্ন খাওয়া দিয়ে ঘুচবে। মুখোশের আড়ালে শুরু হবে কেশব-বাঁশরী উপাখ্যান।