গাংদুয়ার গান

পলাশ মুখোপাধ্যায়

##

বেড়ানোর ক্ষেত্রে খুব জনবহুল স্থান আমায় খুব একটা টানে না। সে অতিজনপ্রিয়ই হোক বা বিখ্যাত। বছর তিনেক আগে একবার গিন্নীর অনুরোধে দীঘায় গিয়েছিলাম। রাত আটটা নাগাদ একবার মনে হল সমুদ্রের ধারে গিয়ে দুজনে বসি। গিয়ে দেখি সেখানে কুম্ভমেলা। বিয়েবাড়িতে নটা থেকে দশটা নাগাদ খেতে বসলে যেমন পাশে আরও দুজন পরের ব্যাচের জন্য জায়গা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, তেমনই আমরা কোনওরকমে দাঁড়িয়ে থাকলাম সামান্য জায়গা মেলার আশায়। এর পর থেকে আর দীঘা নামটার দিকেও তাকাই না। যাই হোক কাজের কথায় আসি। একটু নিরিবিলি ছিমছাম বেড়ানোর লোভেই সেদিন বেরিয়ে পড়লাম বাঁকুড়ার উদ্দেশে। কি ভাবছেন? বিষ্ণুপুর বা মুকুটমনিপুর? একেবারেই না। আমার প্রথম গন্তব্য কোড়ো পাহাড়।

কোড়ো পাহাড় বাঁকুড়া জেলার মাঝামাঝি একটা জায়গায়। যাওয়া যায় দুভাবেই, ট্রেনে বাঁকুড়া শহরে গিয়ে সেখান থেকে গঙ্গাজলঘাঁটির বাস ধরে নামা যায় কোড়ো পাহাড়ের সামনে। আবার দুর্গাপুর বা রানিগঞ্জ পর্যন্ত ট্রেনে বা বাসে গিয়ে সেখান থেকেও গঙ্গাজলঘাঁটি বা অমরকাননের বাস ধরে পৌঁছনো যায় কোড়ো পাহাড়ে। বাঁকুড়া থেকে এর দূরত্ব কমবেশি ২০ কিলোমিটার মত। আমি অবশ্য ভোরবেলা বাস ধরে পৌঁছলাম দুর্গাপুরে। মনে রাখবেন এক্ষেত্রে বাসে দুর্গাপুরের সিটিসেন্টারে নামলে কিন্তু স্টেশনে আসতে হবে আপনাকে। স্টেশন থেকেই গঙ্গাজলঘাঁটি বা অমরকাননের বাস মেলে। কলকাতা থেকে বাঁকুড়ার দক্ষিন বঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থার বাস ধরলে সেই বাস দুর্গাপুর স্টেশনে নামিয়ে দেবে। তবে বাঁকুড়ার বাস অমরকাননের দিক হয়ে যায় না তাই দুর্গাপুর স্টেশন বা বড়জোড়াতে নেমে যাওয়াই সমীচীন। আমিও তাই করলাম, দুর্গাপুর স্টেশন থেকে অমরকাননের বাস ধরলাম। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ বাস আমায় নামিয়ে দিল অমরকাননে। আমার পরিচিত পাঠকেরা তো জানেনই, আমি হিউ এন সাং এর ভক্ত হাঁটাপ্রেমী মানুষ। তো দিলাম হাঁটা, কোড়ো পাহাড়ের দিকে। যারা হাঁটতে পারবেন না তাদের জন্য অবশ্য ভ্যান রিকশা রয়েছে। গ্রামের মধ্যে দিয়ে হেঁটে মিনিট পনেরো পরে পৌঁছলাম কোড়ো পাহাড়ের নিচে।

বাঁকুড়ার অন্য পাহাড়গুলির তুলনায় উচ্চতার নিরিখে কোড়োকে প্রায় কিশোরই বলা যায়। মাত্র চার শো ফুট উঁচু, গাছপালায় ছাওয়া পাহাড়টিকে দেখেই বেশ ভাল লেগে গেল। কেমন যেন নিজের নিজের মনে হল। পাহাড়ের ঠিক নিচে রয়েছে একটি আশ্রম। পোশাকি নাম উত্তমাশ্রম, ডাকনাম তপোবন। প্রথম দেখাতেই মনে হল সত্যিই এ বুঝি তপোবনই বটে। নানা ফল এবং ফুলের গাছ চারিদিকে, শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ। একদিকে গবাদি পশুদের আস্তানা, অন্যদিকে আশ্রমিকদের থাকার জায়গা। শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে এ যেন এক নিশ্চিন্তপুরের ঠিকানা। আশ্রম চত্বরে একটি বটগাছের গোড়া বাঁধানো ইট দিয়ে, মুখে চোখে একটু জল দিয়ে সেখানেই বসলাম বেশ আরাম করে। আহ্‌ কি প্রশান্তি। আমি অবশ্য আশ্রমিকদের কোনও রকম বিরক্ত করিনি, অহেতুক কোনও কৌতুহলও দেখাইনি। বসে থাকতে ভালই লাগছিল। খানিক পরে পা বাড়ালাম পাহাড়ের সিড়ির দিকে। এখন কোড়ো পাহাড়ে উঠতে আর কষ্ট হয় না, স্থানীয় প্রশাসন পাহাড়ের ধাপ কেটে সুপ্রশস্ত সিঁড়ি বানিয়ে দিয়েছে।

শখানেক মত সিঁড়ি আছে এখানে। সিঁড়ি দিয়ে খানিকটা উঠবার পর বিশ্রাম নেওয়ার জায়গাও আছে। আগেই বলেছি গোটা পাহাড়টি নানা রকমের গাছে ঢাকা। তাই ছায়ায় ছায়ায় উঠতে তেমন কষ্ট হয় না। উপরে রয়েছে সাবিত্রী মন্দির। মন্দির চত্বরের পাঁচিলের গায়ে অসংখ্য উক্তি বা বাণী লেখা রয়েছে। সেগুলি পড়তেও মন্দ লাগে না। এবার তাকানো বাহির পানে। পাহাড়ের উপর থেকে চারপাশটা ভারি মনোরম, মায়াবী, ঢেউ খেলানো সবুজ চারিদিকে। সত্যি চোখ এবং মন ভাল করে দেওয়া সৌন্দর্য। পাহাড়ের চূড়া থেকে  আশেপাশে অঞ্চলে চোখ ফেরালে প্রকৃতিক মনোরম পরিবেশ কতটা আলাদা তা বোঝা ‌যায়, এক পাশে গ্রাম, অন্যদিকে রাজপথ, আর বাঁ দিকে ঘুরলেই ধূ ধূ প্রান্তর আর মাঠের আল। এখানে হয়ে গিয়েছে বেশ খানিকক্ষণ, এবার নামার পালা। খুব একটা লোকজন নেই, নির্জন সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই সামনের গাছ থেকে খসে পড়ল একটি পাকা বেল। চমকে উঠে কুড়িয়ে নিলাম সেটা, তবে আমি বেল ভক্ত নই তাই নিচে আশ্রমে একজনকে পেয়ে তার হাতে বেলটি দিয়ে বেরিয়ে এলাম। ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড় এই তপোবন আশ্রম এবং কোড়ো পাহাড় দেখে ভাল লাগবেনা এমন মানুষ মেলা ভার। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে ছোট্ট শালি নদী। তার ধারটিও কিন্তু কম আকর্ষনীয় নয়। দেখতে দেখতেই ফের বড় রাস্তায়।

এবার যাব গাংদুয়া জলাধারে। এখান থেকে গাংদুয়ার দূরত্ব কম করেও চার কিলোমিটার। এবার তাই হাঁটা নয়, একটা ট্রেকারে করে কলেজ মোড়ে নেমে গেলাম। এখান থেকে গাংদুয়া দেড় কিলোমিটার। শালি নদীর উপরে নির্মিত গাংদুয়ার জলাধার আকার প্রকারে ছোট হলেও জলাধারটির রূপ লালিত্য কোনও অংশে কম নয়। জলাধারের লকগেটের মাপ প্রায় ৫০ ফুটের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু আশেপাশের মায়াময় পরিবেশ, সাজানো অরণ্যে আকাশমনি, ইউক্যালিপটাস গাছের সারি, অদ্ভুত নিস্তব্ধতার মাঝে বাতাস গুনগুনিয়ে ‌যায়। হরেক পাখির ডাক হয়ে ওঠে পার্শ্বসঙ্গীত। কয়েক দশক আগে কয়েকশো হেক্টর জমি খনন করে তৈরি করা হয় এই জলাধার। মূলত এই ড্যামের জল সেচের কাজে বণ্টন করার জন্যই তৈরি করা হয়েছিল।

জলাধারের গাঁ ঘেঁসে লাল মাটির পথ চলে গিয়েছে দূরে গ্রামে। এদিকে আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে, মেঘলা আবহে সেই রাঙা মাটির পথ ধরে আনমনে চলা। একপাশে শালি জলাধার অন্য পাশে গাঢ় সবুজ প্রকৃতি, সঙ্গী ফুরফুরে একটা হাওয়া। সত্যি বলছি সংসার-পরিজন সব ভুলে মনে হচ্ছিল স্বর্গ যদি থাকে তবে সেটা এখানেই বোধহয়। দূরে দেখা যাচ্ছে শুশুনিয়া পাহাড়ের অস্পষ্ট অবয়ব। গ্রামের দিক থেকে আসছিলেন এক সাইকেল আরোহী। আমায় এমন আনমনে হাঁটতে দেখে সাইকেল থামিয়ে আলাপ জমালেন। কলকাতা থেকে এখানে বেড়াতে এসেছি শুনে অবাক হয়ে গেলেন। তারপরে অবশ্য তার গর্বিত স্বরে ঘোষণা, “ইখানে এমন সুন্দর জায়গাটোর হদিস্‌ কলকাতার বাবুরা জানেই না, তো আইসবেক কেমনে’’। ঠিক কথা গাংদুয়া ড্যাম বা কোড়ো পাহাড়ের কথা কজনই বা জানে। যাই হোক একটা লাভ হল আমাকে আর হাঁটতে হল না। ওই সাইকেলেই আমি চলে এলাম অমরকানন বাজারে।

ভাল হোটেল তেমন নেই তার মধ্যেই একটা কানার মধ্যে ঝাপসা টাইপের দেখে মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে নেওয়া গেল। দীর্ঘ দিন নানা জায়গাতে ঘোরার সুবাদে আমি দেখেছি এই ধরনের হোটেলগুলি দেখতে আহামরি না হলেও এদের অনেকেরই রান্নাবান্না বেশ ভাল। এই হোটেলটিও অনেকটা সেই রকম। যাই হোক চারাপোনার ঝোল দিয়ে গরম গরম ভাত খেয়ে এবার একটু অমরকানন গ্রামটি ঘুরে দেখার পালা। বাঁকুড়া শহর থেকে মাত্র ১৯ কিমি দূরে ১৪ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে ছোট্ট গ্রাম অমরকানন। নামটি দিয়েছিলেন স্থানীয় জমিদার তথা স্বাধীনতা সংগ্রামী গোবিন্দ প্রসাদ সিংহ মহাশয়। এখানেই রয়েছে গোবিন্দপ্রসাদ সিংহ মহাশয়ের বানানো ও গান্ধিজীর হাতে পথ শুরু করা শ্রী রামকৃষ্ণ সেবা দল আশ্রম যা অমরকানন আশ্রম নামেও পরিচিত। নেতাজী ও এখানে এসেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রাম এর সংগঠন মুলক কাজে। কাজি নজরুল ইসলাম গান বেঁধেছিলেন এই গ্রামটির নামে “মোদের অমরকানন”। জঙ্গল ঘেরা এই গ্রামটি যেন বাঁকুড়ার শান্তিনিকেতন…

বেলা অনেক হয়েছে এবার ফেরবার পালা। আমি তো ফিরে যাব কিন্তু যারা থাকতে চান তাদের জন্যও আছে ব্যবস্থা। থাকার জন্যে রয়েছে বাঁকুড়া বন বিভাগ (উত্তর) এর বন বাংলো ও আশ্রমের গেস্ট হাউস। এখানে এসেও তা বুক করা যায়। ফিরবার সময় আমি চলে এলাম রাণিগঞ্জে। এখান থেকে রানিগঞ্জের বাসও মেলে। রানিগঞ্জ স্টেশনে টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেই শুনতে পেলাম ব্ল্যাকডায়মন্ড ঢুকছে। ব্ল্যাকে বরাবরই বেশ ভিড় হয়, এখানেও ব্যতিক্রম নয়। তারই মাঝে মিলে গেলেন ঈশ্বর প্রদত্ত একজন যিনি দুর্গাপুরে নেমে যাবেন। আমিও সেট হয়ে গেলাম ঠিক তার সামনে। ব্ল্যাকের ভিতরের পাশাপাশি বাইরেটাও ক্রমশ ব্ল্যাক হয়ে আসছে, জায়গাটা পেলেই একটা কচি ঘুম আমার জন্য অপেক্ষা করছে আমারই মত করে। মনের মধ্যে শুধু গুনগুনিয়ে উঠছে নজরুলের লেখা গান–

“অমর কানন
মোদের অমর-কানন!
বন কে বলে রে ভাই, আমাদের তপোবন,
আমাদের তপোবন।

এর দক্ষিণে ‘শালী’ নদী কুলুকুলু বয়,
তার কূলে কূলে শালবীথি ফুলে ফুলময়,
হেথা ভেসে আসে জলে-ভেজা দখিনা মলয়,
হেথা মহুয়ার মউ খেয়ে মন উচাটন।”

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × 4 =