গোকুলে বাড়িছে সে

পলাশ মুখোপাধ্যায় ##

জীবনের নানা ওঠাপড়া যেন গায়ে না লাগে। বিজ্ঞাপনী এই শব্দবন্ধের সঙ্গে তাল মিলিয়েই আমার জীবনেও নানা ওঠাপড়া। তবে আমার গায়ে তার ছাপ স্পষ্ট। কৌলিন্য কিম্বা আভিজাত্য কিছু কম ছিল না আমার, অযত্ন, অবহেলা বা অনাদরের ফলে অনেক কিছু থেকেও কি একটা নেই যেন। ওমা, আমার পরিচয় দিইনি তোমাদের বুঝি? দেখেছ বয়স হয়েছে তো ভুলে যাই। আমি গোকুলনগর। বিষ্ণুপুর আমার সহোদর। কাছাকাছিই বাস আমাদের। এই ধর ১৫ কিলোমিটার দূরে থাকি আমি। অথচ বড়জনের সমাদর, জনপ্রিয়তা বিশ্বজোড়া। এক বুক সম্পদ নিয়েও আমি পড়ে থাকি লোক চক্ষুর প্রায় অন্তরালে।

আমার সামনে দিয়ে যখন গাড়ি চেপে হই চই করে তোমরা চলে যাও বিষ্ণুপুরের দিকে, একবার ফিরেও চাও না আমার পানে, তখন না খুব খুউউউব খারাপ লাগে আমার। কেন এমন হয়? বাঁকুড়া জেলার বৃহত্তম মাকড়া পাথরের মন্দির তো আমার কাছেই। না জেনেই চলে যাও তোমরা জৌলুস, প্রচার আর জনপ্রিয়তায় ভরা সহোদরের কাছে। অথচ আমি জানি বাঁকুড়া জেলার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রথম সারির পুরাকীর্তির মধ্যে অন্যতম হল গোকুলচাঁদ মন্দির। একটি আয়তকার দুর্গের মতো পাথরের প্রাচীর ঘিরে আছে আমার শ্রীকৃষ্ণচাঁদের মন্দিরটিকে।  একবার এসেই দেখ না, চোখ ফেরাতে পারবে না কথা দিচ্ছি।

পূর্ব দিকের প্রাচীরের মাঝখানে রয়েছে প্রধান প্রবেশ দ্বার। সেখান দিয়ে প্রবেশ করলে মাকড়া পাথরে তৈরি পূর্বমুখী মন্দিরটি নজরে আসবে। মন্দিরটি পঞ্চশিখরবিশিষ্ট। পাঁচশিখরের কেন্দ্রীয় শিখর বা চূড়াটি বড় এবং আট কোণা। কোণের দিকের শিখরগুলি চারকোনা, পাতলা ও আশ্চর্য লাবণ্যময়। চারদিকে তিন খিলানযুক্ত বারান্দা ছাড়াও গর্ভগৃহের চারদিকে প্রদক্ষিণপথটি ভারি চমৎকার। মন্দিরের দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে রয়েছে দশাবতার ও পৌরাণিক মূর্তির খোদাই কারুকাজ। ১৬৪৬ সালে মল্লরাজা প্রথম রঘুনাথ সিংহ প্রতিষ্ঠা করেন এই মন্দিরের যার উচ্চতা ৬১ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ প্রায় ৬০ ফুট।  সামনে এবং দক্ষিণ দিকের মন্দিরের গায়ে রয়েছে অপূর্ব ভাস্কর্য। দশাবতার ছাড়াও সেই ভাস্কর্যে দেখা মেলে ছুটন্ত ঘোড়ায় যুদ্ধারোহী, তিরন্দাজদের। এ ছাড়া মন্দিরের আর এক সম্পদ পাথর কুঁদে বানানো অনবদ্য ফুলকারি নকশা।

প্রাঙ্গণের দক্ষিণ দিক বরাবর সুবিশাল এক বেদির ওপর রয়েছে নাটমণ্ডপ। এই মঞ্চটি ব্যবহৃত হত কীর্তনমঞ্চ, সাধুনিবাস সংগ্রহশালা ও ভাগবত পাঠের মঞ্চ হিসাবে। কীর্তনমণ্ডপের মূল দেওয়ালের ভেতরে একটি করে মোট তিনটি ছোট্ট ঘর এবং পাশে রয়েছে ছাদে ওঠবার সিঁড়ি। তোমরা কি জান আকারে বিশাল এই মণ্ডপটির ভেতরে বহু প্রাচীন মূর্তি সংরক্ষিত ছিল, কালের নিয়মে  সেগুলি সবই অদৃশ্য হয়েছে, কিছু বিষ্ণুপুর যোগেশচন্দ্র পুরাকীর্তি ভবনে সংরক্ষিত রয়েছে।

এই বেলা একটা কথা বলে রাখি চুপিচুপি, কুলীন এই মন্দির কিন্তু এখন বিগ্রহহীন, প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায়। ছবিতেই চলে নিত্যপুজো, ভোগ, সন্ধ্যারতি। অথচ সেই দিনগুলি আমার চোখের সামনে ভাসে যখন এই মন্দিরেই একসময় প্রতিদিন সিদ্ধ চালের ভোগ রান্না হত। কাঁচা শালপাতায় পোড়ানো পোস্ত ও কাঁচা বিউড়ি কলাইয়ের ডাল ছিল ভোগের আবশ্যিক উপকরণ। এই খরচ আসতো দেবোত্তর সম্পত্তি থেকে। মন্দিরের পশ্চিম দিকে ছিল পাথরে বাঁধানো একটা কুয়ো। ওই কুয়োর জলেই পুজোর কাজ ও ভোগ রান্না হত। দোল পূর্ণিমায় এখনও বড় মেলা বসে এখানে। এ ছাড়াও রাস, ঝুলন ও জন্মাষ্টমীতেও বিশেষ অনুষ্ঠান হয়।

ভেব না এখানেই শেষ। গোকুলচাঁদ মন্দিরের আধ কিলোমিটার উত্তরে রয়েছে গন্ধেশ্বর শিবের পাথরের সাধারণ দেউল মন্দির। পূর্বমুখী মন্দিরের ভেতরে রয়েছে বৃহদাকার যোনিপট্ট-সহ শিবলিঙ্গ। এরকম শিবলিঙ্গ শুধু এখানে কেন ভুভারতে মেলা ভার। গর্ভগৃহের মধ্যে এক অপূর্ব মহিষমর্দিনী মূর্তি রয়েছে যেটি আজও পূজিত হয়, শুনেছি ঐতিহাসিকেরা মনে করেন এটি নাকি পালযুগের মূর্তি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, অতীতে মন্দিরটি ছিল সাতটি রথের আকারের এবং উচ্চতা কমপক্ষে ৮০ ফুট।  এই মন্দিরেরই কিছুটা উত্তরে একটি বাঁধানো পুকুরের পাড়ে প্রাচীন মন্দিরের ধংসস্তূপ রয়েছে। সেখানে আছে বরাহ অবতারের একটি মূর্তি যা কিছুটা মাটিতে পোঁতা অবস্থায় পড়ে আছে। স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষেত্রপালজ্ঞানে পুজো করে থাকেন।

শুধু কি মন্দির নাকি, যারা জঙ্গল ভালবাসো তারাও এস আমার কাছে। বিখ্যাত জয়পুরের জঙ্গল তো আমার পাশেই। লালমাটির বুকে সবুজের আবহে মন যে ভরে যাবে সে কথা না বললেও হয়। ওমা তোমরা বুঝি বনলতা রিসর্টে এর মধ্যেই রাত কাটিয়ে গেছ! দেখেছ, এত কাছে এসেও একবার এলে না আমার কাছে। জানতে না বুঝি? এবার জানলে তো, চলে এস একবার, অনেক গপ্পো করব তোমাদের সাথে। কি ভাবে আসবে? খুব একটা ঝক্কি নেই, ট্রেনে আরামবাগ অবধি এসে বাসে কোতুলপুর পার করে জয়পুরের আগেই সলদা মোড়ে নামতে হবে। সেখান থেকে হেঁটেও আসতে পার আবার ভ্যান রিকশা বা টোটো নিয়েও চলে আসতে পারবে। গাড়ি নিয়ে এলে আরামবাগ, কোতুলপুর পার করে সলদা মোড় থেকে বাঁ দিকে বেঁকে রেল গেট পার করে চলে এস। কথা দিচ্ছি ঠকবে না। রাতে থাকা এবং খাবারের জায়গা এখন জয়পুরে ভালই মিলবে। পকেটে রেস্ত থাকলে তো কথাই নেই। চোখ চেয়ে রইলাম কিন্তু বাপু… আর কোথায়, তোমাদের পথ পানে…    

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × five =