গোয়া – ভারতের পশ্চিম আকাশের এক উজ্বল জ্যোতিষ্ক

প্রবীর মুখোপাধ্যায়, কলকাতা ##

গোয়া বলতেই আমাদের, মানে আমার মত কলকাতার মধ্যবিত্ত ভ্রমণপিপাসু মানুষদের, চোখে ভেসে ওঠে আরব সাগরের পাশের এক ছোট্ট প্রদেশের ছবি। ১৯৬১ সাল অবধি গোয়া পর্তুগিজদের অধীনে ছিল। গোয়াতে গেলে দেখতে পাব অপূর্বসুন্দর সমুদ্রসৈকত, সপ্তদশ শতকে নির্মিত সুন্দর সুন্দর গির্জা আর মশলা বাগিচা। আর দেখতে পাব এখানকার অন্যতম দর্শনীয় অনুষ্ঠান কার্ণিভ্যাল যা প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও খেতে পাব নানা রকম সামুদ্রিক মাছের নানা পদ আর (গলার স্বরটা একটু নামিয়ে নিয়ে বলি) বিভিন্ন প্রকার দেশি-বিদেশি মদিরা। দীর্ঘদিন পর্তুগিজ প্রভাবে থাকার জন্যে গোয়ার একটা আলাদা আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য আছে যা ভারতীয় সংস্কৃতিকে আরও বৈচিত্রময় করে তুলেছে। এই সব কারণে বিদেশিদের কাছে তো বটেই, ভারতের অন্য জায়গার ভ্রমণপিপাসুদের কাছেও গোয়া খুবই আকর্ষণীয় গন্তব্য।

অর্থনৈতিক দিক থেকে গোয়া ভারতের অন্য সব প্রদেশ ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের থেকে যে অনেক এগিয়ে এই কথাটা আমরা প্রায় কেউই জানিনা। মাথাপিছু নীট ঘরোয়া উৎপাদনের হিসাবে (Net State Domestic Product NSDP) গোয়ার স্থান ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে সবার শীর্ষে। ২০১৭-১৮ সালের তথ্য অনুসারে এর পরিমাণ ₹৪,২০, ৩৮৩ অর্থাৎ মার্কিন $৬,১০০।

এতদসত্ত্বেও গোয়া বা এর ইতিহাস সম্বন্ধে আমরা খুবই কম খবর রাখি। ভারতীয় সংস্কৃতির বহুমুখীনতার ক্ষেত্রে গোয়ার জনগণের অবদান যে অপরিসীম সে সম্বন্ধেও আমাদের ধারণা প্রায় নেই বললেই চলে।  Scroll.in এই ইন্টারনেট ম্যাগাজিনের ১৩ জুলাই ২০১৯-এ পিটার রোনাল্ড ডি’স্যুজা-র প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে [The India of acceptance: What RSS backers could learn from 19th-century thinker Francisco Luis Gomes]  গোয়ার ঊনিশ শতকের এক মনীষী ফ্র্যান্সিস্কো ল্যুই গোমেজ সম্বন্ধে দু’চার কথা জানতে পেরে আগ্রহ বেড়ে যায়। নেটে একটু খোঁজ করতেই সন্ধান পাই আউটলুক পত্রিকার ২০১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত অরবিন্দ আদিগার লেখা প্রবন্ধ দ্য ল্যুসিট্যানিয়ান ইন হিন্দ প্রবন্ধটি। এই দুটি প্রবন্ধে ফ্র্যান্সিস্কো ল্যুই গোমেজ-এর যে ক’টি উদ্ধৃতি দেওয়া আছে আর তাঁর সম্বন্ধে যা লেখা আছে তা’র থেকে আমার মনে হয়েছে যে ইনি আজকের দিনে আমাদের কাছে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। এ প্রসঙ্গে আমি যতটুকু জেনেছি আর বুঝেছি সেটি অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া আমার কর্তব্য মনে করছি বলেই এই প্রবন্ধের উপস্থাপনা।

ফ্র্যান্সিস্কো ল্যুই গোমেজ

পর্তুগাল গোয়া ও অন্যান্য ভারতীয় এলাকা দখল করে সেখানে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী শাসন চালু করার ফলে গোয়া-র, বা ব্যাপক অর্থে পর্তুগিজ শাসিত ভারতের অধিবাসীদের সঙ্গে ভারতের সন্নিহিত অঞ্চলের অধিবাসীদের বেশ কিছু সামাজিক-রাজনৈতিক পার্থক্য গড়ে ওঠে। খুব সচেতনভাবে গোয়া এবং পর্তুগিজ শাসিত অঞ্চলের অধিবাসীদের ‘ল্যুসো-ইন্ডিয়ান’ এই নামে প্রথম অভিহিত করেন ফ্র্যান্সিস্কো ল্যুই গোমেজ। গোয়ার সন্তান ঊনবিংশ শতকের এই অনন্য সমাজ-সচেতন বুদ্ধিজীবী তাঁর ভারতীয় ঐতিহ্যের বহুমুখীনতা নিয়ে যথেষ্ট সচেতন ও গর্বিত ছিলেন। বরং পর্তুগিজ ইউরোপের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংঘাতের মধ্য দিয়ে কি ভাবে ‘ল্যুসো-ইন্ডিয়ান’ জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট বিকশিত হয়েছে সে সম্বন্ধেও তিনি সচেতন ছিলেন। দেশের বিভিন্ন অংশে সামাজিক পরিবর্তন আর বিবর্তনের ফলে এই সাংস্কৃতিক বিকাশ নানারূপে প্রকাশিত হয়েছে। সেই বহুমুখীনতা ভারতের সংস্কৃতিকে এক অনন্য রূপ দিয়েছে। ফ্র্যান্সিস্কো ল্যুই গোমেজ ‘ল্যুসো-ইন্ডিয়ান’ সংস্কৃতির বৈশিষ্টকে মনে করতেন ভারতীয় সংস্কৃতিরই বিভিন্ন রূপের আরেকটি উপাদান। পর্তুগালের সঙ্গে তার উপনিবেশের জনগণের যে সংযোগ সেটা কয়েক শতাব্দী ধরে চলার ফলে যে বর্ণ-সংকরতা জন্ম নিয়েছে তাকে তিনি অনস্বীকার্য বলে মেনেও নিয়েছেন। কিন্তু পর্তুগিজ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে যখন তিনি গোয়া বা অ্যাঙ্গোলার জনগণের অধিকারের কথা বলেছেন তখনই দেখা গেছে যে এই বর্ণ-সংকরতাকে তিনি খুবই কম গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর রাজনৈতিক কাজকর্মের মধ্য দিয়ে তিনি বারবার উপনিবেশবাদকে চ্যালেঞ্জ করেছেন আর ওঁর নিজের দেশকে পর্তুগাল শৃংখলিত করে রেখেছে এই অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন।

        গোমেজের উদার আর জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা প্রবাহিত হয়ে চলেছে গোয়ার ‘ল্যুসো-ইন্ডিয়ান’ বুদ্ধিজীবীদের মধ্য দিয়ে। গোমেজের পর্তুগিজ ভাষায় লেখা রচনাবলী অনুবাদ করেছেন আর্ম্যান্ডো মেনেজেস  (Armando Menezes)-এর মত কবি। ধারওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সময়ে এই মেনেজেসই মধ্যযুগের কন্নড় কবিতাবলীর অনুবাদ করেন। গোয়া থেকে আমরা পেয়েছি ডম মোরেস (Dom Moraes) এর মত লেখক, অ্যান্টনিয়ো জেভিয়ার ট্রিন্ডেড (Ant­onio Xavier Trindade) আর অ্যাঞ্জেলো দ্য’ ফনসেকা (Ang­­elo de Fon­seca)-র মত চিত্রকরকে, চার্লস কোররিয়া (Charles Correa)-র মত স্থাপত্যবিদকে।  

        গির্জায় গিয়ে সঙ্গীতের হাতেখড়ি হয়েছে ‘ল্যুসো-ইন্ডিয়ান’-দের বেশ কিছু লোকের। গির্জার ক্যয়ার সঙ্গীতের সঙ্গে তারা সেখানে শিখেছে স্বরলিপি, ছন্দ ও তালের মাত্রাবিন্যাস, সুর, অর্কেস্ট্রা আর বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার। গির্জার সেই সঙ্গীত গোয়া থেকে ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের বিভিন্ন মহানগরের হোটেল আর পানশালায়; হেঁটে হেঁটে চলতে চলতে ঢুকে পড়েছে বম্বের (এখনকার মুম্বাই-এর) ফিল্মজগতের সঙ্গীতের মধ্যে। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে দ্বৈত সঙ্গীত গাইছেন মহম্মদ রফি – ব্যাকগ্রাউন্ডে সেতারের সঙ্গে বাজছে বেহালা, স্যাক্সোফোন বাজছে সেতারের সঙ্গে। এর থেকে বড় ‘ফিউসন’ কি হয়? এর থেকে মহান পরীক্ষা আর কোথায় হয়েছে? আর এই হল ভারতীয় সংস্কৃতির আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা, আত্মীভূত করে অঙ্গীভূত করে নিজের সাথে মিলিয়ে নেওয়া। উত্তর ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত আর দক্ষিণ ভারতীয় ‘কর্ণাটক’ সঙ্গীত উভয়েরই আছে সুদীর্ঘ সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য। আর আছে লোকসঙ্গীতের এক বিরাট ভান্ডার। তার মধ্যেও পাশ্চাত্য সঙ্গীতকে আত্মস্থ করে নিতে বিন্দুমাত্র দেরি হলনা আর সেই কাজটি করলেন গোয়ানীজ – না ‘ল্যুসো-ইন্ডিয়ান’ – সংগীতজ্ঞেরা। পথিকৃতের কাজ করেছেন অ্যান্টনি গনসালভেস, চিক চকোলেট, জনি গোমস, সেবাস্টিয়ান ডি’স্যুজা আর এরকম অনেক মানুষ। কলকাতায় ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের পাশে (এখনকার মির্জা ঘালিব স্ট্রিটের পাশে) যমুনা সিনেমাহলের উল্টোদিকে ব্র্যাগাঞ্ঝা সাহেবের দোকান পাশ্চাত্য সঙ্গীতের যন্ত্রের কেন্দ্র এ আমি সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি।

        ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সবচেয়ে বেশি অফিসার এসেছে গোয়ার থেকে একথা মনে করিয়ে দিয়েছেন সাংবাদিক বাল্মীকি ফেলেইরো (Valmiki Faleiro) যিনি মার্গাও থেকে কাজ করেন।

        আর এদের অধিকাংশই ক্যাথলিক খ্রীস্টান!

একটি সাম্প্রতিক ঘটনার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে। গোয়াতে ক্যাথলিকদের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে, এখন মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ ক্যাথলিক। নিজেদের ঐতিহ্য রক্ষার তাগিদে ক্যাথলিকেরা এক ল্যুসিট্যানিয়া-ভারতীয় সংস্কৃতি উৎসবের আয়োজন করে। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা এই উৎসবকে এই বলে ঠাট্টা করে যে এরকম উৎসবের মাধ্যমে পর্তুগালের সাম্রাজ্যবাদী শাসনকেই গৌরবান্বিত করা হচ্ছে। আজকের গোয়ায় সরকারি ভাষা কোঙ্কনির সঙ্গে পর্তুগিজ ভাষারও সম-অধিকার দাবী করা হয় ক্যাথলিকদের পক্ষ থেকে। সঙ্গে সঙ্গে এই ক্যাথলিকদের দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকে হিন্দুত্ববাদীরা। অথচ হিন্দুত্ববাদীদের একটা বড় অংশ নিজেরা যখন ভুলভাল হাস্যকর ইংরিজিতে কথা বলে, ক্রিকেট নিয়ে এদের বাড়াবাড়ি পাগলামির সীমা অতিক্রম করে, বিলেতের কোন পত্রিকায় কি বেরলো তাই নিয়ে মাথার চুল ছিঁড়তে ব্যস্ত থাকে তখন কিন্তু তাদের দেশপ্রেম নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা হয় না। এমন কি ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে আজ-ও ইংরিজি-ই কেন একমাত্র স্বীকৃত ভাষা সেসবে এদের অবশ্য কিছু আসে যায় না।     

আজকের ‘হিন্দুত্ববাদীরা’ যতই সনাতন সনাতন বলে চিৎকার করুক না কেন আসলে ভারতীয় সংস্কৃতি যে বহুকিছুর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক অনন্য সৃষ্টি সে কথা অনস্বীকার্য। যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা এই সৃষ্টিকর্মে অন্য সকলের মত গোয়ার জনগণেরও অবদান একে সুন্দরতর করেছে। সাজ-পোষাক বা ফ্যাশন, সাহিত্য, সঙ্গীত, খানা-পিনা সব কিছুতেই ঐ ছোট্ট গোয়ার প্রভাব আর অবদান স্বীকার না করে আমরা পারব না। ভারতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র্য সবাইকে বিমোহিত করে। কত জনজাতি, কত ভাষা, বিভিন্ন আচার-আচরণ কিভাবে এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য গড়ে তুলেছে তা নিয়ে অনেক আলোচনা-গবেষণা হয়েছে, হয়ে চলেছে আর ভবিষ্যতেও হতে থাকবে।       

গোয়াতে সাম্রাজ্যবাদী পর্তুগিজ শাসন শুরু হোল ১৫১০ সাল  থেকে। কিন্তু সব কাজেরই যেমন সুফল আর কুফল দু’টোই থাকে এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলনা। গোয়াতে পর্তুগিজ শাসনের দুটি আশাতীত সুফল আধুনিক ভারতের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই। সারস্বত ব্রাহ্মণেরা নিজেদের ‘ধর্মবিশ্বাস’ বাঁচিয়ে রাখতে কোঙ্কন আর মালাবার উপকূল ধরে অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়লেন। যেখানেই তাঁরা গেলেন সেখানেই ব্যবসা-বাণিজ্য আর সংস্কৃতি বিকশিত হতে লাগল। আর গোয়ার মারগাঁও ও পাঞ্জিমের মত জায়গায় গড়ে উঠল শিক্ষিত ক্যাথলিক স্থানীয় এক সম্প্রদায় – এরা প্রথম প্রথম সাদা চামড়ার শাসকদের অনুসারী থাকলেও অল্প দিনের মধ্যেই শাসকদের সঙ্গে সম-অধিকার অর্জনের স্বপ্ন এঁরা দেখতে শুরু করলেন; কিছুদিনের মধ্যে স্বাধীনতার কথাও ভাবতে শুরু করলেন।

সরকারি চাকরি আর গির্জাতে কর্তৃত্ব করছে পর্তুগাল থেকে আসা ডমিনিকান্স, ফ্র্যান্সিসক্যান্স আর জেস্যুইট এই মিশনারিরা; যতই দক্ষ হোন না কেন, স্থানীয় ‘কালা চামড়া’র লোকেরা কিছুতেই ওপরে উঠতে পারছেন না। স্বভাবতই স্থানীয় গির্জা-পুরোহিতদের মধ্যে ক্ষোভ জমা হতে লাগল। সেনাবাহিনীতে যারা কাজ করছেন তাদের মধ্যেও এই ক্ষোভ ছিল। জোসে অ্যান্তনিও আর ক্যিতানো বিশপ হবার জন্য রোম আর পর্তুগালে দরবার করতে গিয়েও বিফল হলেন। আব্ব্যে ফারিয়ার সঙ্গে মিলে তাঁরাও এর পেছনে উস্কানি দিতে লাগলেন। এই তিন ব্যক্তি কিছুদিন পরেই ফরাসি বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ‘সাদা’ পুরোহিতেরা যে কর্তৃত্ব দেখাচ্ছে তার পেছনের মূল কারণ যে পর্তুগিজ শাসন এটা বুঝতে ভুল করেন নি স্থানীয় গির্জা-পুরোহিতেরা।  ১৭৮৭ সালে গোয়ার একদল গির্জা-পুরোহিতেরা তাদের সমব্যথীদের সঙ্গে একযোগে পর্তুগিজ শাসনকে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু শুধু নিজেদের শক্তিতে পর্তুগিজ শাসকদের হারানো যাবেনা বুঝতে পেরে এঁরা টিপু সুলতানের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন। ফলে ঘটলো ‘পিন্টো বিদ্রোহ’।

এই ‘পিন্টো বিদ্রোহ’ সম্ভবত সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ভারতে সংগঠিত অন্যতম প্রথম বিদ্রোহ। অবশ্য এই বিদ্রোহের সমাপ্তি ঘটে নিখুঁত ভারতীয় স্টাইলে। একেবারে শেষ মুহূর্তে একজন বেইমান সব পরিকল্পনা পর্তুগিজ শাসকদের কাছে ফাঁস করে দেয়। এই বিদ্রোহের অন্যতম নেতা আব্ব্যে ফারিয়া নামের এক গোয়ানিজ গির্জা-পুরোহিত কয়েক বছর পরে প্যারিসে খুব বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। ফরাসী মহিলাদের ওপর ইনি হিপনোটিজম বা সম্মোহন ক্রিয়া করে দেখাতেন, ফরাসী বিপ্লবে যুক্ত হয়ে পড়েন, কুখ্যাত Chateau d’If –এ কিছুদিন কারারুদ্ধ ছিলেন (মতান্তর আছে) আর শোনা যায় আলেকজান্ডার ড্যুমার বিখ্যাত উপন্যাস দ্য কাউন্ট অফ মন্টি ক্রিস্টো-র মহিমান্বিত চরিত্র অ্যাবে নাকি এই আব্ব্যে ফারিয়র দ্বারা অনুপ্রাণিত। 

গোয়াতে আটকে থাকলে কারুর পক্ষেই আব্ব্যে ফারিয়ার মত এত উঁচুতে ওঠা সম্ভব ছিলনা। লিসবনের উদারপন্থী সরকার ১৮৩৫ সালে বার্নার্ডো পেরেস দ্য সিলভা নামে একজনকে গোয়ার শাসনকর্তা হিসাবে পাঠায়। ওল্ড গোয়ার গ্যালারিতে এঁর ছবির তলায় লেখা আছে “ইনি ভারতীয় (নেটিভ) ছিলেন”। পর্তুগালের গোয়া উপনিবেশের ইনিই প্রথম আর ইনিই শেষ ভারতীয় শাসক। শাসনকালের সতেরো দিনের মাথায় সাদা চামড়ার আর মিশ্র-জাতির যে সব অফিসারেরা গোয়ার সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা ওঁকে এক জাহাজে চড়িয়ে দিয়ে বলেন এখান থেকে কেটে পড়। আর এর পরে ওঁর সমর্থকদের কচুকাটা করে মেরে ফেলা হয়। এই সময় থেকে ১৯৬১ সালে গোয়া পর্তুগিজ শাসন মুক্ত হওয়া পর্যন্ত অনেক স্থানীয় ক্যাথলিকেরা বিচারব্যবস্থায় আর গির্জা-পুরোহিত হিসাবে অনেক উচ্চাসনে বসেছেন, কিছু কিছু হিন্দু অকল্পনীয় অর্থসম্পদের অধিকারীও হয়েছেন, কিন্তু গোয়ার কোন ব্যক্তি কখনও গোয়াকে শাসন করার অধিকার লাভ করেননি।

এই পরিমন্ডলে ১৮২৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন গোমেজ।  স্থানীয় ক্যাথলিকেরা যতই প্রতিভাশালী হোননা কেন, পর্তুগিজ, কোঙ্কনি বা ফরাসি ভাষায় যতই সড়গড় হোননা কেন আসলে তিনি গণ্য হবেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে। কিন্তু গোমেজ তো’ শুধু নানা গুণের অধিকারীই ছিলেন না, ছিলেন প্রকৃত এক প্রতিভাশালী ব্যক্তি। কুড়ি বছর বয়স হতে না হতেই ডাক্তারি পরীক্ষা পাস করে সেনাবাহিনীতে সার্জেনের চাকরিতে নিযুক্ত হন। এর পরে বম্বে (এখনকার মুম্বাই) চলে যান সংস্কৃত ভাষা আর ভারতীয় মহাকাব্য অধ্যয়ন করার তাগিদে। ৩০ বছর বয়সে পর্তুগালের পার্লামেন্ট কর্টেস-এ নির্বাচিত হন গোয়ার দক্ষিণ তালুক এলাকার প্রতিনিধি হিসাবে। [প্রসঙ্গত জেনে রাখা ভাল যে পর্তুগালের পার্লামেন্টে উপনিবেশগুলির প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা ছিল – বৃটিশ পার্লামেন্টে যা ছিলনা বলে দাদাভাই নৌরজিকে ইংল্যান্ডে গিয়ে ভোটে দাঁড়াতে হয়েছিল] ১৮৬১ সালের শুরুতেই গোমেজ পার্লামেন্টের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্যে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে পৌঁছলেন। ওখানে পৌঁছে ৫ জানুয়ারি ১৮৬১ সালে বন্ধু অ্যালফ্যান্সো মারী ল্যুই দ্য’ প্রা দ্য’ লামার্তিন (Alphonse Marie Louis De Prat De Lamartine)-কে এক চিঠিতে ফ্র্যান্সিস্কো ল্যুই গোমেজ লিখছেন – “আমি কাব্য, দর্শন আর ইতিহাসের সৃষ্টিকালের লীলাভূমি ভারতে জন্মেছি, [আর] আজকে [সেই দেশ] এক কবরস্থান। আমি সেই জাতির সন্তান যারা মহাভারত লিখেছে, আবিষ্কার করেছে দাবাখেলা – যার মধ্যে একই সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে আছে চিরন্তন আর অনন্তের ধারণা। কিন্তু সেই দেশ, যা কবিতা আর সংহিতা অবলম্বন করে রাজনীতিকে সূত্রায়িত করেছিল সেই দেশ আজ আর জীবিত নেই।” [In a letter, written in French, to his friend Alphonse Marie Louis De Prat De Lamartine, on January 5, 1861, Francisco Luis Gomes wrote, “I was born in India, the cradle of poetry, philosophy and history, [and] today its tomb. I belong to that race which wrote the Mahabharata and invented chess – two conceptions that bear in them the eternal and the infinite. But this nation, that included in its poems and codes by which it formulated its politics … the rules of a game of chess, is no longer alive.”]

ফ্র্যান্সিস্কো ল্যুই গোমেজ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে গোয়া থেকে লিসবনে গিয়েছিলেন পর্তুগাল পার্লামেন্টের এক সদস্য হিসাবে, কিন্তু তিনি যে উপনিবেশের নাগরিক সুতরাং দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, এটা প্রথম দিনেই তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হোল পার্লামেন্টে। পার্লামেন্টের অধিবেশনের প্রথম দিনেই এক সদস্য দাবী করলেন যে উপনিবেশের অসভ্য মানুষদের সুসভ্য পার্লামেন্টে একাসনে বসার যে অধিকার সরকার দিয়েছে তা’ সরকার ফিরিয়ে নিক। গোয়া থেকে নির্বাচিত সদস্য ফ্র্যান্সিস্কো ল্যুই গোমেজ তাঁর প্রথম বক্তৃতায় এর জবাব দিলেন: “অসভ্য?” মাংসাশী ইউরোপিয়নদের তিনি জানালেন: “মানুষের মাংস নিয়ে ব্যাঙ্কুয়েট ওদেশে হয় না; বরং, এমন অনেক জাতির মানুষ ওখানে আছেন যাঁরা কোন রকম রক্ত থেকেই নিজেদের হাত দূরে রাখেন বলে মাংসজাতীয় সব খাদ্যবস্তু থেকেই দূরে থাকেন; সব প্রাণির প্রতি তাঁরা দয়া প্রদর্শন করেন।” ১৫ জানুয়ারি ১৮৬১ পর্তুগালের পার্লামেন্টে গোমেজের মুখের ওপর এক ডেপুটি অ্যাফোন্সেকা সরাসরি বলেই দিলেন যে “সমুদ্রের অপর অংশের প্রদেশগুলিকে [অর্থাৎ উপনিবেশগুলিকে] পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব দেওয়া উচিত নয়, কারণ, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ শক্তি ইংল্যান্ড তার উপনিবেশদের এই অধিকার দিতে অস্বীকার করেছে আর সাগরপারের উপনিবেশগুলি সভ্য নয়।” গোমেজ দৃঢ়ভাষায় জানালেন যে এই প্রসঙ্গে ইংল্যান্ডের যে উল্লেখ করা হয়েছে সেটা তথ্যগতভাবে ভুল আর সেই কারণে যে যুক্তির ভিত্তিতে ইংল্যান্ড উপনিবেশের মানুষদের ভোটাধিকার দিতে চায়নি সে প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বিষয়টাকে অন্যদিকে ঘুরে যেতে পারে। তিনি বলেন যে ইংল্যান্ডের যুক্তিগুলি পর্তুগিজদের কখনই অনুসরণ করা উচিত হবে না আর ভগবান যেন এই অনুসরণ করার কাজ থেকে তাদের রক্ষা করেন। তিনি দাবী করলেন “শত-সহস্র মানুষকে তাদের রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয় ………কেবলমাত্র তাদের এই দুর্ভাগ্যের জন্য যে তারা সমুদ্রের ওপারে উপনিবেশে জন্মগ্রহণ করেছে।” ভেবে দেখুন সালটা ১৮৬১, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস জন্মও নেয়নি তখন, আর গোয়ার এক ল্যুসো-ইন্ডিয়ান পর্তুগিজ পার্লামেন্টে ভোটের অধিকার প্রতিনিধিত্বের অধিকার সুরক্ষিত রাখার দাবী করছেন! আজকের ভাষায় একেই কি আমরা ‘বহুমুখী জাতীয়তাবাদ’ বলবো না?

পার্লামেন্টে তাঁর বাগ্মীতার জেরে লিসবনে অনেকেই গোমেজের গুণগ্রাহী হয়ে ওঠেন। জন স্টুয়ার্ট মিলের সঙ্গে উনি সাক্ষাৎ করেন, ফরাসী ঔপন্যাসিক অ্যালফ্যান্সো দ্য লামার্টাইনের সঙ্গে পত্রালাপ শুরু হয়, ইকনমিক থিওরি-র ওপর ফরাসী ভাষায় বই লেখেন আর ১৮৬৬ সালে পর্তুগিজ ভাষায় Os Brahmanes (দ্য ব্রাহ্মিণস) উপন্যাস সমাপ্ত করেন।       

“ভারত যা একসময়ে ছিল কাব্য, দর্শন আর ইতিহাসের সৃষ্টিকালের লীলাভূমি সেই দেশে জন্মেছিলাম আমি। আর আজ সেই স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে এসবের কবরস্থান।”…… “আমি সেই জাতির সন্তান যারা মহাভারত লিখেছিলেন, আর আবিষ্কার করেছিলেন দাবা খেলা – চিরন্তন আর অনন্তের এমন দুটি ধারণা যার মধ্যে একইসঙ্গে অঙ্গীভুত হয়ে আছে।” এই কথা যিনি বলতে পারেন সেই যুবকের বাসভূমি যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের উপনিবেশে পরিণত হয়েছে তার মূল কারণ এই দেশেরই দুর্বলতা – “ভারত আজ কারারুদ্ধ” – কিন্তু এই তরুণ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা এই দেশের পুনর্জাগরণে বিশ্বাসী – “ভারতের জন্য, মুক্তির জন্য, জ্যোতির জন্য আমি প্রার্থনা করি।”

ওপরের এই কথাগুলো আবারও লিখলাম এটা মনে করিয়ে দিতে যে ১৮৬১ সালে লেখা এই কথাগুলো যেন কলকাতা বা লন্ডনে বসে এক উচ্চবর্ণীয় বাঙালি হিন্দু লিখছেন এটা ধরে নেওয়া খুবই স্বাভাবিক। আসলে মনে নাড়া দেওয়া এই কথাগুলো লেখা হয়েছে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে, আর লিখেছেন যিনি তিনি এক গোয়াবাসী খ্রিস্টান ক্যাথলিক তরুণ, ফ্র্যান্সিস্কো ল্যুই গোমেজ। এই তরুণ গোয়াবাসী পর্তুগিজ ভাষাতেও উপন্যাস লিখে প্রকাশ করেছেন। তাঁর লেখা Os Brahmanes (দ্য ব্রাহ্মিণস) খুব সহজেই ভারতের অন্যতম প্রথম উপন্যাস হিসাবে গণ্য হতে পারে।

অযোধ্যার এক শহর ফৈজাপুরের পটভূমিকায় লেখা Os Brahmanes (দ্য ব্রাহ্মিণস) এই উপন্যাস ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহকে নিয়ে লেখা। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মাগনোদ, গৃহস্থবাড়ির এক ব্রাহ্মণ চাকর আর তার আইরিশ মনিব রবার্ট ডেভিস। মাগনোদ এসেছে এক অতি প্রাচীন সমৃদ্ধ সমাজ থেকে, কিন্তু এই সমাজ যে কতটা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে তার এক উদাহরণ সে নিজে। মাগনোদ বর্ণ-জাতিগত বিশুদ্ধতা রক্ষা করার প্রশ্নে একেবারে অনড়। “এই প্রশ্নে তার পাগলামি এতটাই গভীর যে অকিঞ্চিৎকর প্রাণীদের প্রতি যতটা সহানুভুতি সে প্রকাশ করে সেটাও সে শূদ্র ও পারিয়াদের ক্ষেত্রে দেখাতে চায় না।” তার সাদা চমড়ার মালিক আবার আর এক ধরণের ব্রাহ্মণ, তার পাগলামি চামড়ার রঙ নিয়ে –“রবার্ট মাগনোদের সঙ্গে ইংরিজিতে কথা প্রায় বলতই না, আর প্রায়শই তাকে রঙ্গীন ভদ্রলোক এই অভিধায় অভিহিত করত।” এই দুই পাগলের মধ্যে সংঘাত অবশ্যম্ভাবী ছিলই আর সেই বিদ্রোহ ফেটে পড়ল যখন উপন্যাসটি সমাপ্ত হল। এই উপন্যাসে গোমেজ ইউরোপিয়ন পাঠকদের জন্য মহাভারত আর হিতোপদেশ খুব বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

গোমেজ চেয়ে ছিলেন যে তাঁর ইউরোপিয়ন সেই সব পাঠকেরা, যারা ১৭৫৬ সালের কলকাতার ব্ল্যাক হোল ট্র্যাজেডির মত ভয়ংকর সব কাহিনীর সঙ্গে পরিচিত, তারা ১৮৫৭-র বিদ্রোহ বিষয়ে একটা তুল্যমূল্য দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করবেন: “সেই সব নিরপেক্ষ ব্যক্তি, যাঁরা জাতির জন্য নয় বরং মুক্তির জন্য পরোয়া করেন, তাঁরা চান যে ভারত ভারতের জন্য থাকুক, আর ঘৃণা করুন সেইসব অত্যাচারিদের যাদের নবাব অথবা ক্লাইভ যে নামেই ডাকা হক না কেন।”

গোমেজের ঝোঁক ছিল রচনা আর বাগ্মীতার দিকে। উপন্যাসের একটা অংশ প্রাচ্যের পলায়নী মনোবৃত্তির পরিচায়ক। মাগনোদ শেষমেশ এক ঠগী হয়ে যায়, আর রবার্টের আত্মীয়রা জড়িয়ে পড়ে এক রোম্যান্টিক সাব-প্লটে। এই উপন্যাসে যখনই গোমেজ গল্প বলা থেকে সরে এসে ভারত ও বিশ্ব প্রসঙ্গে মতামত দিতে গেছেন তখনই তাঁর চিন্তন ও মেধার ঔজ্জ্বল্য প্রকাশ পেয়েছে। তিনি লিখছেন: “বলা হয় যে ইউরোপিয় সভ্যতা খৃষ্টের আইন দিয়ে পরিচালিত হয়। এই কথাটি আদৌ সত্য নয় – এশিয়া আর আমেরিকাকে পায়ের নিচে পিষে মেরেছে ইউরোপ, আর এরা সবাই মিলে পিষে মেরেছে হতভাগ্য আফ্রিকাকে – আফ্রিকার কালো জাতির মানুষেরা ইউরোপ আর আমেরিকার ব্রাহ্মণদের কাছে অছ্যুত।” এই অন্ধকারাছন্ন পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসার পথ কোথায়, তাহলে? গোমেজ যিনি হিন্দুত্বকে অপচয়িত শক্তি বলে মনে করতেন তিনি এই প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষা আর খৃস্টানত্বের দিকে নির্দেশ করেছিলেন।

গোমেজ পর্তুগীজ নাগরিক ছিলেন, ১৮৬০ থেকে ১৮৬৯ অবধি তিনি তিন-তিনবার যে কোর্টেসে নির্বাচিত হয়েছিলেন তাই নয়, পর্তুগালের উদারপন্থী প্রধানমন্ত্রী দ্য মারক্যুইসফ পোমবাল-এর এক জীবনীগ্রন্থও লিখেছিলেন। কিন্তু শুধু এই কারণে তাঁকে কোন ভাবেই ইংল্যান্ডের হাউস অফ কমনসে নির্বাচিত জাতীয়তাবাদী দাদাভাই নৌরজীর থেকে কম ভারতীয় বলা যায়না। গোয়াতে গোয়ার লোকেরা সবসময়েই গোমেজকে তাদেরই একজন বলে ভেবে এসেছে। গভর্নর আর শ্বেতকায় বড় বড় লোকেরা যেখানে উপস্থিত থাকবেন গোমেজের সম্মানে আয়োজিত এমন এক সম্বর্ধনা সভায় ধুতি পরে উপস্থিত হয়ে তিনি কি বার্তা দিয়েছিলেন তা এখনও সবাই মনে রেখেছে। 

১৮৬৯ সালে তাঁদের প্রিয় সন্তান গোমেজ গোয়াতে ফিরে আসছেন এই খবর পেয়ে গোয়ানীজেরা বম্বেতে সমবেত হয়েছিলেন। তাঁরা দেখলেন যে জাহাজ এসেছে খালি। জাহাজেই টিউবারক্যুলোসিসে আক্রান্ত গোমেজ মারা যান আর ওঁকে ভূমধ্যসাগরে সলিল সমাধি দেওয়া হয়। তখন ওঁর বয়স মাত্র চল্লিশ বছর।

ফ্র্যান্সিস্কো ল্যুই গোমেজকে গোয়ার শ্রেষ্ঠতম সন্তান হিসাবে অনেকেই মনে করেন। গোয়ার এমন এক ক্যাথলিক ব্যক্তি, যিনি লেখালেখি করেছেন পর্তুগিজ ও ফরাসী ভাষায়, তাঁকে জাতীয়তাবাদী এক ব্যক্তিত্ব হিসাবে মেনে নিতে আজকে অনেক ভারতীয়েরই কপালে ভাঁজ পড়ে যাবে। আর এর থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় ভারতীয়ত্ব বিষয়ে আমাদের এখনকার ধারণা। গোয়া হচ্ছে স্ফূর্তির এক জায়গা – ওখানে যাও মৌজ-মস্তি করো – কলকাতা বা দেশের অন্য বহু জায়গায় যা করতে পারা যায়না তা ওখানে গিয়ে করতে পার কোনরকম মানসিক বা সামাজিক সঙ্কোচ বাদ দিয়ে। কিন্তু এই গোয়ায় যে লুকিয়ে আছে সংস্কৃতির এক বিরাট অনাবিষ্কৃত সম্ভার তার খোঁজ রাখতে কারই বা ইচ্ছে আছে। আর এই সব সংস্কৃতি যারা সৃষ্টি করেছে তারা অধিকাংশই আবার ক্যাথলিক খ্রিস্টান, লেখালিখি করেছে পর্তুগিজ ভাষায়, পর্তুগালের চাল-চলন জীবনযাত্রার অনেকটাই এরা গ্রহণ করেছে। সুতরাং এদের ভারতীয় বলে গ্রহণ করতে একটা অনীহা মনের গভীরে থেকে যায় অনেকেরই। কিন্তু ভারতের সংস্কৃতি কোনকালেই একরঙা ‘মোনোক্রোম্যাটিক’ সংস্কৃতি ছিলনা, আর ছিল না বলেই তার বহুবর্ণের ছটা বিশ্বকে বিমোহিত করেছে এই সত্যকে আজ সকলের সামনে তুলে আনতে হবে। ঐ ছোট্ট একটি প্রদেশ গোয়া যেমন আমাদের বিমোহিত করে দেয় তেমনই ভারতের সব প্রান্তের সব মানুষের জীবনের ঔজ্বল্য আমাদের গর্ব হয়ে উঠুক।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thirteen − 3 =