চন্দ্রিমার গোয়েন্দাগিরি
তপনকান্তি মুখোপাধ্যায়, আরামবাগ, হুগলী ##
ইস্কুল থেকে ফিরে চন্দ্রিমা দেখল, বাড়িতে হুলুসথুলুস কান্ড চলছে। ঠাকুরমা ছাদ থেকে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। মাও ছাদে। নীচে কাজের রানুমাসি বাসন মাজতে মাজতে গজগজ করছে, ‘ কাউকে না পেয়ে আমাকেই সন্দেহ? আমি কি চোর? ‘ চন্দ্রিমা বুঝল, ঘটনাটা ছাদেই ঘটেছে। কাঁধ থেকে বইয়ের ব্যাগটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে সে ছুটল ছাদে।
চন্দ্রিমাকে দেখেই ঠাকুরমা তাকে জড়িয়ে ধরে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলতে লাগল, ‘ সকালে তিন শিশি আমের আচার রোদে শুকুতে দিয়েছিলাম। বিকেলে তুলতে গিয়ে দেখি, একটা শিশি নেই। যাবে কোথায় বল? শিশির তো আর হাত – পাও নেই, ডানাও নেই। ওই রানুই ছাদে কাপড় শুকুতে দিতে এসে শিশিটা সরিয়েছে। ‘ চন্দ্রিমা বলল, ‘ তুমি কি নিজের চোখে দেখেছ রানুমাসিকে শিশিটা নিতে? তাহলে তাকে দোষারোপ করছ কেন? ‘ মা বলল, ‘ চন্দ্রিমা, নীচে যাও। জলখাবার খেয়ে নাও।’ অগত্যা নীচে নেমে এল চন্দ্রিমা। খেতে খেতে ভাবতে লাগল, কে শিশিটা নিতে পারে।
এবার ক্লাসে প্রথম হয়েছে বলে বাবা চন্দ্রিমাকে তুষারকান্তি পান্ডের ‘ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা গল্প’ বইটি কিনে দিয়েছে। বই পড়ে চন্দ্রিমার খুব গোয়েন্দা হবার শখ। এবার তার সামনে একটা সুযোগ জুটে গেছে। শিশিটা খুঁজে বার করতেই হবে।
রাত্রে চন্দ্রিমা ঠাকুরমার কাছে শোয়। গল্প করতে করতে জেনে নিল, ওইদিন মানালি, শ্যামলী আর মিতালি দুপুরে ছাদে উঠেছিল হেলিকপ্টার দেখতে। আর এসেছিল মধু ছাদে কাটা ঘুড়ি পাড়তে। সকালে চন্দ্রিমা ছাদে গেল সবকিছু ভালোভাবে পরীক্ষা করতে। দেখল, ছাদের এককোণে একটা চোষা আমের চোকলা পড়ে আছে। কে খেল? সন্দেহের তিরটা মানালিদের দিকে যাচ্ছে না, কারণ ওরা তিনজন ছিল। তাহলে হয় মধু নয় রানুমাসি।
পরের দিন রবিবার। দুপুরে রাস্তায় বেরিয়ে দেখল, মানালিরা তিনজনে এক্কা – দোক্কা খেলছে । একথা সেকথার পর চন্দ্রিমা বলল, ‘আমাকে কেউ একটু আমের আচার খাওয়াতে পারিস? পেট খারাপ বলে আমাকে কেউ খেতে দিচ্ছে না’ । মানালি বলল, ‘আমসত্ত্ব খাওয়াতে পারি। আমার পকেটেই আছে। ‘শ্যামলী বলল,’কুলের আচার খাবে ? মহিমদাদুর দোকান থেকে কিনে আনতে পারি।’ চন্দ্রিমা বলল, ‘না না। কিনে খাওয়াতে হবে না।’ মিতালি বলল, ‘তোমাদের ছাদে তো তিন শিশি আচার দেখলাম রোদে শুকুচ্ছে। লুকিয়ে খেয়ে নিতে পার তো?’ শ্যামলী বলল, ‘এমা, ছি ছি। সেটা তো চুরি করা হয়ে যাবে। চুরি করা পাপ। ‘ চন্দ্রিমা বুঝল, আচারের শিশি এরা চুরি করেনি। কারণ এরা তিনজনে একসঙ্গেই ছিল। সে ওখান থেকে রিতাদের বাড়ি যাবার জন্য রওনা দিল।
পথে যেতে যেতে মধুর সঙ্গে দেখা। সে গাছে উঠে খেজুর পাড়ছিল। চন্দ্রিমা বলল, ‘আমাকে দুটো খেজুর দিবি? আমি তোকে আমের আচার খাওয়াব। ‘মধু বলল, ‘আমি আমের আচার খাই না। জিব কুটকুট করে। এই নে খেজুর। ‘খেজুর খেতে খেতে চন্দ্রিমা ভাবল, মধু তাহলে চুরি যাওয়া আচারের শিশি নেয়নি। তাহলে নিশ্চয়ই রানুমাসি নিয়েছে। চন্দ্রিমা বাড়ি ফিরে এল।
চন্দ্রিমা ছাদে উঠল। রানুমাসি কাল নিশ্চয়ই গোলমালের মধ্যে শিশিটা নিয়ে যেতে পারেনি। কোথায় রাখল শিশিটা? তন্নতন্ন করে খুঁজতে গিয়ে চন্দ্রিমা দেখল পিঁপড়ে সারি দিয়ে ছাদের চিলেকোঠা ঘরে ঢুকছে, বেরোচ্ছে। ওই ঘরে ঢুকে চন্দ্রিমার চক্ষু চড়কগাছ। পুরোনো খবরকাগজের স্তুপের ভিতর লুকানো আছে আচারের শিশিটা। আজ নিশ্চয়ই সন্ধ্যায় বাড়ি যাবার সময় রানুমাসি নিতে আসবে শিশিটা। তক্কেতক্কে রইল চন্দ্রিমা ।
ছাদ থেকে চন্দ্রিমা দেখল, রানুমাসি বাড়ি যাচ্ছে। তাহলে আজও নিয়ে যাচ্ছে না শিশিটা। ছাদ থেকে নামতে যেতেই কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পেল চন্দ্রিমা। সে দরজার কোণে লুকিয়ে পড়ল। দেখল চিলেকোঠার ঘরে ঢুকে একজন টর্চ জ্বেলে কাগজের স্তুপ ঘাঁটছে। চন্দ্রিমার হাতের কাছেই স্যুইচবোর্ড। টুক করে আলো জ্বেলে যা দেখল তাতে সে তাজ্জব হয়ে গেল। মুখ থেকে শুধু একটা কথাই বের হল, ‘বাবা ? ‘
ধরা পড়ে বাবা বলল, ‘ কাউকে যেন বলিসনি। আমার রোগের জন্য তোর মা- ঠাকুরমা আমাকে আচার দেয় না, কিন্তু খুব খেতে ইচ্ছে করে। তাই …। তোকে আমি শার্লক হোমস সমগ্র কিনে দেব।’
শার্লক হোমস আমার স্বপ্নের গোয়েন্দা। তাঁর বই পেতে চন্দ্রিমা যে কোনও ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। তাই কী ভাবে শিশিটা পেল না বলে শুধু ঠাকুরমার হাতে শিশিটা তুলে দিয়ে বলল, ‘এই নাও।’ ঠাকুরমার সেই মুহূর্তের ফোকলা দাঁতের স্বর্গীয় হাসি চন্দ্রিমা কখনও ভোলেনি।
দারুণ