চিকিৎসক

শারদীয়া ভট্টাচার্য ##

– চিকিৎসার ব্রত নিয়েছিলাম। সাধ্যমত তা পালন করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এই দিন যে দেখব এই ছোট্ট জীবনে, তা সত্যিই ভাবিনি কোনোদিন। বলতে গিয়ে কেঁদেই ফেললেন বছর ত্রিশের ডাক্তার নৈতিক রায়। সুঠাম চেহারার মানুষটিকে অসহায়ের মত কাঁদতে দেখে কী বলবেন ভেবে পেলেন না থানার ওসি সাহেব।

– আপনি ভাববেন না ডঃ রায়। আমরা দেখছি। ওসি আশ্বস্ত করলেন নৈতিকের হাতে আলতো চাপ দিয়ে।

– না না না… ভুল আমারই। আমি এতদিন পরেও কীভাবে যে বুঝতে ভুল করলাম… ডাক্তারদের লোভ করতে নেই। আমি তাই করে ফেলেছি অফিসার।

বাইরে তখনও রীতিমতো গোলমাল চলছে। পুলিশ থামানোর চেষ্টা করেও পারছে না। উন্মত্ত জনতা পারলে হাসপাতাল ভেঙে ফেলবে বলেই মনে হচ্ছে। 

ডাক্তারি পাশ করে এই কমলতলীর গ্রামীণ হাসপাতালে পোস্টিং হয়েছিল নৈতিকের। খুব মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল প্রথমে ওর। দক্ষিণ কলকাতার ছেলে নৈতিক।  এই গণ্ডগ্রামে একা একা এসে থাকতে হবে, ভেবেই গা শিউরে উঠেছিল ওর। সন্ধের পর যার সাউথ সিটি বা এইট বি বাসস্ট্যান্ডে না গেলে ভাত হজম হয় না, তাকে কিনা সন্ধের পর মশা মেরে কাটাতে হবে? ডাক্তারির আজীবনের স্বপ্ন মুহূর্তে উবে গিয়েছিল ওর। 

কি আর করা! ‘যেতে যদি হয় হবে হবে হবে গো’ মনোভাব নিয়ে বাক্সপেটরা গুছিয়ে পাড়ি দিয়েছিল নৈতিক। 

প্রথম প্রথম অথৈ সাগরে পড়ার মত অবস্থা হয়েছিল তার। কমলতলী হাসপাতালে সবই আছে, নেই চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত। কত আধুনিক পদ্ধতি এখন চিকিৎসাশাস্ত্রে। সেসব শিখেও কাজে লাগাতে না পারার যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খেত। নিজে কাজ জেনেও উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে কত রোগীকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিতে হয়েছে। একদম ভালো লাগত না নৈতিকের।

তার ওপর উপরি পাওনা ছিল একাকীত্ব। হাসপাতালের সহকর্মী ডাক্তার যে সংখ্যায় অনেক তা তো নয়। যে কজন আছেন তারা সকলেই এক দুটো গ্রাম পরের শহরতলির বাসিন্দা। বাড়ি থেকে যাতায়াত করেন। ফলত ডিউটি ছাড়া সে বড্ড একা হয়ে পড়েছিল। গল্পের বই পড়ে, নেট ঘেঁটে কতক্ষণ… কতদিন কাটানো যায়! নৈতিকের ভাষায় জীবনটা ডালভাত হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু ক্রমে সাদাকালো রঙ বদলে দিল কমলতলীর মানুষ। এখানকার দীনহীন মানুষগুলোর আর কিছু না থাক আছে একটা মস্ত সৎ মন। তারা আপন করে নিল এই নতুন ডাক্তারবাবুকে। 

-ডাক্তারবাবু নাকি একা থাকেন? আমার বউ খাবার পাঠিয়ে দেবে কেমন?  আউটডোরে দেখাতে এসে বলেছিল হীরু নাপিত। 

হোসেন মিঞা যেদিন একদিন ঝুড়ি ভরতি আম নিয়ে এসে হাজির হয়েছিল হাসপাতালেই, সেদিন যারপরনাই অপ্রস্তুতে পড়েছিল নৈতিক। 

-এসব কেন এনেছেন? বলে অস্বস্তি মিশ্রিত উষ্মা প্রকাশ পেতেই হোসেন মিঞার দুচোখ বোঝাই জল। উফফ আরেক জ্বালা হল!

অশিক্ষিত মানুষগুলোর এই অযাচিত আপ্যায়ন শহুরে কেতাদুরস্ত ছেলেটিকে প্রথমে অস্বস্তিতে ফেললেও ক্রমে সেটাই যাপনে পরিণত হল। 

নৈতিক হাসপাতালের ডিউটি ছাড়াও অবসর সময়ে এপাড়া ওপাড়া ঘুরে সাধ্যমত চিকিৎসা করে বেড়াত। ডাক্তারবাবু একবার নাড়ী ধরলেই নাকি মুখ্যু লোকগুলোর রোগ ভয়ে পালায়।

কত অল্পে এরা খুশি থাকতে পারে! ভাবে নৈতিক। সে জানে না খেতে পেয়ে আলসার হয়ে যাওয়া, কিংবা ক্রিটিকাল প্রেগন্যান্সির হাড়গিলে চেহারার পেশেন্টদের জন্য কত উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। অথচ কতটুকুই বা করতে পারে সে? পরীক্ষাগুলোই ঠিকমতো করাবার পয়সা নেই এদের কাছে! আরও বেশি নেই ইচ্ছে! 

 এখানকার অন্ধ কুসংস্কার দেখে চমকে ওঠা নৈতিকের স্বপ্ন দেখার দিক বদল ঘটতে লাগলো ধীরে ধীরে। এই গ্রামের মানুষদের মধ্যে জ্ঞান বা বিজ্ঞানের আলো জাগাতে চেষ্টা করেই দেখা যাক না। 

– বলেন কী ডাক্তারবাবু? ভূতে পায় না? ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকা লোকগুলো বিশ্বাস করতে না চাইলেও ডাক্তারবাবুর কথা অমান্য করতে তো পারে না। 

 কত যে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে তার! সবচেয়ে মজা লেগেছিল সেদিন, যেদিন দেবু হোড়ের বউকে সাপে কামড়েছিল। 

রাত তখন আটটা সাড়ে আটটা হবে। রোগিনীকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠেছিল নৈতিক, এ তো সাপের কামড়। 

সকলে হাঁ হাঁ করে উঠেছিল। যেন মানুষ খুনের অপরাধ করেছে ডাক্তারবাবু। এক অভিজ্ঞ সহকর্মী বুঝিয়ে দিলেন, সাপকে রাতে লতা বলতে হয়। সাপ বললে বিপদ বাড়ে। 

ততদিনে এদের চিনে গেছে নৈতিক। ফলে অবাক হওয়ার চেয়ে মজা পেয়েছে বেশি।

এসবের পরেই সে নতুন ব্রতে উৎসাহ হয়েছে। এখানে না এলে জানতেই পারত না সত্যিই এত অজ্ঞানতার অন্ধকারে মানুষ আজও নিমজ্জিত।

এত ভালোবাসে যারা, তাদের জন্য কিছু করা যাক। তাই অবসরকে এভাবেই কাজে লাগিয়ে দিন কাটাত নৈতিক। সবাই তাকে খুব মান্যি করে। আগেকার দিনে যেমন দেখা যেত গল্প উপন্যাসে, তেমন যে আজও হয় তা এই অজ গাঁয়ে না এলে অজানা থেকে যেত নৈতিকের। সে নিজেও এমনভাবে কাজে লাগাবে তার শিক্ষাকে তাও কোনোদিন ভাবতে পারেনি। সত্যিই মানবজীবন বড়ই অপ্রত্যাশিত! পথ চলতে বাঁকের আড়ালে কোন চমক লুকিয়ে থাকে আগে থেকে তা কেউ বলতে পারে না।

বেশ কেটে যাচ্ছিল দিন। তবু মানুষের চাওয়ার তো শেষ নেই৷ নৈতিকও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই বড্ড লোভ করে ফেলেছিল। একটু সুখের। একটু আরামের। সেই চাওয়াই আজকের এই ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করল। 

কমলতলীর প্রতিটা আনাচকানাচ ভেঙে পড়েছে হাসপাতালের সামনে। 

কেউ কেউ নাকি কানাঘুষো শুনেছিল। কিন্তু পাত্তা দেয়নি। ভেবেছিল মানুষটা এরকম করতেই পারে না। ডাক্তারকে তারা কেউ দেবতার আসনে তো কেউ নিজের ছেলের আসনে বসিয়েছিল। সেই মানুষটা একবারও ভাববে না ওদের কথা? এ হতেই পারে না। 

সরল মানুষগুলোর বিশ্বাস এমনই দৃঢ় যে তারা শুনেও বেমালুম উড়িয়ে দিয়েছে কথাটা।

কিন্তু আজ যখন সেই কানাঘুষো সবার সামনে সত্যি হয়ে প্রকাশ পেল তখন ফেটে পড়েছে তারা।

-এটা ডাক্তারবাবু অন্যায় করেছেন। আমরা ওনাকে ছাড়ব না।

 সমানে চিৎকার করছে পোশাকি কথা না জানা লোকগুলো। 



আসলে নৈতিক এখানে মিশে গেলেও শহর, আধুনিক চিকিৎসার অভিজ্ঞতার হাতছানি তার অন্তরকে বশ করেছিল। অনেক তদবিরের পর অবশেষে ট্রান্সফার পেয়ে আজ তার চলে যাওয়ার দিন। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

9 − 4 =