ছুটির গহীনে ভেসে থাকা কথা
স্বপন সাহা, মধ্যমগ্রাম, উত্তর ২৪ পরগনা ##
রাতের ট্রেনে ছোট্ট একটা ঘুমেই পৌছে যাওয়া যায় এই শহরে। সেই অনুযায়ী আমাদের সব আয়োজন ছিল হাওড়া স্টেশন থেকে। চোখ কচলাতে কচলাতে পিঠের ব্যাগ নিয়ে ধানবাদ স্টেশনে নামতেই হাতের হাত ঘড়ির সময় দেখি ভোর তিনটে কুড়ি মিনিট। এক মিনিট-ও লেট না করে ট্রেন আমাদের নামিয়ে দিয়ে কু-ঝিকঝিক করতে করতে দূর অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। অতঃপর, রিটায়ারিং রুমে একটু বিশ্রাম নেওয়া। নতুন ভোরের আলো ফুঁটতেই, একটা গাড়ি ঠিক করে বেরিয়ে পড়লাম আমরা ছয়-জন।
অদেখা ঝাড়খণ্ডে আমাদের প্রথম গন্তব্য ভাতিন্ডা ফলস। সদ্য উদীয়মান সূর্যের নরম কুসুমরাঙা আলো ঠিকরে পড়ছে ফলসের জলের উপর। ত্রি-স্তরীয় এই ফলসটি অসাধারণ নয়নাভিরাম, সারারাতের ক্লেশ এক লহমায় শুষে নিয়ে ভরিয়ে দিল প্রাণ- চাঞ্চল্য। শীতল জল নিয়ে চলল শৈশবের মত আনন্দ উপভোগ আর চলল প্রাণ ভরে ছবি নেওয়া।
![](http://www.abekshan.com/wp-content/uploads/2020/04/1585637963778_IMG_20190811_064907-01-1024x576.jpeg)
এরপর আমরা চললাম রাজরাপ্পার দিকে।যাওয়ার পথের দু’ধারে মালভূমির সৌন্দর্য্য, মোলায়েম পিচের রাস্তা আর ঝিরঝিরে হঠাৎ-হঠাৎ বৃষ্টি—এইসব প্রাকৃতিক কোলাজ আমাদের ভুলিয়ে দিল শহুরে সিলেবাস। আমাদের হৃদয় তখন লগ্নি করছিল নির্ভেজাল সুখের কাছে। রাজরাপ্পায় ঢুকবার মুখে একটা দোকান থেকে প্রাতরাশ সারলাম সদ্য ভাজা কচুরি, জিলিপি ও অসাধারণ মোষের দুধের সন্দেশ খেয়ে। মন্দিরে ঢুকবার চেষ্টা করলাম না কারণ আজ ছুটির দিনে অগণিত ভক্তদের বিশাল ভিড় রয়েছে। মন্দিরের পিছনের ঘাটে সারি সারি বাঁধা আছে ছোটো ছোটো নৌকো। তারই একটাতে প্রতিজনা ত্রিশ টাকা হিসেবে উঠে পড়লাম। মাঝিদাদা প্রথমেই নিয়ে চলল, ভৈরবী নদী ও দামোদর নদের সঙ্গমস্থলে।
ভেরা অর্থাৎ ভৈরবী নদী যেন আকূল আকুতি নিয়ে অবিরাম লাফিয়ে পড়ছে দামোদর নদের উপরে।
![](http://www.abekshan.com/wp-content/uploads/2020/04/IMG_20190811_104929-01-1024x576.jpeg)
খানিকক্ষণ নৌকাবিহার চলল, দু’পাশে ক্ষয়িষ্ণু পাথরের পাচিলের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া দামোদর নদের ওপর দিয়ে। একটি তীরে আমাদের নৌকো ভিড়লে, বেশ কসরত করে উপরে উঠলাম। দু’চোখের সম্মুখে সমগ্র দৃশ্যপট ধরা পড়তেই তৃষাতুর নয়নে চেয়ে রইলাম।
হাত ঘড়ির সময় জানান দিচ্ছে এখন সময় দুপুর একটা। গাড়ি আবার ছুটল। ধানবাদের হীরাপুর বাজারের তিওয়ারী হোটেলের উদ্দেশ্যে। সেখানের মাটন কষা নাকি বহু বছর ধরে সুপার হিট! অবশ্য সেখানে পৌছে দেখা গেল চার-চারটি তিওয়ারী হোটেল! বেশ কষ্ট করে আসল তিওয়ারী হোটেল খুঁজে বার করে, সেখানের পুরোনো ধাঁচের ঘরে চেয়ার-টেবিলে বসে সেরে নিলাম দ্বি-প্রাহরিক আহার। শেষ পাতের টক দইটুকুও চেটেপুটে খেতে হলো।
![](http://www.abekshan.com/wp-content/uploads/2020/04/IMG_20190812_134028-01-1024x576.jpeg)
আবার আমরা ছয় সওয়ারী পথে, ছুটে চলেছি পরেশনাথ পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। গাড়ির সাউন্ড সিস্টেমে আদিবাসী মাদল, আর বাইরে তখন দুনিয়া কাপাচ্ছে তুমূলধারার বৃষ্টি। মন চাইছিল, বৃষ্টির জলের কাছে যাই, ভিজি, নীল নির্জনের বাসিন্দারা ওই যে অথৈজলে ভাসছে, সেথায় হারিয়ে যাই। কিন্তু, যে সাবধানী-নিশ্চিন্তে গোলকধাঁধায় জীবন আমাদের বাঁধা, সেথা হতে ওথা যাওয়া বড়ই দু:সাধ্য।
![](http://www.abekshan.com/wp-content/uploads/2020/04/1585637929029_IMG-20190815-WA0079-01-1024x768.jpeg)
সন্ধে হবে-হবে এমন সময়ে আমরা মধুবন এসে পৌছলাম। রাতের আস্তানা হিসেবে বেছে নিলাম একটি জৈন ধরমশালা। ঘন সন্ধ্যায় এই ঐতিহাসিক আঙিনায় কাঠের বেঞ্চিতে বসে, মোষের দুধের চা সহযোগে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় চলল অসম্ভব ভালো আড্ডা।পরদিন খুব ভোরেই বেড়িয়ে পড়লাম পরেশনাথ পাহাড় ট্রেকিং-এর উদ্দেশ্যে। এই পাহাড়টি জৈন ধর্মাবলম্বীদের কাছে খুবই পবিত্র কেননা 23 তম জৈন তীর্থঙ্কর পরেশনাথ এই পাহাড়েই সাধনা করে মোক্ষ লাভ করেছিলেন। আমরা অবশ্য ‘শীতলনালা’ পর্যন্ত গিয়েছিলাম যা কিনা পাহাড়ের পাদদেশে থেকে 6 কিমি দূরে অবস্থিত।
![](http://www.abekshan.com/wp-content/uploads/2020/04/IMG_20190812_085300-01-576x1024.jpeg)
আকাশ মেঘলা থাকার জন্য, আমরা পাহাড়ে চলাকালীন বারবার হালকা মেঘের পর্দায় ঢাকা পড়ছিলাম। ‘শীতলনালা’র শীতল জল আমাদের কষ্ট মুছে দিল। একটি পাহাড়ী দোকান থেকে নিম্বুপানি খেয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। কিছুক্ষনের জন্য তোপচাচি লেক ঘুরে, বিকেল 4 টে 25 এর ব্ল্যাক ডায়মন্ড ধরবার জন্য আমাদের গাড়ি ছুটল। ট্রেনে নির্ধারিত সিটে বসে জমজমাট আলোচনা চলছে পরবর্তী ভ্রমণ কোথায় হবে-সেই সম্পর্কে। কে না জানে-বাঙালী ভ্রমণ শেষে ফেরার পথেই পরেরটা ঠিক করে রাখে!
অসাধারণ মন ভালো করেদেওয়া লেখা যেটা পড়ে এই সময়ে ঘরেবসে মানস ভ্রমন হয়েগেলো।