জঙ্গলে একা

জয়িতা ভট্টাচার্য

মন্দিরা কষ্ট করে চোখ মেলে।দূরাগত ধ্বনি শোনা যায়।আরতির ঘন্টা বাজে ।সন্ধ্যা হয়ে গেছে?নাকি মঙ্গলাচরণ।আবছা।অস্পষ্ট সব।

     এভাবেই আবছা হয়ে থাকে দিনভর। দিন রাত বোঝা যায়না। ঘাড় বেঁকিয়ে দেখে অনেক ওপরে।একটা ঘুলধুলি ।অস্পষ্ট আলো।এক আলোকবর্ষ পেরিয়ে অন্য আলোকবর্ষে ভেসে যাওয়া।

এখানে চার।তিনটি মসিলিপ্ত দেওয়াল ,একটা ছেঁড়া মাদুর। এক ঘটি জল ।দুর্গন্ধ ,পোকা ভাসে।

   মন্দিরার পেচ্ছাপ পায়।কোণের দিকটা সরে যায় বুকে হেঁটে।পৌঁছতে সময় লাগে।চাপতে পারেনা আজকাল। হরহর করে করে ফেলে ।ঘটিটা গড়িয়ে জল। তবু হাইড্রোক্লোরিক এ্যাসিডের বাষ্প পাক খায়। মন্দিরা একটা সরীসৃপ। মানুষ ছিলো অনেকদিন আগে। ঠং করে আওয়াজ হলো।

উর্দিপড়া মেয়ে মানুষগুলো তার ব্যাপারে ঢিলে ঢালা। মুক্তির সব পথ রুদ্ধ হয়েছে তার।

_____” মন্দিরাদি খেয়ে নাও “

রোজকার মতো সে থুতু ছিটিয়ে দেয় ওদের দিকে।ওরা হাসতে হাসতে চলে যায়।

মুখ বদলে যায়।উষা,বিপাশা,মালতি —-

পুষ্পা বা সোমা।ওরা একটাই মানুষ। উর্দি প্রজাতি।

মাছি তাড়ায় মন্দিরা। কোমড়ের নীচে থেকে অসাড় আজকাল।মন্দিরা ন্যাড়া হয়ে থাকে। কামানো ।ওরা আর চুলের মুঠি ধরে না আজকাল।দিন পাল্টেছে।তবু পোকা হয়।গায়ে,মাথায়,কম্বলে ক্ষুদ্র পোকার  দল।কুৎসিত সংক্রমণ হয়।

সেল নং ১০৬। তার ঠিকানা শেষ কুড়ি বছর।পরিবর্তন তারও হয়েছে এত কবছরে ।বছর পাঁচেক আগের কথা।

___” দিদি কাল মানবাধিকার কমিশনের লোক আসবে তোমাকে দেখতে ।”

এসেছিলো চার পাঁচজন ।

মালবিকা গুপ্তা ,রেশমি খাণ্ডেলওয়াল,দিপীকা সেনগুপ্ত ।তখন কোমড়ে চেন পড়ানো থাকত।পা দুটো একেবারে অবশ হয়ে যায়নি তখনও ,তলপেট ধ্বংসস্তুপ। পূর্বতন  সরকারের দান।

___”আপনার কী কী কমপ্লেন আছে বলতে পারেন”

_____” আয়্যাম এ্যাবসোলিউটলি পারফেক্ট ম্যাম্”

আগুন চোখে তাকিয়ে জবাব দিয়েছিলো মন্দিরা ।ছ্যাঁকা লেগেছিলো গলার স্বরে ওদের।

         গভীর জঙ্গল …একটার পর একটা ল্যান্ডমাইন পোঁতা,দৈনিক এনকাউন্টার। ….দীপঙ্কর,গোম্শ …..পার করে দিচ্ছে বর্ডার,বিহার বর্ডার এখন ঝাড়খণ্ড বর্ডার শ

সুমন,তাকেও ঠেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল সুমনকে জোর করে …গাছের শেকড়ে আটকে গেল পা ….শম্পা সায়নাইড, রয়ে গেল।সে সময়ের ভগ্নাংশে…বেঁচে,ধরা পড়ে পুলিশের হাতে।আবছা স্বপ্নের মতো ছবি।

           পরদিন নতুন সরকারের তরফে মোটা মোটা শেকল খুলে নেওয়া হলো ,নগ্ন গায়ে মোটা জামা ছবি উঠল মহান সরকারের বদান্যতায়।

মহানুভব এসি সুজিত মুখার্জীর কল্যাণে এলো কলময়কাগজ। কাঁপা হাতে ধীরে ধীরে ফুটতে লাগল অক্ষর।

       দেওয়ালে নখ দিয়ে তবু আঁক় কেটে কেটে যায়,আঁকে মন্দিরা। মাঝে মাঝে শোনে তার মুক্তির আদেশ হবে। ভয় পায়।এসব জীর্ণ দেওয়াল,গায়ে জলছাপ আর ফাটলের কারুকাজ,এই অন্ধকার গর্তে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।ভালো আছে সে। বাইরে আর যেতে চায়না।এই দ্বীপ তার আত্মরক্ষার খোলোস।ডায়রির পাতা ভরে যায় অসংখ্য দলিলে।ভিজে ঘাস আর শেকড়ের দড়িতে আছড়ে পড়ে থাকে মরার মতো।বুট পরা পা উল্টে দেয়। কেউ নেই। শালবনের অন্ধকারে ঘিরে ফেলে ওরা।ভারত সরকারের ছাপকাটা ইউনিফর্ম। থাই ঘষে দেয় জুতো দিয়ে। পালাতে যায়।একবার দুবার তিনবার…সপাট চড়।নিম্নাঙ্গ উন্মুক্ত করে ফেলে ওরা দশজন।বেয়োনেটের নল …গুঁজে দেয় ,প্রতিরোধের সঙ্গে যন্ত্রণা। চলতে থাকে দশটি পুংলিঙ্গের তাণ্ডব।রক্তাপ্লুত হয়ে অচেতন মন্দিরা শেষবার গুলি চালায়।পড়ে যায় একটা পিশাচ।আরও দু একটি নিকেশ হয় সম্মিলিত গুলির ঝড়ে। 

মেদনীপুর জেলে চাবুক আর ধর্ষণ পারেনি বার করে নিতে একটি কথাও নিতে।পিটিয়ে পিটিয়ে ভেঙে দিয়েছে কোমড়ের হাড়।বিনা চিকিৎসায়। রক্ত বমি।পেটের ঘা।যৌনাঙ্গে বেয়ে রক্তাশ্রাবের নদী…

“আহা,ভালো থাক। বেঁচে থাক ওরা। জাগরনের দল। বেঁচে থাক আমার সুমন।”সেরাত শেষবার রাত হলো রাতেরই মতো।বানমুড়ির জঙ্গলে অস্থায়ী শিবিরে সুমন সেই রাতে ক্ষুধার্ত নেকড়ে হ়য়ে গেছিল আর মন্দিরাও নাগিনী।দুজনে উন্মত্ত প্লাবন ডেকে আনলো তৃষ্ণার্ত ফকিরের মতো সারা রাত,চারবার…পাঁচবার…ছবার একে অপরকে দলে পিষে শেষ করে ফেলা যেন কবেকার ভুখ যেন এই শেষ!

ভোর তিনটেয় প্রথম এনকাউন্টার হলো সেদিন।এইবছর স্বাধীনতা দিবসে যথারীতি কিছু বন্দীমুক্তি হবে।কিভাবে যেন মন্দিরা ব্যানার্জীর নামটা উঠে গেল লিষ্টে।মন্দিরা অসহায় বোধ করে।বাইরের পৃথিবীটা কেমন তার আর জানা নেই।পঙ্গু মাথা, কামানো,ডিগডিগে জরাগ্রস্থ মানুষটা কী করবে কোথায় যাবে! ভেবে কুঁকড়ে যায় সে।তবু তাকে চান করিয়ে নতুন পোষাক পরানো হলো আর কারা যেন বহূদিনের কোন চেনা গ্রহ থেকে নিতেও এলো।শহর গ্রাম ছাড়িয়ে দূরান্তের এক ঝিকমিক সরু নদীর ধারে নির্জন আশ্রমে তাকে নিয়ে এলো প্রায় বিস্মৃত হয়ে আসা সাথীরা।

                ফিকে আলোর রেখা তখনও ফোটে না।আকাশে একই সাথে ডুবন্ত চাঁদ আর বিদায়ী রবির আলো।একটা পাখি এসময় ডাকে।শিস।মৃদু হাওয়া ঠাণ্ডা , শান্ত ছবির মতো দিনের আগমনী।এক বৃদ্ধ শ্বেত শুভ্র।দাড়ি,গোঁফ বসন কুঞ্চিত চামড়া সবই শুভ্র সুন্দর।গ্রামের লোক বাবা বলে।সুন্দর বাবা।

কেউ বলে সুফি বাউল কেউ সাধু।একা থাকেন।সাধন ভজন নেই।গান হয়।কথা হয়।কখনো টুকটাক জ্বর জারি,কাটা ছেঁড়ার চিকিত্সা চলে সারা সকাল।বিকেলে কুচোদের সঙ্গে  লাঠি খেলা ,আর উদ্দাত্ত গলার গান।সারি সারি পাঁচটি ঘর,টালির চালে ঝুমকোলতা,লাউ লতা ,সামনে একটা কুয়ো তার পাশে একটা আম গাছ,পুবদিকে একটা পেয়ারা আর জাম গাছ। পশ্চিম দিকে দশ পা গেলে নদী ওখানে ফুলের বাগান প্রজাপতির ভিড়,কেউ মালিক নয় এসব জমির অথবা সবার।

আজ দিনটা অন্য। আজ অনেক ফুল তুলছেন বৃদ্ধ।কবিও বটে।আজ ওরা ওকে নিয়ে আসবে।তাঁর জীবন প্রতিমা।

                সুমন নিজেকে নির্মোহ ভেবেছিলেন।আর কেন!…তবুও অস্থির লাগছে।এত বিলম্ব কেন!

এত বিলম্ব…..প্রায় চোদ্দ বছর অথবা আরো বেশি, ঠিক ঠাহর হয়না।যেন পূর্বাশ্রমের কথা।শুধু একচিলতে বেদনার কাঁটা।বর্ষণমুখর রাত,গভীর অরণ্যানি আবছা হয়ে আছে ছবিটা।মন্দিরা মরতে পারলো না।পড়ে গেলো লতা গুল্মে পা আটকে……না তিনি যাননি কারাগারে একবারও  না।দু-তিন জন আরো যারা পালাতে পেরেছিলো রয়ে গেল সেবক হয়ে।তারাও ফিরতে চাইলো না পুরোনো জীবনে।তাই এখানে এই পণ্য সভ্যতা থেকে বহূ দূরে নদীর পাড়ে ছোট্ট ঘর বেঁধে লোকচক্ষুর আড়ালে বাস করেন এখন সন্ন্যাসী অথবা বিপ্লবী সুমন মিত্র।উষার প্রথম কিরণের মতো সাদা এ্যাম্বুলেন্স নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে।ওরা, মানে  তাপস,সুবিমল বাদল আর অঞ্জলি যত্ন করে নামিয়ে নিচ্ছে ওকে।সমুখের একমাত্র ঘরটি তে সাদা চাদর বিছিয়ে রেখেছেন সুমন, তার জন্য। তারপর তিনি আবার গ্রামের পথে শান্ত সমাধিস্ত মন,___

“হৃদয়নন্দন বনে নিভৃত এ নিকেতনে…”

এখন একটু মাধুকরীর সময়।ওর কাছে আসার আগে আরেকটু সময় চাই।নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার সময়।

 __”এসো” শীর্ণ রক্ত শূন্য আঙুল হাতছানি দেয় অস্ফুটে।

দরজায় দাঁড়িয়ে কবি।মানবতার পূজারী ,বিপ্লবী।বিমুঢ়।দেখছেন চোখ ভরে।প্রতীক্ষার অবসান।

নেড়া মাথা,শিশুকন্যার মতো জ্বলজ্বলে মুখ বড়ো বড়ো চোখে সারল্য।কোমর ওবধি চাদর টানা।দুহাত বাড়িয়ে ডাকছে সে—তাঁর প্রেয়সী,জীবন সঙ্গিনী, একযুগের পরে পাশে বসেন।সময় স্তব্ধ হলো।চোখে চোখ।

গোমুখ থেকে গঙ্গাসাগর যাত্রা শেষ।চিবুকটা ধরে গাঢ় স্বরে বললেন,  “মুক্তিপ্রাণা”,

মন্দিরা শিহরিত হয়।সুমন

অস্ফুটে বলেন.

__”আজ থেকে তোমার নাম মুক্তিপ্রাণা”।

নদীর ওপার থেকে একদল বক পাখি উড়ে যাচ্ছে আকাশে।শীর্ণ একটি হাত আরেকটি হাতকে আঁকড়ে ধরে।সূর্য ডুবছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fifteen − six =