দইয়ের কথা

নিয়মিত টক দই খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। হজমশক্তি বাড়ে, এমন কি ক্যান্সার প্রতিরোধ করে বলে সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে! আরও কি কি গুণ আছে দই-এর? একটু জেনে নেওয়া যাক।

কেন ভালো দই?


টক দই বা ইয়োগার্ট কেন ভালো, তা বলার আগে একটা ছোট্ট ইতিহাস বলে নিলে ভালো হয়। অনেক বছর আগে রাশিয়ার একটা প্রদেশের মানুষের ক্ষেত্রে অদ্ভুত কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়।
দেখা যায় ওই প্রদেশের মানুষের গড় আয়ু অনেকটাই বেশি।
কেন এমন? বিষয়টা নিয়ে খোঁজ করতে শুরু করেন রাশিয়ান চিকিৎসক মেচিনিকভ। দেখা যায় ওই প্রদেশের মানুষ নিয়মিত দু’বেলা পাতে দই রাখেন। বিষয়টি নজরে পড়ে তার। তিনি বুঝতে পারেন দীর্ঘকাল যাবৎ সুস্থ থাকার পিছনে দই-এর নিশ্চয় কোনো ভূমিকা আছে।

তিনি গবেষণা করে দেখেন, দইয়ে থাকা বিভিন্ন উপকারী ব্যাকটেরিয়া ক্ষতিকর পদার্থকে আটকাতে বিশেষ ভূমিকা নেয়। এছাড়াও দইয়ে আছে প্রোটিন, ফ্যাট, ক্যালশিয়াম, ফসফরাস, রাইবোফ্ল্যাভিন, ভিটামিন বি৬, ভিটামিন বি১২, ভিটামিন এ ইত্যাদি নানা উপাদান। ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। হজমে সাহায্য করে, বয়স বাড়ার পরিবর্তন রোধ করে। ক্যান্সার প্রতিরোধ করতেও বিশেষ ভূমিকা নেয় দই! এই গবেষণার জন্য মেচিনিকভ নোবেল পুরস্কার পান।

দুধের বদলে দই

অনেকেরই পেটে দুধ সহ্য হয় না। দুধ খেলেই ডায়ারিয়া হয়ে যায়। কয়েকজন ছানাও খেতে পারেন না। তাঁদের ক্ষেত্রে দই খুব ভালো পুষ্টির উৎস হতে পারে। দেখা গেছে, দই এবং দুধের রাসায়নিক গঠনে তফাৎ আছে যথেষ্ট। দুধ এবং ছানার যে অংশের (মিল্ক প্রোটিন) জন্য অ্যালার্জি হয়, সেই অংশটিই দইয়ে থাকে না। এখানেই দই খাওয়ার সার্থকতা। কারণ দুধে যে ল্যাকটোজ থাকে, তা দইয়ে অনুপস্থিত। এছাড়া দই সহজপাচ্য হওয়ায় বয়স্ক মানুষদেরও দই খেয়ে হজম করতে বেগ পেতে হয় না।

হজমে সাহায্য করে দই

দইয়ে থাকে প্রচুর পরিমাণে প্রোবায়োটিক। অর্থাৎ উপকারী ব্যাকটেরিয়া। উদাহরণ হিসেবে ল্যাকটোব্যাসিলাস অ্যাসিডোফাইলাস নামের ব্যাকটেরিয়ার কথা বলা যায়। দইয়ের মাধ্যমে এই ব্যাকটেরিয়া মানুষের পৌষ্টিকতন্ত্রে পৌঁছয় ও খাদ্য হজমে সাহায্য করে।

এখানেই শেষ নয়। খেয়াল করলে দেখবেন, ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে অসুখ করলে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার পরামর্শ দেন রোগীকে। রোগী সেই ওষুধ খাওয়ার পরেই খারাপ ব্যাকটেরিয়া মরতে শুরু করে। মুশকিল হল কিছু গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিক থাকে, যেগুলি খেলে খারাপের সঙ্গে ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলিও মরে যায়! ফলে অনেকের খাদ্য হজমে সমস্যা দেখা দেয়। সেই সময় দই খেলে উপকার হয়। কারণ দইয়ের ভিতরে বেশ কিছু ভালো ব্যাকটেরিয়া পুনরায় পৌষ্টিকতন্ত্রের অন্দরে থাকা ভালো ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

কোন কোন অসুখে বেশি করে দই খাবেন?

যাঁদের খাদ্য হজমে সমস্যা হয়, তারা লাঞ্চ ও ডিনারে দই খান। এছাড়া অস্টিওপোরোসিসের রোগীদের নিয়মিত টক দই খাওয়া উচিত। কারণে দইয়ে থাকে প্রচুর পরিমাণে ক্যালশিয়াম। ফলে অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধে দই বিশেষ ভূমিকা নেয়।

দই কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগীদের পক্ষেও উপকারী। দই অন্ত্রনালি পরিষ্কার রাখে। শরীর থেকে টক্সিন বেরিয়ে যেতে সাহায্য করে।

কোন দই খাবেন, মিষ্টি না টক?

মিষ্টি দই একেবারেই চলবে না। সবসময় টক দই খেতে হবে। কারণ টক দইয়ের মধ্যে আলাদা করে চিনি মিশিয়ে দইকে মিষ্টি করা হয়। সুগার মানেই অতিরিক্ত ক্যালোরি। সেখান থেকে ওজন বৃদ্ধি। তাছাড়া মিষ্টি দইয়ে চিনি ছাড়াও থাকে ঘি থাকে। সেটা বরং স্বাস্থ্যের পক্ষে আরও বেশি ক্ষতিকারক। অবশ্য রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডস, শর্করার পরিমাণ ঠিক থাকলে একজন ব্যক্তির মাঝেমধ্যে মিষ্টি দই খেতে বাধা নেই।

দই কি সুষম খাদ্য?

না। সব ভিটামিন, খনিজ কোনও একটি খাদ্যবস্তুতে থাকে না। দইয়েও নেই। ফলে শুধু দই খেয়ে কোনও ব্যক্তি জীবনধারণ করতে পারেন না।

কি ভাবে দই খাবেন?

মূল খাদ্যের সঙ্গে দই রেখে খাওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ লাঞ্চ ও ডিনারের শেষে দই খেতে পারেন। এভাবে দৈনিক গড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ মিলিগ্রাম দই খাওয়া যায়। দই খাদ্য হজমে সাহায্য করে তা আগেই বলা হয়েছে। এছাড়া অনেকটা পরিমাণ দই-এর মধ্যে প্রচুর পরিমাণ স্যালাড দিয়ে খাওয়া যেতে পারে। আবার মাছ-মাংস দই দিয়ে রান্না করলে বা ম্যারিনেট করার জন্য দই-এর ব্যবহার করলে তা হজমে সহায়ক হয়।

ঘরে পাতা দই বনাম প্যাকেটজাত দই

ঘরে পাতা দই সবসময়ই নিরাপদ। তবে ঘরে পাতা দই নিয়ে কয়েকটা কথা বলে রাখা ভালো। মোটমুটিভাবে যেদিন রাতে দই পাতবেন, তার পরের দিন বিকালের মধ্যে খেয়ে নিতে হবে। মনে রাখবেন, ২৪ ঘণ্টা পেরতে শুরু করলেই দই-এর পুষ্টিগুণ কমতে থাকে। এবার আসি প্যাকেটজাত দই-এর প্রসঙ্গে। বহু সংস্থা আজকাল প্যাকেটজাত দইয়ে শরীরের পক্ষে জরুরি কিছু মিনারেল মিশিয়ে দিচ্ছে। যেগুলো ঘরে পাতা দইয়ে পাওয়া যায় না। তা সত্ত্বেও বলা যেতে পারে, ঘরে পাতা দই খাওয়াই শ্রেয়। তবে ঘরে দই পাতলে, ডাবল টোনড দুধেই পাতা ভালো। কারণ ডাবল টোনড দুধে ফ্যাট অনেক কম থাকে। অযথা ওজনবৃদ্ধি রোধ হয়।

কাদের জন্য দই অপকারী?

ক্রনিক কিডনি ডিজিজ-এর রোগী এবং ডায়াবেটিসের রোগীরা দই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাবেন না। কারণ দইয়ে ক্যালশিয়াম এবং ফসফরাস থাকে। কিডনি ডিজিজের রোগীর পক্ষে অতিরিক্ত ক্যালশিয়াম ক্ষতিকারক। অন্যদিকে সুগারের রোগীকে ক্যালরি মেপে খেতে হয়। তাই ইচ্ছেমতো অতিরিক্ত দই খাওয়া যাবে না। আরো একটা কথা বলা উচিত। তা হল, দইয়ে যে প্রোটিন থাকে, সেই প্রোটিনের প্রতি কারো কারও অ্যালার্জি থাকে। এমন মানুষের দই না খাওয়াই উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 − three =