নন্টুর পাথর

 প্রহান মুখোপাধ্যায়,  দমদম,  ষষ্ঠ শ্রেণী  ##

ওঠ! নন্টু, ওঠ!

নন্টু একটুখানি চোখ মেলে বলল, কি হল মা, এই মাঝরাত্তিরে ডাকছো কেন?

মা বলল, ধুর বোকা! ভোর চারটে বেজেছে। চল উঠবি না, আমাদের উত্তরবঙ্গে যেতে হবে। মনে নেই!

নন্টু চট করে উঠে, দাত মেজে, চান করে, উত্তম কুমারের মতো সেজে উঠল। ব্যাগ গোছানোর সময়, সে বাবার কাছে জিগ্যেস করলো, বাবা আমরা কোথায় কোথায় যাচ্ছি। বাবা বলল, আরে কত কি আছে তুই জানিস! দারজিলিং, কালিম্পং, কোচবিহার, ডুয়ার্স আরো কত কিছু।

তারপর তারা টাক্সি ভাড়া করে স্টেশনে পৌঁছলো। ট্রেন অত দেরি করেনি। তারা ট্রেনে উঠে পড়ল।

ট্রেনে সারাদিন নন্টু জানলার দিকে তাকিয়ে রইল। কত পাহাড়, নদী, বন-জঙ্গল, চাষের মাঠ, গ্রাম, ইত্যাদি তার সামনে দিয়ে চলে গেল। মনে হল যেন তারাও কোথাও যাচ্ছে, কিন্ত উলটো দিকে।

দেখতে দেখতে গোটা দিনটা কেটে গেল। নন্টুদের স্টেশন আসতে চলেছে। তারা চটপট তাদের জিনিসপত্র প্যাক করে নিল। নন্টু যেই স্টেশনে নামলো, তার মনে হল এক আলাদা অনুভূতি।

“পাহাড়ের মধ্যে কতো সবুজ! চারদিকে এতো গাছপালা! এসব কতো সুন্দর, অথচ আমরা এটা উপভোগ করতে পারি না! তাই দিনের পর দিন এত গাছপালা কেটে ফেলি। ইস! যদি কলকাতায় এরকম চারিদিক সবুজে ভরে থাকত তাহলে কেমন দারুণই না হত! সবাই তাহলে এইরকমই শান্তির নিশ্বাস নিতে পারত” সে বলল নিজেকে। তার এখনো মনে আছে তার প্রথম সিমলা বেড়ানো। তার বয়েস তখন ৪-৫ বছর। তার সেই পাহাড়ে পাহাড়ে সবুজ গাছপালাদের দেখে খুব ভাল লেগেছিল। এখন অবশ্য তারা অতো দূর যেতে পারেনি। তাই তারা এই উত্তরবঙ্গের এই ট্রিপ ঠিক করেছে।   

সে তার বাবা-মার সঙ্গে তাদের ড্রাইভারের কাছে গেলো। ড্রাইভার সঞ্জয় কলকাতার লোক। প্রায় দশ বছর ধরে সে এখানে ড্রাইভারি করেছে। তাই তার প্রচুর অভিজ্ঞতা। পাহাড়ের যে কোনও প্রান্তই তার হাতের তালুর মত চেনা। এমনকি যে সব জায়গার নাম স্থানীয় লোকে কোনদিনও শোনেনি, সেই সব জায়গাও চেনে সে। হঠাৎ দেখে কেউ তাকে কলকাতার লোক বলে ভাবতেই পারেনা, বরং লোকে তাকে পাহাড়ের মানুষই ভাবে।

নন্টুর বাবা সঞ্জয়কে বলল, আজ আমরা পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াবো, মাঝে একটু তিস্তা নদীতেও যাবো। কালকে তুমি আমাদের কয়েকটা বৌদ্ধ গুম্ফায় নিয়ে যেও।

সেই মতো সঞ্জয় পাহাড়ের পথে তার গাড়ি ছোটাল। কত পাহাড়ে উঠেছে তারা, তার মধ্যে কত চড়াই পথ, কত উৎরাই। নন্টু বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখল, কতো ঘন জঙ্গল, গাছপালার ফাক দিয়ে দেখা যাচ্ছে এক ছোট্ট গ্রাম। আশপাশে কত চায়ের চাষ। বনের মধ্যে ডাকছে কত পাখি। এই সব কিছু মন মুগ্ধ করে দেয়। একটু পরেই দেখা দিল তিস্তা নদী। নদী দেখেই খুব খুশি নন্টু, বায়না ধরল নদীর কাছে যাব একটু, বাবা মায়েরও মনে হল একই ইচ্ছে। তারা তিস্তা নদীর ধারে পৌঁছল। তিস্তা নদীর ধারে তারা কিছুক্ষণ বসে থেকে তারা তিস্তা নদীর মনোরম দৃশ্য দেখতে লাগলো। নন্টুর বাবা কয়েকটা ছবিও তুলতে লাগলো। নন্টু গিয়ে তিস্তা নদীর জলে পা দিতে লাগলো। সেই জলটা কি ঠান্ডা! একদম বরফের মতন। অথচ মজার ব্যাপার, সেই জলটা বরফের মতো ঠাণ্ডা হলেও বরফ হয়ে যায়নি। হঠাৎ নন্টুর নজর পড়ল এক পাথরের ওপরে। সে সেই পাথরটা জলের নিচে থেকে বার করল। সেই পাথরটা খুবই অদ্ভুত। দেখতে একেবারে নীল কাচের মতো। সূর্যের কিরণ লেগে একদম হীরের মতো ঝলমল করছে। আকারে খুব বড় নয়, হাতের মুঠোয় এসে যায়। এই রকম কাচের মতো ঝলমলে পাথর পাওয়া নিশ্চয়ই খুবই মুশকিল। কিন্ত এই রকম এক দুর্লভ পাথর নদীর ভেতরে কি করে এলো!

সে ভাবলো, এই দুর্লভ পাথর না জানি কোথায় পাওয়া যায়। নাঃ, এটা আমি নিয়ে যাই। অন্য কোথাও পেতে নাও পারি। তাই সে পাথরটা নিয়ে পকেটে লুকিয়ে রেখে দিল। তারপর সে সেই গাড়িতে চুপটি করে  বসে গেল। সে দেখল তার বাবা-মাও ফিরছে।

তার বাবা বলল, চলো সঞ্জয়, এবার অন্য আরো অনেক জায়গায় আমরা যাব, যেটার ব্যাপারে আমি তোমাকে বলেছি। নন্টু জিগ্যেস করল, আমরা কোথায় যাচ্ছি? বাবা বলল, এটা হল একটা সিক্রেট, তাই আমি তোমায় এখন বলব না। ততক্ষণ তুমি পাহাড় নিয়ে একটা গান গাইতে পারো, বা অন্য কিছুও করতে পারো। নন্টু ভাবতে লাগলো, আমি তাহলে কি করি।        

হঠাৎ নন্টু তার পাথরের কথা মনে করে সেই পাথরটাকে পকেট থেকে বের করে চুপিচুপি দেখতে লাগলো। সেই পাথরটা অদ্ভুত হওয়ার পাশাপাশি খুব সুন্দরও। সূর্যের কিরণে ঝকঝক করা এই নীল পাথরটা কিন্ত মন্দ লাগে না।

হঠাৎ তার হাতে থাকা পাথরটা ভীষণ উজ্জ্বল হয়ে গেল। নন্টু তো অবাক! এ যে অনেক উজ্জ্বল হয়ে গেছে! এত উজ্জ্বল হবার তো কথা না। দেখি এটার কি হয়েছে। তার ভাল করে দেখার আগেই সেই পাথরটা তার হাত থেকে উড়ে গেল! সে তো হতবাক! তার মা তার সাথে পিছনে বসেছিলেন। তিনিও সেটা দেখে চমকে উঠলেন।

তারপর সেই উজ্জ্বল পাথরটার কিরণটা পড়ল গাড়ির ব্রেকের ওপর। হঠাৎ তারা দেখলও যে ব্রেকটা নিজে থেকেই কষে গেল। বাবা সামনে ছিল, কিছুই দেখেনি, বলল, সঞ্জয় তুমি গাড়ি থামালে কেন। মা বলল, ও থামায়নি, ওই পাথরটা…। মার মুখ বন্ধ হয়ে এল। তাঁরই শুধু হয়নি, বাকিদেরও মুখ বন্ধ হয়ে এল। তারা সামনে হা করে দেখল একটা মস্ত বড়ো পাথর উপর থেকে গড়িয়ে রাস্তায় পড়েছে!

নন্টু ভাবল, সত্যি, এটা কি হল! সে আরও ভাবল, না, এই রকম পাথর তো থাকা সম্ভব নয়! বিজ্ঞানও এটা প্রমাণ করেছে যে এরকম জিনিস হতে পারে না! তাহলে এটা কি করে হল! আর সেটাও আমাদের সাহায্য করতে চেয়েছিল। তার মানে কিছু একটা কাণ্ড তো হবেই।

তারা সবাই গেল সেই বড়ো পাথরের কাছে। সেটা ছিল এতো মস্ত যে তারা এর নিচে এলে পিঁপড়ের মতো পিসে যেত। এতটাই বড় যে তাকে সরাতে গেলে চারজনের বেশি লোক লাগবে।

নন্টুর মা নন্টুকে ধরে বলল, হ্যা রে, তুই এই অদ্ভুত পাথরটা কোথায় পেলি বলতো!

-ওই তিস্তা নদীর ধারে।

-তুই কি করছিলিস?

-নদীতে পা ডোবাচ্ছিলাম।

-নদীতে পা কেন ডোবাচ্ছিলি? জানিস না নদীর জল কতো ঠান্ডা!

নন্টুর মা নন্টুকে জড়িয়ে বলল, না বাবা! এরকম অদ্ভুত দেখতে পাথরকে কেউ নেয় না! আমার লক্ষ্মী বাবা!

মা তার কপালে এক চুমু দিল। তারপরে তাকে আবার বোঝাতে লাগল।

নন্টু বলল, কিন্ত মা, ও তো আমাদের সাহায্য করতে চেয়ে ছিল।

মা বলল, না বাবা, এই রকম নাও হতে পারে। এই রকমও হতে পারে যে ও ওই রূপে আমাদের ক্ষতিও করতে চায়।

তারপর মা নন্টুর মাথায় হাত বুলিয়ে আবার তাকে বোঝাতে লাগলো…

                                                     (ক্রমশ…)

2 thoughts on “নন্টুর পাথর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

six + 16 =