পাবলো নেরুদাঃ স্মৃতির আলোকে

পার্থসারথি সরকার

 

রিকার্দো এলিয়েসের নেফতালি রেইয়েস বাসোআলতো বলে কাউকে তখনো চিনি না, আসলে না চেনারও কারণ ছিল, এ নামে তিনি পরিচিত ছিলেন না বিশ্ববাসীর কাছে—আমার কাছেও না। কবির জীবনচরিত সম্বন্ধে তখনও সঠিকভাবে অবগত হইনি, কিন্তু পড়ে ফেলেছি তাঁর লেখা অনেক কবিতা। চিরপরিচিত কবিতার বাইরে এ এক অভুতপূর্ব স্বাদ এর আগে কখনও পাইনি। সেই বয়সেই যে সব কবিতা যে কী গভীর দাগ কেটে গিয়েছিল আজও সেখান থেকে মুক্তি পাই নি। সে কবি নেরুদা—পাবলো নেরুদা।

বেশ মনে আছে তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। বাড়িতে বড় দাদার কল্যাণে মিলেছিল একটা কবিতার বই। বেশ মোটা মাঝারি সাইজের বই, প্রচ্ছদে সবুজের বাড়াবাড়ি। নাম ‘ইসলা নেগ্রা’। ‘কৃষ্ণদ্বীপ’-এর রহস্য সেই বয়সে ভেদ করতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু মনের যে মৃত্তিকা, তা ভিজে সরস হয়ে উঠেছিল সেই কবিতার বই পড়ে। কবিতার কথায় কোন আড়ষ্ঠতা নেই, একেবারে সোজা, একেবারে চেনা শব্দের ব্যবহার, একেবারে জানা জিনিসগুলো ভিড় করে এসেছে সেখানে। সেখানে আমার চারিদিকে দেখা জিনিসপত্তরগুলোরই বাড়বাড়ন্ত। সেই বয়সেই খোঁজ করে গেছি পাবলো নেরুদার লেখা পড়বার জন্য—পড়েছি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের দুটি অনুবাদ। আশ্চর্যও হয়েছি–

“আজ রাতে আমি সেই বিষণ্ণ শব্দগুলো

লিখে ফেলতে পারি—

          আমি ভালবাসতাম, আর সে-ও, সময় পেলে

                                      আমায় ভালবাসতো।”

সেই কবিতার কথা, সেই কবিতাগুলোর কথা মনে করলে আজও সেইসব দিনগুলি এসে ধরা দেয়। এর পর পেরিয়ে গেছে বেশ অনেক দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আবার আবিষ্কার Alastair Reid-এর ইংরাজি অনুবাদে ‘ISLA  NEGRA’, তবে এবার শুধু অনুবাদ নয়, পাশে মূল স্প্যানিশও। মূল পড়ার জন্য কৈশোরের অতৃপ্ত আশা, এতদিন পরে যে অনুভূতি এনে দিয়েছিল, তার কথা আজীবন মনে থেকে যাবে। পরে নেরুদার আরও অনেক অনেক অনুবাদ এবং মূল লেখা হাতে পাবার সৌভাগ্য হয়েছে—যত পড়েছি তত অবাক হয়েছি।

তবে নেরুদার কবিতায় এতটা ভালোবাসা, এতটা আকৃষ্ট হবার কারণ কি তা অনুসন্ধান করে চলেছি বারবার। কোন সঠিক ধারণায় আসতে পারিনি একেবারে। একবার মনে হয়েছে স্পেনীয় সাহিত্যের সঙ্গে বাংলার কোথাও যেন একটা মিল রয়েছে। সার্ভেন্তেসের ‘দোন কিহোতে’-র ধাঁচ আমরা সংস্কৃত সাহিত্যের মধ্যে পাই। আর তাইতো হিমেনেথ দম্পতি রবীন্দ্রনাথকে এত কাছের করে নিতে পেরেছিলেন। পেরেছিলেন নেরুদাও। রবীন্দ্রনাথের ‘কল্পনা’ কাব্যের অন্তর্গত ‘মানস প্রতিমা’ কবিতায় ছিল—“তুমি সন্ধ্যার মেঘ শান্ত সুদূর, তুমি আমার নিভৃত সাধনা” হিসাবে। যার পাঠান্তর ‘স্বরবিতান’-এর পাতায় দেখা দিল “তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার নিভৃত সাধনা” রূপে। যা কিনা জয়দেবের “মিতা, ত্বমসি মম জীবনং/ ত্বমসি মম ভূষণম্‌/ ত্বমসি মম ভবজলধিরত্নম্‌”-এর দ্বারা প্রভাবিত। এবং এই শ্লোকটি ‘শেষের কবিতা’-য় অমিতের মুখে লাগিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই কবিতাটির অনুবাদ করেন নেরুদা, এবং ঠাঁই দেন তাঁর ‘Viente Poemas de amor y Una Cancion desesperada’ (কুড়িটি প্রেমের কবিতা ও একটি হতাশার গান) প্রকাশিত হয় ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে। কাব্যগ্রন্থটি অসামান্য। জীবনীকারের মতে এই গ্রন্থটি লিখে তিনি তাঁর বান্ধবী তেরুসা, যাকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন বেশ কিছু কবিতা, তাকেই খুশি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কবিতাটি কোথাও রবীন্দ্রনাথের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। আর সেই কারণেই বোধহয় বিষ্ণু দে কবিতাটি স্প্যানিশ থেকে বাংলা অনুবাদ করেন—“আমার আকাশে সন্ধ্যায় তুমি যেন মেঘমালা” হিসাবে; তখন অমিলের মধ্যেও এই মেলবন্ধনের জায়গাটা আরো বেশি হয়ে দেখা দেয়।

আসলে মিলের জায়গাটা বোধহয় কোন এক জায়গায় নয়। তা সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। যাকে আলাদা করে চিনে নিতে যাওয়ার চেষ্টা নিছকই বাতুলতা ছাড়া আর কিছু নয়। সেই চিনে নেবার জায়গা তাঁর কবিতাকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধির মধ্যেই রয়ে গেছে। উপলব্ধিতে মিশে যেতে পারলেই আর কোন ভেদ থাকে না। ভেদ থাকে না আমার জন্মভূমি আর ভাল্‌পোরাইজোর—‘যেখানে জন্মায় বৃষ্টি’। নেরুদার ‘El libro de las preguntas’ (একটি বই—নানা প্রশ্ন) কারাগারে বসে লেখা। ছোট ছোট পংত্তিদ্বয়ের দ্বারা গাঁথা মহাসাগরের গভীরতা। সেখানেই তাঁর প্রশ্ন—

“¿Que´ dira´n de mi poesi´a/ los que no tocaron mi sangre?” (আমার কবিতা সম্পর্কে তারা কি বলবে যারা আমার রক্ত ছুঁয়ে দেখেনি?) আসলে কবিকে উপলব্ধি করতে গেলে যে একাত্ম হতে হয়, সে কথাই বোধহয় তিনি তাঁর এই শেষ কবিতাগ্রন্থে স্বীকার করে গেলেন।

কবির মৃত্যুর পরে পেরিয়ে গেছে অনেক দিন। বর্তমানে তাঁর মৃত্যু স্বাভাবিক কিনা সে বিষয়ে অনেকগুলি প্রশ্ন উঠে এসেছে। হয়তো একদিন তার নিষ্পত্তি হবে। হালকা শীতের আমেজ, সূর্য্যটা অনেক তাড়াতাড়ি হেলে গেছে। ভাবছিলাম নেরুদা কতটা এসেছেন আমাদের কাছাকাছি। হাতে ছিল বই—‘শামসুর রাহমানের কবিতা সংগ্রহ’। বইটা খুলতেই বেরুলো একটা কবিতা ‘দশ টাকার নোট এবং শৈশব’—

“মেরুন রঙের খাতাময় জলছবি,

সন্ধ্যার গলির মোড়ে কাঁধে মইবওয়া বাতিঅলা,

হার্নি সাহেবের হল্‌দে পুরোনো দালান,

খড়বিচালির গন্ধভরা মশা-গুঞ্জরিত

বিমর্ষ ঘোড়ার আস্তাবল, মেরাসীনদের গান

ধরে আছে সময়ের সুদূর তরঙ্গেমেশা আমার শৈশব।”

চমকে উঠলাম। মনে হল নেরুদা না হলে বোধহয় এ কবিতা লেখা সম্ভব ছিল না। আর তখনই পেয়ে গেলাম আমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর।

Pablo Neruda (July 12, 1904 – September 23, 1973)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nine − nine =