ফলদায়ক ফলসা

অভিজিৎ বসু ##

এই ফলসা গাছ নিয়ে বেশ মজার স্মৃতি আছে। ছোটো বেলায় স্কুল যাবার পথে কত দিন যে দেরি হয়েছে পাঁচিল টপকে এই টক মিষ্টি ফলসা খেতে গিয়ে তার হিসেব নেই। একবার তো পাঁচিল টপকে পালাতে গিয়ে পায়ে কাঁচ ফুটে গেলো। সেই অবস্থায় স্কুল কামাই না করে হাজির হলাম ক্লাসে। ফলসার টক মিষ্টি স্বাদ, পায়ের ব্যাথা ভুলিয়ে দিলো। ছোটো বেলার সেই সুন্দর ফল এর দেখাই পাই না। আজকাল সেই ফলসার দেখাই মিলছে না আর। গরম পড়লেই এই সময় বাজারেও ফলসা নিয়ে ঝুড়ি করে অনেকেই হাজির হতেন গ্রামের থেকে। কিন্তু আজকাল আর কই দেখতে পাচ্ছিনা এই ফলটা বাজারে।

ফলসা বাংলাদেশের একটি অপ্রচলিত ফল। এটি প্রধানত দক্ষিণ এশিয়ার ফল। পাকিস্তান থেকে কম্বোডিয়া পর্যন্ত এর দেখা মেলে। অন্যান্য ক্রান্তীয় অঞ্চলেও এর ব্যাপক চাষ হয়। ফলসা গাছ ‘গুল্ম’ বা ছোট ‘বৃক্ষ’, যা আট মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এর ফুল হলুদ, গুচ্ছাকারে থাকে। ফলসা ফল ড্রুপ জাতীয়, ৫-১২ মিলিমিটার ব্যাস বিশিষ্ট, পাকলে কালো বা গাঢ় বেগুনি রঙের হয়। ফলসা শব্দটি উর্দু ভাষা থেকে এসেছে। বাংলা, হিন্দি, মারাঠি সহ পৃথিবীর বহু ভাষাতে এটি ফলসা নামেই পরিচিত।

গরমের সময় ফলসা হল পুষ্টি এবং সতেজতার একটি পাওয়ার হাউস, যা গ্রীষ্মের সময় বিভিন্ন স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান করে। তাই এই সময়ে এটি খবর খুব চল ছিল।

গরম আবহাওয়ায় আপনার স্বাস্থ্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখার নিখুঁত উপায় হল পুষ্টিকর এবং হাইড্রেটিং ফল। এমনই একটি ফল যা আপনাকে ঝলসে যাওয়া তাপ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে তা হল ফলসা। এই ছোট, বেরি-জাতীয় ফলগুলি কেবল সুস্বাদুই নয়, হারানো তরল এবং ইলেক্ট্রোলাইটগুলিকে পুনরায় পূরণ করতে সাহায্য করে, আপনাকে হাইড্রেটেড এবং সতেজ রাখে।

গরমে ফলসা খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা আছে এই ফলটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। এই ফলে অ্যান্থো- সায়ানিন এবং ফ্ল্যাভোনয়েডের মতো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা শরীরের অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করে। সম্ভাব্য দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমায়, যেমন হৃদরোগএবং ক্যান্সার। শুধু তাই নয়, এটি জয়েন্টের ব্যথা উপশম করতে এবং উচ্চ অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উপস্থিতির কারণে আর্থ্রাইটিসের লক্ষণগুলি পরিচালনা করতে সহায়তা করতে পারে।

এই ফল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ফলসা ভিটামিন সি সমৃদ্ধ, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে, এইভাবে সংক্রমণ এবং অসুস্থতা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বাড়ায়। গ্রীষ্মের মাসগুলিতে এই ফলটি নিয়মিত সেবন সাধারণ অসুস্থতাগুলিকে দূরে রাখতে সাহায্য করতে পারে।

এটি হজমে সাহায্য করে ফলসাতে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যতালিকাগত ফাইবার হজমে সহায়তা করে এবং অন্ত্রের স্বাস্থ্যের প্রচার করে। এটি একটি প্রাকৃতিক রেচক হিসাবে কাজ করে নিয়মিত মলত্যাগকে উদ্দীপিত করে, এইভাবে কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে। এছাড়াও, এটি বুকজ্বালা উপশমের প্রাকৃতিক প্রতিকার হিসাবেও কাজ করতে পারে।

হাইড্রেটিং বৈশিষ্ট্য আছে এই ফলের। গ্রীষ্মের মাসগুলিতে বর্ধিত ঘাম এবং তরল হ্রাসের কারণে হাইড্রেটেড থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের উচ্চ জলের উপাদানের কারণে, ফলসা ঝলমলে দিনে একটি প্রাকৃতিক হাইড্রেটিং এজেন্ট হিসাবে কাজ করে। এই ফলটি উপভোগ করা হারানো তরল পুনরায় পূরণ করতে সাহায্য করে, আপনাকে সতেজ এবং উজ্জীবিত রাখে। এ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে আপনি প্রতিদিন ফলসার রস পান করতে পারেন যা হিটস্ট্রোক থেকে অনেকটা রক্ষা করবে।

এই ফল ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করে। এর কারণ হল তাদের কম গ্লাইসেমিক সূচক রয়েছে, যার অর্থ তারা রক্তে শর্করার মাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করে। এটি তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে চাওয়া ব্যক্তিদের জন্য একটি উপযুক্ত বিকল্প করে তোলে।

ওজন ব্যবস্থাপনা সমর্থন করে। ফলসা গুলিতে ফাইবার সমৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে ক্যালোরি এবং চর্বি কম থাকে, যা তাদের ওজন পর্যবেক্ষণকারীদের জন্য একটি সন্তোষজনক স্ন্যাক পছন্দ করে। ফাইবার উপাদান পূর্ণতা অনুভূতি প্রচার করে, সম্ভাব্য সামগ্রিক ক্যালোরি গ্রহণ হ্রাস করে।

এই ফল ত্বকের স্বাস্থ্য বাড়ায়। ফলসায় পাওয়া অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি ফ্রি র‌্যাডিক্যাল ক্ষতির বিরুদ্ধে লড়াই করে ত্বকের স্বাস্থ্যে অবদান রাখে, এইভাবে বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয়। এছাড়াও, ভিটামিন সি উপাদান কোলাজেন উৎপাদনে সহায়তা করে, দৃঢ়তা এবং স্থিতিস্থাপকতা প্রচার করে।

হার্টের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় এটি। ফলসা খাওয়া কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে এবং শরীরের প্রদাহ কমিয়ে হার্টের স্বাস্থ্যে অবদান রাখতে পারে। ফলের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমের অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।

তাপ-সম্পর্কিত সমস্যাগুলি উপশম করে, প্রচণ্ড গ্রীষ্মের অঞ্চলে, ফলসা ঐতিহ্যগতভাবে শরীরকে ঠান্ডা করতে এবং তাপ-সম্পর্কিত অস্বস্তি দূর করতে খাওয়া হয়। এর সতেজ স্বাদ অত্যাচারী তাপ থেকে তাত্ক্ষণিক ত্রাণ প্রদান করে, এটি গরমের সময় এটি একটি জনপ্রিয় পছন্দ করে তোলে।

পেশী স্বাস্থ্য প্রচার করে, ফলসা ফল প্রোটিন এবং পটাসিয়ামের একটি ভাল উৎস, উভয়ই পেশীর কার্যকারিতা এবং বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয়। প্রোটিন পেশী টিস্যু তৈরি এবং মেরামত করতে সাহায্য করে, যখন পটাসিয়াম একটি ইলেক্ট্রোলাইট যা পেশীগুলিকে সংকুচিত করতে এবং সঠিকভাবে শিথিল করতে সহায়তা করে।

শহরাঞ্চলে সহজে খুব একটা চোখে পড়ে না ফলসা (Phalsa)। আগে গ্রামে দেখা গেলেও এখন এর জনপ্রিয়তা কমেছে। যদিও বেশির ভাগ মানুষ বুনোফল হিসেবেই এড়িয়ে চলে ফলসাকে। তবে এখনও বহু মানুষের কাছে স্মৃতি বয়ে চলে এই ফল। ভারতীয় উপমহাদেশে এই ফলসা পাওয়া যায়। মার্চ-এপ্রিল মাসে হালকা হলদে রঙের ছোট ছোট ফুল ধরে গাছে। এর পর ফল পাকে মে-জুন পাসে। কাঁচা অবস্থায় সবুজ রঙের হলেও পাকার পর কালচে বাদামি রঙ ধারণ করে। খেতেও হয় টক মিষ্টি স্বাদের। কিন্তু খুব কম মানুষই এই ফলসার উপকারিতা সম্পর্কে জানেন।

প্রচণ্ড গরমে এটি ক্লান্তি দূর করতে সাহায্য করে, অত্যধিক গরমে, প্রখর রোদে ক্লান্তি হওয়াটা স্বাভাবিক। এই সময় যদি ফলসার রস পান করা যায় তাহলে ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে নিমেষে। ফলসার রস গরমে ক্লান্তি দূর করতে সাহায্য করে। এই কারণে স্কোয়াশ জাতীয় অন্যান্য পানীয়তে ব্যবহার করা হয় ফলসা। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি ১০০০ গ্রাম ফলসা থেকে ৭২৪ ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। এই ফল পুষ্টিতে ভরপুর।

গরমে শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে ফলসা- ফলসা হল গ্রীষ্মকালীন ফল। তাই এতে জলের পরিমাণ বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, গরমে ফলসার রস খেলে শরীরে জলশূন্যতার সমস্যা কোনওদিন দেখা দেবে না। প্রচণ্ড গরমে ডিহাইড্রেশনের সমস্যা থেকে সহজেই মুক্তি পাবেন ফলসা গুণে। এই ফল শরীরে জলের চাহিদা পূরণ করে।

ডায়ারিয়া প্রতিরোধ করে- ডায়ারিয়া প্রতিরোধে ফলসার ফল ও গাছের বাকল অত্যন্ত কার্যকর। এই ফলের মধ্যে ফাইটোকেমিক্যালস নামক উপাদান রয়েছে যা শ্বাস সম্বন্ধীয় সমস্যার উপশম করতে সহায়ক। এর পাশাপাশি এর ফলের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে যা পেটের সমস্যা থেকে ডায়াবেটিসের মতো গুরুতর রোগের জন্য ভাল।

হার্টকে ভাল রাখে- যাঁরা উচ্চ রক্তচাপের রোগী তাঁরা গরমে ফলসাকে ডায়েটে রাখুন। ফলসার রসে স্বাদ বাড়ানোর জন্য লেবুর রস ও পুদিনা পাতাও যোগ করে দিতে পারেন। এতে হৃদরোগের ঝুঁকি সহজেই এড়ানো যাবে।

গাঁটের ব্যথা উপশম করে- ফলসার মধ্যে নানা ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। বাতের ব্যথা, জয়েন্টে ব্যথার মতো সমস্যাগুলোকে দূর করতে সাহায্য করে এই গ্রাম্য ফল। এর পাশাপাশি ফলসার মধ্যে থাকা ক্যালশিয়াম আমাদের মজবুত হাড় গঠনে সাহায্য করে।

তাই এই বুনো ফল যে একসময় আমাদের শরীরের নানা উপকারে লাগে সেটা বুঝতে পারলাম। তাই অযথা একে হেলা ফেলা না করে যদি ফলসার সন্ধান মেলে তাহলে সেই ফল খাওয়া শরীরের পক্ষে খারাপ নয়, ভালই কি বলেন। কিন্তু ডুমুরের ফুলের মত ফলসাও যে ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nineteen − twelve =