ফলের চারা লাগানোর নিয়ম
অগ্নিভ হালদার ##
এখন (এপ্রিল-মে) ফলগাছ লাগানোর আদর্শ সময়। ভালো ও বেশি ফল পেতে হলে প্রথমেই দরকার স্বাস্খ্যবান এবং ভালো জাতের চারা। তারপর চাই সেগুলো সঠিকভাবে লাগানো। যেমন তেমন ভাবে ফলের চারা-কলম লাগালে সেসব গাছ থেকে কখনো খুব ভালো ফল আশা করা যায় না। শুধু বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকায় বেশির ভাগ নার্সারিতেই এখন মানসম্পন্ন চারাকলম তৈরি হচ্ছে না। ফলে অল্প শিকড় নিয়ে গাছ বড় হওয়ায় সহজে ঝড়-বাতাসে গাছ পড়ে যাচ্ছে। শুধু মাত্র ন্যাশনাল হরটিকালচার বোর্ড এর স্বীকৃত নার্সারি বা যেকোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের নার্সারি থেকে ফল গাছ কেনা উচিত। ফলগাছ রোপণের সময় যেসব কাজ করা হয় তার ওপর নির্ভর করে ভবিষ্যৎ গাছের বৃদ্ধি। গর্ত খনন থেকে শুরু করে চারাকলম রোপণ পর্যন্ত সকল কাজের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। এসব নিয়ম ঠিকমতো মানা না হলে গাছের বৃদ্ধিই শুধু নয়, ফলনের ওপরও প্রভাব পড়ে। তাই প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দেয়ার দরকার আছে।
![](http://www.abekshan.com/wp-content/uploads/2021/04/WhatsApp-Image-2021-04-05-at-21.37.03-1-1024x576.jpeg)
গর্ত তৈরিঃ
আমগাছের কলম লাগানোর জন্য যত বড় গর্ত করতে হবে পেয়ারার জন্য তা নয়, কাগজী লেবুর জন্য গর্ত হবে তার চেয়েও ছোট। বড় গাছ যেমন- আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদির জন্যও গর্তের মাপ হবে সব দিকে ৯০ সেন্টিমিটার। মাঝারি গাছ যেমনন্ধ পেয়ারা, বাতাবিলেবু, কমলা, জামরুল ইত্যাদির জন্য গর্তের মাপ হবে সব দিকে ৭৫ সেন্টিমিটার। ছোট গাছ যেমন- কাগজী লেবু, করমচা, কলা, পেঁপে ইত্যাদির জন্য গর্তের মাপ হবে সব দিকে ৪৫ সেন্টিমিটার। ওপরের মাপে গর্ত খননের সময় ওপরের মাটি গর্তের এক পাশে এবং নিচের মাটি গর্তের আরেক পাশে রেখে প্রথমে জৈব সার মেশাতে হবে। এভাবে রেখে দেয়ার ৪ থেকে ৫ দিন পর গাছ রোপণের ৩ থেকে ৪ দিন আগে রাসায়নিক সার মেশাতে হবে। এ সময়ে মাঝে মাঝে এই সার মিশ্রিত মাটি ওলট-পালট করে দিতে হবে।
![](https://www.abekshan.com/wp-content/uploads/2021/04/WhatsApp-Image-2021-04-05-at-21.54.40.jpeg)
রোপণের সময়ঃ
বর্ষার আগে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) বা বর্ষার শুরুতে (আষাঢ়) এবং বর্ষার শেষে (ভাদ্র-আশ্বিন) ফলগাছের চারাকলম রোপণ করা যেতে পারে। তবে জমি সুনিষ্কাশিত ও বেলে দো-আঁশ প্রকৃতির হলে বর্ষায়ও (আষাঢ়-শ্রাবণ) বৃষ্টির দিন ছাড়া রোপণ করা যায়। শীতকালে চারাকলমের নতুন শিকড় গজায় না বা শিকড়ের বৃদ্ধি আশানুরূপ হয় না বলে শীতের সময় রোপণ না করা ভালো। বিকেলবেলা চারা বা কলম রোপণের উপযুক্ত সময়।
রোপণ পদ্ধতিঃ
চারাকলম লাগানোরও বেশ কিছু নিয়ম আছে যেমন- মাটির মধ্যে কতটুকু পুঁতবেন, লাগানোর সময় কোনো ডাল-পাতা ছেঁটে দেবেন কি না অথবা নার্সারি থেকে কিনে এনেই চারাটি লাগাবেন কি না ইত্যাদি। কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চারাকলম লাগালে ওগুলো ভালো থাকে।
যেমন কলম করে সাথে সাথেই বাগানে রোপণ করা চলবে না। তা করলে গাছ রোপণজনিত আঘাতে মরে যেতে পারে এবং কলমের জোড়া খুলে যেতে পারে। সে জন্য কলম করার অন্তত কয়েক মাস পরে তা রোপণ করা ভালো।
রোপণ করার আগে চাষ ও মই দিয়ে বাগানের মাটি সমতল করে নেয়া উচিত। রোপণের আগে অবশ্যই দূরত্ব ঠিক করে নকশা করে নেয়া উচিত। গ্রীষ্মেই এ কাজ করে ফেলতে হবে।
রোপণের অন্তত ২৫ দিন আগে গর্ত তৈরি করে সার মাটি ভরে রাখতে হবে। গর্ত প্রতি ৫-১০ কেজি গোবর সার, ১০০-১৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৫০-২০০ গ্রাম এসএসপি এবং ৭৫-১৫০ গ্রাম এমওপি সার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
![](https://www.abekshan.com/wp-content/uploads/2021/04/WhatsApp-Image-2021-04-05-at-21.37.00-1024x576.jpeg)
রোপণের কয়েক দিন আগে চারা বা কলম সংগ্রহ করে হার্ডেনিং করতে হবে। এ জন্য ছায়াযুক্ত জায়গায় কয়েক দিন চারাকলম শুইয়ে রেখে পাতা ঝরাতে হবে। মাঝে মাঝে গোড়ার মাটিতে ও গাছে হালকা জলের ছিটা দিতে হবে। এতে গাছের রোপণোত্তর মৃত্যুঝুঁকি কমে যায়।
লাগানোর সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন চারাকলমের গোড়ার মাটি যেন ভেঙে না যায়।
মাটির টবে বা পলিব্যাগে চারাকলম থাকলে কিছুটা জল দিয়ে মাটি সামান্য নরম করে নিতে হবে। এরপর টব মাটিতে কাত করে গড়িয়ে এবং পলিব্যাগ গড়িয়ে বা দুই হাতের তালু দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চেপে নরম করে নিতে হয়। টব বা পলিব্যাগের চারাকলমের গোড়ায় হাত দিয়ে চেপে ধরে সম্পূর্ণ চারা বা কলমটি উল্টো করে ধরে টব বা পলিব্যাগ ওপরের দিকে টান দিলে বা টবটির কিনারা শক্ত কোনো জায়গায় ধীরে ধীরে টোকা দিলে মাটির বলটি বেরিয়ে আসে এবং সেটি গর্তে স্খাপন করতে হয়। অবশ্য পলিব্যাগের চারাকলমের ক্ষেত্রে চাকু বা ব্লেড দিয়ে পলিব্যাগের এক দিক কেটে অথবা মাটির টবটির চার দিক আস্তে আস্তে ভেঙে দিয়ে মাটির সম্পূর্ণ বলটি বের করে এনেও গর্তে বসানো যায়।
গর্তে বসানোর সময় চারাকলমের গোড়া টবে বা পলিব্যাগে যে পর্যন্ত গোড়ায় মাটি ছিল বা বাইরে ছিল সে পর্যন্তই বাইরে রাখতে হয়। এর বেশি পুঁতে দেয়া বা ওপরে রাখা কোনোটাই ঠিক নয়।
রোপণের সময় অতিরিক্ত পাতা ছাঁটাই করে দিতে হয়। তবে এটি সতর্কতার সাথে করতে হয়, যেন চারাকলমের গাছটি আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। চারা কলম রোপণের পর গোড়ার মাটি কিছুটা চেপে দিয়ে জল ছিটিয়ে দিতে হয়।
![](https://www.abekshan.com/wp-content/uploads/2021/04/WhatsApp-Image-2021-04-05-at-21.29.21-576x1024.jpeg)
চারাকলম যদি বড় হয় তবে এটিকে সোজা ও শক্ত রাখার জন্য গাছ থেকে ১০-১৫ সেন্টিমিটার দূরে একটি খুঁটি পুঁতে একটু কাত করে সুতলী দিয়ে হালকাভাবে বেঁধে দিতে হয়। শক্ত করে বাঁধলে অনেক সময় চারাকলমের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ঝড়ো বাতাসে উপড়ে যাওয়া থেকে চারাকলমকে এই খুঁটি রক্ষা করে।চারাকলমের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে বেড়া বা খাঁচার ব্যবস্খা করতে হয়। নতুন কুঁড়ি বা পাতা না আসা পর্যন্ত গাছে উপরি সার দেয়ার প্রয়োজন নেই। তবে এই সময়ে গাছের গোড়ায় প্রয়োজন অনুযায়ী জল সেচের ব্যবস্থা করতে হয়।
লেখকঃ কৃষি গবেষক, পল্লী শিক্ষা ভবন, বিশ্বভারতী, শ্রীনিকেতন