ফেরোমন ফাঁদ একটি সাশ্রয়ী, কার্যকর ও বিশ্বস্ত জৈব দমন ব্যবস্থা
অগ্নিভ হালদার ##
প্রাকৃতিক দূর্যোগ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের রোগ ও পোকার আক্রমণে ফসল উৎপাদন ব্যহত হয়। এই উপদ্রব থেকে মুক্তি পেতে চাষীভাইরা নিরুপায় হয়ে যথেচ্ছ ভাবে রাসায়নিক রোগনাশক ও কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকেন। এতে পরিবেশ যেমন দূষিত হয় তেমন বিষযুক্ত ফল ও সবজি খেয়ে মানুষ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়। অপরদিকে, রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করে এই পোকা দমনে সাময়িক স্বস্তি পাওয়া গেলেও রাসায়নিক কীটনাশকের প্রতি খুব দ্রুত রেজিস্টেন্স হয়ে পড়ায় অদূর ভবিষ্যতে মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে পোকাটি। সম্প্রতি জৈব পদ্ধতিতে বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে পরম্পরাগত পদ্ধতির পাশাপাশি বিজ্ঞানীদের গবেষণা লব্ধ জৈব প্রযুক্তির প্রয়োগও শুরু হয়েছে। তার মধ্যে পোকার ফাঁদ একটি প্রযুক্তি যা বেশ কিছু কীট দমনে ব্যবহৃত হয়।
ফেরোমন ফাঁদ
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম পরিবেশ বান্ধব পোকা দমন পদ্ধতি হচ্ছে ফাঁদ ব্যবহারের মাধ্যমে পোকা দমন। এর মধ্যে ফেরোমন ফাঁদ একটি আধুনিক পতঙ্গ দমন পদ্ধতি। পুরুষ পোকাকে প্রজননকার্যে কাছে আকৃষ্ট করার জন্য স্ত্রী পোকা একধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে, যা সেক্স ফেরোমেন নামে পরিচিত। ফাঁদে ব্যবহৃত টোপটিতে স্ত্রী পোকার নিসৃত সেক্স ফেরোমেন কৃত্রিমভাবে বেশ কয়েক গুন বৃদ্ধি করে দেয়া থাকে যাতে আকৃষ্ট হয়ে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষপোকা বক্সের ভিতরে প্রবেশ করে। এভাবে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ পোকা মারার মাধ্যমে কীড়া পোকার বংশ বৃদ্ধি বন্ধ করার মাধ্যমে পোকা দমন করা হয়।
সাধারণত ৩ টি উদ্দেশ্যে এ ফাঁদ ব্যবহার হয় যথা-
০১. পোকার উপস্থিতি মনিটরিং বা পর্যবেক্ষণ
করা;
০২. অধিক হারে পোকা আটকানো এবং;
০৩. পোকার প্রজনন কাজে বাধার সৃষ্টি করা।
বিভিন্ন ধরনের সেক্স ফেরোমন টোপ (লিউর)
১) লুসি ডিটেক্টর লিউর:
বেগুনের মাজরা পোকা (ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা) দমনে ব্যবহার করা হয়। এটি দুটি যৌগিক পদার্থ যেমন- ই-১১-হেক্সডেসিনাইল এসিটেট এবং ই-১১-হেক্সডিসেন-১ অল সমন্বয়ে গঠিত। এ যৌগদুটির ১০০:১ অনুপাতে মিশ্রণ সর্বাধিক সংখ্যক পুরুষ মথ আকৃষ্ট করতে সক্ষম।
২) স্পোডোলিউর:
ফুলকপি, বাঁধাকপি, তরমুজ কচুর লেদা পোকা ও টমেটোর ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনে ব্যবহার করা হয়।
৩) কিউ-ফেরোলিউর:
কুমড়ো জাতীয় ফসল (লাউ, মিষ্টিকুমড়ো, চালকুমড়ো, শশা, ঝিঙ্গে, করলা, কাকরোল, তরমুজ, চিচিঙ্গা, পটল ইত্যাদি) এর মাছি পোকা দমনে ব্যবহার করা হয়।
৪) ব্যাকটো ডিলিউর:
আম, পেয়ারা, কমলা, কুল ইত্যাদি ফলের মাছি পোকা দমনে ব্যবহার করা হয়। মিথাইল ইউজিনল নামক সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করে বিপুল সংখ্যক পুরুষ মাছি পোকা আকৃষ্ট করে ফাঁদে আটকিয়ে ফেলে এ পোকার বংশবৃদ্ধি রোধ করার মাধ্যমে এ পোকার আক্রমণ কমানো সম্ভব।
![](http://www.abekshan.com/wp-content/uploads/2020/04/IMG_20161025_071850-768x1024.jpg)
ফেরোমন ফাঁদ এবং টোপের দাম
ফসল ভেদে প্রতিটি সেক্স ফেরোমন টোপের দাম ২০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে। ফেরোমন টোপ সহ ফাঁদের দাম ৫০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে।
ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারের সুবিধাঃ
- সেক্স ফেরোমন প্রাকৃতিক রাসায়নিক পদার্থ, তাই এটি পরিবেশের কোন ক্ষতি করে না বিধায় এটি সম্পূর্ণ ভাবে পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি।
- এপদ্ধিতিতেবিষমুক্তসবজীওঅন্যান্যফসলউৎপাদনকরাযায়।
- এ পদ্ধতির ব্যবহার বিধি অত্যন্ত সহজ।
- কম খরচে ও কম সময়ে ক্ষতিকর পোকা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করা যায়।
- বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা, ফল গাছের মাছি এবং কুমড়ো জাতীয় ফসলের ফলের মাছি পোকা কার্যকর ভাবে দমন করা সম্ভব।
- সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারে শুধু ক্ষতিকর পোকা মারা যায়। যেখানে কীটনাশক প্রয়োগ করলে ক্ষতিকর এবং উপকারী দুই ধরনের পোকাই মারা যায়।
- ফেরোমন ব্যবহারে ফসলের গুণগত মান ভালো পাওয়া যায়।
![](http://www.abekshan.com/wp-content/uploads/2020/04/IMG_20170415_103332-1-1024x768.jpg)
ফেরোমন ফাঁদ তৈরি ও স্থাপনের পদ্ধতি
উপকরণ: ফেরোমন লিউর, প্লাষ্টিক বৈয়াম, তার, সাবানগুড়ো/নীমপাতারনির্জাস, জল ও বাঁশের খুঁটি।
১. প্লাষ্টিক বৈয়ামের ত্রিকোনাকার ভাবে কাটা অংশের মাঝ বরাবর তার দিয়ে ফেরোমন লিউর / টোপটি ঝুলিয়ে দিতে হবে।
২. গাছের সম উচ্চতায় ফেরোমন ফাঁদটি দুটি খুটির সাহায্যে শক্তভাবে বেধেঁ দিতে হবে। তবে যেহেতু ক্ষতিকর পোকা ফল অথবা ডগা ছিদ্র করে সে জন্য ফুল ও ডগার কাছাকাছি বক্সটিকে রাখতে হবে।
৩. বক্সটির/বৈয়ামের ভিতরে কর্তিত অংশ( ২-৩সে.মি.) পর্যন্ত গুড়ো সাবান/ নীম পাতার নির্জাস মিশ্রিত জল দিতে হবে।
৪. কর্তিত অংশ উত্তর – দক্ষিন মুখ করে ঝুলাতে হবে।
৫. ফেরোমনলিউর / টোপটি যাতে সাবানের জলে না ভিজে যায় সে জন্য জলের কিছুটা উপরে রাখতে হবে।
৬.বৃষ্টির জলে যাতে ফেরোমন লিউর / টোপটি না ভিজে যায় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৭.বিভিন্ন কোম্পানী প্লাস্টিকের ফাঁদ তৈরী করে বাজারজাত করছে।
![](http://www.abekshan.com/wp-content/uploads/2020/04/IMG_20161025_071830-1024x768.jpg)
জমিতে ফাঁদ স্থাপনের সময় ও হার
বেগুন ফসলের জমিতে সাধারণত চারা রোপণের ৪-৫ সপ্তাহ পর থেকেই বেগুনের কচি ডগায় ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ শুরু হয়। তাই ফসলের এ পর্যায় হতেই ফাঁদ স্থাপন করা আবশ্যক। সাধারণত অন্য বেগুনের জমি বা আশপাশের পুরনো শুকনো বেগুন গাছের স্তূপ থেকে পোকার মথ জমিতে আসে এবং পরে ডগা ও ফলে বংশবৃদ্ধি করে। সে কারণে পোকা সফল ভাবে দমন করার জন্য শেষ বার ফসল সংগ্রহ করা পর্যন্ত ফেরোমন ফাঁদ জমিতে রাখতে।
কপির চারা লাগানোর ১ সপ্তাহের মধ্যে ফাঁদ স্থাপন করতে হবে, কচুর ক্ষেত্রে বীজ লাগানোর ৩০-৩৫ দিনের মধ্যে লাগাতে হবে।
কুমড়ো জাতীয় ফসলের জন্য ফুল ফোটার আগেই জমিতে ফাঁদ বসাতে হবে। সফল ভাবে পোকা দমনের জন্য ফসলের শেষ পর্যন্ত ফেরোমেন ফাঁদ জমিতে রাখতে হবে। আম, পেয়ারা, কমলা, কুল ইত্যাদির ফল মার্বেল আকৃতির হলে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে।
ফাঁদগুলি বেগুনের ক্ষেতে ১০-১৫ মিটার, কুমড়ো জাতীয় ফসলে এবং ফলবাগানে ১২ মিটার এবং কপি জাতীয় সবজি ক্ষেতে ২৫ মিটার দূরত্বে স্থাপন করতে হবে।
বেগুন ক্ষেতে বিঘা প্রতি ১৩ থেকে ১৪টি ফাঁদ, কুমড়ো জাতীয় সবজি ও ফল গাছের মাছিপোকা নিয়ন্ত্রণে বিঘা প্রতি ১১টি এবং কপি ক্ষেতে বিঘা প্রতি ৬ টি ফাঁদ বসাতে হবে।
বেগুন গাছের ঠিক উপরে, কুমড়ো জাতীয় গাছের মাচা বরাবর ঝুলিয়ে এবং আম, পেয়ারা গাছে মাটি থেকে হাত উচিয়ে যত টুকু উঠানো যায় ঠিক ততোটুকু উচ্চতায় সেক্স ফেরোমন ফাঁদ স্থাপন করতে হয়। ফসলের উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে ফেরোমেন ফাঁদ এর উচ্চতাও বাড়াতে হবে।
![](http://www.abekshan.com/wp-content/uploads/2020/04/IMG_20181214_083031-1024x768.jpg)
ফাঁদ জমিতে স্থাপনের পর করণীয়
প্রতিদিন ফাঁদ পর্যবেক্ষণ করতে হবে;
প্রতিদিন ফাঁদের জল পরীক্ষা করে মরে থাকা পোকা ফাঁদের জল থেকে আঙুল/কাঠি দিয়ে সরিয়ে ফেলতে হবে;
২-৩ দিন পর পর সাবানের জল পাল্টে দিতে হবে;
সাবান জলের স্তর সব সময় ৩-৪ সেন্টিমিটার যাতে থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে;
ফাটা বা ছিদ্রযুক্ত ফাঁদ পাল্টিয়ে নুতন ফাঁদ প্রতিস্থাপন করতে হবে;
লিউর স্থাপনের সময় লিউরটির মুখ কোনো ভাবেই খোলা যাবে না।
ফাঁদ ও টোপ পরিবর্তনের সময়
সাধারণত ফাঁদ সহজে নষ্ট হয় না। সাবধানতা ও যত্নের সাথে ব্যবহার করলে এ ধরনের একটি ফাঁদ ২-৩ মৌসুম পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। অতিরিক্ত বৃষ্টি, রোদ বা বাতাসে ফাঁদ নষ্ট হতে পারে। সে ক্ষেত্রে দেরি না করে জমিতে নতুন ফাঁদ স্থাপন করতে হবে।
বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার জন্য ব্যবহৃত অধিকাংশ ফেরোমন টিউব/টোপ/ লিউরএ সাধারণত ৩ মিলিগ্রাম পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থ থাকে। এ সব টোপ দেড় থেকে ২-৩ মাস কার্যক্ষম থাকে, সে জন্য ২ থেকে ৩ মাস পর টোপ পরিবর্তন করা দরকার। একটি বেগুন মৌসুমে প্রায় ২টি টোপ প্রয়োজন হয়।
কুমড়ো জাতীয় সবজি ও ফলের মাছির ক্ষেত্রে এক একটি টোপ পুরো একটি ফসলের মৌসুম ধরে সক্রিয় থাকে তাই সাধারাণত টোপ পরিবর্তন করা দরকার হ্য় না।
![](http://www.abekshan.com/wp-content/uploads/2020/04/IMG_20200402_061123-768x1024.jpg)
বিশেষ সাবধানতা ও করণীয়
বিভিন্ন ফসলের জন্য আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য বিশিষ্ট সেক্স ফেরোমন লিউর ব্যবহার করা হয়। লিউরগুলোর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও ভিন্নতা আছে ফলে লিউরগুলো ব্যবহার করার সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।
লিওর সংরক্ষণের পদ্ধতি
ফেরোমন টোপগুলো সিল করা প্যাকেটের মধ্যে রক্ষিত থাকে এবং এ অবস্থায় ১-২ বছর সংরক্ষণ করা যায়।
বেগুন ও কপিতে ব্যবহারের জন্য লিউরগুলো অবশ্যই ডিপ ফ্রিজে রাখতে হয়, তা না হলে লিউরগুলোর কার্যক্ষমতা দিনে দিনে কমে যায়। অন্যদিকে কুমড়া জাতীয় এবং ফলগাছের মাছির লিউরগুলো স্বাভাবিক রেফ্রিজারেটর বা নরমাল ফ্রিজে রাখা যায়। প্যাকেট থেকে খোলা হয়ে গেলে সেই লিউরকে সঙ্গে সঙ্গে মাঠে ব্যবহারের জন্য ফাঁদের মধ্যে লাগিয়ে দেয়া উচিত।
শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার গুণগত মান বৃদ্ধি ও বিষমুক্ত চাষ বর্তমানে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এই বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনের এক যুগান্তকারী পদ্ধতি হল ফেরোমেন ফাঁদ। সরকারি কৃষি বিভাগ ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রচারের ফলে এর ব্যবহার যথেষ্ট বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশ বান্ধব তথা বিষমুক্ত চাষের জন্য যা অবশ্যই একটি আশার কথা।
আম,লেবু,পেয়ারা ইত্যাদি বহুবর্ষজীবী গাছের ফেরোমেন টোপ কি?
ব্যবহার বিধিই বা কি পরিস্কার হলো না।
মিথাইল ইউজিনল নামক ফেরোমন