বজ্রপাত ও আমাদের করণীয়: প্রাসঙ্গিক আলোচনা

দেবজ্যোতি চক্রবর্ত্তি, কলকাতা ##

বজ্রপাত নিয়ে আমাদের অনেকের ধারণাটা অস্পষ্ট।   কেন বজ্রপাত হয় সেটা যেমন জানা দরকার তার থেকেও বেশি জরুরি কি ভাবে নিজেকে ও অন্যদের সুরক্ষিত করা যায়।  আমাদের সঠিক ধারণার অভাবে ও বজ্রপাতের সময় নিজেকে কি ভাবে সুরক্ষিত করা যায় সেটা সম্পর্কে ঠিক ঠাক না জানার ফলে নিজেদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হচ্ছে।  ফলত বজ্রপাতে দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর ঘটনা অনেকটাই বেড়ে চলেছে।  বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে অনেক প্রাকৃতিক ঘটনা (weather events )  বর্তমান সময়ে অনেক বেশি মাত্রাতে দেখতে পাচ্ছি, এ সবের মধ্যে বজ্রপাত অনেকটাই বেশি পরিসর দখল করেছে।  সাম্প্রতিক কালের “Earth Network: India Lightning Report 2019” জানাচ্ছে যে ২৭.৪% বজ্রপাত মেঘে হয়েছে আর ৭২.৬% বজ্রপাত মেঘ থেকে মাটিতে পড়েছে, যেটা চিন্তার কারণ।

২০১৯ সালে সবথেকে বেশি বজ্রপাতের হিসেবে(count) ওড়িশার পরেই পশ্চিমবঙ্গের নাম উঠে আসছে আর তৃতীয় স্থানে আছে ঝাড়খণ্ড।  খেয়াল করলে দেখা যাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গ সহ তার  প্রতিবেশী রাজ্য প্রথম ও তৃতীয় স্থানে আছে।  আমরা যে রাজ্যতে আছি সেই রাজ্যে বজ্রপাত জনিত বিপদ সবথেকে বেশি, অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে যত বেশি মৃত্যু হয় তার থেকে বেশি কেবলমাত্র বজ্রপাতে হয়ে থাকে ।  কিন্ত আমরা গুরুত্ত্ব দিয়ে দেখিনা।  আমরা সচেতন নই।  কেবলমাত্র অগাস্ট ২০১৯ এ পুরুলিয়া জেলাতে ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বজ্রপাতে ।  এখনো পর্যন্ত ১২৫ জন সহ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে বজ্রপাতে (2019) ।

আমাদের ভুল ধারণা যে বজ্রপাতের সময় গাছ একটি নিরাপদ আশ্রয়, একই ভাবে খোলা জায়গায় থাকা বিপদকে ডেকে আনার সামিল।  মোবাইল এ কথা বলা, বারান্দাতে দাঁড়ানো, লোহার গ্রিল ধরে দাঁড়ানো, লোহার চেয়ার টেবিল এ বসে থাকা ও একসাথে দলবেঁধে থাকা এই গুলো সবকটাই ভুল কাজ।   সমস্ত বৈদ্যুতিক জিনিস প্লাগ থেকে খুলে ফেলতে হবে, এই কাজটিও সাবধানতার সাথে করতে হবে।   খোলা জায়গা থেকে তাড়াতাড়ি সরে এসে পাকাবাড়ির ভেতরে আশ্রয় নিতে হবে।  যদি বজ্রপাতের সময় বাইরে থাকা হয় তা হলে খেয়াল রাখতে হবে কখনোই নিজে যেন খোলা জায়গায় সবথেকে উঁচু বস্তু না হই, আবার মাটিতে শুয়ে পড়াও যাবে না,  নিজেকে যতটা সম্ভব গুটিয়ে, পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর ভর দিয়ে, দুপায়ের গোড়ালি এক করে “ভি” আকৃতির মত্ত করে দু কানে হাত দিয়ে চেপে বসে থাকতে হবে ।

সাঁতারকাটা, মাছ ধরা, পুকুর, নদী ও অন্যান্য জলাশয় (সুইমিং পুলও এর মধ্যে পড়ে!) এর কাছে থাকা,  নৌকা করে ভ্রমণ এই সব কাজ  বজ্রপাতের সম্ভাবনা দেখা দিলে করা যাবে না।  এমনকি টিউবওয়েল থেকে জল তোলা, স্নান করা বা ট্যাপের কলের জলের ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে,  কারণ ধাতব বস্তু বিদ্যুতের সুপরিবাহী,  সেই কারণে বজ্রপাত হলে লোহার ও যুগপৎ জলের সাথে পাইপ দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে তড়িতাহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।  মনে করতে পারেন সাম্প্রতিক কালে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল এর বাগানে বজ্রপাতে এক ব্যক্তির মৃত্যু ও অন্যান্যরা মাটিতে জমে থাকা জলে দাড়িয়ে থাকার জন্য জলের মাধ্যমে তড়িতাহত হয়েছিলেন। বজ্রপাত সরাসরি ওনাদের ওপর হয়নি কিন্তু মাটিতে জমাজলের মধ্যে দিয়ে তড়িৎ প্রবাহের কারণে বজ্রাহত হন।  কাছাকাছি বজ্রপাত হলে অনেক সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ঘটে থাকে।   বিশেষকরে বাচ্ছাদের মধ্যে ভয়, উদ্বেগ ও অন্যান্য মানসিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।   পূর্ণবয়স্কদের মধ্যেও দেখা যেতে পারে এই সব অস্থিরতা।   তথাপি আমরা কিন্তু সচেতন নই।   ঝড় বৃষ্টি ও বজ্রপাত হয়ে যাওয়ার আধঘন্টা পরে বাইরে বেরনো উচিত।   এটা মনে রাখা দরকার যে বিনা মেঘে বজ্রপাতের বিষয়টিও ঘটতে পারে, অর্থাৎ একটি শক্তিশালী ধনাত্মক বজ্র বিদ্যুৎ প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরেও প্রভাব ফেলতে পারে।

বর্তমানে স্মার্টফোনের যুগে অনেক App আছে যারা বজ্রপাতের বিষয় সতর্ক করে দেয়।   ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তরের ওয়েবসাইটেও বজ্রপাতের সতর্কতা দেওয়া হচ্ছে।   এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের WB Weather Alert ,  ভারত সরকারের  “Damini  – Lightning  Alert ” এই “App ” গুলোকে ইনস্টল করতে পারেন ।

বজ্রপাতের বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার সবার,  এর মধ্যে যারা বাইরে কাজ করেন তাদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।   এর সাথে আসছে স্কুল ও তার সাথে যুক্ত সকলকে।   ছোটরা মাঠে দৌড়াদৌড়ি করবেই একই ভাবে ক্লাস চলাকালীনও বজ্রপাত হতে পারে।   তাই শিক্ষক শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীবৃন্দদের সতর্ক থাকতে হবে ।  স্কুলে মাঝে মাঝেই বজ্রপাতের বিষয়ে সতর্কতামূলক (অন্যান্য বিপদ নিয়েও আলোচনা করতে হবে) আলোচনা করতে হবে।

ক্লাব ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনদেরও এই বিষয়ে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করতে হবে।   প্রশাসনের তরফ থেকে সচেতনতা শিবির ও প্রচারমূলক পুস্তিকা,  ব্যানার,  লিফলেট ও টিভিতে প্রচার করা হচ্ছে কিন্তু সামগ্রিকভাবে সচেতন হতে হবে প্রত্যেক ব্যক্তি ও সমষ্টিকে।   নিজেকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে, বজ্রপাতে মৃত্যু বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে অন্য কেউ বাইরে থেকে এসে রক্ষা করতে পারবে না। এ ব্যাপারে নিজে সচেতন হয়ে অন্যদের সচেতন করতে হবে।

লেখক বিপর্যয় মোকাবিলা  বিষয়ের একজন প্রশিক্ষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

sixteen − five =