বন্ধন

দীপ কুমার, কলকাতা 

 

নদীর কূল থেকে সন্তান তীরে উঠিলে যেমন মায়ের মন তার দেহে ফেরে, স্বামীর চাকুরী থেকে অবসর না পাওয়া পর্যন্ত যেন বাংলার নারীজাতির ঘরে স্বাধীনতা ফেরে না, ডানা আছে কিন্তু উড়িবার কোথাও একটা যেন বাধন থাকিয়া যায়। স্বাধীন দেশের ছোট্ট একটি সংসারে চাকুরি থেকে অবসর আনিয়া স্ত্রী অনিন্দিতাকে সেই সুখ উপহার দিতে  পারিয়াছেন গৌরব। জলে ডোবা পদ্ম যেমন ফিরে সূর্যের রস্মি মেখে গভীর সুখে ভ্রমর গুঞ্জরে ঘুমাইয়া যায় আবার ঘুমের থেকে জাগে সেরকমই সুখে স্ত্রী অনিন্দিতার ভোরের ঘুম ভাঙিল  আজ। বেশ কয়েকদিন হইল স্বামী গৌরব চাকুরি  থেকে অবসর পাইয়াছেন । আজ ১০ টার ট্রেনে হাওড়া থেকে তাদের পুরি জগন্নাথ দর্শনে যাওয়ার কথা। বিবাহের পড় হইতে একবার অফিসের ট্যুরে রাজস্থান যাওয়া ছাড়া তাদের আর বেড়ানো হয়নি। তাই খুব আনন্দের সহিত সেজে গুজে অনিন্দিতা স্বামী গৌরবকে বলেন, “কি গো দেখতো কেমন লাগছে আমাকে?” খবরের কাগজটা সরিয়ে চশমাটা একটু নাড়িয়ে বলে, “একদম চিনি ছাড়া চায়ের মত অথবা ঝর্ণা ছাড়া নদীর মতই।”  অনিন্দিতার মুখটি একটু শুকিয়ে গেল। গৌরব বাবু উঠে সিন্দুকের দিকে যেয়ে থেমে গেলেন। বললেন ,”চাবিটা দেখি”,

_” কি করবে? ”

“দাও না, পুজোতে যে নেকলেসটি দিয়েছিলাম সেটি না পড়লে আমার পরি রানী যে ডানা ফিরে পাবে না।”

সংসারের ছোট বড় বিসর্জন স্ত্রী জাতি প্রত্যহ নীরবে বলিদান দিয়া থাকেন যাহা অন্তরীক্ষে প্রবেশ কারী ব্যাক্তি ছাড়া সংসারের কর্তা ব্যাক্তি মহা লক্ষ্মী টেরও পর্যন্ত পান না। এরই মধ্যে সাত সকালে দরজার কলিং বেলটা ক্রিং শব্দ করিয়া বাজিয়া উঠিল। গৌরব বাবু দরজা খুলতেই দেখেন তিন চার জন পুলিশ । একটু বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন কাহাকে চাই? একটু অদুরেই অফিসের ম্যানেজার বাবুকে দেখিতে পাইলেন। একজন পুলিশ তাহার ইশারায় গৌরব বাবুকে বলিলেন আপনাকে আমাদের সহিত থানায় যাইতে হইবে। পুলিশের গাড়িতে উঠে গৌরব বাবু পেছন ফিরিয়া শুধু একবার অনিন্দিতার মুখের দিকে দেখিয়াছিলেন। নারী রূপ আপন জনের দুঃখ ব্যাথায় যে গভীর শোক মূর্তি বহন করে তা কোন শিল্পী পাথরে খোদায় করে দেখাতে পারে না। একমাত্র নারী শুধু যেন জগৎ সংসারে দুঃখ ব্যাথার বর্ণনা দিতে পারে। অফিসের ম্যাগাজিনে তিনি বহুবার নারী ভাবনার গল্প- কবিতা, প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন। আজ নিজের স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাইয়া যে রচনার দৃশ্য পড়িলেন তাহা কখনো তিনি কাগজে লিখিতে পারিবেন না ঠিকই আর না লিখিতেও  চাহিয়া যেন হৃদয়ে ব্যাথা ভরা বর্ণমালায় বাঁধা হইয়া গেল।

পুলিশের গাড়িতে যেতে যেতে শুনিয়াছিলেন গত রাত্রে তাহার কর্মরত অফিসের সমস্ত তালা খুলে সেখান থেকে বহু টাকা পয়সা চুরি হইয়াছে। ওই ঘরের চাবি যেহেতু কয়েকদিন আগে পর্যন্ত গৌরব বাবুর কাছেই ছিল তাছাড়া প্রমাণ স্বরূপ অফিসের ব্যালকনিতে তাহার ব্যাবহৃত অতি পরিচিত দামি শালটি পাওয়া গেছে। গৌরব বাবু বুঝিলেন কাজটি তাহার ছেলে বন্ধন করিয়াছে। তাহার কাছে চাবি গুলি থাকার সময় সে এগুলোর নকল বানাইয়া রাখিয়াছিল । শুধু স্ত্রীর কথা ভেবে তিনি নিঃশব্দে এ কু-কর্মের সাজা কোনরূপ আপত্তি ছাড়া মানিয়া লইলেন।

কয়েকবছর জেলে কাটাইবার পর যখন এক সন্ধ্যায় গলির পথ ধরে বাড়ি ফিরিলেন পৌঁছে দেখেন তাহার বাড়ি কোথায়! সেখানে তো বিশালাকার অট্টালিকা। বুঝিতে পারিলেন তাহার অবর্তমানে বন্ধন প্রমোটার দিয়ে এ কাজ করিয়াছে। গেটে আলোর ঝর্ণা। গেট দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করতেই বললেন,  “এ বাড়ির ম্যাডামের জন্মদিন আজ। তাই বড় অনুষ্ঠান চলিতেছে।” গেটে অপরিচিত লোক দেখে ভেতর থেকে এক অল্প বয়সি মেয়ে গেট দারোয়ানকে বললে, “কোন অপরিচিত ব্যাক্তি যেন গেটে ভিড় না করে।”। হালকা আলোর মাঝেই ওই মেয়েটির গলায় সেই প্রিয় নেকলেসটি এত বছর পর দেখিতে পাইলেন। মানুষ যেমন মৃত্যু কালে তার প্রিয় ব্যাক্তির নাম ভোলে না তেমনি পত্নি প্রেমের স্মৃতি হিসাবে প্রেমিক তার প্রিয় উপহার কখনই ভুলতে পারে না! মাঝে এত গুলো বছর তো নিজের স্ত্রী আর ওই নেকলেসের গল্পই লিখে রেখেছেন জেলের কংক্রিটের প্রতি বিন্দু বালুকনার বুকে। সেখানে ওই সামান্য লোহার শিক গুলো যেভাবে মনের কোনায় পরিচিত হইয়াছে, সমাজের মানুষগুলো যেন চোখের কোনায় সেভাবে পরিচিত হইতে পারে নাই। বন্ধনকে হাসি ঠাট্টার উৎসবে বন্ধুদের ভিড়ে একনজর দেখা গেল। গেট দারয়ানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন গৌরব বাবু, “ওই সুন্দরী ম্যাডাম কি বন্ধন বাবুর স্ত্রী?”  উত্তর মেলেনি। যা মিলেছিল তা নিতান্তই বর্ণনাহীন আঘাতের চিহ্ন- ব্যাথারাও বোঝে তাই রক্তরা জমাট বাঁধে! সমাজের এখনো এমন নেতা আছেন যারা মনে প্রাণে চান নদী বাঁধ ভাঙুক সবার ঘরে জল ঢুকুক তাহলে আমাদের পকেটে যদি কিছু আসে।  কিন্তু তাদের সে ভাষা বুঝেই হয়ত নদী সাগর পানে ছুটে যায় নীরবে নিঃশব্দে। গৌরব বাবু অন্ধকারে যেখানে যেয়ে ধাক্কা খেলেন, সেখানে আর কেউ নয় তার স্ত্রী বাক হারা হইয়া পাগলিনীর মতো বসিয়াছিলেন। এইরুপ দেখিতে পাইয়া মনে মনে নিজেকে তিরস্কার করিতে লাগিলেন। তার এরুপ চরিত্রের জন্যে তিনি নিজেকেই কলঙ্কিত নায়ক আখ্যায়িত করছেন। আজ মনে হইতেছে, গেট দারোয়ান এবং ভিতরের কুকুর গুলি যেন সমাজে সঠিক পরিশ্রমের ন্যায় সুস্বাস্থ্যবান । নদী যেমন তার সমস্ত স্রোতে ডানা মেলে ছুটে যায় সাগরের মোহনার খোঁজে- সন্ধ্যার পরিচিত পথের অজানা মোড়ে তেমনি করে স্বস্ত্রীক হারিয়ে গেলেন নিরাশার বুকে পা ফেলে।

কখনো কখনো মানুষের অনিয়ম অমানবিক আচারনের বিরুদ্ধেও যেন প্রকৃতি গভীর ভাবে প্রতিবাদ জানায়। পরিবরতনের সময় যে কখন কাকে ছিকেই বাধিয়ে নেয় তা বন্ধনকে প্রত্যক্ষ করিলেই বোঝা যায়। কয়েক মাসের ব্যাবধানে সে এখন দুরারগ্য ব্যাধির সঙ্গী। আপন বলতে এখন সেই তার । বৃক্ষ হতে যে ডাল আলাদা হতে চায় এ ব্যাধি যেন বিধাতা তাকে উপহার দেয়। ঘরের এক কোনে প্রায় সে পড়িয়া থাকে। স্ত্রী বন্ধুর এক অফিসের হিসাব রক্ষক  পদে কর্মরত। প্রায় সে দেরি করে বাড়ি ফেরে। ছুটির দিনে কখনো কখনো বাইরের বন্ধুদের এনে ঘরোয়া মজলিস তৈরি করে। এখন যেন পাতা ঝরা গাছের ফাগুনের লালায়িত সুরভির মতো বন্ধন বৃক্ষ রুপে অসাহায়াত্ব অনুভব করে।

আজ ছুটির দিন মেঘলা আকাশ। সারাটা দিন ধরে টুপি টাপি বৃষ্টি পড়ছে। সারাটা পাড়া বৃষ্টির ছন্দে গান গাইলেও যেন এ বাড়িতে বন্ধনের শেখানো তানে এখনো ভিন্ন ছন্দে বেজে ওঠে । তাছাড়া বর্তমান সময় লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, কিছু নারী বন্ধু খোঁজার জন্য নিজের রূপের ডালে একটু হাঁসির বাসা বাঁধতেই কাক কোকিল বন্ধুর অভাব মেলে না। কাক হোক আর কোকিল হোক , এক বন্ধু বলেই বসলো বন্ধনের স্ত্রীকে- “তোমার স্বামী তো সারাক্ষণ বাড়িতে বসেই থাকে তা আজ একটু বিলেতির দোকানে পাঠাওনা।” কথাটি যদিও বন্ধন শুনতে পেয়েছিল তবুও স্ত্রীর অনুরোধ না করতে পারলো না। পৃথিবীটা সত্যি অন্যরকম বন্য সময় যেন রাবণ হয়ে মাঝে মাঝে আপন জনকে হরণ করে নেয়। কোন মতে একটি ছাতা নিয়ে বন্ধন অসুস্থ শরীরে বেড়িয়ে পড়ল। কিছুদূর যেয়ে সে সংজ্ঞাহীন হয়ে রাস্তায় পড়ে গেল। যখন জ্ঞান ফিরল তখন সে দেখে সে একটি আশ্রমের দোতলার ঘরে। আশ্রমের নতুন সাদা পোশাকটি যেন তাকে বহুবার নিজের গন্ধে পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করলো…কিন্তু ব্যার্থ। যেখানে ভালোবাসার ত্যাগ সীমানাহীন সেখানে বিচ্ছেদের মেঘ দিয়ে আলোর আকাশের বুক ঢাকার মতন  বোকামি আর কি হইতে পারে ! বন্ধন দু পা এগিয়ে পাশের ঘরে দেখতে পেল অনেক লোকের মাঝে দুজন ব্যাক্তি বসে আছেন। সকলের খুশির উৎস যেন তারাই দুজন।

আশ্রমের এক কর্তা ব্যাক্তিকে ডেকে উৎসুক চিত্তে জিজ্ঞেস করলে, “ওনারা দুজন কারা এবং এত লোক কেনই বা ওনাদের ঘিরে রেখেছেন?” লোকটি বললেন, বেশ কয়েক বছর পর গৌরব নামের ওই ব্যাক্তিটি তার স্ত্রীকে ফিরে পেলেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত  অসুস্থ স্ত্রীকে তিনি বাঁচাতে পারেননি। কিছুক্ষণ আগে তিনি গত হইয়াছেন। তাই আজ সারারাত্রি ধরে আমরা এভাবেই ওনার পাশে থাকবো। কাল দিবসে ওনার স্ত্রীর কৃতকর্ম করা হইবে।

উত্তরে আরও যা যা বলিলেন তাহা পুরোটাই বন্ধনের জানা ছিল। যেটি জানা ছিল না সেটি হল এই, “বহু বছর আগে এই আশ্রম থেকে ওনারা একটি ছেলে দত্তক নিয়েছিলেন তাঁর নাম বন্ধন।” একথা শুনিবার পর বাহিরে ঝড় বৃষ্টি থেমে গেলেও বন্ধনের হৃদয় আকাশের প্রান্তে প্রচণ্ড জোরে বজ্রধ্বনি হতে লাগিল। ফাঁদে পড়l  বগা যেমন তাঁর ব্যাথার ভাষা প্রকাশ করিতে পারে না তেমনি শুকনো গলায় বন্ধনের ভাষার কথারাও আর ভিজতে চাইছে না ।

… আর আজ  হয়তো বহু বছর পরে দুচোখের জলে আশ্রমটি বন্ধনের বন্ধুত্বের বার্তা ফিরে পেল।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

18 − 6 =