বরুনা-অসি সঙ্গমে

ইরাবতী

“যৌবনের বৃন্দাবন, বার্ধক্যের বারাণসী’’ – প্রবাদটি শুনে ধারনা হয়েছিল বারাণসী শুধুই বুঝি বৃদ্ধাবস্থায় জীবনের হাতে গোনা কয়েকটা দিন অতিবাহিত করবার এমন এক জায়গা, যেখানে নেই বাড়তি কিছু পাওয়ার আশা, নেই কোন অপেক্ষা, কোনও আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু পুণ্যক্ষেত্র বারাণসী দর্শন সুযোগ করে দিল এই শহরটাকে আরও একটু কাছ থেকে দেখার। পুণ্য, ভক্তি, কল্পকথা এবং ঐতিহ্যের শহর বারাণসী শুধু ভারতবাসীর কাছেই নয়, অসংখ্য বিদেশীর কাছেও তাদের “ One of the favourite tourist destination…”

পুরাণ মতে, দুই সহচরী নদী বরুণা এবং অসির উচ্ছল মিলন-মানসী আমাদের বারাণসী। গঙ্গা উপকূলে বারাণসী বা কাশী শহরের আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কথকথা। কথায় বলে কাশীর গলি আর ভুলভুলাইয়ার কোন ফারাক নেই। তবে এ শুধু কথার কথাই নয়, সত্যিই মূল সড়কপথ থেকে অসংখ্য গলি সরু, চওড়া এঁকে বেঁকে জুড়ে আছে একে অপরের সঙ্গে। কোন গলি দিয়ে ঢুকে যে কোথায় পৌছানো যায়, তা বোধহয় অতি বড় স্মৃতিধরেরও নাগালের বাইরে। আর সেই সর্পিল গলি পথে হঠাৎ আপনি পৌঁছে যেতেই পারেন ভাগীরথী সন্দর্শনে। উত্তরপ্রবাহী গঙ্গাতরঙ্গে ডুব দিয়ে শুদ্ধচিত্তে বিশ্বনাথ মহাদেবের দর্শনাকাঙ্খী লক্ষ লক্ষ ভক্ত পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেন গর্ভগৃহের উদ্দেশে।

“হরহর মহাদেব” –এর উচ্চকিত ধ্বনি মাতিয়ে রাখে বারাণসীর পথঘাট। আধুনিক সব রকম ছোঁয়া পেয়েও বারাণসী আজও ‘City of congestion’. লাখো মানুষ, যানবাহন আর দোকানপাটের ভিড়ে বারাণসীর রাস্তায় অলি-গলিতে অসংখ্য ষাড়ে-গোরু-মোষের অবাধ বিচরণ। বেনারসী পাতার মিষ্টি পানের খিলি সাজাতে সাজাতে চৌরাশিয়া বাবু যা বললেন, তার মর্মার্থ হল – বেনারসে এসে বৃষের বিষ্ঠায় পা না পড়লে নাকি পুণ্যার্জন সম্পূর্ণই হয় না। আবার এই শহরই ধীরে ধীরে প্রস্তুত হচ্ছে কলকাতা দিল্লি মুম্বইয়ের পাশাপাশি মেট্রো রেলের যোগাযোগ সমৃদ্ধ মেট্রো সিটির তালিকায় স্থান করে নিতে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিজের লোকসভা কেন্দ্র হলেও বারাণসী কিন্তু দিল্লির মত “privileged city” হয়ে উঠতে পারে নি। সাধারণ মানুষ ঘনঘন লোডশেডিং-এ নাজেহাল হলেও আশ্চর্যজনক ভাবে বিশ্বেশ্বর মহাদেবের গর্ভগৃহ বাতানুকুল যন্ত্রের নিরবচ্ছিন্ন পরিষেবাধীন।

১,২০৯ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপ্ত বারাণসী শহরকে ঘিরে রয়েছে ৮৭ টি গঙ্গার ঘাট। প্রতিটি ঘাটকে ঘিরে রয়েছে এক একটি কল্পকথা। মহাদেবের জটা নিঃসৃত পতিত পাবনী গঙ্গা প্রবাহে স্নান সেরে পাপ-শাপ মুক্তির আকুল আকুতিতে বিশ্বনাথ মন্দির সংলগ্ন দশাশ্বমেধ ঘাটে ভিড় হয় সব থেকে বেশি। তবে শুধু পুণ্যস্নানের উদ্দেশ্যেই নয়, জীবনানান্তে আত্মার পরমাত্মার সঙ্গে বিলিন হওয়ার ক্ষণটিতেও ধারমিক হিন্দুর একমাত্র কাঙ্খিত গন্তব্য শংকরমৌলিনীর স্নেহের আঁচল। আর তাই হিন্দু পৌরাণিক বিশ্বাস একের পর এক শবদাহের ভার বয়ে আনে মণিকর্ণিকা ঘাটে। কথিত, আজ পর্যন্ত কখনও মণিকর্ণিকা ঘাটে শবদাহের আগুন নির্বাপিত হয়নি। হবেও না। একের পর এক শবদেহ শায়িত রাখা হয় ঘাটের শেষ সিঁড়ি ছুঁইয়ে। জাতে ভগবতী ভাগিরথীর পুণ্যপ্রবাহ স্পর্শে চিরশান্তি পায় আত্মা। রাতের অন্ধকারে বহু দূরবর্তী কোনও প্রান্ত থেকেও অবিরাম দৃশ্য সদা প্রজ্বলিত চিতাগ্নি।

শেষকৃত্য শেষে একের পর এক চিতাভস্মাবশেষ বা অর্ধভস্মীভূত শবাংশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় গঙ্গার বুকে। তখন ‘নমঃ গঙ্গে বা নমামি গঙ্গে’-র মত গঙ্গা দূষণরোধী প্রকল্প খাতায়-কলমে ফাইল বন্দী হয়েই থেকে যায়। সম্প্রতি বারাণসী শহরের বুকে জমে উঠেছে ক্ষোভের বাতাস। গোটা ভারতবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ এবং দিল্লীর পর সব থেকে বেশি বাঙালি বসবাস করেন একমাত্র বারাণসীতেই। আর লাখো বাঙালির প্রিয় শহর বারাণসীতে দুর্গা পুজো নিয়ে যে উন্মাদনা থাকবে তা আর আশ্চর্য কি? কিন্তু পুজো শেষে মৃণ্ময়ী দুর্গা প্রতিমা প্রবহমান জলধারায় বিসর্জিত করার রীতি নিয়েই সমস্যার শুরু।

গঙ্গা দূষণ রোধে সরকারী ব্যবস্থাপনায় প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য কৃত্রিম জলাশয় তৈরি করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু, বাঙালির ধর্মবোধ বাধা পায় তাতে। প্রবাহী স্রোতে প্রতিমা নিরঞ্জনের রীতি অসম্পূর্ণই থেকে যায় সে ক্ষেত্রে। বাঙালি সমাজের প্রশ্ন, মৃণ্ময়ী দেবী প্রতিমায় এমন কি রাসায়নিক রঙ বা পদার্থ ব্যবহৃত হয় যা গঙ্গা দূষণের কারণ হতে পারে? আর তাই যদি হয়, তাহলে শবাশেষ গঙ্গায় প্রবাহিত হওয়া বন্ধ করা সম্ভব কি? উত্তর বিতর্কাধীন।

বাঙালি, বিয়ে এবং বেনারসী। বাঙালি বিয়ের অপরিহার্য এই উপকরণটির আঁতুড়ঘর এই বারাণসীই। এই শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে আছে একাধিক বেনারসী শাড়ির পসরা। বারাণসীর ঘরে ঘরে ঘন সিল্কের বুনটে বুনটে বেড়ে ওঠা এই বাইশ গজীর কদর বাঙালির উন্মাদনাই প্রমাণ করে। তবে, বারাণসী এসে বেনারসী কিনতে গিয়ে যাতে ঠকতে না হয়, সে জন্য সরকারী ব্যবস্থাপনায় দশাশ্বমেধ ঘাটের উপরেই তৈরি হয়েছে বেনারসী ফ্যাক্টরি। ফ্যাক্টরিমুখী প্রমিলা বাহিনীর দাপটে বঙ্গ পুঙ্গবদের প্রায় নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়।

ঐতিহ্যবাহী বারাণসীর উজ্জ্বল প্রাণকেন্দ্র প্রাচীন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়। তেরশো একর জুড়ে ভারতরত্ন মদন মোহন মালব্যর প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গোটা বিশ্বের উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার অন্যতম পীঠস্থান। প্রতিভা – সংস্কৃতি ও বৈচিত্রের শহর বারাণসী এক কথায় রত্নগর্ভা। প্রাচীন এই শহরের বুকেই বেড়ে উঠেছেন ভারতরত্ন পণ্ডিত মদন মোহন মালব্য, সুর সাধক রবিশঙ্কর ও উস্তাদ বিসমিল্লা খান। বেনারস শহরের অন্যতম ব্যস্ত গলি সরাই হরা বা হরা সরাই-এ সি কে ৪৬/৬২ নম্বর লেখা নবাব আমলের পলেস্তরা খসা দুমহলা বাড়িটি ইতিহাসের সাক্ষী। উস্তাদ বিসমিল্লা খানের সাধনক্ষেত্র গঙ্গা উপকুলস্থিত বেনারস। <br />এ বাড়ির দেওয়ালে কান পাতলেই যেন শোনা যায় সানাইয়ের সুরমূর্ছনা-দিবারাত্রিবব্যাপী উস্তাদি রেওয়াজের ইতিকথা। কথিত আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আজীবন বসবাসের আমন্ত্রণ উস্তাদজি সবিনয়ে ফিরিয়ে দেন এই বলে যে, সে দেশে হয়তো সুখ সুবিধার কোনও অভাব হবে না, কিন্তু স্রোতস্বিনী গঙ্গাকে ত্যাগ করে তো তিনি এ দেশ ছাড়তে পারবেন না।

এমনই নানা কথা-উপকথার তরঙ্গে ভর করে আপনি পৌঁছে যেতেই পারেন বাঙালিটোলায়। নামেই পরিচিতি বহনকারী এই এলাকায় আজও বাঙালিদের মহমা মণ্ডিত উপস্থিতি। বাঙালিটোলার গলি আপনাকে পৌঁছে দেবে কোচবিহার রাজবাড়ির সিংহদুয়ারে। আনুমানিক ১৮২২ সালে কোচবিহারের মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ বেনারসে এসে এক বিশাল এস্টেট প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার পরবর্তী উত্তরসুরী শিবেন্দ্রনারায়ণের হাতে প্রতিষ্ঠা পান মা কালী। কালী মন্দির এবং তৎসংলগ্ন কুঠিবাড়িতে এক সময়ে আশ্রয় পেতেন কোচবিহার তথা বাংলার একাধিক বিধবা। বৈধব্য এবং বার্ধক্যের দিনগুলিতে তারা এই বাঙালিটোলার পথেই পৌঁছে যেতেন শীতল স্রোতস্বিনী ভাগীরথীর আশ্রয়ে।

পূব দিগন্তে সূর্যোদয়ের পুণ্যশিখার লালিমা যখন রাঙিয়ে তোলে সুরেশ্বরীর সীমান্তরেখা, যেন নববধূর অবগুণ্ঠন উন্মোচিত হয় মা গঙ্গার শীতল সমীর স্পর্শে। দিনমান দীবাকরের কঠিন-কঠোর তপোগ্নি আত্মস্থিত ত্রিভুবন তারিনীর অর্চনাজ্যোতি প্রজ্বলিত হয় সন্ধ্যার তির দীপশিখায়। যখন ধুপ-ধুনো-গুগুলের সুগন্ধ সম্বলিত সপ্তদ্বিজের মিলিত হোমবহ্নি দশ-দিশার ললাট স্পর্শ করে যাত্রা করে মহাব্রহ্মের পথে, মানব মন্ত্রের উচ্চারণে তখন আরাধিতা হন শঙ্করমৌলিনী। শিয়রে ধ্যানস্থ ত্রিপুরারির চরণস্পর্শ করে জেগে থাকে “ The Oldest Living city… Banaras”.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 × two =