বাঙালির গান (পর্ব ৮)

পার্থসারথি সরকার ##

শাক্ত পদাবলী:

খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী থেকে শুরু ক’রে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই প্রায় আটশ বছর মধ্যযুগীয় সাহিত্যের যে ধারার প্রচলন ছিল, সেখানে অধিকাংশই ছিল পুরাতনের পুনরাবৃত্তি। এমতাবস্থায় অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিষয়বস্তু ও কাব্যভঙ্গির ক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ নতুন বৈচিত্র্যের আভাষ ফুটে উঠতে লাগল—এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হ’ল শাক্ত পদাবলী, বাউলগান এবং গাথাকাব্যের ধারা। বাংলা সাহিত্যে পঞ্চদশ থেকে শুরু ক’রে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত মূলত প্রেম ভক্তি আশ্রিত বৈষ্ণবধর্মকে আশ্রয় করেই পদরচনা স্ফূর্তিলাভ করছিল; কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দী ছিল শাক্ত পদাবলীর যুগ। শাক্ত পদ উমা-পার্বতী-চণ্ডী-কালিকাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। বৈষ্ণব পদাবলীর মতো শাক্ত পদাবলী অপার্থিব রসস্বর্গে উত্তীর্ণ হয়নি, বরং বলা যায় প্রতিদিনের সুখদুঃখের জীবনের মধ্যেই শাক্তপাদাবলীর বিকাশ ঘটেছে এবং বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের পাশাপাশি আরো একটি সমৃদ্ধিশালী পদাবলী সাহিত্যের ধারা তৈরী করেছে।

       প্রাচীন সৃষ্টিতত্ত্বের মধ্যে জননীতত্ত্ব সৃষ্টির প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছিল। পৃথিবীর বহু জাতিই প্রাচীনকালে মাতৃস্বরপিণী পৃথিবীর পূজা ক’রে এসেছে। প্রাচীন ভারতবর্ষের দ্রাবিড়, নিষাদ, কিরাত জাতিগুলির মাতৃতান্ত্রিক সমাজে দুর্গা অনুরূপ দেবপূজার আভাস পাওয়া যায়।  এইরূপ মাতৃপূজা বৈদিক আমলেও যে প্রচলিত ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দেবীসুক্তে। অথর্ববেদে শক্তিপূজার স্পষ্ট উল্লেখ আছে। বৈদিক সংহিতায় পুরুষ দেবতার প্রাধান্য থাকলেও ক্রমে উপনিষদের যুগে শাক্ত দেবী ভক্তসমাজ নিজের স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

       বঙ্গসাহিত্যে মঙ্গলকাব্যের যে সমৃদ্ধ শাখা, সেখানে উল্লিখিত চণ্ডীর এবং অন্যান্য দেবদেবীর সঙ্গে নিষাদ সংস্কারের ঘনিষ্ট যোগ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু শাক্ত পদাবলীর উমা-পার্বতী-কালিকা-চণ্ডী শাক্তপুরাণ এবং ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। সংস্কৃত সাহিত্যে শিবদুর্গা-কেন্দ্রিক সাহিত্যের দুটি শাখা—একটিতে উমা-মহাদেবের ঘরোয়া কাহিনি উপজীব্য হয়েছে এবং অন্যটিতে তত্ত্বাশ্রয়ী ও সাধন মার্গের সাহিত্যের কথাই ফুটে উঠেছে। বঙ্গসাহিত্যে যে শাক্তসংগীত, সেখানে এই দুই বৈশিষ্ট্যই দেখতে পাওয়া যায়।

       ‘চণ্ডী’-তে দেবী স্বতন্ত্র, মহাদেবের সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু পরবর্তীতে উমা-পার্বতী এবং চণ্ডী একাকার হয়ে গিয়েছেন। শাক্ত পদাবলীর মধ্যে উমা, পার্বতীদের পাশাপাশি আছেন দেবী কালিকা। বেদের রাত্রিসূক্তে কালিকার পূর্বাভাস আছে। মহাভারত, খিলহরিবংশতেও দেবী কালিকা আছেন। বঙ্গে কালিকার আরাধনা বেশ প্রাচীন। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকের দশভূজা দেবীমূর্তিতে, ষোড়শ শতকের কালিকার পূজাপদ্ধতিতে এই কথাই প্রমাণিত হয়।

       অষ্টাদশ শতক শাক্ত পদাবলীর বিকাশ ও পরিণতির যুগ হলেও ষোড়শ-সপ্তদশ শতকেও অনুরূপ সাহিত্যের প্রচলন বঙ্গদেশে ছিল। শাক্তপদাবলী তখন ‘মালসীগান’ নামে পরিচিত ছিল। পাঠান রাজত্বের অবসানকালে এক অরাজকতাময় মুহূর্তে সাধারণ মানুষ প্রচণ্ড ক্ষমতার অধিকারিণী দেবোর কাছে বরাভয় প্রার্থনা করে মঙ্গলকাব্যকে প্রায় জাতিয় কাব্য হিসাবে পরিণত করেছিলেন। অষ্টাদশ শুতকের মধ্যভাগে সাম্রাজ্য, সমাজ, ধর্ম, মনুষ্যত্বের সংস্থান ভেঙে পড়ার যুগে মানুষ আরো বেশি ক’রে আদ্যাশক্তির কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে মুক্তির উপায় খুঁজেছে। মায়ের কাছে অন্তরের আকূতি এক অসাধরণ প্রকাশভঙ্গিমায় উপস্থিত হয়েছে শাক্ত পদাবলীত সুরে ও কথায়। এখানে যেমন একাধারে পুরাণে বর্ণিত হরপার্বতীর কাহিনি ঠাঁই পেয়েছে, পাশাপাশি ঠাঁই পেয়েছে লৌকিক গার্হস্থ্য জীবনের কাহিনি—অবলীলায়, অবিরোধে। ‘মার্কেণ্ডেয় পুরাণে’  চণ্ডীতত্ত্ব যেমন গৃহীত হয়েছে, তেমনি কালিকার  সঙ্গে ভক্ত-সন্তানের স্নেহমধুর সম্পর্ক এই পদগুলির উপজীব্য হয়েছে। বৈষ্ণব সাহিত্যের বাৎসল্য রসের পদগুলি শাক্তপাদাবলীর প্রেরণা জুগিয়েছে। হরগৌরীর বাৎসল্যলীলায় বাংলার প্রতিদিনের গৃহচ্ছবির একটি রূপ ফুটে উঠেছে। বিশেষত ‘আগমনী’ ও ‘বিজয়ার’ পদগুলি বঙ্গদেশের রূপে নিজেকে সাজিয়েছে—তাকে স্নেহ-সজল করে নিয়েছে। সেখানে কোন কৃত্তিমতা নেই—যা শাক্ত পদ্গুলিকে এক অন্য উচ্চতা দান করেছে। বৈষ্ণব পদাবলী যেমন বিভিন্ন ঘরানার কীর্তনের দ্বারা জনমানসে ছড়িয়ে পড়েছিল, তেমনি বিভিন্ন শাক্তপদ বিভিন্ন রাগ রাগিনিতে গীত হয়। নিধুবাবু, কালী মির্জা, শ্রীধর কথকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ‘টপ্‌পার’ ঢঙে ‘ঠাকরুণ বিষয়ক’ বা ‘মালসী’ গান সংগীতরসিক মহলে জনপ্রিয় হয়েছিল। উমার বাল্যলীলা ও কালীমহিমা বিষয়ক ধারাবাহিক পালাগান কালীকীর্তন নামে উনিশ শতকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে শাক্ত পদাবলীর স্ফূর্তি ঘটেছে যার মধ্যে, তা হল প্রসাদী সুর। এই প্রসাদী সুরে রামকেলি ও ভৈরবী রাগের ছোঁওয়া আছে। সুগায়ক রামপ্রসাদের সৃষ্ট এই গানের ধারা পরবর্তী ক্ষেত্রে ক্রমে পরিপূর্ণতা পায় ও সর্বাধিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকের শক্তিশালী শাক্তপদকর্তারা কেউ গৃহী, কেউ সাধক। অশ্রাব্য ভাষার গানের রচয়িতা হিসাবে কথিত টপ্পা কবিওয়ালার দলও ‘ঠাকরুণ বিষয়ক’ গানে সাত্ত্বিক ভাষা ও ভাব অবলম্বন করতেন।

রামপ্রসাদ সেন:

বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলকাব্যের বহু স্থলে শাক্ত পদাবলীর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। তথাপি শাক্ত পদাবলীর শ্রেষ্ঠ পূজারী রামপ্রসাদ সেন। তাঁর সৃষ্টিতে শাক্ত সংগীত এক অন্যমাত্রা পেয়েছে। তাঁর ‘বিদ্যাসুন্দর’ অনুসরণ করলে তাঁর জন্ম পরিচয় সম্বন্ধে যে তথ্য পাওয়া যায় তা হল—তাঁর পূর্বপুরুষ শ্রীহর্ষ সেন নবাব ফকিরুদ্দিন শাহের কৃপায় সেনভূমে জমিদারি লাভ করেন। তাঁর অধস্তন পঞ্চম পুরুষ কৃত্তিবাস সেন। সেনভূম থেকে জয়কৃষ্ণ বা রামেশ্বর বা রামরাম কুমারহট্টে বসতি স্থাপন করেন। ঈশ্বর গুপ্তের মতানুসারে রামপ্রসাদের জন্মসন ১৭২০-২১ অব্দে। রামরামের দ্বিতীয় পক্ষের তৃতীয় সন্তান ছিলেন রামপ্রসাদ। রামপ্রসাদের দুই পুত্র, দুই কন্যা। রামপ্রসাদ খিদিরপুরে গোকুলচন্দ্র ঘোষাল কিংবা কলকাতার দুর্গাচরণ মিত্রের বাড়িতে মুহুরীর কাজ করতেন। কারও কারও মতে আবার তিনি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের মুহুরী ছিলেন। যা হোক হিসাবের খাতায় “আমায় দাও মা তবিলদারী” গান দেখে প্রভু তাঁর চল্লিশ টাকা মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। রামপ্রসাদ সেনের জীবনকে নিয়ে বহুবিধ লোকশ্রুতি আছে। তিনি নাকি দেবীর স্বপ্নাদেশে গান রচনা শুরু করেন। দেবী কালীর কন্যাবেশে বেড়া বাঁধতে সাহায্য করা, তাঁর গান শোনার জন্য অন্নপূর্ণার কাশী পরিত্যাগ, নৌকায় সিরাজদ্দৌলাকে গান শোনানো, এমনকি শ্যামা প্রতিমা বিসর্জনের সময় স্বেচ্ছায় জলে আত্মবিসর্জন ইত্যাদি সেই লোকশ্রুতির অন্তর্ভুক্ত।

       রামপ্রসাদ সেনের নামে ‘কালীকীর্তন’, ‘কৃষ্ণকীর্তন’, ‘সীতাবিলাপ’ ইত্যাদি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। এরমধ্যে ‘লীলাকীর্তন’ এককালে প্রভূত জনপ্রিয় ছিল। ঈশ্বর গুপ্ত এই কাব্য সংগ্রহ করে প্রকাশ করেন ১৮৩৩ সালে। সম্পাদনকালে তিনি ঐ গ্রন্থের বহুবিধ সংশোধন করেন। এখানে উমার বাল্যকৈশোর লীলা আখ্যানের ঢঙে গীতিরসের সাহায্যে বর্ণিত। এরপর বাল্যলীলাতে বৈষ্ণব পদাবলীর অনুকরণ। গোষ্ঠলীলাতেও বৈষ্ণব পদাবলীর অনুকরণ অনেকাংশে শাক্ত গানগুলির অবয়ব গঠনে সাহায্য করেছে। এই অনুকরণ খানিকটা রাসলীলাতেও  আছে—যা গোষ্ঠলীলার চেয়ে অধিক হাস্যকর। এই গ্রন্থের কাব্যমূল্য যৎকিঞ্চিৎ। ‘কৃষ্ণকীর্তন’ নামে পুঁথিটি গুপ্তকবি বিদ্যাসুন্দরের চেয়ে উত্তম বলেছেন—তবে ভাব ভাষায় তা কতখানি রামপ্রসাদের নিজের রচনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ‘সীতাবিলাস’-কে ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ সমালোচকরা কবিওয়ালা রামপ্রসাদের রচনা ব’লে মনে করেন।

       রামপ্রসাদের সর্বাধিক জনপ্রিয়তা যে সাহিত্যসৃষ্টির জন্য, তা অবশ্যই শাক্ত পদাবলী। রামপ্রসাদ যে বহুসংখ্যক গান রচনা করেছিলেন তা জানতে পারা যায়, কিন্তু তার সামান্যই সংগৃহীত হয়েছে। ঈশ্বর গুপ্ত তাঁর ‘সংবাদ প্রভাকরে’ রামপ্রসাদের ৯১টি পদের সংকলন করেন। পরবর্তীতে আরো কিছু পদ সংকলিত হয়, এবং এই পদের সংখ্যা প্রায় তিনশোর কাছাকাছি। তথাপি এই সংগ্রহের মধ্যে দ্বিজ রামপ্রসাদ, কবিওয়ালা রামপ্রসাদ প্রমুখের পদ মিশে গেছে। রামপ্রসাদের সাধন সংগীতের মধ্যে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের বঙ্গের অর্থনৈতিক, বাজনৈতিক প্রভাব অনেকখানি। মুসলমান শাসনের বিশৃঙ্খলা, ইংরাজী শাসনের সূত্রপাত, বর্গীর হামলা, দুর্ভিক্ষ, অনাচার, লুটতরাজে বাঙালি জাতির ত্রস্ততার—যার প্রতিফলন রামপ্রসাদের গানে বাস্তবরূপ নিয়ে ধরা দিয়েছে।

       রামপ্রসাদী পদগুলিকে নানা সময় নানা সংগ্রাহক বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় নির্ধারিত শ্রেণি অনুযায়ি—উমা বিষয়ক (আগমনী ও বিজয়া), সাধন-বিষয়ক (তন্ত্রোক্ত সাধন), দেবীর স্বরূপ-বিষয়ক, তত্ত্বদর্শন ও নীতি বিষয়ক এবং কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি বিষয়ক। রামপ্রসাদের ‘আগমনী’ এবং ‘বিজয়া’ পর্যায়ের গান সংখ্যায় অল্প, কাব্যোৎকর্ষেও খুব ন্যুন নয়।  

       সাধন বিষয়ের গানে রামপ্রসাদের স্ফূর্তি এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তিনি নিজে তন্ত্রসাধনায় ছিলেন একজন বীরাচারী সাধক। তন্ত্রসাধনায় তাঁর সিদ্ধিলাভের কথা জনশ্রুতিতে পাওয়া যায়। তাঁর সংগীতে ‘পঞ্চ মকার’ সাধনা ও পঞ্চমুন্ডির আসনের কথা পাওয়া যায়। দেহকেন্দ্রিক সাধনা এবং তত্ত্বকথা তাঁর গানে অতি চমৎকারভাবে রূপকস্থলে এসেছে। রামপ্রসাদ যে সমস্ত পদে দেবীর স্বরূপ রচনা করেছেন, সেখানে মাতৃহারা সন্তানের মতোই তিনি মাতৃসন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছেন। কখনও দেবীর রণরঙ্গিণী মূর্তি দেখে তিনি সন্ত্রস্ত, কখনও ভাবগম্ভীর—কখনও মায়ের মাতৃরূপ দেখে নিজ মায়ের সঙ্গে দেবীর একীকরণ করেছেন।  তাঁর ধর্মসমন্বয়কামী মনের মধ্যে বৈষ্ণব-শাক্ত ভেদ দূরীভূত হয়েছে। রামপ্রসাদ নিজ অনুভূতির আলোকে জীবন, নীতি ও ধর্মসাধনার কেন্দ্র থেকে অনেকপদ রচনা করেছিলেন, যেগুলি তাঁর গানসমূহের মধ্যে অনেকটা অংশ জুড়ে আছে। কয়েকটি পদের উপজীব্য বিষয়ী মনকে নিজ নিয়ন্ত্রণে বাঁধতে হবে। ব্যক্তিগত জীবনের আর্থিক দুরবস্থা, উদাসীন বাস্তবজীবন চিত্র এসমস্তই তাঁর এই ধরণের গানের মধ্যে ফুটে উঠেছে। আসলে রামপ্রসাদ তাঁর গানগুলিকে বাস্তব প্রেক্ষিতে রচনা করেছেন, তবে বৈষ্ণব পদাবলীর মতো তা সূক্ষ্মরসে পরিণত হয়নি। জীবনে দুঃখ আছে, কষ্ট আছে—সেখান থেকে মুক্তির উপায় খুঁজেছেন রামপ্রসাদ স্বনির্মিত পথে; আর রামপ্রসাদের নির্মিত শ্যামাসংগীতের পথেই বাঙালি জাতি আত্মমগ্ন।

       রামপ্রসাদের গান সহজ সরল গান। স্থানে স্থানে কিছু কিছু অলংকৃত বাক্‌রীতি থাকলেও সহজ কথায় উপমা-রূপকে তাঁর গানে তত্ত্বকথা প্রকাশ পেয়েছে গভীরতায়। অবশ্য অনেক জায়গাতেই তাঁর রচনা রসবর্জিত, কৃত্রিম বা গতানুগতিক ব’লে মনে হতে পারে, তথাপি বাঙালি মানসে তাঁর গানের চিরস্থায়ী আবেদনকে অস্বীকার করা যায় না।

       রামপ্রসাদের সঙ্গে দ্বিজ রামপ্রসাদের গানের মিশ্রণ অনেকস্থলে সংশয় তৈরি হয়েছে। পূর্ববঙ্গে বসবাসকারী এই কবি রামপ্রসাদের ঢঙে অনেক পদ রচনা করেছিলেন। ঢাকা, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা অঞ্চলের মাঝিরা সর্বদাই এই গান গেয়ে থাকেন। ইনি ব্রাহ্মণ ছিলেন। কৈলাসচন্দ্র সিংহের ‘সাধকসঙ্গীত’ অনুযায়ী তিনি ব্রহ্মপূত্র তীরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ঢাকা জেলার চিনীশপুরের কালীবাড়িতে তিনি জীবনযাপন করেন। যোগেশচন্দ্র গুপ্ত-কৃত সেন রামপ্রসাদের সঙ্গে দ্বিজ রামপ্রসাদের ঐক্য প্রমাণে যুক্তি থাকলেও দুজন যে ভিন্ন কবি ছিলেন, সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। এছাড়াও অন্য একজন রামপ্রসাদও ছিলেন ঈশ্বর গুপ্তের সমসাময়িক। তিনি কলকাতায় কবির দলে যোগ দেন—তাই তাঁর পরিচিতি কবিওয়ালা রামপ্রসাদ নামে। তিনি বেশ কিছু শ্যামা বিষয়ক গান রচনা করেছিলেন। এ বিষয়ে আজো একজন মানুষের নাম প্রসঙ্গক্রমে আসে তিনি আজু গোঁসাই। রামপ্রসাদের সঙ্গে আজু গোঁসাইয়ের (অযোধ্যাপ্রসাদ গোস্বামীর) বাকযুদ্ধ সম্পর্কিত কবিতা ঈশ্বর গুপ্ত লিপিবদ্ধ ক’রে গেছেন। রামপ্রসাদের গানের উত্তর তিনি তাৎক্ষণিক দিতেন। রামপ্রসাদের সঙ্গে আজু গোঁসাইয়ের এমন দুটি গানের বাকযুদ্ধের উদাহরণ দুর্গাদাস লাহিড়ী দিয়েছেন, সেদুটি হল—

‘এই সংসার রসের কুটি/ খাই দাই আর মজা লুটি’

এবং ‘হৈও না মন পড়া পাখী’

রামপ্রসাদের কিছু উল্লেখযোগ্য পদ হল–

ক) ‘আমায় দেও মা তবিলদারী।/ আমি নিমক্‌-হারাম্‌ নই শঙ্করী।।/ পদরত্ন-ভাণ্ডার সবাই লুটে, ইহা আমি সইতে নারি।’

খ) ‘ডুব দে রে মন কালী বলে।/ হৃদি-রত্নাকারের অগাধ জলে।।’

গ) ‘মা আমায় ঘুরাবে কত?/ কলুর চোখ ঢাকা বলদের মত’

ঘ) ‘মন রে কৃষি কাজ জান না, এমন মানবজনম রইল পতিত, আবাদ করলে ফলতো সোন’

ঙ) ‘কেবল আসার আশা, ঘবে আসা, আসা মাত্র হলো’

চ) ‘ভবের আশা, খেল্‌বো পাশা’

ছ) ‘এমন দিন কি হবে মা তারা।/ যবে তারা তারা তারা বলে,/ তারা বয়ে পড়বে ধারা।।‘

ছ) ‘সময় তো থাক্‌বে না গো মা, কেবল কথা রবে।’

জ) ‘গিরি! এবার আমার উমা এলে,/ আর উমা পাঠাব না’ ইত্যাদি।

কমলাকান্ত:

রামপ্রসাদ ব্যতীত বাংলা শাক্ত সংগীতের এক অসামান্য কবি ছিলেন কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। রামপ্রসাদের মতো কমলাকান্তের জীবনে বহু জনশ্রুতি থাকায় তাঁর আসল পরিচয় অনেকখানি অলৌকিকতার আবরণে আবৃত হয়েছে, তথাপি তাঁর জীবনী সংক্রান্ত যেটুকু পাওয়া যায়, তার অনেকখানি তাঁর লিখিত ‘সাধকরঞ্জনে’র পাতায়। এর সঙ্গে অতুলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের জীবনী থেকে কমলাকান্তের জীবনের যে তথ্য পাও যায়, তা হল—কালনার অম্বিকা গ্রামে বিদ্যাবাগী্-পাড়ায় তাঁর জন্ম হয়। পিতা ছিলেন মহেশ্বর ভট্টাচার্য এবং মাতা মহামায়া। বাল্যবয়সে গ্রামের স্কুলে সংস্কৃত পাঠ এবং পিতৃবিয়োগের পর মামারবাড়ি চান্নাগ্রামে তিনি আশ্রয়লাভ করেন। মাতুলকুল সূত্রে বর্ধমান রাজপরিবারের সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। মহারাজাধিরাজ তেজচন্দ্র তাঁকে কোটালহাটে গৃহনির্মাণ ক’রে দেন, সঙ্গে বৃত্তিলাভ  এবং সভাপণ্ডিতের গৌরবজনক পদলাভ করেন। তেজচন্দ্র পুত্র প্রতাপচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিজয়চন্দ্র পরে ‘কমলাকান্ত’ নামে একটি নাটিকা লেখেন এবং ‘শ্যামাসঙ্গীত’ নামক গ্রন্থে কমলাকান্তের যাবতীয় পদ সংকলন করেন। কমলাকান্তের লেখা বেশ কিছু বৈষ্ণব পদ পাওয়া যায়, যা তাঁর প্রথম জীবনের সাহিত্যসাধনার ফলশ্রুতি। অতুলচন্দ্র মুখোপাধ্যায় অনুযায়ী কমলাকান্ত উনিশ শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় দশকে প্রায় পঞ্চাশ বৎসর বয়সে কোটালহাটের আশ্রমে প্রাণত্যাগ করেন।

       কমলাকান্ত তন্ত্রসাধনা সম্পর্কিত একখানি পুঁথি রচনা করেন পয়ার ত্রিপদীতে—এর নাম ‘সাধকরঞ্জন’। গ্রন্থনামে মতভেদ থাকলেও ‘সাধকরঞ্জনে’র শেষের দিকে কমলাকান্ত নিজেই গ্রন্থনাম ‘সাধকরঞ্জন’ সম্পর্কে মতামত দিয়েছেন। লোকশ্রুতি কমলাকান্ত তন্ত্রসাধনায় সস্ত্রীক সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। ‘সাধকরঞ্জনে’ শিবসংহিতা’, ‘ঘেরণ্ডসংহিতা’, চক্রনিরূপণ, হঠযোগ প্রদীপিকা ইত্যাদি তন্ত্র যোগানুসারী তত্ত্ব ও পঞ্চক্রিয়া সরল পয়ার-ত্রিপদীতে বর্ণিত হয়েছে। ‘সাধকরঞ্জন’ ষটচক্রবর্ণনা, চিদানন্দলাভের বর্ণনা, সাধকের মোক্ষলাভ ইত্যাদির বর্ণনায় পূর্ণ। মূলত তন্ত্রসাধনার গ্রন্থ হওয়াতে এর দুর্বোধ্যতায় কাব্যরস অনেকখানি মার খেয়েছে। এখানে শাক্ত তত্ত্বালোচনায় বৈষ্ণব পদাবলীর শ্রীরাধার রূপক এসেছে।তবে সরল তত্ত্বকথা  বোঝার ক্ষেত্রেও গ্রন্থখানি প্রয়োজনীয় হলেও সাহিত্যশ্রষ্টা কমলাকান্তকে পেতে গেলে তাঁর পদাবলী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

       কমলাকান্ত শ্রেষ্ট শাক্ত-কবিদের অন্যতম। তাঁর পদের অনেকখানি সঞ্চয় বর্ধমান-রাজানুকূল্যে পাওয়া যায়। রাজবাটী প্রকাশিত ‘শ্যামাসঙ্গীত’-এ মোট পদসংখ্যা ২৬৯ টি। এর মধ্যে ২৪৫ টি শ্যামা এবং ২৪ টি বৈষ্ণব ভাবাপন্ন। বৈষ্ণব ভাবাপন্ন পদগুলি কমলাকান্তের প্রথম জীবনের ফসল। যদিও এই পদগুলির অধিকাংশই কবিত্ববর্জিত। তবে গৌরচন্দ্রিকাতে যৎসামান্য কবিপ্রতিভা প্রস্ফুটিত। রাধার জবানীতে লেখা বিরহ গানের পদসমূহ কিয়দংশে কবিওয়ালা ও টপ্পার ঢং অনুসৃত।

       কমলাকান্তের ভনিতায় প্রায় তিনশ পদ পাওয়া গেছে। এই পদগুলি বিভিন্ন বিষয় কেন্দ্রিক হলেও এর মধ্যে আগমনী এবং বিজয়ার পদগুলি স্বগুণে নিজস্থান করে নিয়েছে। আগমনী পর্যায়ের পদগুলির মধ্যে উমার পিতৃগৃহে আগমন হেতু মা মেনকার মাতৃহৃদয়ের আশা আকাঙ্ক্ষার এক বাস্তব ছবি এই গানগুলির মধ্যে ফুটে উঠেছে। মা মেনকা স্বপ্নে কন্যাকে দর্শন করে কন্যাদর্শনে উন্মুখ—গিরিরাজকে পাঠাতে চায় কন্যাকে গৃহে আনার জন্য—

‘যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী, উমা আমার কত কেঁদেছে।’

কিন্তু কন্যাকে পুনঃ পতিগৃহে চলে যেতেই হবে—মাঝখানে আর মাত্র কটা দিন। মাতৃহৃদয়ের আকুল আর্তি ভাষা পায় বিজয়ার পদগুলির মধ্যে। মাতা মেনকা তাই নবমী নিশির কাছে আকুল প্রার্থনা জানিয়েছেন, যেন সে রাত ভোর না হয়, যদি হয় তাহলে সে প্রাণ ধরে রাখতে পারবে না কন্যার অবর্তমানে—‘নবমী নিশি না হইয়ো রে অবসান।’

কমলাকান্তের আগমনী বিজয়ার পদে সহজ হৃদয় আর্তির প্রকাশ। এখানে তেমন অলংকারের উচ্ছলতা না থাকলেও স্বভাবক্তি সাবলীল। একান্ত আন্তরিকতা এবং মানবিক আবেগ নিয়ে এই পদগুলি উজ্জ্বল হয়ে আছে। আগমনী বিজয়ার পদগুলি ছাড়াও কমলাকান্তের বহু পদ তার বিন্যাস, আলংকারিক উজ্জলতা, স্ব-মাধুর্য নিয়ে বাঙালি মানসে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

       রামপ্রসাদ-কমলাকান্ত ছাড়াও বহু ব্যক্তি শাক্ত পদ রচনায় নিজ নিজ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে অনেক অভিজাত সম্প্রদায়ের ব্যক্তিও ছিলেন। নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর, নাটোর, বর্ধমান, কুচবিহার প্রভৃতি স্থানের জমিদার এবং শাসকবর্গ ছিলেন এঁদের মধ্যে অন্যতম। কৃষ্ণনগরের স্বয়ং রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এবং তৎপূত্র শিবচন্দ্র ও শম্ভুচন্দ্র বেশ কিছু উৎকৃষ্ট শাক্ত সংগীত রচনা করেছিলেন। কমলাকান্তের প্রভাবে বর্ধমান রাজপরিবারের কেউ কেউ শাক্ত ধর্মের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। মহারাজাধিরাজ তেজচন্দ্রের দত্তকপুত্র মহতাবচাঁদ যেমন বর্ধমানের রাজবাটী থেকে শাক্তগীতি প্রকাশ করেন, পাশাপাশি তাঁর ভনিতায় দশমহাবিদ্যা বিষয়ক অনেক পদের সন্ধান মেলে। কুচবিহারের মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ ভূপবাহাদুর এবং মহারাজা নন্দকুমারের ভণিতাতেও বেশ কিছু পদ পাওয়া যায়। নাটোররাজ রাজা রামকৃষ্ণও এ বিষয়ে একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি।

        বর্ধমানের রাজ দেওয়ান ব্রজকিশোর এবং তৎপূত্র নন্দকুমার রায় আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধ ও উনিশ শতকের প্রথমার্ধ সময়কালে বহু শাক্ত সংগীত রচনা করেন। ত্রিপুরারাজ দেওয়ান রামদুলাল নন্দী উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তিনি বেশ কিছু শাক্ত সংগীত রচনা করেন। এর মধ্যে ‘জেনেছি জেনেছি তারা’ এবং ‘সকলি তোমারি ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি’ সংগীত দুটি অত্যন্ত সুপরিচিত। এছাড়াও বগুড়ার গোবিন্দ চৌধুরী, মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়, রামলাল দাস প্রমুখ ব্যক্তিরাও বহু শাক্ত সংগীত রচনা করেছিলেন।

       খ্রিস্টীয় আঠারো-উনিশ শতকের কবিওয়ালা টপ্পা-পাঁচালি গানের স্বনামধন্য সংগীতকাররা হলেন—হারুঠাকুর, নীলুঠাকুর, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, নিধুবাবু, কালী মির্জা, শ্রীধর কথক, দাশরথি রায়, রসিক রায়-রা শাক্ত সংগীত রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। যদিও বৈষ্ণব পদের মতো কল্পনার পরিধিতে, ভাবাবেগের রোম্যান্টিকতায় কিংবা বাকভঙ্গির চমৎকারিত্বে এই পদগুলি অতটা উন্নত ছিল না, তথাপি বাংলা সাহিত্যের পালাবদলে, শব্দবৈচিত্র্যে এই সংগীত এক অন্য ভূমিকা পালন করেছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × five =