বায়োফিউমিগেশন (জৈব ধুমায়ন) এর মাধ্যমে সবজির রোগ নিয়ন্ত্রণ

অগ্নিভ হালদার, কৃষিগবেষক, পল্লী শিক্ষা ভবন, বিশ্বভারতী, শ্রীনিকেতন ##

সুস্থ সবল চারা পেতে গেলে যেমন ভাল এবং শোধিত বীজ দরকার তেমনি দরকার রোগমুক্ত ও উর্বর বীজতলা । কারন জীবাণু থাকা মাটিতে ভাল বীজ লাগালেও সে সব বীজ থেকে হওয়া চারা জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে রোগ সৃষ্টি করতে পারে । টমেটো, বেগুন, লংকা ইত্যাদি সবজিতে অন্যান্য রোগের পাশাপাশি গোড়া পচা, ব্যাকটেরিয়া জনিত ঢলে পড়া ও চারার মড়ক প্রধান সমস্যা। এগুলি মাটিবাহিত রোগ এবং এ সব রোগের জীবাণু মাটিতে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকতে পারে। অনুকূল পরিবেশ পেলে এ রোগ মহামারী আকার ধারণ করে এবং বীজ তলার সমস্ত চারা বা গাছ ধ্বংস করে ফেলে। চারার মড়ক বা ড্যাম্পিং অফ প্রায় সব সবজি ফসলেরই একটি মারাত্মক রোগ। বীজতলায় বীজ গজানোর পর মাঝে মাঝে চারার মাটি সংলগ্ন স্থানে পচন দেখা যায়। পচা জায়গা থেকে চারা ভেঙে ঢলে পড়ে এবং শেষে মারা যায়। আর মূল জমিতে চারা রোপণের পর যে কোনো বয়সের সবজি গাছ একই ভাবে মাটি সংলগ্ন স্থান থেকে পচতে শুরু করে এবং ঢলে পড়ে। ব্যাকটেরিয়া জনিত ঢলে পড়া রোগে আক্রান্ত গাছ হঠাৎ নেতিয়ে পড়ে। এরকম আরো বেশ কিছু রোগ আছে যেগুলো মাটি বাহিত এবং শুধু রোগনাশক স্প্রে করে ভালো করা যায় না। সেজন্য বিজ্ঞানীরা মাটিতে লুকিয়ে থাকা সুপ্তরোগ জীবাণুকে ধ্বংস করতে মাটি শোধনের এমন এক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন যাতে এক ধরনের গাছ দিয়েই সবজি ফসলকে মাটি বাহিত বিভিন্ন রোগের আক্রমণ থেকে বাঁচানো যেতে পারে। সরিষা জাতীয় বিভিন্ন গাছ বিশেষ করে মূলা, সরিষা, কপি ইত্যাদি গাছ মাটিতে মিশিয়ে দিলে তা থেকে মাটিতে একধরনের গ্যাস নিঃসরিত হয়। আইসোথায়োসায়ানেট (আইটিসি) নামের সেই বিষাক্ত গ্যাসই মাটিতে লুকিয়ে থাকা জীবাণুদের ধ্বংস করে দেয়। যে হেতু গাছ মানে জীব (বায়ো), সজীব উপকরণ ব্যবহার করে তার গ্যাসকে (ফিউম) কাজে লাগিয়ে মাটি শোধন করা হচ্ছে তাই এ পদ্ধতির নাম দেয়া হয়েছে ‘বায়োফিউমিগেশন’। কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশের  কৃষিক্ষেত্রে এ পদ্ধতির প্রয়োগ শুরু হয়েছে।

মাটিতে বসবাসকারী বিভিন্ন রোগ জীবাণুকে এ ধরনের জৈবনাশক ব্যবহার করে দমিয়ে রাখার কৌশল একেবারেই নতুন, তবে ব্যয় সাশ্রয়ী। ব্যাপক ভাবে বিশাল জমিখণ্ডে এ পদ্ধতির ব্যবহার অধিক  শ্র্মসাপেক্ষ, তবে বীজ তলার অপেক্ষাকৃত ছোট জমিতে এ পদ্ধতি ব্যবহার করে  অত্যন্ত সহজে চারার মড়ক নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।

বায়োফিউমিগেশন করতে হলে প্রথমে বীজতলার উপরের মাটি ৭.৫ থেকে ১০সেন্টিমিটার গভীর করে তুলে ফেলে একটা অগভীর চৌবাচ্চার মত বানাতে হবে। তারপর বাড়ন্ত বয়সের ইন্ডিয়ান সরিষা, মূলা, কপি (ফুলকপি বা ওলকপি) বা চীনা সরিষা সংগ্রহ করে কুচিকুচি করে কাটতে হবে। কুচি যত ছোট হবে তত বেশি আইটিসি গ্যাস বের হবে। তারপর প্রতি বর্গমিটার জায়গার জন্য ৫ কেজি হারে কাটা কুচিগুলো মাটি তুলে ফেলা জায়গায় পুরু করে বিছিয়ে দিতে হবে। এরপর তুলে রাখা মাটি এর ওপর দিয়ে মাটির সাথে গাছের কুচিগুলো মিশিয়ে দিতে হবে। মেশানোর পর সেখানে জল দিয়ে ভাল করে ভেজাতে হবে। ভেজানোর পর সম্পূর্ণ বীজ তলার মাটি মোটা পলিথিন (কালো হলে ভাল) দিয়ে ঢেকে পলিথিনের চারপাশ মাটির মধ্যে পুঁতে দিতে হবে যাতে ভেতরের কোন গ্যাস বাইরে না আসে। এভাবে ২ থেকে ৩ সপ্তাহ রেখে দিলে গাছের কুচিগুলো পচে গ্যাস ছাড়বে ও সেই গ্যাস মাটির ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও কৃমিকে মেরে ফেলবে। উপরন্তু কুচি কুচি করা গাছের অংশ পচে সবুজ সারের মত মাটিতে জৈবপদার্থ যোগ করে উর্বরতাও বাড়াবে। পরে পলিথিন উঠিয়ে ফেলে দু-একদিন রোদ খাওয়ানোর পর ফের চাষ দিয়ে বীজতলা তৈরি করে সেখানে বীজ বপন করলে রোগ কম হবে। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্যাকটেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ ৬০ থেকে ৭০ ভাগ কমানো সম্ভব হয়েছে। এছাড়া কৃমিজনিত শিকড়ে গিঁট রোগও এ পদ্ধতিতে কমানো যায়। বেলে মাটিতে এ পদ্ধতি ব্যবহার করে বেশি সুফল পাওয়া যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

six + 9 =