ভোরের জুঁই

বিবেক বীর, বাঁকুড়া 

কলিংবেল’এর শব্দে দোতলা থেকে নীচে নেমে এল অচেনা একটা মেয়ে; অপরিচিত তাই সাদামাটা প্রশ্ন- কী চাই?
মনে কৌতুহল অনেক, তবুও বুদ্ধির হাত ধরে ছোট উত্তর- বলছিলাম, আজকের খবরের কাগজটা হবে? খুব জরুরী একটা বিজ্ঞাপনের ওয়েবসাইট টা দরকার।
সংকোচ থাকা সত্ত্বেও মানবতার খাতিরে বলল- ও আচ্ছা, দাঁড়ান। এনে দিচ্ছি।
– ঠিক আছে, বলে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল মাখন।
মোটরবাইক এর আওয়াজ পেতে পেছন ফিরে দেখল, বিমলবাবু।
– আরে, মাখন যে, কী ব্যাপার! কেমন আছো?
– ভালো আছি কাকু, আপনি কেমন আছেন?
– ভালো, তা বলছি বাইরে কেন, ভেতরে যাওনি?
– না, মানে কাকু..
– আরে এসো এসো।
– না কাকু, ঠিক আছে। আসলে আজকের খবরের কাগজটা কমল কাকু সঙ্গে নিয়েই অফিস চলে গেছেন, তাই এলাম
– ও এই ব্যাপার, নিশ্চয় কোন চাকরির বিজ্ঞপ্তি।
– হ্যাঁ, কাকু। ওই ক্লার্কশিপের একটা বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, ওয়েবসাইট টা লাগবে।
– আচ্ছা। ভেতরে এসো, বাইরে দাঁড়াতে হবে না। বিমলবাবুর কথামতো বিনয়ী মাখন তার পিছুপিছু গেল। ভেতরে গিয়েই বসতে বললেন বিমলবাবু, শখের বাড়ি বানিয়েছেন তাই সকলকে ঘরের ভেতর ডেকে আনেন। সব দামী দামী আসবাবপত্র, আধুনিক ডিজাইনের সো পিস। সারাজীবন দেশের বাইরে বাইরে ঘুরেছেন। মার্চেন্ট নেভি’র চাকরি ছিল, তাই এত বাহার। আর মাখন তো তার খুব কাছের
অবশ্য মানুষটা ভাল, শখ আছে আর বাড়িতে পুরোদমে চর্চা চলে কাব্য-কবিতার, টুকিটাকি লেখালেখিও করেন।
হাত-মুখ ধুয়ে মাখনের কাছে এলেন,
– কী ব্যাপার মাখন, দাঁড়িয়ে কেন! বসো।
– হ্যাঁ, কাকু বসছি।
আসলে শৈশবের সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত অভাবের একলা চিলেকোঠায় বড় হয়েছে মাখন, খুব একটা মিশুকে নয়। তবে বিমলবাবুর সাথে মনের মিল আছে বেশ, বয়সের বৈষম্য থাকলেও এরা দুজন মনের মানুষ বলা চলে।
কমদামী’ শব্দটাই এতক্ষণ ধরে বসতে দ্বিধা করছিল মাখনের, শেষে বসেই পড়লো মখমলের কভারে মোড়া সোফাটায়।
ম্যাগাজিনে চোখ বোলাতে বোলাতে বিমলবাবু বললেন- তা মাখন, বাড়ির খবর কী?
সব ভালো তো?
– হ্যাঁ, কাকু।
– আচ্ছা, আর তোমার মা’এর শরীরটা ভালো আছে তো, অসুখ সেরেছে?
– হ্যাঁ, কাকু মা এখন ভালো আছেন।
মাখন অত্যন্ত প্রত্যন্ত এক গ্রামের ছেলে। স্কুলজীবন শেষ করে এই বাঁকুড়া শহরে তার আগমন।
এখানেই কলেজ কমপ্লিট করে, বর্তমানে সরকারি চাকরির পেছনে লেগে আছে। পকেটের অভাব রোজ ভয় দেখায়, মাখনও জেদী কলমের সাহসে আজো নিজের পথে অটল।
বিমলবাবুর মেয়ে যূথিকা পেপার নিয়ে ঘরে ঢুকেই অবাক, এই অপরিচিত ছেলেটা ঘরে, কী ব্যাপার!
বিমলবাবু বললেন- দে মা, পেপার টা দে।
আর হ্যাঁ, একে চিনিস? এর নাম মাখন। আমাদের পাশে ওই যে কমল কাকু আছেন না, ওনার বাড়িতে ভাড়া থাকে। খুব ভালো ছেলে।
– আচ্ছা। ছোট শব্দে উত্তর যূথিকা’র।
আর মাখন, এ হচ্ছে আমার মেয়ে, যূথিকা। ওরও সবে কলেজ শেষ হয়েছে। এইতো দু’দিন হল হস্টেল থেকে বাড়িতে এসেছে। মজার ব্যাপার কী জান, যূথিকা’রও সাবজেক্ট বাংলা।
এবার যূথিকা বলল- আপনারও কি বাংলা?
– হ্যাঁ।’ ভদ্র, ছোট, বিনয়ী উত্তর মাখনের।
যূথিকা বলল- বাবা, চা খাবে?
– হ্যাঁ, খাব।
মাখন প্রায় চলেই যাচ্ছিল,
পেপার নিয়ে দরজার কাছে যেতেই পেছন থেকে বিমলবাবু ডাকলেন- এই মাখন, একটু চা খেয়ে যাও..
– না কাকু, আজ নয়। অন্য কোনদিন। আমাকে দুপুরে বেরোতে হবে।
– বেশ, এসো তাহলে।
চা’ এ মুখ দিতেই যূথিকার প্রশ্ন- আচ্ছা বাবা, এই ছেলেটাকে তুমি কতদিন ধরে চেন?
কেমন যেন অন্যটাইপ লাগল, খুব কম কথা বলে।
– তা প্রায় বছর তিনেক ধরে দেখছি ওকে, খুব শান্ত, ভালো ছেলে। তবে সবার সাথে মেশে না, আমার সাথে পরিচয় ওই কমলের বাড়িতেই, আমিও প্রথমে ওকে দেখে অবাক হয়েছিলাম। তারপর আমি রোজ যেতাম, দেখা করতাম। তবে এখন আমার কাছে ও অনেক খোলামেলা। নিজেতেই মত্ত থাকে।
খুব সাধারণ। আমার তো খুব প্রিয়, ও। আর হ্যাঁ জানিস, খুব সুন্দর কবিতা লেখে।
– তাই, বাহ। বলছি বাবা ওর কি কোন কিছু ঘটেছে, যাতে ও এত চুপচাপ!
– আমারও মনে হয়েছিল, তবে আমি সাহস করে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি। আর কমলের স্ত্রী কাকলি, নাকি ওকে আগের থেকেই চিনতো। এর বাবার বাড়ির কাছাকাছি মাখনের বাড়ি। ও সব জানে, ওর কাছেই আমি এসব শুনেছি। আসলে নিজের মুখে মাখন একটা শব্দও বলে না, তবে নোডাউট ভালো ছেলে।
আনমনেই যূথিকা দিল উত্তরটা- ও আচ্ছা।
বিমলবাবু হাতে সিগারেট নিয়ে মাতলেন ধোঁয়ার নেশায়, আর যূথিকা দোতলায় নিজের ঘরে গিয়ে তার প্রিয় বই, সঞ্চয়িতা নিয়ে বসল। মনটা যেন একটু আনমনা, বেখেয়াল।

কবিতা পড়তে পড়তে হঠাৎ যূথিকার মনে পরে গেল, ওর বাবা বলেছিলেন কমল বাবুকে ডাকার কথা, ভাবলো এই সুযোগ।
কোনকিছু না ভেবে সোজা নিচে গিয়ে মা কে বলে- মা, আমি একটু কমল কাকুর বাড়ি থেকে আসছি।
বাবা ওনাকে একবার ডেকে পাঠিয়েছেন, বলে আসি।
মা- তোকে আর যেতে হবে কেন, হরি কে বলে দে। ও গিয়ে বলে আসবে ক্ষণ।
– না, হরিদা কে আর যেতে হবে না। আমিই বলে আসছি।
– আচ্ছা, তবে তাড়া তাড়ি চলে আসিস।
– ঠিক আছে।’ বলেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাঁটল, রেলিং খুলেই কাকু কাকু, করে ডাক দেয় যূথিকা,
ভেতর থেকে কাকলি দেবী ওরফে কমলবাবু’র স্ত্রী বললেন- কে?
– আমি, কাকিমা। যূথিকা।
ভেতরে যেতেই কাকলি দেবী অবাক হয়ে বললেন- বাবা, আমার কি ভাগ্য, আজ যূথিকা এসেছে আমার বাড়িতে, তোর তো পাত্তায় পাওয়া যায় না। আয় আয় ভেতরে আয়।
তা বল, কেমন আছিস?
– ভালো আছি।
– কাকিমা, কাকুকে বাবা একবার যেতে বলেছেন।
– ও আচ্ছা। আর ওদের কাজ কি, আড্ডা মারতে পেলে আর কিছু দরকার নেই। মা কী করছে,
– ওই তো বাড়িতে, রান্না করছেন।
– ও, বলছি কিছু খেতে দি, বোস। কতদিন বাদে এলি, পরীক্ষা কেমন হয়েছে?
– ভালো হয়েছে কাকিমা। তবে আমি কিছু খাব না।
পরে না হয় দিও।
– আচ্ছা। বোস তাহলে।
– হ্যাঁ, বসছি।
যূথিকার মনে কৌতুহল একটা ঘুরঘুর করছে, অনেকক্ষণ থেকেই, কথায় কথায় বলে ফেলল- আচ্ছা কাকিমা, তোমাদের বাড়িতে লোক বলতে তো কাকু আর তুমি, এত বড় বাড়িতে একা একা লাগেনা?
– কথা টা ঠিকই বলেছিস, তবে একা লাগে না অভ্যেস হয়ে গেছে। আর তাছাড়া মাখন তো আছেই। ওকেও আমাদের বাড়ির সদস্য বলা চলে।
সব জানা সত্ত্বেও প্রশ্ন করে বলল-
কে মাখন?
– ও, তুই তো ওকে চিনিস না, মাখন, আমাদের ওপর তলার একটা ঘরে ভাড়া থাকে। দু বছর ধরে আমাদের এখানেই আছে, আমাদেরই একজন হয়ে উঠেছে। তোরই বয়সী হবে, মানে ও প্রায় একই আরকি। পড়াশোনা করে, আর টিউশন করে। চাকরির জন্য ছেলেটা দিন-রাত এক করে বসে আছে। খুব ভালো ছেলে।
এই খুব ভালো ছেলে’ কথাটা যত শুনছে, যূথিকার কৌতুহল, প্রশ্ন আরও বাড়ছে। কী এমন আছে, যে খুব ভালো ছেলে, মনে মনে ভাবল ও।
– আর হ্যাঁ, মাখন খুব ভালো ছোটগল্প, কবিতা লেখে।
– তাই, একটু খোলামেলা হবার অভিপ্রায়ে, বেশ খুশি মনোভাব যূথিকার কথায়। আসলে বাবাকে তো আর সব খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করা যায় না, কাকিমা মা’এর মত। তাই কোন সমস্যা নেই। আর যেহেতু জানতে ওকে হবেই।
– হ্যাঁ, রে। এইতো এখন সারাদিন ওর পাত্তা পাওয়া যাবে না। সন্ধ্যে বেলায় বাড়ি আসে। সেই ১২টার সময় বেরিয়েছে। রাত্রে আমার এখানেই খাওয়া-দাওয়া করে। দিনের বেলা বাইরে।
বেশ কিছু জানা হল, মাখনের ব্যাপারে। তবুও মন যেন অধীর আকাঙ্ক্ষিত। আরও আরও জানতে উৎসুক। ও জানেওনা কি সব ভাবছে মনে মনে, আদৌ ঠিক কি ভুল তাও না, তবুও জানার ইচ্ছে।
– আচ্ছা কাকিমা, বাবা বলছিলেন, ও নাকি খুব কম কথা বলে, তোমাদের এই মাখন।
– কম, হ্যাঁ। কম বলতে যতটা দরকার ঠিক ততটা।
বেশী কথা ও বলেনা। চুপচাপ থাকে, তবে মনের মধ্যে যেন বিশাল কিছু একটা লুকোনো। চোখ মুখ দেখে আমি অনেকবার লক্ষ্য করেছি।
– মানে?
– জানিনা, মনে হয়। এই শোন তুই একটু বোস। আমি এক্ষুনি আসছি। বলেই কাকলিদেবী চলে গেলেন।
এদিকে কৌতুহলের মাত্রা প্রায় আকাশপট ছোঁয় ছোঁয়, আর থাকা যায় না।
কে, এই মাখন? কী এবং কেন?
নানা প্রশ্ন।
সুযোগ দেখে যূথিকা ভাবলো একবার ওপরতলা থেকে ঘুরে এলে মন্দ হয় না। যেমন ভাবা তেমন কাজ, টুক করে উঠেই সিঁড়িতে পা। একবার দেখেই আসা যাক। দোতলায় উঠে প্রথম দুটো ঘরে তালা ঝোলানো। তৃতীয় ঘরটায় তালা নেই, ঈষৎ দরজাটা লাগানো আছে, ভাবল তাড়াহুড়ো করে তালাও দিয়ে যায়নি, ভালোই হয়েছে।
সামনে গিয়েই দেখল দরজায় একটা কাগজে লেখা ‘ প্লিজ নক।’
সংকোচ বোধ হচ্ছিল একটু, কিন্তু সেই অসীম কৌতুহলের পাহাড় ভাঙতে ওকে যে ভেতরে ঢুকতেই হবে। মনের প্রবল ইচ্ছে মুহুর্তে মুহুর্তে তরান্বিত করছে ওর প্রতিটি রোমকূপ।
কী করবে, ঢুকবে। নাকি..
এই ভেবে দরজাটা একটু হাত দিতেই খুলে গেল, ঢুকে পড়লো মাখনের অগোছালো জীবনের সযত্নে গোছানো ছোট ঘরটায়।
আট বাই দশ, মাপের এই ছোট দুনিয়াতে একা হলেও স্বাধীন মাখন। দেওয়ালে নানাবিধ রকমভেদ, কোথাও কবিতার বিন্যাসে ক্যানভাস ঝোলানো, কোথাও গাণিতিক সূত্রের তালিকা, আবার ঘটে যাওয়া অতীতের পরিসংখ্যানে মনের কথা দেওয়ালজুড়ে। পড়ার টেবিলে রাশিরাশি বই, ডায়রি , কলম। জানালা বেয়ে রোদ এসেছে শখের টেবিলে, পাতাবাহার’এর বাহারে চিরসবুজ একটা আমন্ত্রণ সারা ঘরময়। টের পেল যূথিকা। নামীদামী সব বস্তুর ভিড়ে থাকতে অভ্যস্থ মেয়েটা আজ একটু অন্যরকম খুশির ছোঁয়া পেল। অনুভব চাহিদা দেখে না, আর মাখন তাই বোধহয় এত তৃপ্ত। কিছু যেন খুঁজে চলেছে মনটা, নিজেও জানেনা সেটা কী,
হঠাৎ, বিছানায় পড়ে থাকা ডায়েরিতে নজর গেল যূথিকা’র। হাতে নিয়ে পাতা কয়েকটা উল্টাতেই কাকিমা ডাকলেন- যূথিকা, কোথায় গেলি, ও যূথিকা!
– আসছি, কাকিমা। বলেই ডায়েরি টা রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, কি জানি কাকিমা আবার কী ভাববে? চিন্তা করতে করতে।

নীচে এসে কাকিমার কাছে যেতেই, কাকিমা বলেন- কী রে! কোথায় ছিলি?
– এই তো তোমাদের বাড়িটা ভালো করে একটু ঘুরে দেখছিলাম।
– তা, কী দেখলি?
– হ্যাঁ, ভালো।
মেয়ের উৎসুক, কৌতুহলে কাকিমা একটু আভাস পেয়েছিলেন, যে মাখনের জন্য যূথিকার মনে অনেক প্রশ্ন। মেয়েটা সত্যিই জানতে চায় ওকে। বললেন – মাখনের ঘরটা দেখলি?
– কই, আমি তো কোন ঘরে ঢুকিনি,
– ও তাই, আচ্ছা। সময় করে আসিস, আমি তোদের আলাপ করিয়ে দেব।
– খুব ভাল হবে কাকিমা। মা’এর থেকে এই কাকিমার কাছে অনেকটা খোলামেলা যূথিকা। খুশি মনে বলল- আমি এখন আসি, তাহলে। মা আবার খোঁজ করবে।
– আয়।
বাইরে থেকে রেলিং টা লাগাতে যাবে অমনি দেখল, যে মাখন!
সাইকেল নিয়ে ওর দিকেই আসছে।
মনে ভালোলাগার যে জ্বর চড়চড় করে বাড়তে থাকল, তার মাত্রা বোধহয় থার্মোমিটারেও ধরা পাওয়া যাবে না।
যূথিকা কে দেখে মাখন ঈষৎ অবাক হল, কী ব্যাপার এ এখানে! এইসব বোকা বোকা প্রশ্ন,
– ভালো আছেন? বলেই হালকা হাসির হাতছানিতে বাক্যালাপের সূচনা করে যূথিকা,
– হ্যাঁ।
এই ছোট উত্তর মাখনের। আসি।
অনেক কথা বলতে চায়, কিন্তু অতীত মনে করায় তার ফেলে আসা দিনের তীব্র যন্ত্রণাময় অধ্যায়গুলো, তাই চুপ সে।
– যূথিকা খুশি হয়ে মনে মনে প্রায় নেচে উঠল। আর অবাকও হচ্ছে এই ভেবে যে, কেন ও এত খুশি, আর এই অচেনা ছেলেটা যাকে সে কাল অব্দি চিনতোই না, তার জন্য মনে হাজার কৌতুহলের স্রোত, কেন!
যার নাম পর্যন্ত জানত না ও, আজ তার জন্যই মনে এত উত্তেজনা কেন, কেন এত ভালোলাগাবোধ!
ভাবতে ভাবতে বাড়ির পথে হাঁটল..
মাখন কম কথা বলে, কিন্তু তার মন মোটেও চুপ থাকে না। প্রেম’ এই অলৌকিক একটা অনুভবে নেশাগ্রস্থ সেও হয়েছে, কয়েক বছর আগে। না আর ভাববে না ওসব কথা। এগিয়ে চলতে হবে।
তবে, এই যূথিকা’র কথাটাও ফেলে দেওয়া যায় না। মেয়েটাকে সেই প্রথম দিন, এখানে আসার সময় দেখেছে মাখন। বিমলবাবুর মেয়ে তাই ভাবনাকে আর এগোতে দেয়নি। আর ভালোবাসার হলে সে এমনিতেই হবে। ওটা তো গোপন, নিজস্ব ব্যাথা।
এবার রুমে এসেই বুঝল কেউ এসেছিল, পড়ার টেবিলের দিকে তাকাতেই বুঝল, ডায়েরি টা কেউ খুলেছে। তাড়াহুড়ো তে বন্ধ করেনি।
বুঝতে কোন অসুবিধায় হয়নি যে এটা যূথিকার কাজ। কাকিমার কাছে গিয়ে বলবে! নাকি কী করবে? বুঝতে পারলো না। পরে দেখা যাবে। এই ভেবে স্নানের জন্য বাথরুমে গেল। আবার দুপুরে পড়ানো আছে।
মোবাইলটা চার্জে দিয়েই বাথরুমে ঢুকল, হঠাৎ কাকিমার ডাক, – মাখন, এই মাখন..
মাখনের সাড়া না পাওয়ায় কাকিমা নিজেই এসে ঘরে ঢুকলেন, এই মাখন, স্নান করছ নাকি!
– হ্যাঁ, কাকিমা। কিছু বলবেন?
– তোমার একটা চিঠি এসেছে। আমি সই করে দিয়েছি।
– চিঠি!
– হ্যাঁ, বোধহয় কোন কল লেটার, আমি টেবিলে রেখে দিচ্ছি।
– আচ্ছা কাকিমা।
চিঠিটা রেখে কাকিমা বিদায় নিলেন,
ওদিকে মাখনের মনে পড়ল, যাক কলটা এসেছে তাহলে..
এতদিন ধরে ভাবছিল, কবে আসবে, এবার মানসিকভাবে তৈরী হতে হবে।

বিমলবাবু’র বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গাটায় বসার জন্য চেয়ার-টেবিল, একটা দোলনা আর শখের কিছু ফুলের চাষ করেছেন। ওনার ফুল খুব পছন্দ, বিশেষ করে জুঁই ফুল। আর সে জন্যেই মেয়ের নাম যূথিকা। খাওয়া-দাওয়া সেরে ওনার স্ত্রী একটু আধটু জিরিয়ে নেন, শীতের রোদেলা উষ্ণতার সুখ পান করেন।
পানটা মুখে নিয়েই বিমলবাবু বললেল- আচ্ছা, শুনছো, বলি আজ রাত্রে কমল আর কাকলিকে ডাকলে কেমন হয়, আড্ডাও হবে আর ভালো কিছু খাওয়াও যাবে। কি বল গিন্নি..
– হঠাৎ?
– না, ভাবছিলাম অনেকদিন তো আনন্দ-মজা, গল্প করা হয়নি, তাই ওদের ডাকি, সময়টাও ভালো কাটবে আর বেশ গল্পও করা যাবে।
– তোমার তো আড্ডা, গল্প ছাড়া আর মাথায় কিছু আসেনা, আমাকে খাটাতে পারলেই তো তুমি খুশি, বলি অত রান্নাবান্না আমি করতে পারবো না বাপু।
– আহা, তোমাকে কিচ্ছুটি করতে হবে না, আজ বাইরে থেকে খাবার আনাবো। ফোনটা করেই ফেলি, কী বলো..
– তাহলে তো খুব ভালো হয়, হ্যাঁ তুমি বরং ডেকে পাঠাও। আর হ্যাঁ ওই যে ছেলেটা কী নাম! আরে মাখন, ওকেও নিয়ে আসতে বলবে। ও তো রাত্রে কাকলির বাড়িতেই খায়, ও বেচারা কোথায় খাবে।
স্ত্রী’র মুখে নিজের ইচ্ছেটা প্রকাশিত হওয়াতে এক অদ্ভুত আনন্দ পেলেন বিমলবাবু। খুশিতে বলেই ফেললেন- জো হুকুম, মালকিন।

এদিকে স্নান সেরে মাখন রেডি হয়, কল লেটারটা খুলে একটু বিস্মিত হল, এক্সাম সেন্টার লখনৌও, ইউ. পি।
কলকাতায় দেওয়ার কথা ছিল। তাহলে এমন কেন?
মার্চেন্ট নেভি’র চাকরির জন্য ফর্ম ফিল আপ করেছিল, তারই এক্সাম। এতদূর কীভাবে যাবে, কোথায় থাকবে, কী করবে, এসব প্রশ্ন এল মনে। আর এক সপ্তাহ পরে এক্সাম। সেই মত রেডি হতে হবে। হাতঘড়িটায় সময় দেখল, ০১:৫০ বেরোতে হবে, আবার মাঝে খেতে হবে, ব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মাখন।
নীচে আসতেই কাকিমা বললেন- এই মাখন বেরোচ্ছ?
– হ্যাঁ, কাকিমা।
– বলছি আজ একটু তাড়াতাড়ি আসবে, রাত্রে বিমল কাকুর বাড়িতে নেমন্ত্রণ আছে, সবাইকে যেতে বলেছেন। আর বিশেষ করে তোমাকে যেতে বলেছেন। যাবেতো..!!
– আপনি যা বলবেন..
– আমি, কী বলবো.. আচ্ছা আমরা তো আছি। চিন্তা নেই আমার সাথে যাবে তুমি।
– ঠিক আছে, কাকিমা। এখন আসি।
বলেই বেরিয়ে গেল মাখন।
কাকিমা খুব খুশি হন, ওর ব্যবহারে কথায়। ছেলেটা সত্যিই খুব ভালো। ওনাকে মা’এর মত শ্রদ্ধা করে। মনে মনে খুব ভালোবাসেন কাকলিদেবী মাখনকে।
সবেতেই এনার মত দিতে লাগে, মনে মনে ঈষৎ হেসেই বললেন বোকা ছেলে একটা..
মাখন জানতোই না, এই অহেতুক আমন্ত্রণে ওর পৃথিবীটাই পালটে যাবে, যাইহোক বেশি না ভেবে সাইকেলের প্যাডেলে জোর দিল সামনের পথে..

সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে ফিরতেই কাকিমা বললেন- মাখন তৈরী থাকবে, আমি ডেকে নেব।
– আচ্ছা, কাকিমা।
নিজের ঘরে এসে মুখ-হাত ধুয়ে ফ্রেস হয়ে একটু ডায়েরি নিয়ে বসে মাখন, অভ্যাসবশত। আর বসল না, মাথায় তার পরীক্ষার জন্য চিন্তা বাড়তে লাগল।
তবে এতদূর রাস্তা একা কীভাবে যাবে, কী করবে, এসব ভাবতে লাগল।

এদিকে আজ কমলবাবু’রা আসছেন শুনে যূথিকার তো আনন্দের সীমা নেই। বাবাকে বার তিনেক জিজ্ঞেস করা হয়ে গেছে বাবা, ওনারা কখন আসবেন? আজ এও জেনেছে মাখন আসছে কিনা,
০৮:১০ কি ১৫ হবে কলিংবেলে আওয়াজ শোনা মাত্রই ছুটে গেল দরজা খুলতে, কাকিমা, কাকু আর মাখন কে দেখে এক অন্যরকম খুশির বার্তা পেল যূথিকার মন।
– আরে কাকু আসুন, আসুন। মাখনকে কিছু না বলে, মৃদু হাসি।
ভেতরে গিয়ে টি-টেবিলের চারিপাশ জুড়ে সোফাসেট এ জায়গা দখল হল।
– তা বিমল, এই অকারণ নেমন্ত্রণের কথা কাকলির মুখে শুনেই ভাবলাম, যাক আড্ডাটা আজ জমাটি হবে। কী ভুল বললাম কিছু!
– একদম না, কমল।
– তোমাদের তো আড্ডা ছাড়া আর কিছু চলে না,
চা’এর ট্রে হাতে এগিয়ে এলেন যূথিকার মা।
– একদম ঠিক বলেছন, দিদি। সারাদিন আড্ডা মারতে পেলে এদের আনন্দের সীমা থাকবে না,
সবাই হাসতে শুরু করে, আর বেচারা মাখন চুপটি মেরে বসে,
– এই মাখন, পড়াশোনা কেমন চলছে?
– ভালো।
হৈ হট্টগোল এর মহড়ায় মুখরিত হল, সারা বাড়ি। অনেকদিন পর একসঙ্গে মেতে উঠেছে এই দুই পরিবার। গল্পে, কথায়, হাসিতে মত্ত সবাই, মাখনের একটু ইতস্তত লাগছে, বেশ বুঝলেন বিমলবাবু। মেয়েকে বললেন- এই যূথিকা, তুই বরং মাখনকে নিয়ে ওপরে যা, বাড়ি টা দেখিয়ে নিয়ে আয়।
যূথিকা মনে মনে এতক্ষণ এটাই ভাবছিল, কখন ওরা নিভৃতে একটু সময় পাবে?
– হ্যাঁ, বাবা যাচ্ছি।
মাখনের দিকে শালীনতাসম্মত সাড়া- আসুন।
মাখনের কিঞ্চিৎ সংকোচ বোধ হচ্ছিল, কাকলি দেবী ভালোই বুঝেছেন। তাই সাহস দিয়ে বললেন- যাও।
আমরা আছি এখানে।
দোতলায় নিজের ঘরে মাখনকে এনে বসালো যূথিকা। মনে তো লক্ষাধিক খুশির ঢেউ একে অপরকে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার প্রবল তাড়া। বাঁধ না মানা এক নদীর মত শুধু ছুটে চলতে চায়, কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই।
কী বলবে, কী বলবে ভেবেই অস্থির, হঠাৎ বলেই ফেলল- আপনাকে কিন্তু আমি আর আপনি দিয়ে বলতে পারছি না, তুমি দিয়েই বলছি..
– আচ্ছা।
– শুনেছি খুব সুন্দর লেখ তুমি।
মাখন বলল- ওই ভুলভাল কলম ধরা একটু আরকি,
– কেন? ভুলভাল কেন?
কাকিমা বলছিলেন তুমি নাকি গল্পও লেখ,
– খুব বেশি কিছু নয়।
প্রেম যে কী অবুজ, তা জানে মাখনের মন। তাই অপার চেষ্টা নিজেকে ধরে রাখার। তবে বিপরীতে উল্টো আবেশ। প্রেম এর চারা অলরেডি জন্ম নিয়েছে যূথিকার শখের মন আঙিনায়। আর তাতে পরিচর্যাকারিণী’র কোন ত্রুটি নেই।
বলার কিছু খুঁজে পেল না, তবে মন যেন হাজার কথা বলতে চায়, – আচ্ছা একটা কথা খুব জিজ্ঞেস করতে মন করছে, করি..
– হুম..
– তুমি এত চুপচাপ থাকো কেন, সবসময় যেন ভয়ে ভয়ে.. ব্যাপারটা কী!
– কিছু না,
– কিছু না বললেই হলো.., বলো আর যদি একান্তই আপত্তি থাকে তাহলে থাক
– না, না এতে আপত্তির কী আছে, আসলে আমি নিজেকে সংযত রাখতে চেষ্টা করি। না হলে আবার প্রলয় নেমে এলে কে সামলাবে?
– খুলে বলো না..
– না, আসলে এই মন খুব বেয়াদব। চোখে চোখে না রাখলে, অন্যায় আবদার করে মাথা খারাপ করবে। তাই ওকে ভুলভাল বুঝিয়ে রাখা, আর চুপ থাকার কথা বললে বলব, ওটা আমি ছোটবেলা থেকেই।
– হুম, বুঝলাম। আচ্ছা আমরা তো বন্ধু হতে পারি..
প্রেমের প্রথম অধ্যায় বন্ধুত্ব, এটা অভিজ্ঞতাজনিত জ্ঞান মনে করালো মাখনকে। যূথিকা তাই প্রথমে এই পদক্ষেপ নিয়েছে। ছোট্ট উত্তরে, অল্প হাসি মিশিয়ে হাতটা বাড়ালো মাখন। ফুলের পাপড়ির মত কোমল হাতটাকে কলম ধরা প্রাপ্তবয়স্ক হাতটা গভীরত্ব দিয়ে আদর করল, যূথিকা বেশ বুঝল, মাখন ভেতরে ভেতরে তৃপ্ত। ঠিক ওরই মত।
হঠাৎ,
নীচের থেকে ডাক,- যূথিকা, বলি তোরা নেমে আয়, খাবার দেওয়া হয়ে গেছে।
– যাই বাবা..
এতক্ষণ ধরে মুখ যত বলল, তার চেয়ে ঢের বলল ওদের মন, কত আবদার, লাজুকতা, হিসেবহীন আলাপনে এক অলীক জোয়ার দুই মেরুতে, বন্ধুত্বের খোলা আকাশে বেশ উন্মত্ত হয়ে উড়ছে ওদের প্রেম এর ঘুড়ি।
এটা দুজনেই উপলব্ধি করে।

খেতে বসে মাখন, সবে ভাতটা মুখে তুলবে, বিমলবাবু বললেন, এই তোমার কল টা এসেছে..?
-হ্যাঁ, কাকু। আজই এল।
– বাহ! তা সেন্টার কোথায়?
– লখনৌও তে।
– কেন, তোমার তো কলকাতায় দেওয়ার কথা ছিল। এরকম করার মানে কি!
– জানিনা কাকু..
– কী করবে?
– কী আবার করবে, দাদা, যাবে পরীক্ষা দিতে। এত পড়াশোনা করল, শুধু শুধু..কাকলিদেবীর উত্তর।
– বটেই তো।’ বলে মাংসের খন্ডটা মুখে পুরলেন কমলবাবু।
– তা এক্সাম কতদিন পর..?
– এক সপ্তাহ পরে।
– ভালো মত এক্সাম টা দিয়ে এসো। তারপর দেখছি।
এতক্ষণ যূথিকা সব শুনলো, আর মাখনের দিকে এমন দৃষ্টিপাত করল, তার মানে কিছুটা এই..
– মানেটা কী, আমাকে বলোনি কেন? কবে যাবে, কত দিন পর আসবে? ‘
মাখনও কম যায় না..গোপন হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিল..
‘ চিন্তা নেই ক’দিনের মধ্যেই চলে আসবো। ভালো থাকবে।’

নির্দিষ্ট দিনে মাখন, প্রেম’ আর পকেট’ এর মধ্যবর্তী দোটানার ব্যাকুলতায় পাড়ি দিল আরও একবার নিজের পরিচয় পেতে, অচেনা এক অভিজ্ঞতার উদ্দেশ্যে।

কয়েকদিন পর..
কাকলিদেবী সন্ধ্যে বেলায় বাংলা সিরিয়ালে মগ্ন থাকেন, হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠল, আবার কে ফোন করল..
– হ্যালো!
– হ্যালো, কাকিমা, আমি মাখন বলছি।’ একটা ভারী স্বর ভেসে এল ওপার থেকে।
– হ্যাঁ, বলো.. তোমার গলাটা এরকম কেন শুনতে লাগছে? কেমন আছো, কী হল? পরীক্ষা কেমন হয়েছে?
– চাকরিটা হয়ে গেছে কাকিমা।’
বলতে বলতে খুশিতে কেঁদেই ফেলল, ছেলেটা।
আমি আগামী পরশু বাড়ি আসছি। আচ্ছা কাকিমা, পরে ফোন করছি। এবারে বেরোতে হবে..
একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন কাকলিদেবী,
যাক এতদিন পর ছেলেটার অভাব টা কাটলো তবে, হে ঠাকুর, দেখো। ওর মঙ্গল করো।
কাকিমাই জানেন, মাখনের পরিশ্রম, সারাদিন ঠিক মত খাওয়া নেই, দাওয়া নেই, এর বাড়ি, ওর বাড়ি ঘুরে ঘুরে নাজেহাল অবস্থা। ভগবান এতদিনে মুখ তুলে চেয়েছেন,
এবারে যূথিকা’কে খবর টা দেওয়া যাক..খুব ভালোবাসে মাখন’টাকে
মেয়েটা মনে হয় আনন্দে জ্ঞানই না হারায়। ফোনটা করেই ফেলা যাক।
এইভেবে নম্বর মেলালেন..

ফোনটা বেজে উঠতে বিমলবাবু সোফা থেকে উঠে এলেন, – হ্যালো!
– হ্যালো, দাদা কাকলি বলছি, একটা সুখবর আছে।
– হ্যাঁ, বলো..,কী সুখবর!
– বলছি যে, মাখন সিলেক্টেড হয়েছে। চাকরি টা ওর হয়ে গেছে।
– কী!!!!!!!!
– হ্যাঁ, দাদা… আমাকে ফোন করেছিল এইমাত্র, ও তো আনন্দে কেঁদেই ফেলেছে। পরশু নাগাদ আসছে বলল।
– জানতাম হয়ে যাবে, ওর মত এত পরিশ্রমী ছেলে, না হয়ে উপায় আছে! যাক বাবা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। একটা চিন্তা ছিল, জান কাকলি..
– তা আর বলতে, আমি তো আনন্দে আত্মহারা, দাদা।
– ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন।
– আচ্ছা, দাদা রাখি। সকালে কথা হবে।
– ‘ তোমার ভগবান আবার কার দিলে মুখ তুলে চাইলো গো?’ রান্নাঘর থেকেই প্রশ্ন টা ছুঁড়লেন, বিমলবাবু’র স্ত্রী।
– কার আবার, মাখনের। ওর চাকরিটা হয়ে গেছে, বুঝলে গিন্নি।
– বাঃ, তাই.., খুব ভালো খবর।
– তা আর বলতে!!
আওয়াজ পেয়ে নীচে নেমে এল, যূথিকা। কী হয়েছে!
বিমলবাবু বললেন, জানিস মা, মাখনের চাকরিটা হয়ে গেছে।
– তাই বাবা!
এই দুটো শব্দের মধ্যে কত ভালোবাসা, কত প্রেম, গভীর আলাপন লুকিয়ে তা একমাত্র যূথিকাই জানে।
মেয়েটা কোনকিছু না ভেবে, এক অবুজ পাখির মত আকাশে দুহাত বাড়িয়ে উড়ছিল, আর গোপনে সেই অচেনা এক পরিযায়ী সম মাখনকে ভালোবেসেছে, বাস্তব সব যুক্তির বিপরীতে।
একলাঘরের তার আবেগ, তার আলাপন, নিভৃতের সেই উষ্ণ সুখ, নির্জন রাতের গহীন তৃষ্ণা, একমাত্র সেই জানে।
দূরত্বেই সামিল বোধের প্রকৃতার্থ। নিজের অব্যক্ত ইচ্ছেরা চিরস্বাধীন, এবার ইচ্ছে ডানায় যেন এক উদ্যমী আলোড়ন, তবে তার পথচলা থামবে না, কোনমতে। সে উড়বে..
আপন পৃথিবীজুড়ে।
অনুভব সামলে বলেই ফেলল,
– সত্যি বাবা, কে বলল??
– এই তো রে কাকলি ফোন করেছিল, মাখন নাকি ফোন করেছিল, ওকে..
– খুব ভালো হয়েছে।
মনের আয়নার এক কোণে সে প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করে, মাখনকে।
সেই অচিনপুরে যেখানে কেউ চেনেনা ওদের, স্বাধীন কলরবে কাটবে দিন, সন্ধ্যায় একরাশ মুখরতা নিয়ে বাড়ি ফিরবে মাখন, আর শখের গৃহকোণ এ ভালোবাসবে ওরা ঠিক ওই পরিযায়ী পাখিসম।
জোছনার চাদর নিয়ে নেমে আসবে ঘুম, আর কোকিলের স্বরে ঘুমভাঙানি ভোর নাড়া দেবে দুয়ারে…
কত কি ভেবে চলে যূথিকা’র মন,
হঠাৎ ই চাপা একটা ভীতি আস্কারা দেয় বাস্তব জানালায়। ভাবে..
প্রত্যেক আনন্দের পিছনে দুঃখেরা ঘোরাঘুরি করে,
অস্ফুট একটা অভাব’এর সঞ্চার মনে,
তবে আনন্দ, যতখানি, তার চেয়ে ঢের বেশি বিষণ্ণতা। মাখন এবার দূরে চলে যাবে ওর থেকে, আর কি তাহলে দেখা হবে না!
তাহলে..
সেদিন রাত্রে অনেকবিধ চিন্তা যূথিকার মনে বারবার ধাক্কা মারল, তার প্রেম কি শুরুতেই সমাপ্ত হবে! না, ও তো আর চিরদিনের জন্য যাচ্ছে না, আবার তো ফিরে আসবে। নানান যুক্তি সান্তনা দিল মনে..
ভালো-মন্দ কত চিন্তা গ্রাস করল মেয়েটাকে।
ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমের তরলে ডুবে গেল..
ওদিকে খুশির বাতাবরণে ছেয়ে মাখনের সমগ্রটা, এবার ছেলে হিসেবে সব দায়িত্ব, দায়িত্ববোধের আঙ্গিকে পালন করবে, সে।
যাদের জন্য এই পৃথিবীর আলো দেখা, যাদের জন্য আজ ও এতটা, সেই আলোকদর্শন কারী বাবা-মা’র মুখে হাসির স্রোত বইয়ে দেবে, তাদের শেষ দিন পর্যন্ত।
হীনমন্যতার পিরিয়ড ভুলে এগিয়ে না এলে, আজ এই সার্থকতা বোধহয় না পাওয়ায় থাকত, আনন্দে ভেতরটা নেচে উঠল মাখনের, চলন্ত ট্রেনের ঝিক ঝিক শব্দে।
বাতাসে ভেসে এল একটা চেনা গন্ধ।
যার নির্যাসে শিহরণ খেলে যায় মাখনের রোমে, রোমে। বুঝতে অসুবিধা হয়নি গন্ধটা, উদাস করা আকূলতায় মনে পড়ল সেই গন্ধবাহ বাতাসেও যূথিকা’র নাম।
আনমনা হয়ে গেল মাখন।
প্রেম’এর মঞ্জুরিতে মনে পড়ে যায় সেই নির্জন রাতের মালশ্রী’র সুর, আত্মসুখের বিরহের গহীন অন্ধকারে এক অশরীরিণী যেন তার আঁচলের নীলে ঢেকে রাখে এক কচি বসন্তকে।
মাতাল যেমন মৌতাতের প্রেক্ষাপটে গিলে গিলে পান করে বাস্তব বিপরীত অলৌকিকতা, তেমনই চেরা শীতের দেহ জুড়ে বাতাসে উড়ে বেড়ায় উষ্ণীয় বসন্ত, আর তাতেই মেতেছে মাখনের মন,
সিরিয়ালে মগ্ন কাকলিদেবী, বোকা বাক্সে সাংসারিক কলহের বাক্যালাপের মাঝে কানে এল বাইরের রেলিং খোলার শব্দ। শব্দ না করেই মনটা যেন বলে- বোধহয় মাখন এসেছে।
উঠে বাইরে যেতেই বুঝলেন, তার মন ভুল বোঝেনি, পরিশ্রান্ত চোখে একরাশ খুশি আজ ছেলেটার সর্বাঙ্গব্যাপী।
– এসো, এসো। শরীর ঠিক আছে তো!
– হ্যাঁ, কাকিমা।
যাও যাও রুমে গিয়ে ফ্রেস হও, তারপর আমি খাবার দিচ্ছি,
– হ্যাঁ। কাকিমা, এই যে ব্যাগে কিছু মিষ্টি আর কেক আছে, রেখে দিন।
– আবার এত কিছু কেন?
– কাকিমা, আজ যদি এসব না আনতাম, তাহলে বিধাতা ছেড়ে দেবে আমাকে!
– আচ্ছা, আচ্ছা। চলো যাও আমি খেতে দিচ্ছি।
বিমলবাবু সকাল সকাল কমলবাবুর বাড়িতে এসেই শুরু করলেন- মাখন! এই মাখন! মজা করে বললেন, চাকরি পাওয়ার আনন্দে ভুলে গেলে নাকি!
নীচে এসেই প্রণাম করল মাখন, কি যে বলেন কাকু!
মৃদু হাসি হেসে, আরে না না, আমি মজা করছিলাম।
তা জয়েনিং কবে?
– আগামী শুক্রবার।
– মানে হচ্ছে গিয়ে আর ছয় দিন পর!
– হ্যাঁ, কাকু।
– তা পোস্টিং কোথায়?
– প্রথম ন’মাস লখনৌও তেই, ট্রেনিং। পরে পছন্দমত জায়গায় পাঠাবে বলেছে।
– আচ্ছা।

এদিকে প্রেমের গন্ধ খুঁজে পা টিপে টিপে যূথিকা এসে উপস্থিত। এসেই বাবার পাশে বসে পড়ল। চোখ দেখেই মাখনের বুঝতে অসুবিধা হলনা যে হাজার প্রশ্নের ডালি নিয়ে এসেছে যূথিকা।
এতদিনে মেয়ের আচার-ব্যবহারে বিমলবাবুও বেশ বুঝেছেন মেয়ের মনের অবস্থা। মনে মনে তিনি খুশিও ছিলেন, বললেন- তোমরা কথা বলো, আমাকে একবার বাজারে যেতে হবে।

আজ আসি মাখন, পরে কথা হচ্ছে।
– হ্যাঁ, কাকু।
কাকিমা রান্নাঘরে ব্যস্ত, যূথিকা এবার বলেই বসল- চলো তোমার ঘরে যাই।
আকস্মিকতায় আপনি’টা তুমি’তে বদলেছে এটা মাখনের অভাবের কারণ।
– ওপরে!!
– হ্যাঁ, চলো না।
– চলো,
যতই হোক কাকিমা আছেন পাশের ঘরে, তবে আজ আর বাধা নেই, এই বোধেই সিঁড়িভাঙ্গা শুরু করে ওরা।
খানিক বাদে কাকিমা মাখনের খোঁজে ওর ঘরে ঢুকতে যাবেন, অমনি দাঁড়িয়ে পড়লেন,
– আচ্ছা, বাবা বলছিলেন ওখানে নাকি দিনের পর দিন জলের ওপরেই থাকতে হয়!
– হ্যাঁ। দিন নয়, মাসের পর মাস।
– ভয় করবে না!
– করলে কি আর করার আছে।
– যাকগে বাদ দাও,
আচ্ছা, তুমি চলে গেলে অতদূরে কীভাবে কথা হবে! আমাকে মনে থাকবে তোমার?
– আরে বাবা, আমি কি চিরদিনের জন্য যাচ্ছি!
আর তাছাড়া তুমি এত চিন্তা করছ কেন?
আমাকে বিশ্বাস করো?
– হুম,
– তাহলে নিশ্চিন্ত থাকো।
ওদের মুখের ভাষায় বাস্তব কথা থাকলেও মনে মনে আলিঙ্গনাবদ্ধ ছিল অপরিমেয়।
কাকিমা, বুঝলেন এরা সত্যি নিজেদের অজান্তে একে অপরকে আপন করেছে, হয়তো বিধাতারও এই ইচ্ছে।
বিরক্ত না করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন, কাকলিদেবী।
আচ্ছা, তুমি কবে যাবে?
– এইতো, আগামী পরশু। ভোরের ট্রেনে।
– মানে আর মাত্র কালকের দিনটা!
– হ্যাঁ। চিন্তা করোনা। আমি রোজ ফোন করব,
– না করলে মেরেই ফেলব।
মৃদু হেসে মাখন বলল- বাবা! এত ভালোবাসা,
যূথিকার দিকে ঘুরে ওর মুখ তুলে ধরল, সময়ের তোয়াক্কা না করে অবিরাম দৃষ্টি বিনিময় ঘটে গেল সহস্রবার, অপলকে। অনিমেষে।
লজ্জা নারীর ভূষণ” – এই ভূষণে ভূষিতা যূথিকা মুখ গুঁজল, মাখনের সহজাত বুকে।
আরও একবার ভালোবাসার আলিঙ্গনে আবদ্ধ হল মাখন, তবে অশ্রুরা যেন অন্য কথা বলল।
সারা প্ল্যাটফর্ম জুড়ে শীতের আধিপত্য, হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় বোবাকান্না কাঁদে পড়ে থাকা প্লাস্টিক, রোদনধ্বনি তে ঘুম ভাঙে শুকনো পাতাগুলোর। সারা শরীরে অভাবনীয় উত্তেজনা।
– এই মাখন, বলছি সব ঠিকঠাক নিয়েছো তো?
আর খাবার, মোবাইল, ব্যাগ সব ঠিক করে রাখবে।
– হ্যাঁ কাকু।
মাখন বাড়িতে গতকাল দেখা করে এসেছে, হঠাৎ করে ওর মা’এর কথা মনে পড়ে গেল। মা বলেছে সাবধানে থাকিস বাবা, আর আমাদের জন্য চিন্তা করিস না, এখানে সবাই আছে। নিজের খেয়াল রাখবি।
– এই মাখন খুব ভালো মনে কাজ করবে, আমরা আছি, কোন ভেবোনা। তোমার মা’এর নং আছে আমার কাছে, আমি যোগাযোগ রাখব।
কথাটা শুনে একটু স্বস্তি পেল মাখন, তবে মনে মোটেও স্বস্তি নেই যূথিকা’র।
অম্লানবদন এ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই গল্পে ব্যস্ত, আর আরও ব্যস্ত প্ল্যাটফর্ম। সুযোগ বুঝে ডেকে বলল- মন খারাপ করো না, কয়েকটা মাস দেখতে দেখতে পেরিয়ে যাবে। খুব ভালো থাকবে। তাছাড়া ফোনে তো কথা হবেই, চলে যাবার আগে শেষ বারের মত যূথিকা জড়িয়ে ধরল মাখনকে।
প্রকৃতিও বুঝল ওই স্বচ্ছ অশ্রুকণায় কতটা সত্যি লুকিয়ে,
আচ্ছা আসি, লাভ ইউ। কান্নাগুলোর আবদার আর রাখল না মাখন, শুকনো হাসিতে উঠে পড়ল ট্রেনে।
ইঞ্জিন স্টার্ট হতেই ধস করে উঠল বুকটা যেন মেয়েটার,
মাখনের চোখে আজ যূথিকা দেখল ভালোবাসার স্বরূপ। যেখানে সহস্র অনুভব স্পষ্টভাষী, কুয়াশার হাত ধরে।
সব কলরব নিয়ে পাড়ি দিল ট্রেন..
কাকিমাকে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটা, করুণ আলাপনে।
ষ্টেশন ছাড়লেন ওনারা নত মুখে, অলীক দুঃখে।
তবে
বিমলবাবু বেশ টের পেলেন –
কুয়াশামাখা আবহে, অস্বচ্ছ প্ল্যাটফর্ম এ ছড়িয়ে পড়ল ভোরের জুঁই ‘ এর মাতাল করা গন্ধ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four + 2 =